Amitava Saha

Fantasy

0.3  

Amitava Saha

Fantasy

দেবতার কোপ

দেবতার কোপ

10 mins
1.4K


দশ-বারো বছর আগেকার কথা। আমার জীবনে এমন একটি ভয়ের ঘটনা ঘটেছিল, যা এখন তোমাদের বলব। তোমাদের হয়ত পড়ে মনে হবে গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছি। কেননা, আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল যে কোন ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজা। যখন আমরা কোনকিছু বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি না, তখনই তাকে “রহস্যময়” আখ্যা দিই। আমি যে ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম, তার ধর্মীয় ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা লৌকিক বিশ্বাস ও সংস্কার মেনে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারব না। আমি বিশ্বাস করি, দৈবিক শক্তি অতীতেও ছিল, আজও আছে। এমন এক শক্তি, যা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁকে সমীহ না করে উপায় নেই, যা ইচ্ছে করলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। মানুষের ক্ষমতা আর কতটুকু! ভণিতা না করে গল্পটা বলি। তখন আমার বয়স কত হবে, চব্বিস-পঁচিশ।

আমাদের পাড়ায় এক খিটখিটে স্বভাবের বুড়ো ভদ্রলোক থাকতেন। কথায় কথায় লোককে ছোট করা ওনার স্বভাব ছিল। এমন একটা ভাব, যেন উনি যেটা জানেন, সেটাই ঠিক; বাকিরা সবাই ভুল। পাড়ার কারো সঙ্গেই ওনার বনত না। বদরাগী বলে ওনার সাথে কেউ বিশেষ মিশত না। উনি একাই থাকতেন, বিয়ে-থাও করেননি। বাড়িতে লোকজন এলে উনি ভীষণ বিরক্ত হতেন, তাই পাড়াপ্রতিবেশীরা ওনার কাছে ঘেঁষত না। আত্মীয়স্বজনও তেমন কেউ ছিল না। কোনদিন দীনদুঃখীকে পাঁচটা টাকা দিয়েও সাহায্য করেননি। পাড়ার ছেলেরা পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে তাড়িয়ে দিতেন। শুধু কাজের লোক ছিল বুড়োর রান্নাবাড়া করে দেওয়ার জন্য। তাও ঠিকঠাক বেতন দিতেন না বলে আকছার চলে যেত। আবার নতুন লোক খুঁজে আনতেন।

যেদিন সকালে উনি মারা গেলেন, সেদিন পাড়ার লোক বলেছিল, বুড়ো মরেছে, ভালোই হয়েছে। তখন সবে বাংলা নববর্ষ পড়েছে। সকাল থেকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গুমোট গরম কেটে গিয়েছিল। ওয়েদার ঠাণ্ডাই ছিল। ওনার আত্মীয়দের খবর দেওয়া হল; তা সত্ত্বেও তাদের আসার লক্ষণ দেখা গেল না। মৃতদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যাবার লোক পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু সৎকার তো করতেই হবে। বেলা বাড়তে লাগল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কষ্টেমষ্টে তিনজন লোক পাওয়া গেল কান্ধা দেওয়ার জন্য। একজন আমাকে অনুরোধ করল, “ভাই, তুই চল”।

আমি বললাম, “আমি শ্মশানটশানে যাইনি কখনও। আমি ওসব মড়াটড়া পোড়াতে যাই না”।

-“কিন্তু, দেখছিস তো, আরেকজন লোক চাই। আর কিছুক্ষণ পরে তো দুর্গন্ধ ছাড়বে! চল না ভাই! বেশিক্ষণ লাগবে না। রাত্রি আটটার মধ্যেই চলে আসব”।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে রাজি হলাম। 

বাঁশের মাচায় শব তুলে কাঁধে নিয়ে খই ছড়াতে ছড়াতে আর “বলহরি হরিবোল” করতে করতে আমরা চললাম। আমার বাড়ি কুচবিহার শহরে। বাড়ি থেকে শ্মশান অনেকটাই দূরে ছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে বাবুরহাট ব্রিজ পেরিয়ে মরা তোর্সার ধার বরাবর রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ শ্মশানঘাটে উপস্থিত হলাম। তখনও এত পাকা রাস্তা হয়নি। বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় কি কাদা! মরা তোর্সার ধারে অশ্বত্থ গাছের নিচে মড়া পোড়ানোর জন্য একটা টিনের চালা ছিল। মেঝেটা ছিল পাকা। তখন ইলেকট্রিক চুল্লীর বালাই ছিল না। শব নামানো হল। ডোমদের বাড়ি আশেপাশেই ছিল। সেদিন মড়া পোড়ানোর আর কোন ক্যান্ডিডেট ছিল না। তার উপর সুন্দর ঠাণ্ডা ওয়েদার। ডোম’রা বাড়িতে তাড়ি গিলে আয়েস করছিল, কেউ আসতে চাচ্ছিল না। একজনকে ভালো দক্ষিণা দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হল। সে ব্যাটাও ঢুলুঢুলু করছিল। ও-ই কাঠ নিয়ে এসে চিতা সাজাতে লাগল।

শব নদীতে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে, গায়ে ঘী-মধু মাখিয়ে তুলে দেওয়া হল চিতায়। সেই কাঠ জোগাড় করা হয়েছিল সদ্য গাছ কেটে। কাঁচা কাঠের চিতায় আগুন দিতেই ধোঁয়া উঠতে লাগল পাকিয়ে পাকিয়ে। ঠিকঠাক জ্বলে উঠতে অনেকটা সময় নিল। ততক্ষণে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। ওখানে আলো খুব কম ছিল; বাঁশের খুঁটিতে একটা বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছিল। কিছুক্ষণ পরেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি আরম্ভ হল, সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া দিতে লাগল। জলের ছাট এসে চিতা ভিজে যেতে লাগল; আগুনও গেল নিভে। পাশেই কিছু টিন পড়ে ছিল। আমরা চিতার চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা দিতে গিয়ে নিজেরাই ভিজে গেলাম। বাল্বটাও দুম শব্দ করে বার্স্ট করে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি সঙ্গীসাথীদের বলেই ফেললাম, “এই বুড়ো হাড়জ্বালানি! মরার আগেও লোককে জ্বালিয়েছে, এখন মরার পরেও জ্বালাচ্ছে”। ওরা হেসে উঠল। ডোম বাড়ি থেকে হ্যাজাক নিয়ে এলো।

আধঘণ্টা খানেক চলার পর বৃষ্টি বন্ধ হল, হাওয়াও কমে গেল। ডোম কাঠগুলোকে ঠিকঠাক সরিয়ে আবার আগুন জ্বালিয়ে দিল। রাত্রি এগারোটা বেজে গেল মড়া পড়ানো শেষ হতে।

আমরা ফিরতে লাগলাম। রাস্তায় আলো ছিল না, ওদের কাছে টর্চ ছিল। আমি ওদের পিছুপিছু যাচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচন্ড প্রস্রাব চাপল। মরা তোর্সা পার হবার জন্য বাবুরহাট ব্রিজে ওঠার মুখে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে হালকা হয়ে নিলাম। তারপর ওদের সাথেসাথে বাড়ি ফিরে এলাম।

স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে ঘুমোতে রাত্রি একটা বেজে গেল। পরদিন সকালে প্রচন্ড গা ম্যাজম্যাজ করছিল আর সেই সঙ্গে জ্বর। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছিলাম না। মাথা অসম্ভব ভার। জ্বরের বড়ি খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলাম। জ্বর কিছুমাত্র কমল না। সারাদিন দুধ-সাবু খেয়ে কাটালাম। অন্যদিন হলে সন্ধেবেলা বাইরে আড্ডা মারতে যেতাম, কিন্তু সেদিন আর পারলাম না। রাত্রিবেলা একটু সুস্থ বোধ করছিলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে আমার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেল। জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছিল আর সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল। হঠাৎ কেন জানিনা মাছ ধরতে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে হল। মাছ ধরার শখ আমার কোন কালেই ছিল না। কিন্তু সেই মাঝরাতে সেই তীব্র ইচ্ছে কিছুতেই দমন করতে পারলাম না। মাছ ধরার জন্য তো জাল বা ছিপ দরকার। আমার জাল বা ছিপ কিছুই ছিল না; থাকার কথাও নয়। মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। মশারিটাকেই খুলে নিয়ে সেই মাঝরাতে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়লাম।

আমাদের বাড়ি থেকে অনতিদূরে তোর্সার বাঁধ পেরিয়ে ফাঁসিরঘাটে তোর্সা নদীতে জেলেদের মাছ ধরতে দেখেছিলাম। বাঁধের উপরের রাস্তা ধরে চলতে চলতে বাঁধ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। বৃষ্টি হয়ে কি কাদা হয়েছিল! পায়ের পাতা ডুবে যাচ্ছিল; আমার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। এক অজানা শক্তি আমাকে নদীর দিকে টানছিল এবং আমি একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলছিলাম। জলের কলকল ধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। ওখানে আলো ছিল না, মেঘলা আকাশের জোছনার আবছা আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তততুকুই। পিচ্ছিল মাটিতে আস্তে আস্তে পা ফেলে এগোচ্ছিলাম। নদীতে নেমে হাঁটুজলে গিয়ে দাঁড়ালাম।

জলের মারাত্মক বেগ ছিল। চৈত্র মাসের শেষে ক’দিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। তার উপর সেদিন সকালবেলা বৃষ্টি হয়ে নদী খরধারা হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল জলের তোড়ে উলটে পড়ে যাব। তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতের মশারিটা তাক করে জাল ফেলে দিলাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, হুঁশ নেই। হঠাৎ মনে হল, নদীর ওপার থেকে কেউ একজন আমায় ডাকছে। স্রোত মারাত্মক হলেও ফাঁসিরঘাটে নদীটা খুব বেশি চওড়া ছিল না, দু’শ ফিটের মত হবে। জলের প্রচন্ড গর্জনের মধ্যে হালকা ডাক “ও ভাই, ও ভাই” শুনতে পেলাম। আবছা আলোয় লোকটাকে ভালো দেখতে পাচ্ছিলাম না; শুধু হাত নাড়ানিটা বুঝতে পারছিলাম।

আমি বললাম, “কি?”

লোকটা বলল, “কিনারে বেশি মাছ নেই; মাঝ নদীতে আসো; অনেক মাছ পাবে”।

আমি আচ্ছন্নের মত ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম; কোমর জল পর্যন্ত নেমে গেলাম। তারপর আবার লোকটার হাত দেখতে পেলাম সামনের দিকে ডাকছে। তারপর গলা অব্দি জলে নেমে গেলাম। আমার সাঁতার জানা ছিল না। একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে চলছিল। যখন হুঁশ এলো, তখন নাকের মধ্যে জল ঢুকতে শুরু করেছে; শ্বাস নিতে পারছিলাম না। হাত-পা অবশ, আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব, মনে হচ্ছিল। কিন্তু কে যেন আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে; এক বিন্দু নড়াচড়া করার শক্তি আমার নেই; গলাটাও যেন চেপে ধরেছে; মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারছি না। শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম হল, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শক্তিটাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পেরে উঠছিলাম না। মৃত্যু অনিবার্য মনে হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল, কেউ যেন আমাকে ছেড়ে দিল। আমি হাঁসফাঁস করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে হুড়মুড় করে নদী ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে এলাম।

তারপর দৌড় দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। দেখি, সদর দরজা হাট করে খোলা। সবাই ঘুমুচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে বাবাকে ডাকলাম। বাবা আমার চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন। আমার সারা গা ভেজা; হাঁটু অব্দি কাদা।

বললেন, “কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

-“নদীতে”

-“এই মাঝরাতে! পাগলটাগল হলি নাকি?”

তারপর মা’কে ডেকে আমাকে স্নান করিয়ে গা মুছিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। পরদিন আবার ভয়ানক জ্বর। আমার আগের রাতের কীর্তি দেখে মা বাবাকে বললেন, “ওকে নিশ্চয়ই ভূতে ধরেছে। মড়া পোড়াতে গেছিল। ওখানেই ধরেছে নিশ্চয়ই। ওকে ঝাড়ফুঁক করাতে হবে”।

কুচবিহার জেলার দিনহাটার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক মহিলা ওঝা ছিলেন। ওনার নাম ছিল কুন্তলা, খুব নামডাক ছিল। প্রত্যেক মঙ্গল ও শনিবার ওনার উপর দেবতা ভর করতেন। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ওনার কাছে আসত। উনি মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ যেমন বলে দিতে পারতেন, তেমনি বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার সরল সমাধানও বলে দিতেন। গল্প শুনেছিলাম, অনেক বছর আগে উনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তার পর থেকেই প্রতি মঙ্গল ও শনিবার ওনার ভর হত।

আমি মা’কে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে খুব ভোরে ওনার আস্তানায় গিয়ে পৌছালাম। ক’দিনের জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। শরীরও শীর্ণ হয়ে পড়েছিল। আমি যাবার পর আরো আট-দশজন লোক ওখানে উপস্থিত হল। কুন্তলা স্নান সেরে এসে মা কালীর মন্দিরে ঢুকে মায়ের সামনে ধ্যানে বসলেন। আমরা মন্দিরের বাইরে হাতজোড় করে বসেছিলাম। লক্ষ্য করলাম, ধীরে ধীরে ওনার হাব-ভাব যেন কেমন বদলে যেতে লাগল। কাঁপতে লাগল ঠোঁট দুটো। চোখদুটো হ’য়ে গেল ঢুলু ঢুলু। কেমন যেন গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে লাগলেন। 

মেয়েরা শঙ্খধ্বনি করতে লাগল। সবাই বলল, ওনার উপর দেবতা ভর করেছেন আর সবাই উপুড় হয়ে প্রণাম করতে লাগল। আমিও তাই করলাম। হঠাৎ উনি আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আমার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন, “দূর হ! ভাগ! ভাগ এখান থেকে”।

আমি বিস্মিত হয়ে কাঠের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।

উনি বললেন, “এত বড় স্পর্ধা তোর! তুই দেবতার অমর্যাদা করিস! মরবি তুই। মরবি তুই অকালে”।

আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম, “কেন? কি করেছি আমি?”

উনি বললেন, “ভালো করে ভেবে দেখ মূর্খ কি করেছিস?”

আমি জ্ঞানশূন্যের মত বলে উঠলাম, “কবে, কি করেছি?”

উনি বললেন, “মড়া পোড়াতে গিয়ে কি করেছিলি, মনে করে দ্যাখ”।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মনে করতে লাগলাম, সেদিন কি করেছিলাম। মৃত ভদ্রলোককে কটূক্তি করেছিলাম, মনে পড়ল। এছাড়া তো আর কিছু মনে পড়ল না। কিন্তু তাতে তো দেবতা অসম্মান হবার কথা নয়।

আমি করজোড়ে অনুরোধ করে বললাম, “একটু স্পষ্ট করে বলুন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না”।

উনি নিরুত্তর হয়ে রইলেন। অনেকবার অনুরোধ করার পর বললেন, “মাশান দেবতার কোপে পড়েছিস তুই। প্রায়শ্চিত্ত করগে যা”। আর কোন কথা বললেন না।

পাশের লোকজনরা বলছিল, এবার পরেরজন আসুন। এক বিবাহিত দম্পতি এগিয়ে এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কি এমন অপরাধ করলাম যে মাশানবাবা আমার উপর অসন্তুষ্ট হলেন! আমার সঙ্গে তো আরও তিনজন ছিল। ওদের কিছু হলো না। কুন্তলার কথা অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। মনে হল, একবার ঐ শ্মশানে গিয়ে দেখি। জ্বরের দুর্বল শরীরেই সাইকেলে চড়ে মরা তোর্সার ধারে শ্মশানঘাটে দিনেরবেলা উপস্থিত হলাম। ওখানে একটা বিশাল শিবের মূর্তি ছিল। কোন মাশান মন্দির ছিল না। ওখান থেকে ফেরার পথে বাবুরহাট ব্রিজে ওঠার সময় খেয়াল করলাম, ব্রিজটা রাস্তা থেকে অনেকটাই উঁচু। তোর্সার বন্যার কথা মাথায় রেখে ব্রিজ ডিজাইন করার সময় “হাই ফ্লাড লেভেল” কন্সিডার করে ইঞ্জিনিয়াররা ব্রিজটা এত উঁচু বানিয়েছিলেন। ব্রিজের পাশেই ব্রিজের লেভেল থেকে নীচে চোখে পড়ল চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া একটা মাশান পাট। তিনদিক ঘেরা দেওয়া, সামনের দিকটা খোলা। নীল রঙের গাত্রবর্ণের মাটির মাশানবাবা পদ্মাসনে উপবিষ্ট, হাতে গদা। চোখমুখের ভীষণ আকৃতি। চট করে দেখলে ভয় লাগে।

হঠাৎ করে আমার মনে পড়ল, সেদিন রাতে শ্মশান থেকে ফেরার পথে আমার প্রচণ্ড প্রস্রাব পেয়েছিল এবং আমি এই স্থানেই হাল্কা হয়েছিলাম। সেদিন রাতের অন্ধকারে খেয়াল করিনি। মাথায় যেন বাজ পড়ল। কুন্তলা তাহলে ঠিকই বলেছিলেন। মাশানবাবা আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ রইল না।

বাড়িতে এসে শুনলাম, বাবুরহাটের মাশান অত্যন্ত জাগ্রত। ব্রিজটি তৈরি হবার পর থেকে ঐ স্থানে অসংখ্য পথ দুর্ঘটনা হত। দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচার জন্যই ঐ জায়গায় মাশানপাট বসানো হয়। এটাও শুনলাম, মাশানপাট অতিক্রম করার সময় ড্রাইভাররা মাশানের সম্মানার্থে হর্ন না দিয়ে কেউ যায় না।

সেই সময় দিনহাটার গোসানীমারিতে পনের দিন ব্যাপী মাশান পূজা ও মেলা চলছিল। প্রাচীন কামতাপুরের কামতেশ্বর রাজার গড় বা দুর্গ কাটার সময় ওখানে মাশান পাট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলে এই মাশান “গড়কাটা মাশান” নামে পরিচিত। প্রত্যেক বছর বৈশাখ মাসে গড়কাটা মাশানের মন্দিরের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গনে পনের দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় পূজা ও মেলা। আমি আরোগ্য পাবার আশায় ওখানে পূজা দেবার জন্য হাজির হলাম। ওখানে গিয়ে দেখি, কুন্তলা এই মন্দিরে মাশানবাবার পূজারী ছিলেন।

ওনাকে গিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম, “আপনি সেদিন আমার সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ সত্যি”।

উনি তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বললেন, “আমার তো কিছু মনে পড়ছে না ভাই। ভর ওঠার সময়ের কোন কথাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পরে আমার মনে থাকে না। তখন যা ঘটে, সবটাই ঈশ্বরের ইচ্ছায়”।

আমি ওনাকে সেদিনকার কথা মনে করিয়ে দিলাম। উনি আমাকে পূজার জন্য সরঞ্জাম যোগাড় করতে বললেন। পূজার উপকরণ হিসেবে আঁটিয়া কলা, ঘটিতে পাতা দই, চিঁড়ার নৈবেদ্য, চালভাজা, ইত্যাদি এনে কলাপাতার উপর রাখলাম। বলি হিসেবে উৎসর্গ করেছিলাম একজোড়া কবুতর। কুন্তলা আমাকে ঠাকুরের সামনে কাঠের পিঁড়িতে বসিয়েছিলেন। তারপর একটা ধাতুর পাত্রে জল নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক আমার গায়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন।

পূজা শেষে কলাপাতা, নৈবেদ্য ইত্যাদি একসঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়েছিলাম। এভাবে পূজা করার ফলে আমার জ্বর কমে গিয়েছিল এবং মাঝরাতে মাছ ধরতে যাবার মত মানসিক বিকৃতিও আর কখনও হয়নি। মাশানের কোপ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।

মাশান দেবতা সম্পর্কে দু’একটা কথা বলে শেষ করছি। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে মাশান দেবতার প্রভাব অত্যন্ত বেশি। রাজবংশী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দেবতা মাশান। মাশানের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে প্রচলিত লোককথা হল, “একদিন মা কালী একাকী নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে ধর্ম দেবতার আবির্ভাব ঘটে। এরপর উভয়ের মিলনের ফলে জন্ম হয় মাশানের”। মাশান ভয়ঙ্কর দেবতা। সবাই তাঁকে ভয় করে। লোকালয়ে মাশানের অধিষ্ঠান হয় না। কোন নির্জন নদীর ধারে, মা কালীর পাটের পাশে, কোথাও বট বা শ্যাওড়া গাছের নিচে এই দেবতার অধিষ্ঠান হয়ে থাকে। মূলতঃ আঠারো রকমের মাশান দেখা যায়। যেমনঃ বাড়িকা মাশান, ছুচিয়া মাশান, ন্যাড়া মাশান, ভুলা মাশান ইত্যাদি। আমাকে মনে হয় ছুচিয়া মাশান ধরেছিল। ছুচিয়া মাশান দোষী পথচারীদের শাস্তি দেয়।

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রোগ থেকে আরোগ্য কামনায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও পথ দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচার জন্য মাশান দেবতার আরাধনা হয়ে থাকে। আমি অজ্ঞানতাবশত ভুল করে মাশান দেবতার কোপে পড়ে বিকারগ্রস্ত হয়েছিলাম এবং পরে তাঁর কৃপায় মুক্তিও পেয়েছিলাম। গ্রামীন সমাজের মানুষ আজও বিপন্মুক্তির জন্য মাশানবাবার দ্বারস্থ হন এবং ধুমধাম করে তাঁর পূজা সম্পন্ন হয়।

জয় মাশানবাবার জয় ।


Rate this content
Log in