রহস্য যখন সিংহ পাহাড়ে(পর্ব-৩ )
রহস্য যখন সিংহ পাহাড়ে(পর্ব-৩ )


আলোক ঘুরে দেখে ওর হাতে একটা ব্রাউন রঙের খাম, খামের ভেতর কি আছে বোঝা যায় না। আলোক খামটা হাতে নিয়ে আলোর দিকে ধরে, একটা সাইডে কালচে খয়েরী রক্তের ফোঁটা শুকিয়ে রয়েছে। খামের ওপর কাঁপা হাতে মিশাইয়ের নাম লেখা ইংরাজি তে। তবে পোষ্ট অফিসের কোনো ছাপ নেই। ঠিকানা এই বাড়ির। পিয়ম আর আলোক খামটা নেড়েচেড়ে দেখে। আলোক বলে -"এটা মিশাইকে ডেকে দেওয়া উচিৎ। আগে ও খুলুক তারপর না হয় আমরা দেখতে চাইবো। তবে এই খামটাই হয়তো সব রহস্যর চাবি কাঠি।"
মিশাই রান্নাঘরের পাশের ষ্টোর রুমে শোয়। তখনো জেগে ছিল। পিয়মের ডাকে স্টাডিতে এসে দাঁড়াতেই আলোক খামটা এগিয়ে দেয়। মিশাইকে বলে -" এটা তোমার নামে এসেছে। লেটার বক্স খালি করার সময় দেখো নি?"
ও একটু ঘাবড়ে যায়। বলে -"আমি তো কিছু জানি না। আমার নামে কখনো কিছু আসে নি। যা থাকে চিঠির বাক্সে সব ডাক্তার বাবুর জিনিস। তাই টেবিলে রেখে দি। আজ বিকেলেই এগুলো এনেছি। রোজ বিকেলেই একবার বক্স চেক করি।"
আলোক আগেই দেখেছিল গেটের পাশে বড় গাছ গুলোর সামনে দেওয়ালের গায়ে চিঠির বাক্স। ঐ গাছ গুলোর পাশেই বড় গাব গাছটার আড়ালেই আবদুল দাঁড়িয়েছিল। তার মানে ও ঢুকতে না পেরে এটায় নাম লিখে লেটার বক্সে ফেলে দেয়। তখনি হয়তো রক্ত লেগে গেছিল। ও এটা মিশাইকে দিতে চাইছিল কোনো ভাবে। অঙ্কের অনেকটা মিলে যাওয়ায় একটা হাল্কা হাসি ফুটে উঠেছিল ওর মুখে।
মিশাই বোকা বোকা মুখে খামটা নিয়ে এক ঝলক দেখেই আবার পিয়মকে দিয়ে দেয়।ওর ভাষায় কি একটা বলে ওঠে, যার বাংলা পরে শুনেছিলা, -' রক্ত মাখা খাম মৃত্যুর বার্তা বয়ে আনে।'
পিয়ম ক্রিও ভাষায় ওকে একটা ধমক দেয়। তারপর খামটা নিজেই খোলে, ভেতরে ডাইরির কিছু ছেঁড়া পাতা, আর আলোকদের অবাক করে তাতে ঝরঝরে বাংলায় লেখা কিছু দিনপঞ্জি।
পাতা গুলো ছেঁড়া, তাই অনেক খুঁজেও ওরা লেখকের নাম পেলো না। মিশাই বাংলা বলতে জানলেও পড়তে পারে না বলেছিল। আবদুল বাংলা জানত বুঝেছিল। তবে কি লিখতেও পারতো!! আলোক ছেঁড়া পাতা গুলো হাতে নেয়। ভালো করে দেখে বলে,-"এ তো কোনো বঙ্গ সন্তানের হাতের লেখা। এতো সুন্দর পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলা এরা কি লিখতে পারে!!" আর ডাইরিটা ২০০১ সালের। মোট নয়টা পাতা। ঠিক রোজনামচা নয়, তবে কতগুলো ঘটনা। তবে এর আগে পরেও আছে কিছু হয়তো। দু পাতা পড়েই আলোক বুঝতে পেরেছিল এ কোনো সৈনিকের লেখা। হঠাৎ মিশাইয়ের দিকে তাকিয়ে ওরা দেখল ওর মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ও হঠাৎ ভীষণ ভয় পেয়েছে। ওর ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে।
-"কি হয়েছে মিশাই? তুমি এমন করছ কেনো?" পিয়ম বলে।
-" এগুলো.... এগুলো.... শয়তানের দলিল। এসব আবদুলের মরার কারণ। পুড়িয়ে ফেলুন এ সব।" ওকে দেখে হিষ্টিরিয়া রুগী মনে হচ্ছিল। ও যে ভীষণ ভয় পেয়েছে বোঝা গেছিল।
আলোক জলের বোতল এগিয়ে দেয় ওর দিকে, ওকে ধরে বসায় একটা চেয়ারে। তারপর বলে -"তুমি কি বলছ এবার বলো?"
কিন্তু মিশাই উত্তর দেয় না। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। আলোক ওকে সময় দেয় । একটু পরে ও চোখ খোলে ধীরে ধীরে। বলে -" এ সব পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্রচুর অভিশাপ লেগে রয়েছে এ কাগজে। ছোট ছোট বাচ্চাদের মৃত্যু-কালীন কান্না এ কাগজে বন্দী।এগুলো তো বহু আগেই পুড়িয়ে ফেলার কথা। আমি দেখেছিলাম পুড়িয়ে ফেলতে এ ডাইরি।"
আলোক ততক্ষণে পড়তে শুরু করে দিয়েছে পাতা গুলো।
প্রথম পাতা ১২/৩/২০০১
হেলিকপ্টার ভেঙ্গে পড়ার পর আমরা মাত্র পাঁচ জন বেঁচে আছি। আমি ইকবাল, আলি, অরুণ আর রবি। জায়গাটা ঘন জঙ্গল, পাহাড়ের মাথাটা নেড়া। যতদূর চোখ যায় সবুজ রেইন ফরেস্ট। আমরা দেশটার পূর্বদিকের পাহাড়ে আছি মনে হয়। এদিকে লোকালয় নেই। গত দু দিনে উপজাতি গোষ্ঠীর কাউকে দেখি নি। আমাদের সাথে কম্পাস নেই। খাবার, জল সবই শেষ। সকালে একটা ছোট ঝরণা থেকে জল ভরেছিলাম। রবির আবার জ্বর এসেছে। এ আফ্রিকার জ্বরে গত বছর কত বন্ধুকে চলে যেতে দেখলাম। এখন কবে লোকালয়ে ফিরতে পারবো জানি না। আন্দাজে ভর করে চলেছি। এই জঙ্গলে পুমা, শিম্পাঞ্জি, চিতা এসব যেমন আছে হাতির দল ও আছে। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে।
১৩/৩/২০০১
আজ একটা পুমা ইকবালকে তুলে নিলো। ও ফলের খোঁজে জঙ্গলে ঘুরছিল। সকালে কয়েকটা কাসাভা পেয়েছিলাম। তাই পুড়িয়ে খেয়েছি সবাই। রবির বমি হচ্ছিল, জ্বর বেড়েছে। আমাদের খোঁজে একটাও হেলিকপ্টার আসে নি এদিকে। পাহাড় ভেঙ্গে উঠতে হচ্ছে। এই পাহাড়টা টপকালে মনে হয় কোনো গ্ৰামের দেখা পাবো। সামনে একটা পাহাড়ি নদী , সূর্যের আলোর সোনালী বালি ঝিকমিক করছে। এতো দিন শুনেই এসেছি এ দেশে নদীর তটে সোনা আর হীরে পাওয়া যায়। এই বালিতে মনে হয় সোনা আছে। কিন্তু এখন কারো সেদিকে মন নেই। তবুও আমি কিছুটা বালি তুলে ব্যাগে ভরে নিলাম। দানা গুলো বেশ বড় বড়। সোনা থাকলেও থাকতে পারে আকরিক হিসাবে। ইকবালের জন্য মনটা খারাপ লাগছিল। দেশে ওর নতুন বৌ রেখে এসেছে। আমিও আজ প্রায় তিনবছর বাড়ি যাই না। এ দেশে যুদ্ধ থামতে চলেছে। এ বার হয়তো বাড়ি যাবো। তবে আগে লোকালয়ে ফিরতে হবে।
১৫/৩/২০০১
আমরা বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি। মনে হয় একই জায়গায় ঘুরছি। এই পুমা গুলো বড় সাঙ্ঘাতিক। আজ আবার একটা আক্রমণ করেছিল। গুলি ছুঁড়লেও লাগে নি ওর গায়ে। তবে পালিয়ে গেছে। চিতার থেকেও বেশি ধূর্ত এগুলো। বোঝাই যায় না কোথা থেকে এসে আক্রমণ করে।
আজ চারটে বন্য খরগোশ পুড়িয়ে খেয়েছি, আর ঐ কাসাভা পোড়া, জল প্রায় শেষ। একটা ঝরণাও চোখে পড়ছে না। এদিকে রবি বড্ড ভুল ভাল কথা বলছে। আমরা তিনজন ওকে ফেলে যেতেও পারছি না। ওর জন্য জোরে হাঁটাও যায় না। আজ তো পালা করে ওকে পিঠে নিয়ে হাঁটতে হলো। এ ভাবে চললে হয়তো সবাই মারা পড়বো।
১৬/৩/২০০১
মনে হচ্ছে আর কোনোদিন বাড়ি ফিরতে পারবো না। আমার সোনার বাংলা আর দেখতে পাবো না। নদীতে ঘেরা আমার গ্ৰাম ঐ বরিশালের কলসকাঠিতে, আর কি ফিরতে পারবো? আজ আমার জ্বর এসেছে। রবির বোধহয় মাথার ভেতর রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়েছে, ওর মুখ বেঁকে গেছে সারা গায়ে অজস্র পোকার কামড়, শরীরের বাঁ দিকে সাড় নেই। এ অবস্থায় ওকে টেনে নিয়ে গেলে বাকিরা অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি দলপতি, আমায় কঠোর হতেই হবে। আজ রবিকে ত্যাগ করে এগিয়ে গেলে হয়তো কাল আমরা এই মৃত্যু উপত্যকার বাইরে যেতে পারবো। হ্যাঁ , এটা মৃত্যুর উপত্যকা, পদে পদে মৃত্যুদূত পাহারায় রয়েছে। ভুল একটা পদক্ষেপ চিরতরে শেষ করে দেবে এ জীবন। কাল আর আজ আমি কঙ্কাল দেখেছি,নর- কঙ্কাল। এই মৃত্যুপুরিতেও মানুষ এসেছিল, ওরা এসেছিল সোনা, হিরা, আরো খনিজের খোঁজে। যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ এখানে ছুটে এসেছে, আর ফাঁদে পড়েছে। এখান একবার যারা এসেছে আর বোধহয় সভ্য পৃথিবীতে ফিরতে পারে নি। ফিরলে সভ্য পৃথিবীর মানুষ দলে দলে এখানে আসতো এবং এখানকার এতো সম্পদ এভাবে হেলায় পড়ে থাকত না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে এ ও একটুকরো পৃথিবী।(চলবে)