রহস্য যখন সিংহ পাহাড়ে ৮
রহস্য যখন সিংহ পাহাড়ে ৮


পিটারের দলের কুলি দুটো দেখে বলল," এরা পিটারের দলের ই লোক। এদের জ্বর এসেছিল, হয়তো তাই এভাবে মরতে হলো। অথবা কোনো মনমালিন্য হওয়ায় এদের গুলি করেছে পিটার বা তার সাথী।" মিশাই কতটা বিপদের মধ্যে আছে বুঝতে পারছিল ওরা। এদের প্রাণে দয়া মায়া বলে কিছু নেই। সামান্য কারণে মানুষ খুন করতে এদের হাত কাঁপে না।
পাহাড়ের ধারে একটা বড় গুহা দেখে সবাই ওখানেই রাত কাটাবে ঠিক হলো। সকালে কুলিরা ফিরে যাবে। গুহাটা রাত কাটাবার জন্য ভালোই, ভেতরে একটা চাপা দুর্গন্ধ৷ কুলিরা আগুন জ্বালিয়ে কয়েকটা গাছের পাতা পোড়াতেই একটা ধুপের মতো গন্ধ ছড়াল। পাশেই একটা পাহাড়ি নদী। রাতে নদীর চরে চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে দেখে আলোক বলল -"এ নদীর বালিতেও কিছু আছে। কয়েকটা পাথর যেমন উজ্জ্বল হয়তো এগুলোই হিরা।"
হুয়ান বলল -"হতেও পারে।এ দিকে নদীর চরে হীরা ভেসে আসে শুনেছি ।"
খাওয়ার পর পায়ে পায়ে সবাই নদীর ধারে নেমে গেছিল। এতো সুন্দর প্রকৃতির মাঝে বিপদের কথাটা কিছুক্ষণের জন্য সবাই ভুলে গেছিল। আর ঠিক তক্ষুনি বড় পাথরের আড়াল থেকে আলোককে লক্ষ্য করে লাফ দিয়েছিল পুমাটা। একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বালিতে আছড়ে পড়েছিল জন্তুটা। নরম বালি বলেই উঠে দাঁড়াতে সময় নিয়েছিল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও লাফ দিয়ে একটা পাথরে উঠে পড়লো। সাহানা আর পিয়ম একদম সামনে। আলোক তখনো সামলে ওঠে নি ঝটকা টা। কয়েক সেকেন্ডে বিহ্বলতা কাটতে কাটতেই আবার লাফ দিয়েছে ধুসর জন্তুটা। কিন্তু এবার আলোক বিদ্যুৎ গতিতে সরে গেছে একপাশে। হঠাৎ পর পর গুলির আওয়াজে পালিয়ে গেল জন্তুটা। গুলি লেগেছে কিনা বোঝা গেল না। একটা পাথরের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো মিশাই। ওকে দেখে পিয়ম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। ততক্ষণে হুয়ানের লোকেরা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
আলোক সাহানা সবাই মিশাইকে দেখে খুব খুশি। পিয়ম কে দেখে মনে হচ্ছে রক্তের সম্পর্কের কাউকে ফিরে পেয়েছে।
বড় করে আগুন জ্বালিয়ে তার ধারে বসে ওরা মিশাইয়ের মুখে ওর গল্প শুনছিল। মিশাই বলছিল -" আমি ঐ পিটার আর জ্যাকের বিশ্বাস জিতে নিয়েছিলাম এই বলেই যে ,আমিও এই অভিযানে যেতে চাই। একা সাহস পাই নি। আর দল তৈরি করার সামর্থ্য ছিল না। ওদের নিয়ে পছন্দ মতো কুলি সংগ্ৰহ করে এগিয়ে যাই। বুঝেছিলাম পালিয়ে লাভ নেই , ওরা আমায় মেরে দেবে তাহলে। আবদুল পালাতে পারে নি। আমায় আবদুলের বদলা নিতেই হবে। প্রথম দু দিন ওদের সাথে এতো ভাল ব্যবহার করি যে ওরা আমায় বিশ্বাস করছিল পুরোটাই। এ পথে একটু অসাবধান হলেই যে মৃত্যু ওরা বুঝে গেছিল এরিককে যখন চিতায় টেনে নেয়। কাল এম্মাকেও সাপে কেটেছিল। দুজনের জ্বর এসেছিল এদিকে। কুলি দুটো ফিরে গেছে। একটা কুলি আজ সকালে পুমার পেটে গেছে। এখন এতো জিনিস সবাই বইতে পারছিল না। জ্বরে ওরা আর হাটতে পারছিল না। বাঁচতো না সবাই বুঝেছিলাম। নির্দয় পিটারের ওদের জন্য দেরী হচ্ছিল। তাই আজ বিকেলে ওদের শেষ করে দিয়েছিল । রাতের রান্নার দায়িত্ব আজ আমার ছিল। এখানে এতো ধরনের বিষাক্ত গুল্ম আছে আগেই জানতাম। আজ খাবারের সাথে একধরনের বিষাক্ত শিকড় রান্না করি। এই খাবার খেলে দুর্বলতা - গা বমি, পাতলা পায়খানা দিয়ে শুরু হবে। কয়েকঘন্টার মধ্যে সব শেষ। ওরা এখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে। আমি ওদের বন্দুক আর গুলি নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ওরা একে বিষের জন্য অসুস্থ, তাতে নিরস্ত্র। ওদের উচিত শাস্তি ওরা পেয়েছে। এ জন্য সরকার আমায় শাস্তি দিলে আমি তা মাথা পেতে নেবো। "
পুরোটা বলে দম নেয় মিশাই। হুয়ান বলে -" জঙ্গলে সরকারী আইন চলে না। জঙ্গলে নিজের প্রাণ বাঁচানোর অধিকার সবার আছে। আর ঐ নরকের কীট গুলোকে মেরে তুমি জঙ্গলকে পরিষ্কার করেছো। এ সব কথা আশা করি আমাদের মধ্যেই থাকবে। এই অভিযান অত্যন্ত গোপনীয়। সরকার চায় না এ খবর সবাই জানুক। তাহলে আবার বিদেশি শক্তি ঝাঁপিয়ে পড়বে এ দেশের সম্পদের ওপর। আশা করি এখানকার কোনো কথাই বাইরে যাবে না।"
এরপর হুয়ান রাতেই সব জানিয়ে দেয় ওদের সদর দপ্তরে। সকালের আলো ফুটলেই দুটো হেলিকপ্টার চলে আসবে ওদের উদ্ধারে।
চাঁদের আলোয় চরাচর জুড়ে এক মায়াবী আলোর খেলা, রহস্যময় প্রকৃতি জেগে উঠেছে ধীরে ধীরে।আলোক আর পিয়ম দু চোখ ভরে দেখে প্রকৃতির এই অপরূপ রূপের খেলা। সাহানা নদীর চরে কুড়িয়ে পাওয়া একটা সবজে পাথর তুলে আগুনের সামনে ধরে পরীক্ষা করছিল। নদীর বুকে এমন ছোট বড় পাথর অল্পই পড়ে রয়েছে।
মিশাই বলে -"এটাই অপরিশোধিত হিরা, তবে আরো এগোলে আরো ভালো পাওয়া যাবে। আর একদিনের পথ পার হলে সোনার বালিতট। এই পাহাড় পার হলেই আদিম অরণ্য। যা পাহারা দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে এই প্রকৃতির সন্তানরা। লোভের বশে যারাই ওখানে পা দেয় আর ফিরে আসে না।"
আলোক বলে -" যতদিন সভ্য জগতের পা এখানে না পড়বে এরা সুরক্ষিত। যে দিন সভ্য মানুষ এখানে অবাধে বিচরণ করবে এই প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। রক্ত ঝরবে এই নদীর বুকে। আমরাও এ সব খবর বাইরে দিতে চাই না। এ দেশের সরকার সব জেনেও যখন এগুলো অধিগ্ৰহণ করছে না এ সব লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকুক।"
কয়েকটা পাথর সবাই স্মৃতির জন্য সঙ্গে নিয়েছিল। আলোক হাসতে হাসতে সাহানাকে বলে -" এয়ার পোর্টে কাস্টমসে আটকে দেবে।"
-" স্মৃতি হিসাবে দুটো পাথর নিলে পার করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। সরকারের তরফ থেকে, দেশের তরফ থেকে এ আপনাদের উপহার।"হুয়ান বলে ওঠে।
একটু পরেই হেলিকপ্টার এসে যাবে। আলোক ভাবে আর একটু পড়েই সবাই সভ্য জগতে ফিরে যাবে। এই আদিম অরণ্যর রহস্য অনাবৃতই থেকে যাবে। তাই হয়তো এদেশের জন্য মঙ্গল। আস্তে আস্তে পূব আকাশে শুরু হয় রঙের খেলা।