Amitava Saha

Horror Tragedy Thriller

3  

Amitava Saha

Horror Tragedy Thriller

রাতের আগন্তুক

রাতের আগন্তুক

5 mins
36


                                                                    (১)

অনেকদিন ধরে একটা গল্প লিখব লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু ভালো গল্পের আইডিয়া মাথায় আসছিল না। কিছু খুচরো আইডিয়া মাথায় আসছিল, যা দিয়ে ভালো গল্প লেখা যায় না। অনেক চেষ্টাতেও যখন লিখতে পারলাম না, তখন ভাবলাম, একটু নিরিবিলি পরিবেশে গিয়ে একান্তে ভেবে দেখি। তাহলে যদি কোন আইডিয়া মাথায় আসে। শহরের এই হৈ হট্টগোলের মধ্যে গল্পের আইডিয়া মাথায় আসবে না। ডুয়ার্স ঘুরে আসব ঠিক করলাম। সেইমত অনলাইনে একটা রিসর্ট বুক করে ফেললাম। অফ সিজন ছিল, বুকিং পেতে কোন অসুবিধা হল না। আমি উত্তরবঙ্গের ছেলে। ডুয়ার্সের অনেক জায়গা আমার আগে থেকেই ঘোরা। আমি যে রিসোর্টে যাব বলে ঠিক করলাম, সেটা আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তর চকোয়াখেতি নামে একটি গ্রাম আছে, সেখানেই। ওখান থেকে কাছেই চিলাপাতা ফরেস্ট শুরু হয়েছে। খুব সুন্দর জায়গাটা। দূরে সবুজে মোড়া পাহাড়ের হাতছানি আর কাছেই আছে মথুরা চা বাগান। বেশ ভালো, নিরিবিলি পরিবেশ।

দুদিন পরেই রিসর্টে গিয়ে হাজির হলাম। খুব সুন্দর গাছপালা ঘেরা দোতলা বিল্ডিং। সামনে বিভিন্ন ফুল, অর্কিডের বাগান, থাকার রুম দশ-বারোটা হবে। বাজেটের মধ্যেই ছিল রিসর্টটি। এমন কিছু লাক্সারিয়াস নয়। বেশি লাক্সারিয়াস আমার দরকারও ছিল না। আমি শুধু নিরিবিলিতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে গল্পের প্লট ভাবব বলে এসেছিলাম। অফ সিজন বলে একটু বেশিই নিরিবিলি মনে হল। টুরিস্ট খুব বেশি চোখে পড়ল না। গ্রাউন্ড ফ্লোরে দুটো ফ্যামিলি এসেছিল। আমি দোতলায় একটা রুম নিলাম। দোতলায় আর কাউকে চোখে পড়ল না। রুমে ফ্রেশ হয়ে গাড়ি ভাড়া করে চিলাপাতা জঙ্গল ঘুরতে বেরোলাম। পিচের রাস্তার দুধারে জঙ্গল। অজস্র সারি সারি উঁচু উঁচু গাছ আর শুধু সবুজ। রোদ ঝলমলে ওয়েদার ছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে জঙ্গলের টাটকা বাতাস এসে ব্রেন সেলগুলো যেন চাঙ্গা করে দিল।

জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর যেতেই টেম্পারেচার অনেকটা কম মনে হল। আর বিভিন্ন বুনো গাছপালার মেশানো একটা গন্ধ নাকে লেগে জঙ্গলের অনুভূতিটাকে জোরাল করে তুলল। বেশ ভালোই রিফ্রেশ লাগল। জঙ্গল সাফারি করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তার জন্য আগে থেকে বুকিং করতে হয়। রাস্তায় যেতে যেতে এক জায়গায় ঝোপের মধ্যে বাইসন চোখে পড়ল আরেক জায়গায় দেখলাম ময়ূর। ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে মেন্দাবাড়ি হয়ে ন্যাশনাল হাইওেয়েতে উঠে নিমতি ধাবায় গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। আহা! কী অপূর্ব রান্না! মুখে লেগে থাকার মত। মধ্যাহ্নভোজ সেরে রওনা হলাম পোরো বস্তির উদ্দেশ্যে। এটি একটি পিকনিক স্পট। তখন কোন পিকনিক অকেশন ছিল না। তাই একদম ফাঁকা ছিল। মাঝখান দিয়ে নদী চলে গেছে এঁকেবেঁকে আর দুধারে সবুজ ঘাসের বিশাল ফাঁকা প্রান্তর। রোদ ঝলমল দুপুরে নিরালা প্রান্তর আর নদী মিলে সিনিক বিউটি ছিল অসাধারণ। পোরো বস্তি ঘুরে রিসর্টে ফিরে এলাম। 

বিকেল হয়ে গিয়েছিল। চা-বিস্কুট খেয়ে রিসর্ট থেকে বেরিয়ে উত্তর চকোয়াখেতি গ্রামটা একটু হেঁটে বেড়িয়ে দেখতে লাগলাম। রাস্তার দুধারে বিঘের পর বিঘে ফাঁকা ধানের ক্ষেত। তখন ধান কাটা হয়ে গিয়েছিল। ধান ঝাড়াই করে খড়গুলো ক্ষেতের মধ্যেই জায়গায় জায়গায় পুঞ্জীভূত করে রাখা ছিল। ক্ষেতের সংলগ্ন গাছপালা ঘেরা কিছু কিছু জনবসতিও চোখে পড়ল। সুপারির গাছ ছিল প্রচুর। দূরে অনেকটা এলাকা জুড়ে শালের বন চোখে পড়ল। সেই নিরালা অনাড়ম্বর গ্রামের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে ভালোই লাগল। অনেকদিন পর অনেকটা হাঁটা হল। সন্ধে নামলে রিসর্টে ফিরে এলাম। রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। তারপর জানলা খুলে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রান্তরের দিকে চেয়ে রইলাম। দিগন্তবিস্তৃত শুন্য ধানক্ষেতের দিকে চেয়ে মনটা উদাস হয়ে আসছিল। আটটা বাজতে রিসেপশন থেকে রাতের খাবারের জন্য ডেকে গেল। আমি নীচতলায় গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। খেয়ে রুমে যাবার সময় রিসেপশনের ছেলেটা বলল, “বাইরে আবার হাঁটতে যাবেন নাকি?”

আমি বললাম, “না”

ছেলেটা বলল, “আমি তাহলে গেট বন্ধ করে দিচ্ছি। রাতে কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন। আমি এখানেই আছি”।

-“আচ্ছা”

আমি ঘরে চলে গেলাম। তখন রাত মোটামুটি সাড়ে আটটা। ভাবলাম, শোবার এখনও দেরি আছে। খাতা কলম নিয়ে কিছুক্ষণ বসি, যদি কোন গল্পের আইডিয়া মাথায় আসে। জানলা দিয়ে শিরশির করে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল। তাই জানালার পাল্লাটা চাপিয়ে দিলাম। টেবিলে বসে কপালে হাত দিয়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম খেয়াল নেই। দরজা ঠেলার শব্দ শুনে ঘুরে দেখি, দরজায় একজন ইয়াং ছেলে দাঁড়িয়ে। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। বলল, “আসতে পারি?”

বললাম, “এসো”

-“আপনার সাথে একটু গল্প করতে এলাম”

-“তুমি কোন রুমে উঠেছ?”

-“এই পাশের রুমেই…”

-“তোমাকে তো সারাদিনে দেখলাম না” (বিস্ময়ের সুরে বললাম)

-“সারাদিন তো ছিলামই না, দেখবেন কি করে?”

-“ওহ, তাহলে সন্ধের দিকে এসেছ?”

-“না, এইমাত্র ঢুকলাম”

-“এত রাতে?”

-“রাত আর এমন কি! ন’টা। সবে তো সন্ধ্যে”

-“তোমরা ইয়াং জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা সব রাত জাগা পাবলিক। এখানে অবশ্য রাত ন’টা অনেক রাত”

-“তা আপনি এখানে খাতা কলম নিয়ে কি করছেন?”

-“তেমন কিছু না। একটা গল্প লিখব ভাবছিলাম”

-“শখের লেখক বুঝি!”

-“হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ”

-“তা কিছু মাথায় এল?”

-“না এখনও আসেনি”

-“আপনি চাইলে আমি একটা গল্প শোনাতে পারি। আপনার গল্প লেখার কাজে লাগতে পারে”।

-“কী গল্প?”

-“আমার নিজের লাইফের গল্প। বেশ সাসপেন্স আছে। যদি চান তো শোনাতে পারি”

-“শুনি তাহলে। গল্প শুনতে আর কি আপত্তি থাকতে পারে!”

-“একটা সিগারেট ধরাই? অসুবিধে নেই তো?”

আমি সম্মতি দিতে ছেলেটা সিগারেট ধরিয়ে আমার বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। গল্প শুরু হল। গল্পটা ওর বয়ানেই বলছি।

বছর দুয়েক আগের কথা। আমি তখন দিল্লিতে থাকতাম। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম। ইউনিভার্সিটির হস্টেলে থাকতাম। ওখান থেকে একবার পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল আমার সাথে। সেই ঘটনাটাই বলছি। 

সেবার এক রাজনৈতিক ইস্যুতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের জেরে আমাদের ইউনিভার্সিটির পঠনপাঠন শিকেয় উঠল। হস্টেলে আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বেশিরভাগ বন্ধুই ছিল নন-বেঙ্গলি। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একজন ছিল বিকাশ।  উত্তরাখন্ডের পাহাড়ি ব্রাহ্মণ ছিল। ওর দাদুর বাড়ি ছিল নৈনিতালে। ক্লাস যেহেতু বন্ধ ছিলতাই বিকাশ আমাকে একদিন বলল, “চলক্লাস যখন নেই তখন এই সুযোগে তোকে পাহাড় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। কদিন দাদুর বাড়িতেই থাকব  অবশ্য হিন্দিতে বলেছিলআমি বাংলায় বলছি। 

আমি এককথায় রাজি হলাম। আমরা পরদিনই বেরিয়ে পড়ব ঠিক করলাম। উত্তরাখণ্ডের মনোরম পাহাড় আর জঙ্গল ঘোরার স্বপ্ন আমার অনেকদিনের ছিল। তাই পরদিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিলাম। কিন্তু বিকাশের ব্যাঙ্কে একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গেল। তাই আমাকে বলল, “তুই যখন তৈরি হয়ে গিয়েছিসতখন চলে যা। আমি ব্যাঙ্কের কাজ সেরে এগারোটার মধ্যে রওনা হব। দাদুকে বলে দিচ্ছি। বাসস্ট্যান্ড থেকে তোকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে। লাল মারুতি গাড়ি। স্ট্যান্ডে নেমে দাদুকে ফোন করে নিস  

আমি বললাম, “বয়স্ক লোকটাকে কষ্ট দেবার কি দরকার?”

বিকাশঃ “বয়স্কদাদু এখনও শক্তপোক্ত। দিব্যি হাঁটাহাঁটি করেন। কোন অসুখবিসুখ নেই। আমরা পাহাড়ের লোক ভাই

আমিঃ “আচ্ছাঠিক আছে

আমি বাসে রওনা হয়ে গেলাম। দুপুর দুটো নাগাদ নৈনিতাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। নেমে এদিকওদিক দেখতে লাগলাম। কিছুদূরে একটা লাল মারুতি দাঁড়িয়ে ছিল। আমি আর ওর দাদুকে ফোন করলাম না। সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। ড্রাইভারের সিটে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। আমি বললাম, “দাদুআমি রাজেশ। বিকাশ আমার কথা বলেছে নিশ্চয়ই। ওর আসতে আসতে বিকেল হয়ে যাবে। চলুন আমরা ততক্ষণে বাড়ি চলে যাই। পরে এসে ওকে নিয়ে যাব 

ভদ্রলোক সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে গাড়ি স্টার্ট করলেন। দুদিকে ঘন উঁচু উঁচু গাছপালা ছাওয়া চওড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ভালোই লাগছিল। নৈনিতাল পাহাড়ের উচ্চতা দার্জিলিঙের তুলনায় কিছুটা কম। তাতে কীপাহাড়ের মনমোহক রূপের কোন কমতি নেই। পাহাড়ের কোলে বিশালাকৃতি লেক আর পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলমান সাদা মেঘের নয়নাভিরাম দৃশ্য রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ল। চোখ জুড়িয়ে যায়। তার উপর বেশ সুন্দর ঠাণ্ডা ওয়েদার। দিল্লিতে যা অসহ্য গরম পড়েছিলঘন্টাখানেক যাবার পর রাস্তার এক জায়গায় বাঁক নিয়ে একটা সরু পাথুরে রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে এক জনশুন্য জঙ্গলের মধ্যে এসে গাড়ি থামালেন ভদ্রলোক। অনতিদূরে দৃষ্টিনন্দন সবুজে মোড়া পাহাড় আর চারপাশে শুধুই গাছগাছালি। বাঁশগাছের পাতায় পাতায় মাতাল হাওয়ার তোড়ে শনশন শব্দ অবিরাম শোনা যাচ্ছিল। ফুরফুরে টাটকা বাতাস প্রাণভরে ফুসফুসে ভরে নিচ্ছিলাম আমি। এখানকার মতই এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছিল চারিদিকে। দিল্লির কোলাহলযানজটের জীবন যেন অনেক পেছনে ফেলে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিল সময় যেন ওখানে থমকে গেছে। সামনেই একটি পাকা দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। তবে অবাক লাগল জঙ্গলের মধ্যে এমন অদ্ভুত জায়গায় বাড়িআশেপাশে কোন জনবসতি নেই। 

 

                                                             (২)

বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। বেশ বড় বাড়িনীচতলাতেই গোটা চারেক ঘরকিন্তু বাড়িতে উনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ভদ্রলোককে লক্ষ্য করলামভীষণ চুপচাপ। এত বড় বাড়িফাঁকা শুনশান। হয়ত উনি একটু বেশি নির্জনতাপ্রেমী। বাড়ির একদম পেছনদিকে একটা ঘরে আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমাকে সেই ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি স্নানটান করে নাও। আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করছি 

আমি ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবলামবিকাশ কতদূর এলএকটু খবর নেওয়া দরকার। ফোন করতে গিয়ে দেখিমোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। যে ঘরে ছিলাম, তার পেছন দিকের দরজাটা খুলতেই বাড়ির বাইরে বেরনোর রাস্তা দেখতে পেলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েই জঙ্গলতবে ঘন জঙ্গল নয়ফাঁকা ফাঁকা। কিছুদূর এদিকওদিক ঘুরে দেখতে লাগলামমোবাইলের নেটওয়ার্ক আসে কিনা। কিন্তু কোন নেটওয়ার্ক আসছিল না। ফাঁকা জঙ্গলের মধ্যে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম। জঙ্গলের রাস্তা গাছের ঝরা পাতায় ঢেকে গিয়েছিল। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে চলার সময় মচমচ শব্দ হচ্ছিল। তখন পড়ন্ত বিকেল। এক জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। বিকাশকে ফোন করে বললাম, “ কেমন অদ্ভুত জায়গায় তোর দাদুর বাড়িফোনের নেটওয়ার্কই নেই। শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল

বিকাশ বলল, “তুই বাড়ি পৌছে গেছিস?”

আমিঃ “হ্যাঁ। আমি তো অনেকক্ষণ আগেই এসেছি

বিকাশঃ “তাই নাকিকখন পৌঁছলিতুই তো দাদুকে ফোন করিস নি। বাড়ির ঠিকানা জানলি কি করে?”

অজানা আশঙ্কায় আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, “ফোন করব কিগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল আর তোর দাদুই তো আমাকে ড্রাইভ করে ওনার বাড়িতে নিয়ে এলেন

বিকাশ বলল, “কি বলছিসদাদু তো কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বললেনতোর ফোন আসে নি। উনি তোর জন্য অপেক্ষা করছেন বাসস্ট্যান্ডে

আমি অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁসে কি!”

 

গল্পের মধ্যে ইন্টারাপ্ট করলাম। বললাম, “হ্যাঁ বয়স্ক ভদ্রলোক তাহলে কে ছিলেনবিকাশের দাদু ছিলেন না?”

ছেলেটা বলল, আরে শুনুনই না গল্পটাবলে গল্প চালিয়ে যেতে লাগল। 

 

আমি তো পুরো আকাশ থেকে পড়লাম। হঠাৎ ফোনের নেটওয়ার্ক চলে গেল। কল কেটে গেল। মাথায় কিছু ঢুকছিল না। তখনই কাঁধে কারো হাতের ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করলাম। একটা হিমেল স্রোত যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। আঁতকে উঠে পেছন ফিরে দেখিসেই বয়স্ক লোকটিইযিনি আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে এসেছিলেন। আমার মনে ভয় বাসা বাঁধল। ভ্রু-কুঞ্চিত করে লোকটির দিকে তাকালাম। দেখলামওনার চোখদুটি রক্তবর্ণরাতের পর রাত ঘুম না হলে যেমন হয়সেরকম। “লোকটি যদি বিকাশের দাদু না হনতাহলে কে?”, “কেনই বা আমাকে এখানে নিয়ে এলেন?”, “উনি কি আমার কোন ক্ষতি করতে চান?” এসব প্রশ্ন মনে জাগল। কিন্তু মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করলাম না। ভাবলামআতঙ্কিত হয়ে পড়লে বিপদ আরও বাড়তে পারে। আর এই নির্জন জঙ্গলে কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে না। তাই ঠাণ্ডা মাথায় ভদ্রলোককে বললাম, “মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না। তাই ঘুরতে ঘুরতে এতদূর চলে এসেছি

ভদ্রলোক আদেশের স্বরে বললেন, “এখানে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো নিরাপদ নয়। বাড়ি চলো

আমি ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে বললাম, “আচ্ছাচলুন

জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা চলে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোকের পিছুপিছু আসতে লাগলাম। কিভাবে এখান থেকে পালানো যায়তাই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে বাড়িটার কাছে চলে এলাম। ভদ্রলোক বাড়িতে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। ডাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে করতে আমাকে বললেন, “খাবার তৈরি করেছি। খেয়ে নাও” 

আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। একজন অপিরিচিত লোক কেন আমাকে  বাড়িতে নিয়ে এলবুঝতে পারছিলাম না। বললাম, “বিকাশ এলে আমি ওর সাথেই খাব। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। এতক্ষণে ওর চলে আসা উচিত ছিল। রাস্তায় কোন বিপদআপদ হল কিনা জানা দরকার

ভদ্রলোক ধীর কণ্ঠে বললেন, “আচ্ছাতুমি খেয়ে নাও। তারপর ওর খোঁজ করছি

আমি এবার জোর গলায় বললাম, “নাএখনই খোঁজ করা দরকার। আর দেরি নয়। আমি রাস্তায় এগিয়ে দেখছি।

ভদ্রলোক আমার কথা শুনে রাগান্বিত হলেন। তারপর কি একটা ভেবে বললেন, “আচ্ছা দাঁড়াও। উপর থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে আসছি। তারপর বেরোচ্ছি। সন্ধ্যে নামতে চলেছে। একা একা বাইরে বেরনো এখন নিরাপদ নয়।” বলে ভদ্রলোক উপরে চলে গেলেন। 

আমি নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওপরের ঘর থেকে অনেকক্ষণ ধরে কিছু খোঁজার আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ আমার মনে হলগাড়ির চাবি তো সদরদরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই বাঁদিকে কি-হোল্ডারে ঝোলানো দেখেছিলাম।  

তাকিয়ে দেখলামঠিক তাই। তখন ভাবলাম, “গাড়ির চাবি তো এখানেতাহলে উনি উপরে কি খুঁজছেন?” 

খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে সদরদরজা দিয়ে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগলাম। যে সরু পাথুরে রাস্তা ধরে এই বাড়িতে এসেছিলামসেই রাস্তা ধরেই উল্টোদিকে বড় রাস্তার দিকে দৌড়তে লাগলাম। আমার হাতে মোবাইল ফোন ছিল আর চেক করছিলাম ফোনে নেটওয়ার্ক আসে কিনা। কারণবিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলে আমি কঠিন বিপদে পড়ব। ফোনে নেটওয়ার্ক আসছিল না। অনেকটা দৌড়নোর পর বড় রাস্তার ধারে এসে পৌঁছলাম। মোবাইলে দেখলামনেটওয়ার্ক এসেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ফোন লাগালাম বিকাশকে। 

বিকাশ বলল, “আমি দাদুর গাড়িতে করে আসছি 

আমি বললাম, “প্লিজতুই আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর। কে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বিকাশ বলল, “তুই বড় রাস্তার ধারেই থাক। আমি তোকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছি 

বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরে একটু স্বস্তি পেলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আমি জানতাম বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ওখানেও চলে আসবেন। তাই গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলামযাতে উনি এলেও আমাকে দেখতে না পান। হলও তাই।  ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বারকয়েক  রাস্তা দিয়ে ঘোরাঘুরি করলেন। বুঝতে পারলামউনি আমাকেই খুঁজছেন কিন্তু অন্ধকারে আমাকে দেখতে পেলেন না। অনেকক্ষণ বাদে বিকাশ আর ওর দাদু গাড়ি নিয়ে ওখানে এসে পৌছাল। বিকাশকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। গাড়িতে উঠে পড়লাম। বিকাশের সঙ্গে যাবার সময় সব ঘটনা ওকে বিস্তারিতভাবে বললাম। বিকাশের দাদু বললেন, “এখানে কিছু জাদুগর শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে অপহরণ করে বেড়ায়। হতে পারে এটা ওদেরই কাজ 

বিকাশ বলল“আমি কালই পুলিশে নালিশ জানাব”। 


আবার গল্পের মাঝে ইন্টারাপ্ট করে বললাম, “বাহবেশ সাসপেন্স আছে তো!”

ছেলেটা বলল, তারপর শুনুন


আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আমাকে কে অপহরণ করবেআমি তো এখানে আগে কখনো আসিনিএখানে আসার কথা আগেরদিনই বিকাশের সাথে ঠিক হয়েছিল।  ভদ্রলোক জানলেনই বা কিভাবে যে আমি নৈনিতালে আসছি। আশ্চর্যজনকভাবে গাড়ির রঙও মিলে গেল। ভদ্রলোক কি কোন কালা জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিক জানেনযা দিয়ে মাইন্ড রিডিং করা যায়। শুরু থেকেই ওনার হাবভাব একটু অস্বাভাবিক ঠেকেছে। উনি বেশিরভাগ সময়েই ছিলেন নিশ্চুপ। খুব কম কথা বলছিলেনযতটা না বললেই নয়ততটাই। ওনার অভিসন্ধি কি ছিলবোঝা যায় নি। 

 

 

বিকাশের দাদুর বাড়ি পৌছে রাতে হাল্কা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের অস্বাভাবিক ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা আমার অবচেতন মনে ঘোরাঘুরি করছিল। তাই ভালো ঘুম হচ্ছিল না। রাতে একবার ঘুম ভাঙলে সামনের দেয়ালে আবছা আলোয় কার যেন ছায়া দেখতে পেলাম। আমি বিকাশের সাথেই শুয়েছিলাম। ওকে যেই ডাকতে যাবছায়াটা সরে গেল। 

পরদিন সকালে বিকাশ  দাদুর সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছিলাম। হঠাৎ দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে চোখ যেতে পুরো হাঁ হয়ে গেলাম। বিকাশ বলল, “কি হল রে?”

আমি বললাম, “ইনিই তো সেই ভদ্রলোকযিনি আমাকে কাল ওনার ডেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন

বিকাশঃ “অসম্ভবহতেই পারে না

বিকাশের দাদু পাশ থেকে বললেন, “তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে রাজেশ। উনি আমার বড়দা। অনেক বছর আগে উনি মারা গেছেন।

আমিঃ “মারা গেছেন?”

বিকাশের দাদুঃ “হ্যাঁ। সংসারে ওনার মন ছিল না। বিবাগী ধরনের মানুষ ছিলেন। বিয়েশাদি করেন নি। যৌবন বয়সেই তন্ত্রসাধনার ভূত ওনার মাথায় চেপেছিল। আমরা বাড়ির লোকজনেরা আপত্তি করেছিলাম। শোনেন নি। ভবঘুরের মত নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। শেষে এক সিদ্ধ তান্ত্রিকের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর শিষ্য হয়ে ডাকিনীহাঁকিনীইত্যাদি বশ করার সাধনা করতেন। ডাকিনীহাঁকিনীরা সব মরণোত্তর দশার জীব। এঁদের বিশেষ ক্ষমতা আছে। এঁরা ভালো-মন্দ দুই ধরনেরই হয়। তন্ত্রবিদ্যা দ্বারা এঁদের বশ করে কারও মঙ্গল যেমন করা যায়তেমনি অনিষ্টও করা যায়। কিন্তু এঁদের নিয়ে খেলা করা বিষাক্ত সাপ নিয়ে খেলা করার মতন। একটু অসাবধান হলেই এঁরা প্রাণে মেরে ফেলতে পারে। দাদার সাথেও তাই হল। তন্ত্রসাধনায় দীক্ষিত হয়ে উনি শ্মশানে-মশানে পড়ে থাকতেনরাতবিরেতে শবদেহ নিয়ে কি সব বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ করতেন। শেষের দিকে অস্বাভাবিক খ্যাপাটে উন্মত্ত ধরনের হয়ে উঠেছিলেন। দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরত। ওনার কাছে যেতেই আমাদের ভয় হত। একদিন সকালে ওনাকে শ্মশানের ধারে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়

আমি তো পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম।  কি করে সম্ভবএতক্ষণ লোকটার সাথে সময় কাটালাম। আর এঁরা বলছে ছবির ব্যক্তি সেই ব্যক্তি নয়এত বড়ো ভুল আমার হবে না। যাই হোকওরা আমার কথা বিশ্বাস করল না। 

বিকাশ বলল, “কালকের কথা ভুলে যা। চটপট তৈরি হয়ে নে। গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরব আমি তৈরি হয়ে নিলাম। বিকাশও রেডি হল। 

বেরোতে যাববিকাশ বলল, “গাড়ির একটা ডকিউমেন্ট খুঁজে পাচ্ছি না। রাস্তায় অনেক সময় চেকিং হয়। তুই গাড়িতে গিয়ে বোস। আমি একবার আলমারিতে খুঁজে দেখে আসছি

আমি গাড়িতে গিয়ে পেছনের সিটে বসলাম। বিকাশ একটু পরেই এসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমি বিকাশকে পেছন থেকে বললাম, “আমার শার্ট-প্যান্ট আরও অন্যান্য জিনিসপত্র যে ব্যাগে রাখা ছিলসেটা তো  ভদ্রলোকের বাড়িতেই রয়ে গেছে। আমাকে কিছু শপিং করতে হবে রে

বিকাশঃ “শপিং করতে হবে কেনওঁর বাড়ি থেকেই উদ্ধার করব। তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন

বিকাশের কথাবার্তা একটু বেশি ডেস্পারেট মনে হল।  গাড়ি নিয়ে  রাস্তা বরাবর চলতে লাগলযে রাস্তা দিয়ে আমরা গতকাল এসেছিলাম। গত রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নিতাই আমার একটু ঝিমুনি এসেছিল। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বড় রাস্তা থেকে মোড় নিয়ে গাড়ি যখন সেই সরু পাথুরে রাস্তায় ঢুকলতখন একটু ঝাঁকুনি দিল আর আমার ঝিমুনি কেটে গেল। আমার ভীষণ ভয় ভয় লাগছিল। বিকাশ এত সাহসী হয়ে উঠল কি করেযেচে  বয়স্ক ভদ্রলোকের গাড্ডায় গিয়ে পড়া কি ঠিক হবেওনার কি মতলব সেটাই তো পরিস্কার নয়ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে গতকাল যেখানে  বয়স্ক ভদ্রলোক নৈনিতাল বাসস্ট্যান্ড থেকে আমায় নিয়ে এসে গাড়ী থামিয়েছিলেনঠিক সেখানেই এসে গাড়ি দাঁড়াল। 

আশ্চর্য হয়ে গেলাম সামনে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। গতকাল যে বড় বাড়িটাতে এসে উঠেছিলামআজ সেটা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হয়ে একটা ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ঘরের দরজাজানালা ভাঙা; ইঁটপাথরপ্লাস্টার ইত্যাদি জায়গায় জায়গায় স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছেমনে হচ্ছিল বহু বছর আগের পরিত্যক্ত বাড়ি। আমার মাথায় কিছুই আসছিল না। আশপাশের সবকিছু একইরকম ছিলশুধু বাড়ীটাই একটা ধ্বংসস্তূপ। 

কেমন যেন একটা আতঙ্ক গ্রাস করল। কোন অশুভ ঘটনা ঘটার আগে যেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সেরকম মনে হল। মনে হচ্ছিলকোন অপ্রাকৃতিক ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছি আমি। চারিদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ আমার মোবাইল বেজে উঠল। এতেও আশ্চর্য হলাম। বুকটা ধক করে উঠল। কারণগতকাল এখানে কোন নেটওয়ার্ক ছিল না। নেটওয়ার্কের জন্য কত ঘুরতে হয়েছে। যাই হোকফোন তুলে দেখিবিকাশের দাদুর ফোন।

ফোন রিসিভ করতেই দাদু বললেন, “কোথায় গেলে তুমিআমরা তো তোমার জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছি

আমার গলা কেঁপে উঠল। বললাম, “আপনারা অপেক্ষা করছেন মানেআমি তো বিকাশের সাথে গাড়িতে চলে এলাম

দাদুঃ “কোথায় চলে গেলেবিকাশ তো গাড়িতেই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য

ফোনে দাদুর পাশ থেকে বিকাশের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে ফোনটা তখনই ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ভয়ে আমার হৃৎস্পন্দন আচমকা বেড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে সামনে তাকিয়ে যা দেখলামতাতে আমার মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা। ড্রাইভারের সিটে বসে ছিলেন সেই বয়স্ক ভদ্রলোকযার কবল থেকে গতকাল অনেক কষ্টে রেহাই পেয়েছিলাম। 

হায় রে নিয়তি! এই ছিল কপালে! এক অমঙ্গলসূচক দুশ্চিন্তায় আমার দিশেহারা হয়ে পড়ার উপক্রম হল। মনে হল, আমার জীবনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। মৃত্যুচিন্তাজনিত ভয় গ্রাস করে নিল আমার সমস্ত সত্ত্বাকে। ভদ্রলোক বোধ হয় ড্রাইভারের সিটে বসেই বুঝতে পেরেছিলেনআমি পেছন থেকে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আকস্মিক বিদ্রূপাত্মক খলখল অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আর আমার মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগল। আমার আর জ্ঞান রইল না।

 

 

 

                                                           (৩)

যখন আমার জ্ঞান ফিরলআমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। জ্ঞান ফিরলেও পুরোপুরি প্রকৃতিস্থ ছিলাম না। সেদিনের ঘটনায় মারাত্মক শক পেয়ে আমি ট্রমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। একটা আতঙ্ক আমায় সবসময় ঘিরে থাকত। জ্ঞান ফেরার পরেও ঠিকঠাক কথা বলতে পারছিলাম না। আকস্মিক আতঙ্কে হার্টফেল করার উপক্রম হয়েছিল সেদিন। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছেও কোনরকমে ভাগ্যের জোরে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর বিকাশকে পাশে দেখে আমি একটুখানি মানসিক স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। সেদিনের ঘটনা আমার মনে এমন বিষম প্রভাব ফেলেছিল যেস্বাভাবিক চিন্তাশক্তিও আমার কাজ করছিল না তখন। জঙ্গলের মধ্যে  পরিত্যক্ত বাড়ি আর অপহরণকারী  বয়স্ক ভদ্রলোকের দুর্বিষহ স্মৃতি আমায় তাড়া করে ফিরছিল আর সেদিনের ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক প্রতিনিয়ত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে আমায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। 

সেই মানসিক অবস্থাতেও আমার জানার কৌতূহল হলসেদিনের ঘটনার পর বিকাশ আমাকে উদ্ধার করল কিভাবে

ওকে জিজ্ঞেস করলে বলল, “ আর ওর দাদু মিলে অনেক অনুসন্ধান করার পর আমাকে জঙ্গল থেকে বেহুঁশ অবস্থায় উদ্ধার করেছিল 

যদিও আমার মনে বিকাশের উত্তর নিয়ে খটকা ছিলকারণ বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে যে স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেনসেখানে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোন জনবসতি ছিল না। আর আমি ঐরকম কোন স্থানে অপহৃত হয়েছিসেটা ওদের আন্দাজ করা দুঃসাধ্য। যাই হোকআমার মানসিক অবস্থা তখন টালমাটাল ছিল আর বিকাশের কনফিডেন্স দেখে আমি চুপ করে গেলাম।  কৃতজ্ঞতার আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। 

আরও দুতিন দিন হাসপাতালে কাটালাম।আমি সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতাম আমার মধ্যে সবসময় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা ভয় কাজ করত এবং শেষ মেশ এমন হলযেন আমি আমার মানসিক ভারসাম্য হারাতে চলেছি।

 

ডাক্তারবাবু বললেন, “এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে আমার সময় লাগবে। সেইজন্য আমার দীর্ঘ বিশ্রাম আর কাউন্সেলিং প্রয়োজন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি বিকাশের দাদুর বাড়িতেই থেকে বিশ্রাম করতে লাগলাম। 

বিকাশ বলল, “কলেজ খুলেছে। চল এবার ফেরা যাক

কিন্তু আমার মনের মধ্যে এমন ভয় গেঁথে গিয়ে গিয়েছিল যেমনে হচ্ছিলআমি ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারব না। 

কাঁদতে কাঁদতে বিকাশকে বললাম, “বন্ধুআমার পড়াশোনা বোধ হয় শেষ হয়ে গেল রে। আমি  ট্রমা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাব 

বিকাশ বলল, “তুই বেশি চিন্তা করিস না। তোর বিশ্রামের প্রয়োজন। তুই নিশ্চয়ই কদিনের মধ্যে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবি। আমি কাল ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি। দিন ক্লাস করে শীঘ্রই ফিরব 

বিকাশ দিল্লি চলে গেল। আমি ওর দাদুর বাড়িতেই রয়ে গেলাম। রোজ রাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে গেলে লক্ষ্য করতামআমার ঘরে অন্ধকারে একটি ছায়া হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছায়া দেখে মনে হত বয়স্ক ভদ্রলোক ওখানেও এসে উপস্থিত হয়েছেন আর ভয়ে আমার শরীর কাঠ হয়ে যেত।  ভদ্রলোক যেন আমাকে পাগল করেই ছাড়বেন 

ভয়ে আমার চিৎকার শুনে রাত্রিবেলা বিকাশের দাদু ছুটে আসতেন। কিন্তুঘরে আলো জ্বালার পর আর কাউকে দেখা যেত না। আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে লাগলআমি কোনদিন আর সুস্থ হয়ে উঠবো না। 

দিন পনের পরে বিকাশ ফিরে এলো। বিকাশকে কাছে পেয়ে আমি একটু মনের জোর পেলাম। রাতের বেলা  ছায়ার উপদ্রব কদিন বন্ধ রইল। বিকাশের সংগ্রহের কিছু গল্পের বই পড়ে মনের ভীতিটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। একদিন খবরের কাগজ পড়তে পড়তে একটি বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ গেল। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিলপ্রখ্যাত তান্ত্রিক দ্বারা বশীকরণ  জাদুটোনা সহ সকল প্রকার কাজে সিদ্ধহস্ত তান্ত্রিক আর সঙ্গে দেওয়া ছবিটি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেই বয়স্ক ভদ্রলোকের ছবি যিনি আমাকে অপহরণ করেছিলেন।

আমার মাথা ঘুরে গেল। মনে হলবিরাট কোন ষড়যন্ত্র হয়েছে আমার সাথে।  ব্যক্তি যে জীবিতসে ব্যাপারে কোন সন্দেহও নেই। নাহলে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরত না। আর বিকাশের দাদু এই ব্যক্তিকে নিজের মৃত দাদা বলে পরিচয় দিয়ে যে গল্প শুনিয়েছিলেনতা আদ্যৈপান্ত মিথ্যা। আমাকে কি তাহলে পরিকল্পনা করে ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে

সেইসময় বিকাশ আমার ঘরে এলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম।  থতমত খেয়ে গেল। ওর দাদু সম্ভবত আমার আর কথোপকথন শুনে ফেলেছিল। কিছুক্ষণ পর আমার ঘরে ঢুকে বলল, “তুমি আগে এই ওষুধটুকু খেয়ে নাও। আমি সব কথা তোমায় খুলে বলছি

ওষুধে মনে হয়কোন নেশাজাতীয় কিছু মেশানো ছিল। চুমুক দেওয়ার পরপরই আমার মাথা ঘুরে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। সংজ্ঞা হারালাম।

মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা লেগে সম্বিৎ ফিরে পেলাম আমি। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কোথায় আছি। কেমন যেন আবছা অন্ধকার চারিদিকে। চিৎকার করে সাহায্য চাইবার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে ঠিকঠাক আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। জড়ানো জড়ানো কথা বেরোচ্ছিল মুখ থেকে। নেশাজাতীয় ওষুধের ইফেক্ট তখনও ছিল।  

---“মশাইয়ের ঘুম ভাঙল তাহলে?”—বিকাশের কণ্ঠ। বিকাশ কোথায়যথাশক্তি প্রয়োগ করে চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলামআমি একটা চেয়ারের সাথে বাঁধা আছি। একটা বদ্ধ রুম ছিল। কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছিল। বিকাশ বসে ছিল সামনেইমুখে হাসি। সেই হাসিতে কি যেন একটা আছেঅশুভ কিছু।

---“তারপর রাজেশকেমন লাগছে এখন?”

জড়ানো জিভে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। 

---“আমরা এখন কোথায় আছি জানিস রাজেশ?” বিকাশের কন্ঠে কেমন একটা রহস্য ভাব। 

---“আমরা এখন নৈনিতাল শহর থেকে অনেক দূরে। এটা একটা পুরনো বাড়ি। এর আশেপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই 

আমি বলার চেষ্টা করলাম, “আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন?”

---“আমি জানি তোর মনে প্রশ্ন জাগছেকেন আমি তোকে এখানে নিয়ে এলাম। বলছি শোন। আমি স্কুল লাইফ থেকে বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে এসেছি। অনেক নতুন স্টুডেন্ট এসেছেগেছেকিন্তু তারা কেউ আমাকে টপকাতে পারেনি। আমি ধারাবাহিকভাবে প্রথম হয়ে এসেছি। ক্লাসের টিচারদের প্রশংসা কুড়িয়ে এসেছি। কিন্তু ইউনিভার্সিটে আসার পর থেকেই তুই শনির মত আমার পেছনে লেগে আছিস। সেই ফার্স্ট সেমিস্টার থেকে এইটথ সেমিস্টার পর্যন্তপ্রত্যেকটা সেমিস্টারে তুইই টপার। টিচারদের সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিস তুই। আমার অহঙ্কার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিস তুই। তোর জন্য ডিপার্টমেন্ট টপারের গোল্ড মেডালটা ফস্কে গেল। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর মাস্টার ডিগ্রিতেও তুই আমার পিছু ছাড়িস নি। তোর জন্য হতাশায় ভুগছি আমি মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এবারের কনভোকেশনে গোলদ মেডাল আমি তোর হস্তগত হতে দেব না। তোকে আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছি 

ওর কথা শুনে আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল। 

 আরও বলে চলল, “ বয়স্ক ভদ্রলোকযিনি তোকে জঙ্গলের মধ্যে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেনউনি আসলে একজন তান্ত্রিক এবং আমিই তাঁকে নিযুক্ত করেছিলামযাতে উনি তোকে একটা মেন্টাল ট্রমার মধ্যে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের বাড়িতেও রাত্রিবেলা ওনার আনাগোনার ব্যবস্থাও করেছিলামযাতে করে তুই আর কোনদিনই এই ট্রমা থেকে বের হতে না পারিস। অনেকে ট্রমা থেকে বেরোতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমিও চেয়েছিলাম তোকে সেই পথে ঠেলে দিতে। অনেকাংশে সফল হয়েও গিয়েছিলামকিন্তু খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে তুই আমার প্ল্যান ধরে ফেললি। তাই আজ না হোক কালতুই নিশ্চয়ই ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসে মানসিক সুস্থতা লাভ করবি আর আমার অগ্রগতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবি

আমি আকুতিমনতি করে বললাম, “তুই যদি আমাকে খোলসা করে আগে বলতিসতাহলে আমি অনেক আগেই তোর রাস্তা থেকে সরে আসতাম। কিন্তু তুই যে এতটা বিকৃতমস্তিষ্কআমি কল্পনাই করতে পারছি না। এখনও সময় আছে। তুই আমাকে মুক্তি দে। আমি দরকার হলে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে চলে যাব। কোনদিন তোর পথে আর আসব না 

---“সেটা সম্ভব নয় বন্ধু। তুই ইউনিভার্সিটিতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আমার কুকর্মের কথা ফাঁস হয়ে যাবে। তাই আমি কোন রিস্ক নেব না। আমি তোকে এখানে এভাবেই ফেলে চলে যাব রাজেশ। এই বাড়িটাতে কেউ আসে না। তবে ভাগ্যক্রমে কোন চোরবাটপার আসতে পারে। তোর যদি ভাগ্য ভালো হয়তাহলে তারা তোকে বাঁচাতেও পারে। আর ভাগ্য খারাপ হলে তুই এখানেই ধুঁকে ধুঁকে ক্ষুধায় আর তৃষ্ণায় মারা পড়বি। তোর পরিণতি আমি তোর ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দিলাম

আমি প্রবল বেগে হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করলাম। কিন্তু তাতে বাঁধনগুলো আরও শক্তভাবে এঁটে বসে গেল। বিকাশ রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কাতরস্বরে চিৎকার করলেও ওর পাষাণ মন বিগলিত হল না। 

বাইরে বোধ হয় গাড়ি দাঁড় করানোই ছিল। গাড়ির শব্দ কিছুক্ষণ পর সুদূরে মিলিয়ে গেল। অসহায় আমি ছটফট করতে লাগলাম বদ্ধ রুমের ভেতর। 

ভাগ্য কিন্তু আমার সহায় হয় নি।  


(৪)

এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত ছেলেটার গল্প শুনছিলাম। উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেললাম, “কী ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে তোমার সাথে!”

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখিওর মুখটা বড্ড বিষণ্ণফ্যাকাশে লাগছে। রক্তশুন্য হলে যেরকম হয়, অনেকটা সেরকম।

প্রবল উৎসাহ নিয়ে বললাম, “এর পর কি হল?”

সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর পরিপূর্ণ হয়েছিল। 

ছেলেটা মৃদুস্বরে বলল, “জানালার পাল্লাটা খুলে দিন তো। ধোঁয়ায় ঘরটা ভীষণ গুমোট লাগছে আমি উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিলাম। ঘরে দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গল্প শুনতে শুনতে আমার সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না। জানলা খুলে দিতে সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলীকৃত হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরের দমকা ঠাণ্ডা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিল। 

জানালা খুলে দিয়ে এসে দেখিছেলেটা নেই। আরে, এই তো ছিল ছেলেটা। কোথায় গেল! গল্পের শেষটা তো জানা হল না।

ভাবলামনিশ্চয়ই ওর ঘরে গেছে। বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল গল্পটা শুনতে। রুম থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে দেখিতালা ঝোলানো। বেশ অবাক হলাম। এরই মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল ছেলেটা! গ্রাউন্ড ফ্লোরে যায় নি তো! নীচে অ্যাকোয়াগার্ড ছিল। তাই ভাবলাম খাবার জল আনতে গেল কিনাদেখার জন্য নীচে নেমে গেলাম। ওখানেও দেখতে পেলাম না। রিসেপশনের ছেলেটা মেঝেতে তোষক পেতে ঘুমোচ্ছিল। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইআমার পাশের ঘরে যে ছেলেটা উঠেছে কোথায় গেল রে?”

 চোখ ঘচলাতে ঘচলাতে বলল -“আপনার পাশের ঘরেওখানে তো কেউ ওঠেনি

-“সে কী কথাএতক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে যে গল্প করে গেল!”

-“দোতলায় আপনার পাশের ঘরে কেনকোন ঘরেই গত তিন-চার দিনের মধ্যে কেউ আসেনি। আপনি চাইলে রেজিস্টার খুলে দেখাতে পারি।

                                                       ********



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror