Manasi Ganguli

Classics

4.5  

Manasi Ganguli

Classics

সাঁঝতারা

সাঁঝতারা

8 mins
688


 সাঁঝতারায় আজ উৎসব লেগে গেছে, সবাই দারুণ খুশি,দারুণ ব্যস্ত। চারদিক আলো ঝলমল,আনন্দমুখর। আশপাশের মানুষজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে,কি ব্যাপার তারা বুঝতে পারছে না। কখনও কখনও দেখেছে সাঁঝতারাদের একটি তারাকে খসে যেতে,অন্তর্জলি যাত্রা করতে কিন্তু এমন আলো-ঝলমল উৎসব ! কোনো পুজো টুজোও তো নেই আজ ! বাইরে দিয়ে তাকাতে তাকাতে তারা যাচ্ছে কিন্তু বুঝতে কিছুই পারছে না।

       সাঁঝতারা হল একটি বৃদ্ধাশ্রম। এখানে যাঁরা থাকেন স্বেচ্ছায় এসে থাকেন তাঁদের একাকীত্ব কাটাতে,সমবয়সী সঙ্গী পাবার লোভে। জীবন সায়াহ্নে এসেও তাঁরা প্রত্যেকে সাঁঝতারা বলেই পরিচিত এখানে। কর্তৃপক্ষের মতে তাঁরা প্রকৃতই এক একটি সন্ধ্যা তারা,এক এক করে ফুটে ওঠে বৃদ্ধাশ্রমের আকাশটাকে ঝলমল করে তুলেছেন। এনারা সকলেই শিক্ষিত,কাউকে বাড়ির মানুষ জোর করে এখানে ফেলে দিয়ে যায়নি। এঁরা এখানে আনন্দে,হাসি,গানে খুব ভালো থাকেন। তাঁদের মতে সারাজীবন সংসার,চাকরি সব সামলাতে গিয়ে এত আনন্দে তাঁরা থাকতে পারেননি কখনও,সর্বদাই চাপে থাকতে হয়েছে। আজ তাঁরা চাপমুক্ত। যার যা কোয়ালিটি ছিল পারিপার্শ্বিকতার চাপে চাপা পড়েছিল বা হারিয়েছিল তা আবার চাপা সরিয়ে বেরিয়ে পড়েছে স্বমহিমায়। এখানে এসে আবার চর্চা শুরু করেছেন তাঁরা,কেউ গান,কেউ নাচ,কবিতা আবৃত্তি, আঁকা,অভিনয় এমনকি লেখালেখিও।

      সুমনার ছেলেমেয়ে বিদেশে,এই ৫৬ বছর বয়সে স্বামী মারা যাবার পর বড্ড একা লাগে,যদিও আত্মীয়-স্বজন কাছাকাছি সবাই আছেন কিন্তু যতটুকু সময় বাড়িতে থাকা সে তো একাই,ভালো লাগে না মোটে। ছেলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইলেও উনি যেতে চাননি। তারা সারাদিন বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকবে,সেই তো একা,রাতে একটু দেখা বই তো নয়।বিদেশ-বিভুঁইয়ে তা তার মোটেই ভাল লাগবে না,তার চেয়ে নিজের দেশই ভাল। মাকে একা রেখে যেতে ছেলেরও খুব খারাপ লেগেছে কিন্তু সে আর কতদিনই বা এদেশে বসে থাকবে চাকরি বাদ দিয়ে। অতঃপর ফিরে যেতেই হয় তাকে। যাবার আগে মাকে প্রচুর বই কিনে দিয়ে গেছে সে। সুমনার বই পড়ার খুব নেশা। বই পড়ার সময় তিনি যেন অন্য জগতে চলে যান। নিজেও টুকটাক লেখালেখি করতেন আগে স্কুল কলেজে পড়ার সময়,তাই বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার লেখালেখি শুরু করেন। নিজেই লেখেন,নিজেই পড়েন। কিন্তু মাঝে মাঝে অবসাদ এসে ঘিরে ধরে। ভাল থাকার চেষ্টা করেন নানাভাবে। গান শোনেন, নাটক দেখতে যান,কখনও বা সিনেমা দেখতে। কিন্তু সে তো আর রোজ নয়। একদিন খবরের কাগজে সাঁঝতারার বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হলেন তিনি। শহর থেকে একটু দূরে,তাল তমালের ছায়ায় ঘেরা এই বৃদ্ধাবাসটি দেখতে গেলেন তিনি। বেশ একটা গ্রাম্য পরিবেশ।শহরের এত কাছে যে এমন গ্রাম আছে এ তাঁর জানা ছিল না। কিন্তু ঐ গ্রাম্য পরিবেশেই সাঁঝতারার নতুন কনস্ট্রাকশন,বেশ ঝকঝকে তকতকে। প্রত্যেকের একটি করে ঘর,নিজস্ব লাগোয়া বাথরুম,এক টুকরো বারান্দা। প্রতি ঘরে ছোট একটা ফ্রিজ,টিভি,মাইক্রোওভেন,এসি,খাট,

আলমারি,পড়ার চেয়ার টেবিল ছাড়া বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ারও রয়েছে। বাথরুমে গিজার, ঘরের এক কোণে ওয়াটার পিউরিফায়ার। ঘরটা বেশ বড় সাইজেরই,১৫/১২মাপের। একজন মানুষের একা থাকার পক্ষে যথেষ্ট। পাশাপাশি ঘরগুলো,অপেক্ষাকৃত ছোট ঘরও রয়োছে কিন্তু সুমনার এটাই পছন্দ। বারান্দা থেকে পাশের বারান্দায় কথা বলা যায়। সব থেকে বড় কথা লিফ্টও আছে। চারতলা বিল্ডিং,সুমনা তিনতলার একটা ঘর পছন্দ করল। হাঁটুতে ব্যথা যদিও, লিফ্ট তো আছে চিন্তা কি ! একটু উঁচু থেকে আকাশ বাতাস যেন বেশি ভাল লাগে। বরাবরই ও প্রকৃতিপ্রেমিক। এখানের আকাশটা যেন নীল বড় বেশি, বলতে ইচ্ছে করে সুনীল আকাশ, গাছেরাও যেন তরতাজা সবুজ, এত সতেজতা শহরো দেখোনি কখনও সুমনা।সবুজের কত বাহার,এক একটা গাছ একেকরকম সবুজ,সেখানে নানারঙের পাখি কিচির মিচির করে গান শোনায়। বারান্দা থেকে দেখা যায় নিচের বাগান, ওয়েল মেইনটেইন্ড,বট গাছের গোড়ায় বাঁধানো বেদি,সেখানে বসে অনেকে গল্প করেন। এছাড়া বাগানে বিভিন্ন জায়গায় বেঞ্চও রয়েছে। সর্বদা মালি কাজ করছে। যদিও কয়েকজন বোর্ডার ডাক্তার আছেন,তাছাড়াও এখানকার নিজস্ব ডাক্তার রয়েছেন। নিচের একটা ঘরে তাঁর চেম্বার রয়েছে,দুবেলা নিয়ম করে এসে বসেন এছাড়াও প্রয়োজনে কল দিলে তিনি বা তাঁর জুনিয়ার এসে পড়েন কিছুক্ষণ পরেই। এমন সুব্যবস্থা যেখানে আর চিন্তা না করেই সুমনা মোটামুটি থাকার ব্যবস্থা পাকা করে দিয়ে যায়। এ তো তার কাছে পাঁচতারা হোটেলের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সুমনা সব ছবি তুলে নেয়,ছেলেমেয়েকে দেখাতে হবে যে। ঘরের ছবি,বাইরে থেকে ছবি,আশপাশের ছবি,বাগানের ছবি সব তোলে,মায় পুকুরের ছবি পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে ছেলে মেয়ের সঙ্গে কনফারেন্স কল করে তাদের বলার সময় সুমনা খুব আপ্লুত হয়ে পড়ে। মায়ের উচ্ছ্বাস দেখে ছেলেমেয়ে রাজি হয়ে যায়। মা যেখানে ভাল থাকবে,থাকুক সেখানে। ছেলে অনলাইন সব পেমেন্ট করে দিলে সুমনা দুদিন পর নতুন মাস পড়লে সেখানে এসে থাকতে শুরু করে। মাঝে মাঝে বাড়ি যায়,পরিষ্কার করায়, গাড়ি নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যায়। সুমনা এখন বেশ খুশি। এখানে আলো-হাওয়া রোদের খেলা সারাদিন। একটা পুকুর আছে,সেখানে হাঁসেরা চড়ে বেড়ায়। ভোরবেলায় এখানে হাঁটতে সুমনার খুব ভালো লাগে।

         কয়েকদিনের মধ্যে কয়েকজন সঙ্গী-সাথীও হল ওর। কিছু সময় তাদের সঙ্গে গল্পগুজবে বেশ কাটে। বাকি সময় ইচ্ছেমত আরামে,আয়েশে,নিশ্চিন্তে কাটায়। একা থাকলে একটা টেনশন কাজ করত বাড়িতে,এখানে তা নেই। মনের সুখে পড়ে ও প্রচুর বই। সঙ্গে কিছু এনেছে, আর হ্যাঁ,এখানে লাইব্রেরীও একটা আছে,আর বাংলা,ইংরেজি প্রচুর বইও আছে সেখানে। সুমনা পড়ে আবার লেখাও শুরু করেছে সে। রোজই কিছু না কিছু লেখে সে,নিজের জীবনের কাহিনী, চেনাজানা,কানেশোনা নানারকম ঘটনাকে আশ্রয় করে তৈরি হয় তাঁর গল্প। জীবনটাও তো তাঁর কম দীর্ঘ নয়,সেইসব অভিজ্ঞতার কথা সাজিয়ে,কখনও গল্প, কখনও মন ফুরফুরে থাকলে কবিতাও লিখতে থাকে সে। কখনও ঝড় বৃষ্টির দিনে ও বারান্দায় বসে,বৃষ্টি যে বড় প্রিয় তাঁর। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখতে বড় ভাল লাগে। কেটে গেছে এখানে সাতটা মাস, সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেছে,সবাই চেনে ওনাকে। ক্লাবে ক্যারাম খেলেন উনি সঙ্গীদের সাথে,পুরুষ-মহিলা সকলে মিলে। লুডো খেলাও দারুণ জমে। ব্যাডমিন্টনটা কেউ কেউ খেলেন,সুমনা দেখে,ওর ইচ্ছে করে খুব, একসময় খেলত কিন্তু এখন হাঁটু ব্যথা তাই কেবল দেখা,মাঝে মাঝে র্যাকেট নেয় হাতে যদিও কিছুক্ষণের জন্য।

       নতুন একজন বোর্ডার এলেন সাঁঝতারায়,সৌম্যদর্শন,গম্ভীর গলার স্বর, গভীর দৃষ্টি,লম্বাচওড়া চেহারা,এককথায় বেশ সুপুরুষ,নাম দ্বৈপায়ন বসু। ভদ্রলোকের স্বভাব খুব মিষ্টি সকলের সঙ্গেই মেশেন তবে বেশি সময় ঘরেই কাটান। সুমনার সঙ্গে ওনার বেশ আলাপ হয়ে গেছে। ওনার সঙ্গে কথা বলে,গল্প করে সুমনা খুব তৃপ্তি পায়,মনে হয় যেন কত চেনা কেউ, আগেও বুঝি কথা হয়েছে কখনও ওনার সঙ্গে। কথায় কথায় উনি জানতে পারেন সুমনা গল্প,কবিতা লেখে, আর উনি এতে খুব প্রশংসা করেন, দেখতে চান,পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতদিন সুমনা কাউকে বলেনি লেখার কথা,এখন দ্বৈপায়নবাবুকে বলে ফেলে একটু লজ্জা পায়। উনি সুমনার লেখা পড়ার জন্য জোরাজুরি করেন। সুমনা তাঁর ডায়েরীটা পড়তে দিতে বাধ্য হন। লেখা পড়ে তো উনি ভীষণ খুশি,সুমনার পারমিশন নিয়ে কয়েকটি পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর সে লেখা ছাপা হলে সৌজন্য কপি সাঝতারাঁয় এসে পৌঁছায় সুমনার নামে। সুমনা ভীষণ খুশি, আপ্লুত,বলেন,"কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাচ্ছি না। জীবনে কখনও ভাবিনি আমার নিজের লেখা ছেপে বেরোবে, সবাই পড়বে। জীবন সায়াহ্নে এসে এটা আমার বিরাট প্রাপ্তি।" উনি বলেন, "নিজেকে এতদিন প্রকাশ করেননি কেন? এ তো আপনার প্রাপ্য, এত ভাল লেখেন,আপনি কেন নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন,জনসমক্ষে আসুন"।ক্রমে সাঁঝতারার সকল বাসিন্দা জানল সুমনার লেখার কথা,তাই ওর পরের জন্মদিন দারুণভাবে পালন করা হল ওখানে,কেক কাটা,ছবি তোলা,কত হইহই। সুমনা সেসব ছবি ছেলেমেয়েকে পাঠায়। মেয়ে তো হতবাক, বলে,"মা তুমি চিনতে পারনি তোমার দ্বৈপায়নবাবু তো তোমার ফেভারিট লেখক নবজাতক? তুমি তো বরাবর ওনার ফ্যান।" "আমি ওনার লেখা পড়ি,পড়তে ভালোবাসি কিন্তু দেখিনি তো কখনও, চিনব কেমন করে?" মেয়ে বলে, "কিন্তু আমি চিনি ওনাকে,একবার বইমেলায় এক বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম,ওনার হাত দিয়ে তরুণ এক লেখকের বইপ্রকাশ হয়েছিল। মা তুমি কি লাকি,উনি তোমার লেখা পড়েন,প্রশংসা করেন আবার তোমার লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা উনিই করলেন।" সুমনা তো রীতিমতো উত্তেজিত, কখন সকাল হবে, দেখা হবে ওনার সঙ্গে। ওখানের অন্য কোনও আবাসিকও চিনতে পারেনি ওনাকে। আসলে উনি ছদ্মনামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসেন বরাবর। অকৃতদার মানুষটি সারা জীবন লেখাপড়া নিয়ে কাটাতে কাটাতে কবে যে জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছেন নিজেই টের পাননি। আজি 62 বছর বয়সে বড় একা লাগে বাড়িতে,তাই এই সাঁঝতারায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। বেশি সময় তিনি নিজের ঘরে লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সবার অজান্তে।

         পরদিন সুমনা চেপে ধরে তাঁকে, তাঁর বিভিন্ন বইয়ের কথা তোলে। ধরা পড়ে যান নবজাতক তাঁর পাঠিকার কাছে। এরপর চলে তাঁর বিভিন্ন বইয়ের নায়ক নায়িকার চরিত্র বিশ্লেষণ। বই পড়ার সময় সুমনার কিছু কিছু প্রশ্ন জাগত মনে। লেখকের পাশে বসে পরিষ্কার করে নিতেন তিনি। প্রিয় লেখককে এত কাছে পেয়ে,তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরে সুমনা বেজায় খুশি। তিনি যেন এখন এক কিশোরী কন্যা। দ্বৈপায়ন বাবুর অনুরোধে সুমনা তাঁর পরিচয় অন্য কারো কাছে জানায় না। ওঁরা দুজন এখন অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটান সাহিত্য-আলোচনায়, বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন বই নিয়ে নানারকম আলোচনা,কখনও বটগাছের বেদীতে বসে,কখনও পুকুর ধারে ঘুরে ঘুরে ওঁদের আলোচনা চলতে চলতে দুজন জড়িয়ে পড়েছে ক্রমশ দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপারে। দুজনের জীবনের খুঁটিনাটি সব দুজনের জানা হয়ে গেছে। সুমনার একদিন একটু জ্বর হওয়ায় উনি ঝট করে উদ্বেগের সঙ্গে ওঁর কপালে হাত রাখেন, "একি? বেশ গরম তো! ভালো টেম্পারেচার রয়েছে।" সঙ্গে করে নিয়ে যান ডাক্তারের চেম্বারে,পরে ঘরে পৌঁছে দেন সঙ্গে করে,গায়ে চাদর চাপা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এই বয়সেও দ্বৈপায়ন বাবুর হাতের স্পর্শে সুমনার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। সুমনা দুর্বল হয়ে পড়ছেন ওনার প্রতি, দ্বৈপায়নবাবুকে যেন ওঁর কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। দুদিন সুমনার শরীরটা বেশ খারাপ থাকায় ঘর থেকে বের হননি তিনি। দ্বৈপায়নবাবু দুবেলা ওঁর ঘরে এসে, পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে,একটু গল্পগুজব করে তাঁর কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছেন। নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন, পথ্যটাও খাইয়ে দিয়ে গেছেন। বেশ লাগছে সুমনার,বড় আন্তরিকতার স্পর্শ পেলেন দ্বৈপায়নবাবুর কাছে।

         ওনাদের মেলামেশাটা,ঘনিষ্ঠতা ক্রমে সকলের নজরে পড়ে তবে সবাই এখানে ভদ্রলোক তাই এ নিয়ে কোন গসিপ হয় না। জ্বর ছাড়লে দ্বৈপায়নবাবু সুমনাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বার করেন। দুজনে হাঁটছেন তাঁরা বাগান দিয়ে, পুকুর পাড়ে, হাঁসেরা জলে চড়ছে, খানিকবাদে সূর্য অস্ত যাবে,ওরা জল থোকে উঠো যাবে ঘরে। আস্তে আস্তে সূর্যের তেজ ঝিমিয়ে পড়ল,লাল টকটকে অস্তগামী সূর্যের দিকে দুজনে তাকিয়ে প্রণাম করল সেই বিদায়ী দিননাথকে। দ্বৈপায়নবাবু সুমনার হাত দুটি ধরে তাঁকে প্রেম নিবেদন করলেন, "তোমার জন্যই বুঝি অপেক্ষায় ছিলাম আমি,সারাজীবন সংসার করার কথা মনে আসে নি। তুমি আমায় তোমার হৃদয়ে আশ্রয় দাও,ধন্য হব আমি।" সুমনা কিছু বলবে কি! সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে তখন তাঁর। সে রাতটা কাটল সুমনার একটা ঘোরের মধ্যে। বুঝতে পারছে নিজে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি তাঁর প্রিয় লেখক 'নবজাতকে'র ওপর।

        পরদিন সকালে হাঁটার সময় দেখা হলে মৃদু হাসেন দ্বৈপায়নবাবু,সুমনা যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন,চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না তিনি দৈপায়নবাবুর দিকে। যেন এক কিশোরীর লজ্জা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। পাশে হাঁটতে হাঁটতে উনি বলেন, "দেবে তো আশ্রয় আমায় সুমনা?" কি বলবে ভেবে পান় না তিনি,চুপ করে থাকেন। উনি আবার বলেন,"কি আমার উত্তরটা পেলাম না যে"। সুমনা মাথা নিচু করেই ছোট্ট করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন। দ্বৈপায়নবাবু একগাল হেসে ওর হাতটা ধরেন, "আমি জানতাম,তুমি আমায় ফেরাবে না, ঠিক রাজী হবে।" এরপর উনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে সুমনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখেন। জানতে চান তাদের মত। ছেলেমেয়ে একবাক্যে রাজী। মায়ের একাকীত্বের জীবনে তাঁর পরমপ্রিয় মানুষটি যখন ধরা দিয়েছেন, তখন আপত্তি কিসের?

    আজ সুমনা ও দ্বৈপায়নের বিয়ে। সাঁঝতারা তাই সেজে উঠেছে আলোয়, ফুলে। বিদেশ থেকে এসেছে ছেলে, মেয়ে,জামাই,বৌমা। সুমনা সবার সামনে লজ্জা পাচ্ছে কনে বউ সাজতে কিন্তু দ্বৈপায়ন বসু জীবনে প্রথমবার বিয়ে করবেন তাই তিনি টোপর পরে, পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র পাঠ করে, মালাবদল করেই নবপরিণীতার হাত ধরতে চান।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics