STORYMIRROR

Rima Goswami

Tragedy Others

3  

Rima Goswami

Tragedy Others

রসময়ের পৌষ সংক্রান্তি

রসময়ের পৌষ সংক্রান্তি

4 mins
279

পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে পিঠে পুলি বানানোর হিড়িক পড়েছে গ্রামে । রসময় খুব ভালোবাসে পিঠে খেতে । তার গিন্নি বেঁচে থাকতে ঢেঁকিতে পাঠ দিয়ে চাল গুঁড়ি করত । তারপর ঘরের গাইয়ের দুধ দুইয়ে সেই দুধ দিয়ে ক্ষির বানিয়ে দুধ পুলি বানাতো , ওই স্বাদ কেউ এনে দিতে পারে না রসময়কে । এখন গিন্নিও নেই গাই বাছুরও নেই আর সেই ঢেঁকিশালও নেই । রসময়কে পিঠে দেবার কেউ নেই , তাই মকর সংক্রান্তি কেমন যেন ছন্দহীন লাগে তার । তখন বউকে নিয়ে সকাল সকাল জয়দেবের মেলা যাওয়া আর অজয় নদে মকর স্নান করে বাউল গানের মজা নেওয়া । সেদিন কি ভাবে যেন আজ অতীতের পুরু ধুলোর তলায় ঢাকা পড়ে গেছে । ছেলে মেয়েরা থাকে না তার সঙ্গে কাটাবেড়িয়াতে । তারা যে যার মত এদিকে ওদিকে চলে গেছে । বুড়ো বাবাকে নিয়ে যাবার আগ্রহ নেই তাদের । মা বেঁচে থাকলে হয়ত নিয়ে যেত কারণ মা তাদের সংসারের কাজে লাগত । বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে যাওয়া মানে তো ঘাড়ে বোঝা নেওয়া ছাড়া আর কিছু না । বৌমারা বলে বুড়োর বড্ড নোলা । খালি খাবো খাবো ধান্দা বুড়োর । রসময় ওদের কি করে বোঝায় যে সারাজীবন সে যে ভাবে থেকে এসেছে সেই অভ্যাস ত্যাগ করা কি এত সহজ ? হয় না সম্ভব হয়না চিরকালের অভ্যাস ত্যাগ করে বুড়ো বয়সে নতুন কিছু অভ্যাস গড়ে তোলার ।


সেই জন্য রসময় আজ একা আর নিঃসঙ্গ বসে আছে নিজের বসত ভিটে আগলে ধরে । খড়ের চালের দুটো মাটির ঘর , কতকাল গোবর দিয়ে নিকানো হয়নি । পাশে একটা কলঘর আর একটু দূরেই একটা পুকুর । পুকুর কালের নিয়মে পানাতে বুজে গেছে । নিজে নিজেই চারটে ভাত ফুটিয়ে খায় রসময় । রাতে বেলায় মুড়ি দিয়েই চালিয়ে নেয় সে । বাড়িতে তো আর ধানের গোলা নেই তাই আউনি বাউনি পালন ও হয় না । পৌষ সংক্রান্তির দিন দু-তিনটি ধানের শিষ বিনুনি করে 'আউনি বাউনি 'তৈরি করা হয়। শিষের অভাবে দু-তিনটি খড় একত্রে লম্বা করে পাকিয়ে তার সঙ্গে ধানের শিষ, মুলোর ফুল, সরষে-ফুল, আমপাতা ইত্যাদি গেঁথে 'আউনি বাউনি' তৈরি করত রসময় আর তার গিন্নি । এই আউনি বাউনি ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-পেটরা-তোরঙ্গ ইত্যাদির উপর এবং খড়ের চালে গুঁজে দিত ওরা । বছরের প্রথম ফসলকে অতিপবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করে একটি পবিত্র ঘটে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়। এই আচারটিকেই 'আউনি বাউনি' বলা হয়।


সেসব কথা ভেবে চোখে জল এসে যায় রসময়ের । কেন চলে গেল গিন্নি ? সে থাকলে তো আজ এভাবে স্মৃতি হাতড়ে মরতে হত না রসময়কে । না ভেবে লাভ নেই , এই চার কুড়ি বয়সে এসে আর কিছু করতেও তো পারবে না রসময় । সে কম্বল ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ে । গ্রামের ছেলেরা মাঠে ঘাটে আগুন জ্বালিয়ে তাঁবু খাটিয়ে রাত জাগবে আজ । ভোরে তারা মকর স্নান করতে যাবে পাশের গ্রাম কেন্দুলিতে । ওখানে জয়দেবের মেলা উপলক্ষে বাউল হবে , খিচুড়ি খাওয়া হবে । ঘুম আসে না রসময়ের , উঠে বসে সে । তারপর একটা পোটলা নিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে । তালা ঝুলিয়ে আসতেও তার মনে থাকে না । পোটলাতে একটা গামছা , সর্ষের তেল , দুটো মুড়ি নেয় সে । অন্ধকার কাটেনি এখনো রসময় হেঁটে যায় কেন্দুলির দিকে । পিঠে বানাবার ক্ষমতা তার নেই তাই খাবেও না তবে মকর স্নান তো করাই যায় ! সকাল সকাল পৌঁছে যায় সে কেন্দুলিতে তারপর মকর স্নান সেরে সে এগিয়ে যায় জয়দেবের মেলা । কত বহুরূপী , কত মেলা বসেছে সব দেখে রসময় খুব খুশি । এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সে আবিষ্কার করে একটা পুলি পিঠের দোকান । হাতে মাত্র দশটা টাকা আছে একবুক আশা নিয়ে রসময় দোকানটির কাছে যায় । পাঁচ টাকা দিয়ে দুটো সেদ্ধ পিঠে আর দুটো পাটিসাপটা খায় সে । দোকানি ছেলেটা মায়া করে বুড়োকে ইচ্ছা করে মাত্র পাঁচ টাকায় পিঠে গুলো দেয় । না হলে এগুলোর দাম কুড়ি টাকা । এত বছর পর আগের মতো মকর স্নান করে , বাউল শুনে , পিঠে খেয়ে তৃপ্ত রসময় । সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরে যেতে হবে তবুও বাউল গানের আসরে একটু গড়িয়ে নিতে রসময় শুইয়ে পরে । ঘুম নেমে আসে দুচোখে , বউকে দেখতে পায় সে ঘুমের মধ্যে । বউ বলে , ' কি গো আর কত কাল একা একা থাকবে ? চলে এসো আমার কাছে ।' রসময় ঘুমের মধ্যেই হেসে উঠলো ।


মেলা কর্তৃপক্ষ মাইকিং করছে , একটি অজ্ঞাত পরিচয় বৃদ্ধ বাউলের আসরে মৃত পড়ে আছেন । কেউ যদি তার পরিজন আছেন তো শীঘ্রই যোগাযোগ করুন ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy