Sourya Chatterjee

Comedy Children

4.5  

Sourya Chatterjee

Comedy Children

রক্তারক্তি কান্ড

রক্তারক্তি কান্ড

6 mins
290


দেখতে দেখতে ক্লাস ফোর হয়ে গেল সুশান্তর। এই সেদিন জন্মালো, আর দেখুন, এর মধ্যে কত বড় হয়ে গেল। বড় তো নয়! বিচ্ছু একেবারে! সেদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আর উনি ছাদে গিয়ে ভিজে সর্দি জ্বর বাঁধালেন। এই সেদিন, আমার কোলে হিসি করে দিয়ে নিজেই আমার কোলে গড়াগড়ি খেয়ে হিসি মাখত গায়ে, আর এখন বৃষ্টি পড়লে ছাদে গিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাদা মাখে, যেমন বাঁদর ছিল, তেমন ই রয়েছে। সবই মানলাম, কিন্তু তাই বলে এমন রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে বসবে তা আমার কল্পনাতেই ছিল না।

রোজকার মত আজও বটতলার মোড়ে ওকে আনতে গেছি। আসলে বটতলার পাশেই ওর স্কুলটা। তো চার পাঁচজন বন্ধু, ওরা একসাথে বটতলা অবধি আসে। তারপর আমি নিয়ে আসি মহাশয়কে। অবশ্য আমি ওকে আনি তো না! ও আমাকে নিয়ে আসে। রীতিমত দৌড় করায়। বয়স হয়েছে, আমার হাঁটুর ব্যাথা! এখন দৌড়াতে পারা যায় নাকি!

তা হয়েছে কি! ওর বাকি বন্ধুরা দেখি আসছে, সুশান্ত নেই ওদের সাথে! ভালো ছেলেটা! গিয়ে স্কুলে ছেড়ে এলাম। গেল টা কোথায়! ডাকলাম ওদের

-   এই সুমন

-   হ্যাঁ গো দাদু

-   বলছি সুশান্ত কোথায়! 

-   আরে দাদু, ও আসছে। শোনো না! আজ স্কুলে কি হয়েছে! 

-   কি হয়েছে! মারপিট করেছে নাকি সুশান্ত! 

-   আহা! শোনোই না! এই, রিন্টু বল! তুই তো ওর পাশে বসেছিলি! বল দাদু কে ! বল! বল!

এই রিন্টু ছেলেটি নাকি সুশান্তের বেস্ট ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ড না ছাই! পার্টনার ইন ক্রাইম আসলে। সেও নেহাত কম যায় না! সুশান্তর সাথে পাল্লা দিয়ে সেও সমান তালে বাঁদরামি করে।

-   দাদু, আজ সুশান্তর এক পাশে আমি বসে ছিলাম। আর এক পাশে কৌশিক বসে ছিল। হুমম। হঠাৎ দেখি কৌশিক সুশান্ত কে মারছে।

-   বলিস কি রে! ঠিক ধরেছি। মারপিট করেছে! আমার নাতিটাকে নিয়ে আর পারিনা। এই, তারপর ব্যাথা পেয়েছে রে ও? 

-   শোনো না দাদু! তারপর দেখি সুশান্তর ঘাড়ে রক্ত। 

-   মানে!! সর্বনাশ!! সুশান্ত কি করছে কি! আসছে না কেন এখনো! কৌশিক কি সুশান্তর ঘাড়ে মেরেছিল।

-   হ্যাঁ গো দাদু, আমি স্পষ্ট দেখেছি। তারপর শোনো না!

-   কি বদমাইশ রে কৌশিক । ইস! আমি একটু স্কুলে গিয়ে দেখে আসি সুশান্ত কি করছে। 

-   এই সুমন। একটু দেখে আয় না তুই! কি করছে ! আমি দাদুকে বলি তারপর কি হয়েছে।

-   ভাই সুমন তাড়াতাড়ি যা একটু।

জানেন! আমি জানি আমার নাতিটা টুকটাক বদমায়েশি করে। কিন্তু তবুও না, আমি, আমার ছেলে, আমার বৌমা ওকে বকি। এমন নয় যে ও বকা খায় না। কিন্তু ওই কৌশিকের মতো ছেলেপুলেরা! আদৌ কি ওর বাড়িতে শাসন আছে! মনে তো হয় না। আমার নাতি মারপিট করে হয়তো। কিন্তু এরম কারোর রক্ত বের করে দিয়েছে! এমন করেনি জীবনে। ভয় পেতাম মাঝেমধ্যে। ভালো ছেলে। খেলার ছলে মারপিট করতে যায়! কোনোদিন না কিছু হয়ে যায়! বলেওছি ওকে। কিন্ত ক্লাস ফোরে পড়ে। ওইটুকু ছেলে কী বুঝবে! রিন্টুকে জিজ্ঞেস করলাম

-   ভাই রিন্টু, কি রকম আঘাত লেগেছে! কেটে গেছে নখের আঁচড়ে?

-   না গো দাদু! যখন স্যারের টেবিলের উপর বসেছিল, তখন থেকেই কৌশিক ওর পেছনে পেছনে। হঠাৎ সুযোগ পেয়ে তারপর ওর মাথাটাকে কৌশিক চেপে ধরে।

-   সর্বনাশ! কৌশিক এমন ছেলে জানতাম না তো! 

সত্যি বলতে এমন কিছু হতে পারে আন্দাজ করতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষকরাই বা কেমন! এমন ঘটনা ঘটে গেল বাড়িতে খবর জানালো না! নাতিটা কেমন আছে কে জানে! তবে আমি কাল ছেলেকে বলবো স্কুলে গিয়ে কথা বলতে। কৌশিককে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া উচিত! আমি তো ভাবতেই পারছি না। ছি! খুবই চিন্তা হচ্ছে। রিন্টু নিজে থেকেই বলল

-   দাদু! বুঝলে কৌশিক যতই মাথাটা চেপে ধরুক না কেন, তখন কিছু করতে পারেনি। তারপর স্যারও চলে এসছে।

-   ভাগ্যিস স্যার ঠিক সময় এসেছেন! কখন হয়েছে রে এসব! মানে কোন পিরিয়ডে!

-   লাস্ট পিরিয়ডে গো দাদু। 

-   হুমম! স্যারকে তোরা কিছু বললি না?

-   তখন ও তো আসলে মারেনি! মানে টেবিলের উপর মাথা চেপে ধরা! এসব তো দুটো ক্লাসের মাঝে হয়েছে। 

-   তার মানে স্যার থাকাকালীন মারপিট হয়েছে! ছি! কোন স্যার ছিলেন রে!

-   শান্তনু স্যার।

কাল ছেলেকে স্কুলে পাঠাতেই হবে। স্যারই বা কিরকম হে! তার সামনে স্টুডেন্টরা মারপিট করছে! আর স্যার কিছু বললেন না। ভালো স্কুল দেখে ভর্তি করালাম। আর ভেতরে ভেতরে এতটা বাজে হয়ে গেছে স্কুলটা! প্রতিজ্ঞা করে নিলাম। এই ঘটনার শেষ দেখে ছাড়বো।

-   খুলে বল তো রিন্টু, তারপর কি হল?

-   আমি তো আন্দাজ করতে পারছি যে কৌশিকের ক্লাসে মন নেই। ও না মারা অবধি শান্তি পাচ্ছে না। তারপর স্যার অঙ্কটা দিয়েছেন। সবাই করছি। সেই সময়..

-   সেই সময় মারলো!

-   হুমম দাদু।

-   স্যার কি বললেন? বকলেন?

-   স্যার একটু বরং খুশি হলেন। বললেন সাবাস কৌশিক! তখন থেকে গান করেই যাচ্ছে। মন দিয়ে অঙ্কটা করাতেই পারছি না। খুব ভালো করেছিস মেরে।

-   কি বললি! স্যার খুশি হয়েছেন!

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এরকম স্যার হন! সুশান্তকে বলতে পারতেন এখন গান গাস না! নাতিটাও হয়েছে বটে! বাড়িতেও ওর এই স্বভাবটা আছে। যখন তখন সিরিয়াস কথার মাঝে গান গেয়ে ওঠে। কিন্তু এরম অঙ্ক ক্লাসে গান গাইবে আর স্যার তাতে বিরক্ত বোধ করছেন এমন অভিযোগ তো আগে পাইনি।না, না! ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নিলে হবে না। হেস্তনেস্ত একটা করতেই হবে। দরকার হলে আজই।

-   এই , কৌশিক বাড়ি চলে গেছে?

-   তা তো জানিনা দাদু।

-   সুমনও তো সুশান্তকে ডাকতে গেল অনেকক্ষণ হল বল। আসছে না। আমি একটু এগিয়ে দেখে আসি। তোর দেরি হলে বাড়ি যা না হয়।

-   না গো দাদু। সত্যিই তো! সুমনও অনেকক্ষণ গেল। তার থেকেও বড় কথা সুশান্ত এতক্ষণ কি করছে! বলল তোরা এগো। আমার জুতোর ফিতেটা খুলে গেছে। বেঁধে নিয়ে আসছি।

-   তোরা যখন বেরিয়ে এলি, তখনও কৌশিক ক্লাসে ছিল?

-   হুমম! ছিল দাদু।

সবাই বেরিয়ে আসার পর কৌশিক আবার মারছে না তো সুশান্তকে! নাতিটার বাড়িতেই সব হম্বিতম্বি, এখানে বসে মার খেয়ে যাচ্ছে। কি করি! বাড়িতে ফোন করে বৌমাকে ডাকবো একবার! আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না তো। খুব একা লাগছে। রিন্টুর সাথে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করেছি। কি জানি গিয়ে কি দেখবো! চিন্তায় হৃদস্পন্দন ক্রমবর্দ্ধমান।

একটু এগোতেই দেখি সুমন ছুটে এদিকেই আসছে। কই! সুশান্ত তো ওর সাথে নেই। বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। রিন্টু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল

-   কিরে সুমন! সুশান্ত কই!

সুমন দৌড়ে আসতে আসতে দূর থেকেই চিৎকার করে উত্তর দিল

-   আসছে। নাক ফেটে গিয়েছে।

মানে! কি বলছে সুমন! কৌশিক মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। পকেট থেকে ফোন টা বের করলাম। কাকে ফোন করব! ছেলে বা বৌমা কে! নাকি ডাক্তার ডাকবো! ওখানে দাঁড়িয়ে তখন রীতিমত কাঁপছি। খুব অসহায় লাগছে। 

হঠাৎ দেখি রিন্টু হো হো করে হাসতে হাসতে দৌড় লাগাল স্কুলের দিকে। পাগল নাকি! ও হাসছে ওর বন্ধুর নাক ফেটে গেছে শুনে। আমিও এগোলাম স্কুলের দিকে। একবার হোঁচট খেলাম। তবুও যতটা সম্ভব জোরে ছোটার চেষ্টা করছি।

হঠাৎ চোখ তুলে দেখি ওই তো! ওই তো রিন্টু, সুমন, সুশান্ত! ওরা আমার দিকে ছুটে আসছে। সুশান্তর পাশে ওটা কে! কৌশিক না! ওরা তো সবাই মিলে খিলখিলিয়ে হাসছে। সুশান্তর নাক ও তো অক্ষত। কারোরই চেহারায় মারপিট বা ধস্তাধস্তির চিহ্নটুকুও নেই। ওদের সারল্য মাখা হাসি মুখ গুলো ঠিক যেন চারটে সদ্য প্রস্ফুটিত সূর্যমুখী ফুল। 

ওরা এসে আমার সামনে দাঁড়াল। কি বলব কৌশিককে! কি বলব সুশান্তকে! পড়ন্ত বেলার সূর্যের রোদ ওদের হাসিতে প্রতিফলিত হচ্ছে তখন। সুশান্ত জিজ্ঞেস করল

-   দাদু, শুনেছ আজ কি হয়েছে!

রিন্টু বলল 

-   হুমম রে, আমি সব বলেছি দাদুকে। তাই না দাদু?

আমি সত্যি তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। ওদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দাদুভাই আমায় জিজ্ঞেস করল

-   কিগো দাদু! রিন্টু বলেছে সব?

-   হ্যাঁ রে সুশান্ত। সব বলেছি দাদুকে। প্রথমে মশাটা স্যারের টেবিলের উপর বসেছিল। তখন ই কৌশিক মশাটার মাথাটা চেপ্পে ধরে মারার চেষ্টা করল। সে মশা উড়ে গেল। তারপর ক্লাসের মধ্যে সুশান্তর ঘাড়ে এসে বসল। ব্যাস! আর ছাড়ে নাকি কৌশিক! পেট মোটা মশাটা সঙ্গে সঙ্গে পটল তুলেছে। 

আমি হাসব নাকি কাঁদব, বুঝতে পারছি না। কোনো রকমে গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

-   সুমন, কি বলছিলি রে! নাক ফেটে গিয়েছে না কি! মশার আবার নাক হয় নাকি!

-   না না দাদু। আমি তো বলছিলাম কাক হেগে দিয়েছে। সুশান্তর জামায় কাক হেগে দিয়েছিল। তাই তো কৌশিক আর ও দুজন মিলে পরিষ্কার করছিল বলে ওদের বেরোতে দেরি হল।

তারপর ওদের সাথে হাসতে হাসতে কখন যে শৈশব মাখা গালিচার উপর দিয়ে সারল্যের কাননে প্রবেশ করে গেছি, বুঝতেই পারিনি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy