ANURADHA BHATTACHARYA

Abstract Inspirational

3  

ANURADHA BHATTACHARYA

Abstract Inspirational

সহধর্মিণী

সহধর্মিণী

9 mins
254



অনন্ত কেবিনের একটা টেবিলের দুপাশের দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে শুভ্র আর রমা। তাদের সামনে দুটো প্লেটে কাটলেট আর কফি । রমা, প্রায় মিনিট পনের হয়ে গেছে একটা কথাও বলেনি । মুখটা ভার করে চুপচাপ বসে আছে।শুভ্র বুঝতে পারছেনা যে কি এমন হতে পারে যার জন্য রমা এমন অস্বাভাবিক চুপচাপ! বেশ কিছুক্ষণ রমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থেকে, একটা কাটলেট প্লেট থেকে তুলে , তাতে একটা কামড় দিয়ে, কফির কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে শুভ্র বলল --- কি ব্যাপার ! তখন থেকে একটা কথাও বোলছো না।মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছ ! কি হয়েছে বলবে তো? আর যদি না বলতে চাও বোলনা , কিন্তু কফিটা তো খাও।ওটা ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার কোল্ড কফি বলে দাম বেশি চাইবে।সেটা জানতো? এবার রমা ধীরে চোখ তুলে শুভ্রর দিকে তাকালো। তার চোখ ছলছল করছে।-- কি ব্যাপার ! মেঘ করেছে সে তো বুঝতে ই পারছি, কিন্তু আবার বৃষ্টি নামছে কেন?

-- মা আমাদের সম্পর্কের কথা জানিনা কিভাবে জেনে গেছে।

-- তো ? একদিন না একদিন তো জানাতেই হোত! জেনেছ তো কি হয়েছে?

-- মা এখন আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।

-- ভালোই তো ।

-- মানে ?!

-- আমি কাল যাচ্ছি তোমাদের বাড়ি। তোমার মা'র সাথে কথা বলতে।

-- মানে ! কি বলবে তুমি মাকে?

-- বলবো, আমি তোমায় বিয়ে করবো। ওনাকে তোমার জন্য ছেলে খুঁজতে হবেনা।

-- তুমি কি পাগল হয়েছ?

-- কেন পাগল হবো কেন? তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না?

-- না, তা নয়।কিন্তু তাই বলে ---

-- কি তাই বলে? তুমি যখন এতদিনে ও তোমার মাকে আমাদের সম্পর্কের কথা টা জানাতে পারলে না, তখন কাল আমিই তোমার মাকে জানিয়ে আসবো।

রমা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল শুভ্রর দিকে। রমা কিছু বলার আগেই,শুভ্র বলে উঠল, -- নাও নাও তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও । সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো , তোমার বিয়ে আমার সাথেই হবে। অন্য কোথাও হবে না।বলে হাসতে থাকে।

এরপর শুভ্র রমাকে এ ব্যাপারে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। তারপর কফি পর্ব মিটিয়ে তারা সেদিনের মতো যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ালো।


পরদিন রবিবার, সকাল প্রায় দশটা নাগাদ শুভ্র হাজির রমাদের বাড়ি।রমা তো দরজা খুলে শুভ্রকে দেখে চমকে উঠল ।রমা ভাবেনি ,শুভ্র সত্যি সত্যিই ওদের বাড়িতে ওদের বিয়ের ব্যাপারে ওর মা'র সাথে কথা বলতে আসবে! রমা দরজা খুলে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ই ছিল।

--- কি হোল, পথ ছাড়ো! ঢুকতে দেবে না?

ভেতর থেকে রমার মা , (বেশ চিৎকার করে)"কে এসেছে রে রমা ? তোর বাবা তো বাড়িতে নেই , বলে দে পরে আসতে। "

"আমি আপনার কাছেই এসেছি "--বলে রমা কে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ই ঘরে ঢুকে যায়।

--"আমার কাছে !!" (মনে মনে বলে।তারপর) কে বাবা তুমি? বলে ভেতরের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।সামনে শুভ্রকে দেখে ,-- তোমায় তো চিনলাম না বাবা!


-- আমি শুভ্র, শুভ্র চক্রবর্তী।থাকি সোদপুর ঘোলায়।আমি আর রমা গত আট বছর , মানে সেই স্কুল থেকে প্রেম করছি। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি ।আপনি রমার বিয়ের চিন্তা করছেন। তাই আপনাকে কথাটা জানাতে এলাম যে রমার জন্য আপনাকে কষ্ট করে ছেলে খুঁজতে হবেনা।রমাকে আমিই বিয়ে করবো। 

রমার বাবা যে কখন বাইরে থেকে ফিরে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে সেটা কেউ খেয়াল করনি।


( ভয়ানক জাঁদরেল ও কমান্ডারিং স্বভাবের মহিলা,) রমার মা, এইরকম কথা বা ব্যাবহারে এতটাই আর্শ্চয্য হয়ে গিয়েছিলেন যে , তিনি কি বলবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।এভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ এতবড় কথা বলতে পারে এটা তার ধারণার বাইরে। তখন শান্ত মেজাজের মানুষ, রমার বাবা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি এসব বিয়ের কথা হয় ? এস , এখানে বসো।বলে শুভ্রকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নিজে সোফায় বসলেন।তারপর বললেন, বিয়েতো করবে , কিন্তু তুমি কি কর?


-- আমি এখনও কিছুই করিনা।গত ছয় মাস আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি। এতদিন বসেই ছিলাম, তবে এখন একটা চাকরি পেয়েছি। সামনের মাসে জয়েনিং।

কথাটা শুনেই রমা লাফিয়ে উঠল ।"তুমি চাকরি পেয়েছ ! বলোনি তো ?!"

-- বলবো বলেই তো কাল ডেকেছিলাম। তুমি সুযোগ দিলে কোথায়? সে যাক, তাহলে মাসিমা, ঐ কথাই রইল । রমার জন্য অন্য ছেলে খুঁজবেন না।

রমার বাবা বললেন, তুমি নিজেই নিজের বিয়ের কথা বলতে এসেছ ! তোমার বাড়িতে বড় কেউ নেই? 


আছেন, কিন্তু আমি তো শুধু জানাতে এসেছি যে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি,আর আমরা একে অপরকে বিয়ে করবো।তবে সেটা এখন ই নয়। বছর দুয়েক বাদে। কথাটা রমা আপনাদের বলতে পারছিলনা তাই আমি বাধ্য হলাম আসতে।

তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?

--- যদিও আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, কিন্তু আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি।বাবা-মা ছাড়া আমার ঠাকুমা আছেন।আর জ্যাঠা,ও কাকার ফ্যামিলি ।জ্যাঠার দুই ছেলে ও কাকার এক মেয়ে।আমরা সবাই একসাথেই থাকি ।

রমার মা একপ্রকার চিৎকার করেই উঠলেন।না, অসম্ভব। এতবড় পরিবারে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা।

শুভ্র রমার মায়ের চোখে চোখ রেখে --অন্য কোথাও রমার বিয়ে ঠিক করলে , বিয়ের দিন বিয়ের মন্ডপ থেকে রমাকে তুলে নিয়ে যাব।পারলে আটকাবেন। এরপর রমার বাবার দিকে তাকিয়ে নরম হয়ে ,-- আমার দুটো বছর সময় চাই। চাকরিটা পেয়েই বিয়ে করতে চাইছিনা।একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর বিয়েটা করতে চাই। আশাকরি আপনার অন্তত আপত্তি হবে না। আজ আসি ।বলে রমার মার দিকে তাকিয়ে, তারপর --রমা, আজ একবার অনন্ত কেবিনের সামনে বিকেল চারটেয় এস। আমি অপেক্ষা করবো।বলে যেমন এসেছিল তেমন চলে যায়।


খুব স্বাভাবিক ভাবেই এইরকম একটা ছেলেকে পাড়ার উঠতি মস্তান বা গুন্ডা ভাবা কিছু ই অস্বাভাবিক নয়। রমার মাও শুভ্রর সম্পর্কে সেইরকমই একটা ধারনা করে মেয়ের ভবিষ্যত সম্পর্কে খুবই দুশ্চিন্তাগ্ৰস্হ হয়ে পড়লেন, এবং তার প্রভাব পড়ল যথারীতি রমার উপর। তিনি প্রথমত শুভ্র সম্পর্কে রমা কতটা কি জানে সে ব্যাপারে জেরা করতে লাগলেন। কিন্তু রমার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ভাবলেন প্রেমে অন্ধ হয়ে একটা ভুল ছেলেকে পছন্দ করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চলেছে।তাই লোক লাগালেন, এবং বরকেও বললেন শুভ্রর সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নিতে। এবং অল্প দিনের মধ্যেই জানতে পারলেন ছেলেটি খুব ভালো পরিবারের এবং সৎ চরিত্রের ছেলে। শুধু দোষের মধ্যে , একগুঁয়ে আর ভয়-ডর বলে কিছু নেই।কথা বার্তার ধরনটা ঐরকম ই , মনে হয় গুন্ডা বা মস্তান। কিন্তু আসলে পরিবার এবং ছেলে, দুটোই মেয়েকে পাত্রস্হ করার উপযুক্ত। ফলে বছর দুয়েক বাদে খুব ঘটা করে শুভ্রর সাথেই রমার বিয়ে হয়ে যায়।


বিয়ের পর রমা ও শুভ্র বেশ ভালই ছিল।শুভ্রদের অতবড় পরিবারে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও রমা নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে নিচ্ছিল। বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি পাশাপাশি বা একই পাড়ায় না হলেও খুব দূরেও ছিল না। তাই প্রায় দিনই বিকেলে এবং ছুটির দিন গুলোয় শুভ্রকে সাথে নিয়ে রমা বাপের বাড়ি চলে আসত। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন হোল না।কারন বিয়ের দেড় বছর বাদে শুভ্র একটা বড় কোম্পানিতে ভালো অফার পেল। এবং তার ফলে তাকে কোলকাতা ছাড়তে হোল।


বদলীর চাকরী। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অফিসের ইউনিট। ফলে নতুন নতুন জায়গায়, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথমটা রমার ভালো ই লাগছিল।সে নিজে খুব মিশুকে।তাই খুব তাড়াতাড়ি সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে নিতে কোন অসুবিধা হয়না।এরই মধ্যে সুখবর, সে মা হতে চলেছে। বাড়ির লোকেদের মতামত অনুযায়ী তাকে কলকাতায় ফিরতে হোল। সময়মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে এল তার কোল জুড়ে। মাস ছয়েক মা'র কাছে থেকে এবার সে যখন শুভ্রর কাছে ফিরবে , তখন তাকে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হোল ।


শুভ্রর তখন নতুন পোস্টিং, মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্ৰামে।শুভ্র সকালে অফিসে বেড়িয়ে যাবে , ফিরতে ফিরতে রাত আটটা সাড়ে আটটা হবে ।এই সারা দিন অজানা অচেনা পরিবেশে, ছোট্ট শিশুকে নিয়ে রমাকে একা থাকতে হবে। কখনো কোন বিপদ হলে , বাচ্চার শরীর খারাপ হলে খুবই বিপদে পড়তে হবে।আর অন্য দিকে শুভ্র আর একা একা নিজের খাওয়া দাওয়া ম্যানেজ করে উঠতে পারছে না।ফলে তার রমাকে প্রয়োজন।তাই সেই কোলের শিশুকে মা'র কোলে রেখে রমা চলে যায় শুভ্রর সাথে তার সংসার জীবনে।


প্রতি এক - দেড় বছর অন্তর শুভ্রর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলী হয়।রমাও নতুন নতুন জায়গায় নতুন নতুন বন্ধু পাতায়, আবার তাদের ছেড়ে চলে নতুন অভিযানে।এইভাবে চলতে চলতে এবার তারা এসে পৌঁছায় পুনায়।এবার আর কোন প্রত্যন্ত গ্ৰামে নয়, একদম শহরেই তাদের বাসা এবং অফিস। এখানে এসে ওরা এই প্রথম প্রচুর বাঙালির সংস্পর্শে আসতে পেরে যেন নতুন করে জীবন ফিরে পায়। এখানে ওদের বাসার খুব কাছাকাছি দোকান বাজার, স্কুল সব থাকায় রমা আর চুপ থাকতে পারলো না। সে এবার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত শুভ্রকে জানালো।শুভ্র ও এক কথায় রাজি হয়ে গেল।


অন্যদিকে তাদের সেই কোলের মেয়ে দিদুর আদর-যত্নে একটু একটু করে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।সে এখন কেজি ওয়ান , কেজি টু শেষ করে ক্লাশ ওয়ানে পৌঁছে গেছে।


ক্লাশ ওয়ানের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে, রমা মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসে এবং এখানেই স্কুলে ভর্তি করে দেয়।পুনায় আসার পর বছর তিনেকের মধ্যে শুভ্রর অন্য কোথাও পোস্টিং হয়নি। এই তিন বছরে গানের জগতে রমা পুনায় এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে এখান থেকে আর অন্য কোথাও যাবার কথা সে ভাবতেই পারেনি। আসলে ওরা ভেবে ও নিয়েছিল যে এখানে শুভ্রর পার্মানেন্ট পোস্টিং হয়ে গেছে। কিন্তু তিন বছর পরে আবার যখন শুভ্রর একটা রিমোট এরিয়ায় বদলির অর্ডার এল তখন যেন ওদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল।

এবার শুভ্র খুব শান্ত ভাবে চিন্তা ভাবনা করে, চাকরি তে ইস্তফা দিয়ে, নিজে কনসালটেন্সি করতে শুরু করল। খুব বড় পোস্টের অভিজ্ঞ ইন্জিনিয়ার থাকায় কনসালটেন্সি র কাজ পেতে সময় লাগেনি।


শুভ্রর নিজের কাজ, আর রমা মেয়ের পড়াশোনা ও নিজের গানের প্রোগ্ৰাম নিয়ে ভালো ই আনন্দে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এরমধ্যে তারা ভাড়া বাসা ছেড়ে , ফ্ল্যাট কিনে সেখানে চলে আসে। সময় যে কোথা দিয়ে চলে যায়, টের ই পাওয়া যায়না। দেখতে দেখতে মেয়ে স্কুল - কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন চাকরি পেল তখন হঠাৎ যেন মনে হল, মেয়ে এতবড় কবে হয়ে গেল!


এবার রমা মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য অস্হির হয়ে উঠল। আত্মীয় - বন্ধু সকলকে ডেকে ডেকে বলতে লাগলো মেয়ের জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ এনে দিতে। ফলে একটা -দুটো করে সম্বন্ধ আসতে লাগলো। কিন্তু কোনটাই ঠিকঠাক মনের মতো হয়না । এইভাবেই সময় এগিয়ে যায়। সেবার পূজোর প্রোগ্ৰামে রমার মেয়ের নাচ দেখে এক ভদ্রমহিলার রমার মেয়েকে তার ছেলের জন্য পছন্দ হয়ে যায়। এক পরিচিত মহিলার মাধ্যমে যোগাযোগ করে ,দেখা শোনা কথাবার্তা হয়ে শেষমেশ এখানেই বিয়ে ঠিক হয়। খুব ধুমধাম করে, আনন্দে র সাথে শুভ কাজ সম্পন্ন হয়।


শ্বশুরবাড়ি খুব একটা দূরে নয়। ফলে মেয়ে প্রায় ই ছুটির দিন গুলো তে চলে আসতো মায়ের কাছে। গানের প্রোগ্ৰাম, মাঝে মাঝে কোলকাতা যাওয়া, মেয়ে -জামাই এর আসা যাওয়া এই নিয়ে ভালো ই চলছিল রমার জীবন। 

 দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেছে মেয়ের বিয়ে হয়েছে অথচ ছেলে-মেয়ে কিছু ই হোল না।এই নিয়ে শুরু হোল রমার দুশ্চিন্তা।যদিও মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তে বা মেয়ে-জামাই এর মনে এই নিয়ে কোনরকম অশান্তি ছিল না, কিন্তু রমা মেয়েকে ডাক্তার দেখানো র জন্য যেমন অস্হির হয়ে উঠল, তেমনি শুরু হোল তার মন্দিরে মন্দিরে পূজো দেওয়া আর মানত করা। এভাবেই পার হোল আরো দুটো বছর।


  হঠাৎ কোথা থেকে এক মহামারি রোগ, 'কোরনা ' এসে সারা পৃথিবীর বুকে শুরু করল তান্ডব নৃত্য। জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। অফিস, স্কুল, কলেজ, দোকান বাজার সব বন্ধ। কারো সাথে কারো দেখা নেই , কোথাও যাওয়া নেই ।সে এক দূর্বিসহ অবস্হা। দুনিয়া জুড়ে লকডাউনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যখন রমা কোথাও যেতে পারছেনা, প্রোগ্ৰাম করতে পারছেনা, ঘরের মধ্যে বসে বসে দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা, সেই সময় রমার মেয়ে, 'মা হতে চলেছে ' এই সু সংবাদ দিয়ে রমাকে আনন্দে ভরিয়ে দিল।


রমার খুশির শেষ নেই। কিন্তু আবার অস্হিরতা শুরু। তার মানত পূরন করতে হবে। মন্দির বন্ধ, তাই সেখানে পূজো দিতে যেতে পারছেনা।ঘরে রোজ পূজো দিচ্ছে কিন্তু মন ভরছেনা।একসময় অবস্থা একটু স্বাভাবিক হয়। ধীরে ধীরে অনেক বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। রমার আর দেরি সহ্য হয়না। সে মেয়ে নিয়ে কলকাতা যাবে তার মানত পূরন করতে। অনেকেই মানা করল, কিন্তু তার একটাই কথা "আমি মানত করেছি , মেয়ে কনসিভ করলে ওকে নিয়ে দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে পূজো দিয়ে আসবো।"      ঐদিকে কোলকাতায় বছর তিনেকে আগে রমার বাবা গত হয়েছেন।মা একা থাকে। বহুবার রমা তার মা কে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছে, কিন্তু রমার মা নিজের জায়গা ছেড়ে আসতে রাজি হননি।এই মহামারির পরিস্থিতিতে মা কে নিয়েও রমার মনে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। তাই এখন সে স্বামী, মেয়ে-জামাই নিয়ে কলকাতা চলল মা কে দেখতে এবং মানত পূরন করতে। কিছু আপত্তি থাকলেও , যেহেতু অফিসের কাজ ঘরে বসেই চলছে ,তাই মেয়ে-জামাই ও কোলকাতায় যেতে শেষ মেশ রাজি হয়ে যায়।


  কোলকাতা গিয়ে রমা যেন কোরনার কথা ভুলেই গেল। এমনিতেই কোলকাতায় কেউই তেমন করে লকডাউনের বাধা নিষেধ মানছিলনা।আর রমাও সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তার মানত পূরন করে , তারপর এদিক ওদিক আত্মীয় বন্ধু দের সাথে দেখা করার আনন্দে মেতে উঠল। দেখতে দেখতে ফেরত আসার দিন এগিয়ে এল। এমন সময় হঠাৎ রমা অসুস্হ হয়ে পড়ল । টেস্ট করে জানা গেল কোরনা হয়েছে। দেখ না দেখ বাড়াবাড়ি হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হোল। পরদিনই শুভ্রর ও কোরনা ধরা পড়ল ।তিন দিনের মাথায় প্রথমে শুভ্র ও পরে রমা , দুজনেই ইহোলোক ছেড়ে চলে গেল।


   সংসারের শুরুতে , ছোট্ট শিশুকে মায়ের কোলে তুলে দিয়ে রমা স্বামীর হাত ধরে চলে গিয়ছিল সংসার করতে। আর আজ ! সন্তান সম্ভবা মেয়েকে আবার সেই মায়ের কাছে রেখে, নাকি বৃদ্ধা মা কে তার নাতনির কাছে রেখে (জানা নেই ) রমা এবার সংসার ধর্ম শেষ করে আবারও আগের মতো স্বামী র হাত ধরে চলে গেল পরপারে।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract