নতুন দিগন্ত
নতুন দিগন্ত
"কাকা, কাকা, " বলতে বলতে রুদ্র বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। কাকা একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে বইটার পাতা উল্টে যাচ্ছিল, পড়ায় মন ছিল না। রুদ্রর কথাই ভাবছিল। কোন ছেলেবেলায় রুদ্র তার বাবা কে হারিয়েছে।তারপর কাকা-কাকির কাছেই তার বড় হওয়া। কাকা কোনদিনই তাকে তার বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি ।কাকিও তাকে নিজের সন্তান স্নেহে ই আদর যত্ন দিয়ে বড় করেছে। কিন্তু কেন জানি রুদ্র কোন দিন ই তাদের আপন করে নিতে পারেনি।সেই কেন র উত্তর খুঁজতেই কাকা মগ্ন ছিল। রুদ্রর ডাকে হুঁশ এল ।--- আয়, ভেতরে আয় , বোস। বৌদি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? তুই ও ঘর থেকে চলে এলি যে!
--- হ্যাঁ, মা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল।
--- আসলে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি তো, দূর্বলতা টা যেতে একটু সময় নেবে।
---- মা হঠাৎ এত অসুস্থ হয়ে পড়ল! কি এমন হয়েছিল যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল? আর এতকিছু ঘটে গেল অথচ আমাকে একটা খবর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না তোমরা?
--- ডাক্তার বলল তেমন গুরুতর কিছু নয়, বয়স হয়েছে তাই দূর্বলতা একটু বেশি। চিন্তার কোন কারন নেই। তাছাড়া প্রতি বছরই ঠান্ডার শুরুতে ওনার শ্বাসের প্রবলেম হয় ই।এখন বয়স বেড়েছে বলে ডাক্তার রিক্স না নিয়ে দুটো দিন হাসপাতালে পুরো কেয়ারে রাখতে চাইলেন, তাই আমরা মানা করিনি।
রুদ্র একভাবে কাকার দিকে তাকিয়ে রইল।
--- কি দেখছিস অমন করে?
--- ভাবছি, মাত্র মাস ছয়েক ই হয়েছে আমি এখান থেকে গিয়েছি, তাতেই মা-র অসুস্থতার খবর তোমরা আমাকে জানানোর প্রয়োজন ই মনে করলেনা। এরপর তো -----
কি এরপর? বলতে বলতে চা নিয়ে কাকিমা ঘরে আসে। কাকাকে চা দিয়ে , রুদ্রর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে , নিজের চায়ে চুমুক দিতে দিতে সোফায় বসে --- তুই সবে নতুন চাকরিতে গেছিস ।ছয় মাসের আগে ছুটি পাবি না ।এই সময় তোর মায়ের অসুস্থতার খবর পেলে তুই কি করতিস? খবরটা পেয়ে ওখানে শান্তিতে কাজ করতে পারতিস? নাকি এত কষ্ট করে পাওয়া চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে আসতিস?
--- কিন্তু মা-র যদি কিছু হয়ে যেত?
--- সেইরকম পরিস্হিতি তৈরিই হয়নি। আর তাই যদি হতো তাহলে অবশ্যই তোকে খবর পাঠানো হোত।
রুদ্র চা খেতে খেতে জানলার কাছে চলে যায়, কাকা-কাকির দিকে পিছন ফিরে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, একটু বাদে বলে --- " আমি মাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।"
--- নিয়ে যাবে ! তোমার কি আমাদের --- কাকাকে মাঝপথে থামিয়ে কাকি বলে , বেশ তো, সে তো আনন্দের কথা। কিন্তু তার আগে বিয়ে করে বৌ নিয়ে আয়, তারপর তোর মা কে তোর কাছে নিয়ে যাবি।
---- মা কে নিয়ে যাবার সাথে আমার বিয়ে করার কি সম্পর্ক?
----আছে বৈকি । এক তো ব্যাঙ্গালোর নতুন জায়গা।তুই নিজেই সেখানে নতুন।তারপর সেখানে তোর মার ভাষার প্রবলেম হবে। তুই অফিস চলে গেলে সারাদিন একা একা কথা বলার কেউ থাকবেনা। একাকীত্ব শরীর এবং মন দুটোর জন্যই ক্ষতিকারক। এছাড়া, এখন যেমন দিদির শরীর খারাপ হওয়ায় আমরা সাথে ছিলাম বলে সাথে সাথে সামলে নিয়েছি, ওখানে কোনকারনে হঠাৎ কোনরকম শরীর খারাপ বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তুই খবর পেয়ে অফিস থেকে ঘরে আসতে আসতে বড় কিছু অঘটন যদি ঘটে যায় -------
কাকির কথায় রুদ্র ধাক্কা খায়। একা থাকার চেয়ে আর পাঁচ জনের সাথে একসাথে থাকার সারমর্ম টা যেন এক লহমায় উপলব্ধি করে ফেলে। কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল সেটা বুঝতে পেরে একটু থমকে যায়। এমন সময় কাকা, ---
না, না, সেই ভালো। বৌদিকে ও নিজের কাছেই নিয়ে যাক। এখন ও বড় হয়েছে, চাকরি করছে, আমার দায়িত্ব শেষ। যদিও দাদাকে কথা দিয়েছিলাম যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওর আর বৌদির সব দায়-দায়িত্ব আমার। কিন্তু ওর যখন আমাদের ওপর কোনো ভরসা ই নেই, তখন আমি জোর করে দায়িত্ব নেব কেন? ওর মাকে ও নিজের কাছে নিয়ে যাক, আর ও শান্তি তে থাকুক।
রুদ্র বুঝতে পারে যে তার কথায় কাকা আঘাত পেয়েছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি কাকার কাছে ছুটে গিয়ে, ক্ষমা চায় ।--- " sorry কাকা, আমি এরকম কিছু ভেবে বলিনি।" কাকির কাছে গিয়ে , তার পায়ের কাছে বসে, " আসলে মাকে এতটা অসুস্থ দেখে---- এর আগে মাকে কখনো এত অসুস্থ হতে দেখিনি। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম,। আ মি---"
কাকি মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর করে বলে, হয়েছে হয়েছে, সব বুঝেছি। ওঠ তো এখন যা ক্লাবে যা। সবাই জানে তুই এসেছিস।তোর বন্ধুরা ক্লাবে তোর অপেক্ষায় বসে আছে।এই ছয় মাসের কত গল্প জমে আছে ।
--- হ্যাঁ, যাচ্ছি। আচ্ছা কাকি, আমি চলে যাবার পর শ্যামল, পরি ওরা কেউ আর এ বাড়িতে আসতো না , তাই না?
--- এখানে কার সাথে গল্প করতে , আড্ডা মারতে আসবে? তবে এই পথ দিয়ে যাতায়াতের সময় বাইরে থেকেই আওয়াজ দিয়ে খবরা খবর নিতো। দিদি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল তখন ওরাই তো সবটা সামলেছে।
----- অথচ ওরাও আমাকে মায়ের অসুস্থতার খবর দেয়নি!
--- ওরা তোর প্রকৃত বন্ধু, তোকে ভালোবাসে, তাই খবর দেয়নি।জানতো যে খবরটা পেলে তুই চাকরিতে ছুটি না পেয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে আসবি।আর সেটা ওরা চায়নি, কারন ওরাও জানতো যে দিদি অসুস্থ হলেও ভয়ের কোন কারন ছিল না। যা দেখি, এবার তুই তৈরি হয়ে ক্লাবে যা। মনটা হাল্কা হবে।
রুদ্র হাসে, বলে -- হ্যাঁ যাচ্ছি।
****************************************
রুদ্র ক্লাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চলুন আমরা বরং বন্ধুদের পরিচয় গুলো জেনে নিই।
চন্দন, বড়লোকের একমাত্র সন্তান ।বাবা ,মা দুজনেই ডাক্তার। নিজেদের নার্সিং হোম নিয়েই ব্যস্ত । ছোট থেকেই চন্দন আয়ার কাছে মানুষ। বাবা মা র সান্নিধ্য পায় না বললেই চলে।
শ্যামল, বাবা, মা ও ছোট বোন এই নিয়ে তাদের ছোট সংসার। মধ্যবিত্ত পরিবার, অভাব আছে কিন্তু হাসি খুশি সুখী পরিবার।
পরি মানে পরিতোষ , বাবা-মা, কাকা-কাকি, জ্যেঠা -জ্যেঠি ও তুতো ভাই বোনেদের নিয়ে যৌথ বড় পরিবার ।যা আজকাল সচারচর দেখতে পাওয়া যায়না।
****************************************
আজকাল সবাই যে যার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত , তাই আগের মতো প্রতিদিন কারুরই ক্লাবে আসা হয়ে ওঠেনা।তবে মাঝেমধ্যে প্রোগ্রাম করে বন্ধুরা ক্লাবে দেখা করে। আজ রুদ্র ছয় মাস বাদে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে, তাই সবাই আশা করছে যে ও নিশ্চিত ক্লাবে আসবে বন্ধু দের সাথে দেখা করতে ।সেই আশাতেই আজ সবাই ক্লাবে এসেছে। কিন্তু নির্দ্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পর ও যখন রুদ্র ক্লাবে এসে পৌঁছায় না, তখন বন্ধু দের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। চন্দন জিজ্ঞাসা করে, --- আজ ই তো রুদ্রর আসার কথা ছিল , তাই তো? ও এসেছে কিনা তোরা কেউ সঠিক জানিস কি ?
একটা সিগারেট ধরিয়ে শ্যামল বলে, --- রুদ্রর পাশের বাড়ির রবির সাথে আমার দেখা হয়েছিল ক্লাবে আসার পথে।রবি বলল বেলা বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ রুদ্র এসেছে, ও দেখেছে ।
পরি, ---- আমার মনে হয় আজ আর রুদ্র আসবে না। তার থেকে চল আমরাই ওর সাথে বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসি।
চন্দন বাদ সাধলো, -- না, আজ ওকে ওর মায়ের কাছে ই থাকতে দে। কাল বরং আমরা ওর সাথে যোগাযোগ করবো।চল আজ ওঠা যাক।এই বলে যখন ওরা ক্লাব ছেড়ে বেরুতে যাবে " Hai " বলে রুদ্র সামনে এসে দাঁড়ায়।
-- ঐ তো এসে গেছে। আরে শালা, ছয় মাসে ভোল্ট পাল্টে গেছে। "Hai" বলছে।-- ফুট কাটে পরি।
--- তারপর কেমন আছিস তোরা? বলতে বলতে ক্লাব ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। শ্যামল বলে , খবর তো বলবি তুই।প্রথম চাকরি, তাও বাইরে। নতুন জায়গা, কাজ-কর্ম, অফিস, নতুন পরিবেশ সব কেমন লাগছে ?
--- ঠি-ক-ই আছে।
পরি বলে, "ঠি-ক-ই আছে" মানে?
শ্যামল বলে, আমরা তো ভেবেছিলাম যে তুই আনন্দে, নাচতে নাচতে আসবি ।
রুদ্র হঠাৎ ই চুপ হয়ে যায়।কোন কথা বলে না। চন্দন জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার?এমন চুপ মেরে গেলি ! কোন প্রবলেম ? কোথায় ? বাড়িতে না ওখানে কাজের জায়গায়?
-- না, না, চাকরি , মানে কাজ ভালোই লাগছে, এনজয় করছি । আসলে---
আসলে কি ? বাড়িতে কোন প্রবলেম?কাকিমা এখন সুস্থ আছে তো ? চন্দন আবার জিজ্ঞাসা করে।
--- হ্যাঁ, মা ঠিক আছে। সেটা কোন প্রবলেম না।আসলে আমি বলছিলাম, -- মানে ---
শ্যামল চিৎকার করে ওঠে, প্রবলেম না তো কি ? মানে মানে করছিস কেন? খোলসা করে বলবি কি হয়েছে
--- আমি আমার মত পাল্টালাম।
সকলেই অবাক হয়ে রুদ্র র দিকে তাকিয়ে থাকে।পরি বলে "মানে " ? চন্দন জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপারে ?
রুদ্র সকল কে একবার করে দেখে নিয়ে , দুম করে ---" আমি তোদের সাথে একমত।"
সবাই অবাক দৃষ্টিতে রুদ্র কে দেখে। রুদ্র বলে, "যৌথ পরিবার"। ছোট পরিবারের থেকে যৌথ পরিবার যে অনেকাংশে ভালো , সেটা আজ আমি স্বীকার করছি।
সবাই অবাক হয়ে রুদ্র র দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর শ্যামল "হুর--র--র--রে--- , বাছার চোখ খুলেছে ।" করে চিৎকার দিয়ে ওঠে।চন্দন একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে, তা এই মহান উপলব্ধি টা কি করে হোল?
--- চাকরি সূত্রে বাইরে না গেলে আর সেই সময় মা অসুস্থ না হলে হয়তো কোনদিন ই এই উপলব্ধি টা হোত না ।
ব্যাপার টা ঠিক বোঝা গেল না। বলে রুদ্র র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকায় শ্যামল।
---- আজ বাড়ি এসে মাকে এতটা অসুস্থ দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মায়ের অসুস্থতার খবর আমাকে জানানো হয়নি বলে আমি খুব অসন্তুষ্ট হয়ে দুটো কথা কাকাকে বলে ফেলি।
সে আর নতুন কথা কি ? শ্যামল বলে।
একটু চুপ থেকে রুদ্র আবার বলতে শুরু করে ---- তারপর বলি , যে এবার যাওয়ার সময় আমি মা কে আমার সাথে নিয়ে যাবো।
পরি আওয়াজ দেয় ---- বাহ্, এতো ভালো কথা।
পরির দিকে তাকিয়ে রুদ্র মাথা নেড়ে জানায় 'না '। দেখলাম মা কে নিয়ে যাবার কথা বলায় কাকা খুব আঘাত পেয়েছে। আর কাকিমা যা বলল সেটাও ভাববার বিষয়। আমি সারাদিন ঘরে থাকবো না, সেই সময় হঠাৎ মা র শরীর খারাপ হলে আমি সময় মতো খবর ও পাবো না। তাই কাকিমার বক্তব্য, আগে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসো তারপর মাকে নিয়ে যাও।
শ্যামল লাফিয়ে উঠল, আরে গুরু, তুই তো ফাটিয়ে দিলি।চাকরি পেতে না পেতেই বিয়ে !
পরি জিজ্ঞাসা করে , তা মেয়ে টেয়ে দেখতে হবে , না কি এর মধ্যেই ওখানে জোটানো হয়ে গেছে? যাই বল গুরু , তুই কিন্তু ঠিক যেমনটা চেয়েছিলিস তেমনি পেয়ে গেলি। কাকা - কাকির থেকে দূরে, মা বৌ নিয়ে ছোট্ট সংসার।
এ্যাডভান্স congratulations। Good luck
---- না রে, এই ছয় মাস ওখানে একা একা থেকে এগুলো আমিও বেশ কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছি। একসাথে থাকার বা যৌথ পরিবারের উপকারিতাটা এখন আমিও বুঝতে পারছি। ভাবছি, এক বছর হয়ে গেলে কলকাতায় বদলী নিয়ে চলে আসবো।
যা বলছিস ভেবে বলছিস তো? চন্দন জিজ্ঞাসা করে।শ্যামল ফুট কাটে -- কাকা-কাকির সাথে একসাথে থাকবি বলছিস ! তুই তো তাদের সহ্য ই করতে পারতিস না। তাদের প্রতি রাগ বিদ্বেষ সব শেষ ?
---- ছাড় না পুরোনো কথা।
ছাড়বো মানে ? যৌথ পরিবারের বিরুদ্ধে তুই এতদিন যা কিছু বলেছিস --- চন্দন তোর মনে আছে ,সেবার শ্যামলের দাদু মারা যাবার খবর পেয়ে শ্যামল যখন খুব ভেঙে পড়েছিল, তখন রুদ্রর কথাগুলো মনে আছে ?
শ্যামল বলে , মনে নেই আবার ---
****************************************
চলুন আমরা একটু অতীতের পাতায় ফিরে যাই।
ছুটির দিনে বন্ধুরা ক্লাবে জড়ো হয়েছে। শ্যামল তখনো এসে পৌঁছায়নি। চন্দন জিজ্ঞাসা করে, তোরা কেউ কোন খবর পেয়েছিস, শ্যামলের দাদু এখন কেমন আছেন?
রুদ্র খুব অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তোরা পারিস ও বটে ! শ্যামলের দাদু ! তাও যদি নিজের দাদু হোত ।ওর দাদুর কোন খুড়তুতো ভাই , তাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি।
পরি বলে , কেন খুড়তুতো ভাই কি ভাই নয়?
----- থাম তো। এতদিন কোথায় ছিলেন উনি? যেই অসুস্থ হয়েছিলেন অমনি ডাক্তার দেখাবার নাম করে, আত্মীয়তা খুঁজে খুঁজে এখানে চলে এসেছিলেন। দুনিয়ার এমাথা ওমাথা থেকে লোকজন খুঁজে এনে আত্মীয় আত্মীয় করে, তোদের এই যৌথ পরিবার বানানোর কোন অর্থ ই আমি খুঁজে পাই না।
রুদ্র র কথায় চন্দন ও পরি দুজনেই অসন্তুষ্ট হয় কিন্তু কিছু বলেনা ।এর ই মধ্যে শ্যামল চলে আসে, জানায়, আজ সকালে ভাই ফোনে জানিয়েছে যে গতকাল শেষ রাতেই দাদু মারা গেছেন । বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
পরি জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু হঠাৎ কি হোল?
--- কিছু ই না, বয়স তো হয়েই ছিল। দুদিনের জ্বরে চলে গেলেন।
রুদ্র আর সহ্য করতে পারে না, বলে -- এক তো বয়স হয়েছিল, তার উপর তোর কোন কাছের মানুষ নন। কোন দূর সম্পর্কের এক বুড়ো , সে মারা যাওয়ায় এমন করছিস যেন ---
তুই থামবি । বলে চন্দন এক ধমক দেয়।শ্যামল বলে , নিজের দাদু ঠাকুমা কে তো এত কাছের করে পাইনি। আমরা তখন খুব ছোট, যখন ওনারা চলে গেছেন। সেই ছয় মাস , যখন এই দাদু ঠাকুমা আমাদের কাছে ছিলেন তখন সেই অভাবটা পূরণ হয়ে গেছে।কি যে আনন্দে কেটেছে ঐ ছয় মাস , দাদু ঠাকুমার সান্নিধ্যে , সে তোকে বলে বোঝাতে পারবো না রে রুদ্র।
---- হ্যাঁ, তোমার আর কি , তুমি তো আনন্দে ই থাকবে।তোর বাবা তখন কিভাবে সংসার চালিয়েছে সে খবর কি রাখতিস? প্রায় ই মেশোমশাই কাকার কাছে আসতেন সুখ দুঃখের গল্প করতে । সে সব অনেক কথাই আমি পাশের ঘর থেকে শুনেছি ।
শ্যামল হেসে বলে , হ্যাঁ, টাকা পয়সার অভাব তো ছিলই। কিন্ত দাদু-ঠাকুমার আদর , ভালোবাসার ছোঁয়ায় এতটাই আনন্দে ছিলাম যে অভাব বা কোন ভালোমন্দ খেতে না পাওয়ায় কোন কষ্ট কোনদিনই আমাদের স্পর্শ করতে পারে নি। বরং ওনারা চলে যাবার পর খুউব খারাপ লাগত।
চন্দন কিছু বলতে যাবে এমন সময় সুভাষ, পাড়ার ই একটা ছেলে ক্লাবে ঢুকেই -- আরে এই তো তোমরা সবাই এখানেই আছো দেখছি।
পরি বলে, কেন আমাদের এখানে থাকা না থাকায় তোর কি কাজ ?
---- না, আমার কোন কাজ নেই , তবে তোমার জ্যাঠামশাই তোমায় খুঁজছেন ।তোমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে বলেছেন।
---- জ্যাঠামশাই আমায় খুঁজছেন ! তুই কি করে জানলি ?
--- তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলাম, আমাকে ডেকে বললেন," শোন, ক্লাবে গিয়ে পরিকে বলতো আমি এক্ষুনি ডাকছি।"
পরি একটু চিন্তায় পড়ে গেল, বাড়িতে কোন কিছু অঘটন ঘটল কিনা।
সুভাষ আবার বলে , আমি চলে আসতে আসতে শুনতে পেলাম, তোমার কাকার ছেলেটা বলছে , --- "computer আমিও জানি, দাদা একাই সব কিছু জানে নাকি?"
এবার পরি হেসে ফেলে । বলে, বুঝেছি । জ্যেঠু বোধহয় computer এ গেম খেলছিল, কোন কারনে computer ঠিক মতো কাজ করছে না , তাই।
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে , যাক্ বাঁচা গেল, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তুই এক্ষুনি এক্ষুনি না গেলেও কোন ক্ষতি হবে না।
না, না ,পরিদা , প্লিজ তুমি কিন্তু দেরি কোরনা । তা নাহলে উনি ভাববেন যে আমি তোমাকে সময় মতো খবরটা দিইনি।
চন্দন বলে , এই ব
য়সেও নতুন কিছু শেখার আগ্ৰহ , এটা বেশ ভালো লাগলো। তাহলে তুই এখন বাড়ি যাবি তো?
--- হ্যাঁ রে। বয়স্ক মানুষ, চট করে রেগে যান।এখন যেতে দেরি হলে ভাববেন আমি ওনাকে গ্ৰাহ্য করছি না।
সেই ভালো , তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা , আমরাও উঠি । চন্দনের কথা শুনে রুদ্র রেগে যায়। বলে , এই তো তোদের যৌথ পরিবারের মাহাত্ম্য। একটা ছোট্ট ফালতু কারনে ওর জ্যেঠা একেবারে ফরমান জারি করে পাঠালেন , "এক্ষুনি বাড়ি আসতে হবে। "অথচ প্রয়োজন তেমন জরুরী কিছু নয়। আর উনিও চললেন। এর কোন মানে হয় !
রুদ্র র কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে, পরি বলল, আমি চলি, তোরা গল্প কর , বিকেলে দেখা হবে।
চন্দন ও উঠে পড়ে , বলে চল্ বেলা অনেক হয়েছে, এবার আমরাও ঘরে যাই।
রুদ্র বলে, তুই এখন বাড়ি গিয়ে কি করবি? কি কাজ আছে তোর এখন বাড়িতে?
----- তাই বলে সারাদিন ক্লাবে পড়ে থাকবো?
শ্যামল বলে , ঠিকই তো , সারাটা দুপুর ঘরে একা একা কি করবি ? তারচেয়ে আমাদের বাড়ি চল, যা রান্না হয়েছে একসাথে বসে খাবি। মা খুব খুশি হবে।
--- কথাটা মন্দ বলিস নি। ঘরে গিয়ে সেই নিজের হাতে খাবার বেড়ে খাওয়ার চেয়ে , মাসিমার সামনে বসে খাওয়ানো, সে খাওয়ার মজাই আলাদা। আর একটু রিনির পিছনেও লাগা যাবে। ওকে রাগাতে খুব ভালো লাগে।
সারাটা দুপুর শ্যামলদের বাড়িতে কাটিয়ে, সন্ধ্যায় ক্লাবে আড্ডা মেরে রাত নটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে বাবা -মা দুজনকেই বাড়িতে দেখে অবাক হয়ে যায়। --- "কি ব্যাপার , তোমরা দুজনেই আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে !"
সৃজা , চন্দনের মা বলল, আজ বিকেলে পরপর তিনটে অপারেশনের পর মনে হোল একটু রেস্ট দরকার। নার্সিং হোমে থাকলে তো রেস্ট হয় না ,তাই চলে এলাম ।
---- খুব ভালো করেছ। তোমরা দুজনে একসাথেই এসেছ?
না , তোর বাবা আগেই চলে এসেছে ।আমি মিঃ দশেক হোল এসেছি।
যাই হোক , তোমাদের দুজনকে এই সময় ঘরে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
শোন চন্দন , (চন্দনের বাবা রজত বললেন ) আগামী পরশু আমি আর তোমার মা দুজনেই
এক সপ্তাহের জন্য মুম্বাই আর হায়দ্রাবাদ যাবো , conference আছে।তোমার জন্মদিন টাতে আমরা থাকতে পারছি না। তোমার ব্যাঙ্কে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছি। তুমি বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিনের পার্টি মানিও।
---- একটু হেসে, ঘুস। তাছাড়া এ আর নতুন কথা কি? আমার জন্য তোমাদের কবেই বা সময় ছিল? ছোট বেলায় নিত্য নতুন খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছিলে, আর এখন টাকা।
রজত অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তুমি কি মনে কর, আমাদের তোমার সাথে সময় কাটাতে , তোমাকে সময় দিতে ইচ্ছে করে না?
----- রিয়েলি ! তাহলে নার্সিং হোম টাকে একটু কম ভালোবেসে সেখান থেকে একটু সময় আমার জন্য বার করলেই তো তোমাদের সেই ইচ্ছেটা কে বুঝতে পারতাম।
---- যা কিছু করি, তার সবটাই তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করি।
--- আর সেই জন্য ই ----
চন্দনের কথার মাঝেই রজতের ফোন বেজে ওঠে।--- "হ্যালো । -- -- হ্যাঁ, হ্যাঁ , আমি এক্ষুনি আসছি। --- --- তোমরা অপারেশন থিয়েটার রেডি করো ।আমি পৌঁছাচ্ছি। " এরপর চন্দন আর সৃজার উদ্দেশ্যে --- একটা accident কেস এসেছে।আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে।
---- মাঝে মাঝে মনে হয় ,আমার যদি একটা accident হোত , অথবা খুব বড় critical কোন অসুখ , তাহলে তোমাদের নার্সিং হোমে ভর্তি থেকে কটাদিন অন্তত তোমাদের কাছের করে পেতাম।
রজত যেতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। চন্দনের দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে -----আমি ফিরে এসে তোমার সাথে কথা বলছি।
রজত বেড়িয়ে গেলে সৃজা চন্দনকে বলে, যথেষ্ট বড় হয়েছ বাবাই, একটু বুঝতে চেষ্টা করো। বাস্তবটা অত সোজা নয়।এই দুনিয়ায় টাকা ছাড়া এক পা ও চলা যায় না। তুমি কোনদিন অভাব দেখনি, তাই টাকার মূল্য বোঝ না।
----- হবে হয়তো। তবে টাকার বাইরেও যে আরো কিছু আছে সেটা হয় তোমরা জানো না , নয় জানতে চাওনা।
---- কি বলতে চাস তুই?
---- কিছুনা। তুমি ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম করোগে। বলে ভেতরের ঘরে যেতে নিলে সৃজা আওয়াজ দেয় - "বাবাই"
চন্দন ঘুরে দাঁড়ায়। সৃজা জিজ্ঞেস করে "আজ দুপুরে খাস নি কেন?
--- খেয়েছি তো ।
--- রান্নাঘরে খাবার তো যেমনকার তেমন সবই পড়ে আছে।
--- ঘরে খাইনি । শ্যামলদের বাড়িতে খেয়েছি।
--- ঘরের ভালো ভালো খাবার ফেলে তুই ---
কথা পুরো হতে দেয় না , চন্দন বলে , ডাল , ভাত আর আলু সেদ্ধ । অমৃত সমান খেয়েছি।
--- তুই ভালো থাকবি , ভালো খাবি সেই চিন্তা করে আমরা এত পরিশ্রম করি। আর তুই ---
---- কাকিমা, শ্যামলের মা , সামনে বসে গল্প করতে করতে নিজে হাতে পরিবেশন করে যখন খাওয়ায়, তখন সে খাওয়ায় যে তৃপ্তি, যে স্বাদ তা তোমার এই মাটন, চিকেন বিরিয়ানি তেও নেই।
--- আমি তোকে আজকাল বুঝে উঠতে পারিনা ।এত সুখ- স্বাচ্ছন্দ, ঐশ্বর্য দিয়েও তোর মন পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।
--- হ্যাঁ, দিয়েছ । অঢেল দিয়েছ। ছেলেবেলায় দামী দামী খেলনা আর আয়া দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলে। বড় হয়েছি তো টাকার পাহাড়ে ঢেকে দিয়েছ। কিন্তু কখনও জানতে চাওনি আমি কি চেয়েছি। ছোটবেলায় তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চেয়েছি, জ্বর হলে মাথার পাশে তোমাকে খুঁজেছি। আর পাঁচ টা বাচ্চাদের মতো বাবার হাত ধরে পার্কে বেড়াতে যেতে চেয়েছি । এগুলোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে শৈশব কৈশোর পার করে এতটা পথ এসে আজ ও যখন মনের কথা বলার জন্য , আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ শেয়ার করার জন্য তোমাদের কে খুঁজি, তখনো তোমরা টাকার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ। আমার জন্য তোমাদের সময় ই কোথায়? যাক্ , এসব বলেই বা কি লাভ ? তার থেকে যাও বিশ্রাম করো , আমারো কিছু কাজ আছে , আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।
এই ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। বছর দুই পরের কথা, সময়ের সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন এসেছে ।পরিরা আগের মতো প্রতিদিন ক্লাবে যায়না। এখন পরের জেনারেশন সেই জায়গা নিয়েছে। পরিরা যায় মাঝে মধ্যে। সেদিন যখন পরিরা ক্লাবে গেছে, তখন পরের জেনারেশন এর কয়েকটা ছেলে ক্লাবে ক্যারাম খেলছিল। ওদের খেলা প্রায় শেষ যখন পরিরা ক্লাবে ঢুকছে। খেলা শেষে সবাই একে একে চলে গেলেও সুভাষ বসে রইল , জিজ্ঞাসা করল , -- কি ব্যাপার ! তোমরা আজকাল ক্লাবে আসোই না !
পরি বলল, কেন রে , আমাদের আসার সাথে তোদের কি সম্পর্ক ?
---- কিছুনা , তোমরা ক্লাবে থাকলেই বেশ গান বাজনা করতে , খুব ভালো লাগতো । কতদিন তোমাদের গান শুনিনি।
শ্যামল বলল, এখন আর আমাদের গান শুনতে হবে না। এখন আমাদের পদোন্নতি হয়েছে। গান বাজনা করার সময় নেই।
---- পদোন্নতি হয়েছে মানে ?
চন্দন বলল, আমরা আর বেকার নই , চাকরি পেয়েছি।
---- আরে এতো দারুণ খবর। সবাই একসাথে চাকরি পেয়েছ?
পরি --- বলতে পারিস। শ্যামল গত সপ্তাহে জয়েন করেছে। রুদ্র আর আমার জয়েনিং ডেট টা এখনও আসেনি। আর চন্দন চলে যাবে আগামী মাসে র প্রথম সপ্তাহে।
--- চলে যাবে মানে !
শ্যামল বলে , চন্দন U K যাচ্ছে। ও ওখানে ভালো চাকরি পেয়েছে।
---- তাহলে উড়ে যাচ্ছে বলো।
সবাই হাসে। সুভাষ আবার বলে, আচ্ছা চন্দনদা, তোমার চাকরির কি দরকার ? তোমার বাবার এতো টাকা ---
---- আমার বাবার টাকা আছে বলে আমি রোজগার করবো না? সারা জীবন বসে বসে বাবার রোজগারে আয়েস করবো ?
---- না ঠিক তা বলছি না । তবে বলছিলাম যে , তুমি তো তোমার বাবার টাকায় এমন কিছু ব্যাবসা করতে পারো ,যেখানে আমাদের মতো দু চরটে বেকার ছেলেও কাজ পাবে। আর অন্যদিকে তোমার পোস্টে অন্য আর একটা যোগ্য বেকার ছেলের চাকরি হবে। তাহলে কত জনের উপকার হবে, ভেবে দেখ।এমনটা হলে ভালো হয় না?
চন্দন বলে , অনেক জ্ঞান হয়েছে , এবার এখান থেকে কেটে পড় তো দেখি।আর যাবার আগে ক্যারাম বোর্ডটা তুলে রেখে যাও।
সুভাষ বেগতিক বুঝে ক্যারাম টা তুলে জায়গা মতো রেখে তাড়াতাড়ি চলে যায়, অবশ্য যাবার আগে --- " আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো " বলে পালিয়ে যায়।
এবার চন্দন রুদ্রকে জিজ্ঞাসা করে, কিরে তোর পিসিমা কেমন আছেন? ওনাকে কি এখানে নিয়ে এসেছিস?
---- পিসিমা চলে গেছেন ।
শ্যামল আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে , চলে গেছেন? কোথায় ? তোর ভাই নিয়ে গেছে?
পরি বলে ,তাহলে তো খুব ভালো কথা।
----- ভাই নিয়ে যাবে, স্বপ্ন দেখছিস? পিসিমা গতকাল সকালে চির শান্তির দেশে চলে গেছেন।ভাই এসেছিল, শ্মশানের কাজ সেরেই সোজা শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু জানে না।
চন্দন বলে , স্বার্থ বলছিস কেন ? শ্মশানের কাজ সেরে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে বলে? একা একা কি করতে ঐ বাড়িতে সে থাকবে ?
---- মা যখন ছিল , তখনই বা সে কি করেছে? মা কে একা রেখে দিব্যি গুজরাট চলে গেল তো !
চন্দন বোঝাবার চেষ্টা করে , তাছাড়া কি করতো ? অত ভালো চাকরি , সেটা তো পায়ে ঠেলতে পারেনা । এখানে কবে একটা ভালো চাকরি পাবে সেই ভরসায় হাতে আসা চাকরি টা ছেড়ে দিত কি ? আর রইল তোর পিসির কথা । তিনি তো নিজেই ভিটে আঁকড়ে পড়ে ছিলেন , ছেলের সাথে যেতে চাননি ।তাহলে তোর ভাই এর দোষটা কোথায়?
পরি বলে , আচ্ছা রুদ্র , তোর পোস্টিং যদি বাইরে কোথাও হয় , তাহলে তুই কি করবি ? বাংলার বাইরে মাসিমা যেতে রাজি না হলে জোর করে নিয়ে যাবি ? নাকি মাসিমার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিবি?
শ্যামল বলল, একবার ভেবে দেখ , সত্যিই যদি তোর বাইরে ই পোস্টিং হয় তাহলে তুই কত নিশ্চিন্তে মাসিমাকে তোর কাকা কাকির কাছে রেখে যেতে পারবি। এটাই যৌথ পরিবারের উপকারিতা। নাহলে তো তোকেও তোর পিসতুতো ভাই এর মতো----
****************************************
কি রে মনে পড়ে সেদিনের সেই কথাগুলো?বলে শ্যামল অর্থ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রর দিকে।
---- ছাড়্ না পুরোনো কথা। বলছি তো আজ আমি তোদের সাথে একমত। যৌথ পরিবার ই ভালো। এবার তোদের কথা বল।
পরি বলে আমার তো পোস্টিং আপাতত কলকাতাতেই হয়েছে ।তবে পরে অন্য কোথাও বদলি করলেও করতে পারে।
---- এতো দারুণ খবর। হ্যাঁ রে শ্যামল , রিনির বিয়েটা হয়ে গেলো? দুটো মাস পিছিয়ে বিয়ের দিনটা রাখতে পারলি না?
---- sorry ,উপায় ছিল না রে। ছেলের বাড়ির তাড়া ছিল।
---- চন্দন কি রিনির বিয়েতেই এসেছিস?
পরি বলে, চন্দন তো কোথাও যায়নি ।
----- মানে ! ওর U K র চাকরি?
---- চন্দন হাসতে হাসতে , --- ভেবে দেখলাম , কারো গোলামী করার থেকে , স্বাধীন ভাবে নিজে কিছু করা ভালো।আর সেখানে যদি দু একজন বেকার ছেলেকে কাজ দেওয়া যায়, তা থেকে ভালো আর কি হতে পারে?
---- তার মানে সেদিনের সুভাষের কথা টা ---
--- একদম মনে গেঁথে গিয়েছিল। কথাটা খুব দামী মনে হয়েছিল।
---- তাহলে এখন কি করছিস? ব্যাবসা ? কিসের ব্যাবসা?
----- দুটো এ্যম্বুলেন্স আর দুটো অটো কিনেছি। এ্যম্বুলেন্স দুটো , এমার্জেন্সি পারপাস , রুগীদের যেকোন হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে জনা ছয়েক ছেলে ড্রাইভার ও হেলপারের কাজ পেয়েছে। আর অটো দুটো বস্তির দুটো ছেলেকে দিয়েছি , ওরা মান্হলি আমাকে একটা টাকা দেয়।
---- কিন্তু তোর অত ভালো চাকরি ! তোর বাবা -মা অসন্তুষ্ট হন নি?ওনারা তো টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না।
---- না রে , অসন্তুষ্ট হয়নি উল্টে খুশিই হয়েছে।
--- বলিস কি রে !
--- হ্যাঁ রে , বয়স হচ্ছে তো ।আমি চলে গেলে বুড়ো বয়সে একা হয়ে যাবে সেই ভয়টা তো মনের মধ্যে ছিল। এছাড়া তাদের ধারনা যে, যারা চাকরি করতে দেশের বাইরে যায় তারা আর এই দেশে ফেরত আসতে চায় না।
শ্যামল বলে , তাহলে তো খুশি হবার ই কথা।
---- তাছাড়া আমিও ভেবে দেখলাম , ছেলে বেলায় যখন আমার তাদের কে দরকার ছিল তখন তাদের কাছে না পেয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছি, রাগ করেছি ।আর আজ যদি চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাই , তাহলে আমিও তো সেই একই ভুল করবো ।বৃদ্ধাবস্হায় তারা তাদের পাশে আমাকে খুঁজবে , যেমন আমি ছেলেবেলায় তাদের কে খুঁজেছি।
রুদ্র চুপ থাকতে পারে না , বলে , তোর ছেলেবেলায় তাদের একবার ও মনে পড়েনি যে তাদের কে তোর দরকার , আর আজ বৃদ্ধাবস্হায় তাদের প্রয়োজনে তারা তোকে খুঁজবে ! স্বার্থপর।
--- এভাবে বলিস না। একটা কথা ভেবে দেখ, সেদিন তারা আমার প্রতি ভুল করলেও , যা কিছু করেছে , আমার জন্য ই তো করেছে। সেদিন আমাকে সময় না দিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে এত রোজগার করেছে বলেই তো সেই টাকায় আজ অনেক না হলেও দু চারজনকে কাজ দিয়ে সাহায্য করতে পালাম।এটাও তো ওনাদের ই দান।
পরি বলে , আর একটা কাজ ও তো হচ্ছে , সেটা বল।
----আর একটা কাজ মানে ! রুদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
চন্দন বলে, এটা আমার নয়, শ্যামলের স্বপ্ন ।আমি শুধু ওর সাথে আছি এই পর্যন্ত।
রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, কাজটা কি?
--- শ্যামলের ইচ্ছা, ওর কাকা-কাকি, মাসি-মেশো,পিসি , সবার বয়সকালে সকলকে একসাথে এক জায়গায় রাখার।তার জন্য একটা জায়গা চাই, বড় বাড়ি চাই, আর চাই অর্থ। ওর সেই স্বপ্নটাই পূরণ করার চেষ্টা করছি।
---- কেন তোর তুতো ভাই বোনেরা সবাই বাইরে থাকে ?
শ্যামল বলে, না তা নয়। আসলে দেখ যে কোন বয়সেই সকলের ই সমবয়সী সাথীর দরকার হয়। রিনির বিয়ে হয়ে যাবার পর দেখলাম মা খুব একা হয়ে গেছে। আমিও সারাদিন নিজের কাজে বাইরেই থাকি। তাদের প্রয়োজন মতো সময় বা সাথ দিতে পারিনা। তাই ভাবলাম, যদি তাদের বন্ধু স্হানিও যারা ,যেমন আমার মাসি-মেশো, পিসি-পিশো, মামা-মামি , কাকা-কাকি এইরকম সবাইকে যদি এক জায়গায় রাখতে পারি, তাহলে তারা কখনো ই একাকীত্ব অনুভব করবেনা। নিজেরা গল্প গজব, হাসি ঠাট্টা য় আনন্দে থাকবে।আর এক জায়গায় থাকলে, তাদের দেখাশোনা করতেও অনেক সুবিধা হবে।
---- রুদ্র আঁতকে ওঠে। " বাপরে কি ভয়ঙ্কর আর উদ্ভট চিন্তা।"
তুই কোন কিছুই পসেটিভ এ ভাবতে পারিস না , তাই না? পরি রেগে যায়।
চন্দন বলে, উদ্ভট নয়। স্বপ্নটা কত সুন্দর সেটা ভেবে দেখ। এভাবে যদি সবাই ভাবে, আর করতে চেষ্টা করে, তাহলে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন হয়না। আর শেষ বয়সে এই বয়স্কো মানুষ গুলো কতো আনন্দে থাকবে, ভাবতে পারিস?পরিবারে শুধু যদি 'আমার আমার ' চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দেওয়া যায়, তাহলে এই যৌথ পরিবারের থেকে ভালো আর কিছু হয়না।
কি বলেন আপনারা, পাঠক পাঠিকারা?