Amitava Saha

Horror Classics Thriller

3  

Amitava Saha

Horror Classics Thriller

শীতের নিঝুম রাস্তায়

শীতের নিঝুম রাস্তায়

7 mins
260


ভূত বা আত্মাদের নিজস্ব একটা জগত আছে। ওরা ওদের জগতে জীবিত মানুষের অনুপ্রবেশ পছন্দ করে না। কোন মানুষ যদি ভুলক্রমে ওদের আস্তানায় ঢুকে পড়ে, তাহলে ওরা তাকে সতর্কীকরণের জন্য কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী করে তোলে, যাতে করে মানুষ পরবর্তীতে আর ওদের কাছাকাছি ঘেঁষার দুঃসাহস না করে। যারা কোনভাবে ভূতেদের সম্মুখীন হন, তারা পরবর্তীকালে তাদের সেই ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনী যখন বন্ধুবান্ধব বা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে গল্প করে শোনান, তখন শ্রোতাদের পক্ষে তা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। গল্পটা আমার এক মারাঠি বন্ধুর কাছে শোনা। সেই সময় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতাম। একদিন রাতে যখন লোডশেডিং হল, তখন আমরা কজন বন্ধু মিলে হস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রোহিত তখন এই গল্পটা শুনিয়েছিল। রোহিতের এক কাকা চাকরি করতেন মহারাষ্ট্রে এক কল সেন্টারে। অন্য কোম্পানি ছেড়ে সদ্য জয়েন করেছিলেন। ওনার ডিউটি ছিল ইভিনিং শিফটে। ডিউটি শেষ হত রাত এগারোটায়। উনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেটি ছিল অফিস থেকে অনেকটা দূরে। আসলে সিটিতে বাড়িভাড়া অনেক বেশি বলে উনি একটু শহরতলীতে থাকতেন।


একদিন ডিউটি শেষ করে বেরতে কাকার একটু দেরি হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে যখন বাইকে উঠলেন, তখন রাত প্রায় বারোটা। তড়িঘড়ি বাইক স্টার্ট দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তখন সবে জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল। রাস্তাঘাটে দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শহর পেরিয়ে হাইওয়েতে উঠে ৫-৬ কিলোমিটার যাবার পর ওনার ভীষণ সিগারেটের নেশা উঠল। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলেন, রাস্তায় যেতে যেতে হাইওয়ের ধারে কোন দোকান থেকে নিয়ে নেবেন। হাইওয়ের দুধারে মাইলের পর মাইল জুড়ে ফাঁকা শস্যখেত, অনেকদূর যাবার পর দুএকটা দোকান চোখে পড়ছিল। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা ছিল বলে তাও বন্ধ ছিল। যেতে যেতে এক জায়গায় লক্ষ্য করলেন, হাইওয়ে থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার মোড়ে কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছিল। উনি ভাবলেন, এই রাস্তা বরাবর কিছুদূর এগিয়ে দেখা যাক, কোন সিগারেটের দোকান খোলা পাওয়া যায় কিনা। রাস্তায় ঢুকতে প্রথমে কিছুদূর জনবসতি, কিছু যানবাহন চোখে পড়ল। কিন্তু মাইলখানেক এগোনোর পরও কোন দোকান খোলা চোখে পড়ল না। উপরন্তু মনে হল রাস্তাটা যেন ক্রমশ নির্জন হয়ে দুদিকের গাছপালা ঘেরা এক অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করছিল। আর এগিয়ে লাভ হবে না ভেবে উনি বাইক ঘুরিয়ে নেবেন, মনস্থ করলেন। বাইক ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে আচমকা স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। সেলফ স্টার্ট নিচ্ছিল না দেখে কাকা বাইক রাস্তার ধারে সাইড করে কিক দিতে লাগলেন, তাতেও বাইক স্টার্ট নিচ্ছিল না। আচ্ছা যন্ত্রণায় পড়া গেল! এদিক ওদিক তাকাতে কিছুদূরে বাইকের হেডলাইটের আবছা আলোয় খেয়াল করলেন রাস্তার ধারে একজন মাঝবয়সি মহিলা দাঁড়িয়ে। মহিলাকে দেখে মনে হল, আশেপাশের কোন গ্রামের মহিলা। পরনে শাড়ি, হাতে কাঁচের চুড়ি। উনি কাকার কাছে এসে ওদের মারাঠি ভাষায় বললেন, “আমার ছেলের শরীর খারাপ। আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও”।


কাকা এমনিতেই বাইক স্টার্ট না নেওয়ায় চিন্তিত ছিলেন। বললেন, “আমার গাড়িটা একটু আগেই খারাপ হয়ে গেছে। স্টার্ট নিচ্ছে না। আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারব না” বলতে বলতে কিক দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বাইক স্টার্ট নিয়ে নিল। কাকাও অবাক হয়ে গেলেন। এতক্ষণ ধরে কিক দিচ্ছিলেন, কিন্তু বাইক স্টার্ট নিচ্ছিল না। এখন হঠাৎ করেই স্টার্ট নিয়ে নিল। কাকা মহিলার সামনে একটু বিব্রতও হলেন। কারণ, ঐ মহিলা ভাবতে পারেন, কাকা ইচ্ছে করেই ওনাকে বাড়ি পৌঁছে না দেবার জন্য বাইক খারাপ হয়ে যাওয়ার বাহানা করছিলেন। তাই ঠিক করলেন, মহিলাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন এবং ওনাকে বাইকের পেছনে বসতে বললেন।


কাকা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাড়ি কতদূরে?”


মহিলা বললেন, “সামনেই। আপনি চলুন। বাড়ি এলেই আমি নেমে যাব”।


কাকার এবার একটু খটকা লাগল মনে। একজন মহিলা যার ছেলের শরীর খারাপ, তিনি এত রাতে বাইরে এই নির্জন রাস্তায় কি করছেন, এই ভেবে। কাকা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন আর যে রাস্তা দিয়ে উনি যাচ্ছিলেন, রাস্তাটা ছিল একদম নিঝুম। এতক্ষণ যে বাইক খারাপ হয়ে এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, না কোন গাড়ি ক্রস করল না অন্য কোন মানুষ নজরে পড়ল।


পেছনে মহিলা বসেছিলেন বলে কাকা একটু আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পর কাকা খেয়াল করলেন, সামনে কিছুদূরে রাস্তার ধারে আরেকজন মহিলা দাঁড়িয়ে হাত দেখাচ্ছিলেন। এবার কাকা বাইক থামাতে চাইছিলেন না, কারণ, বাইকে আগে থেকেই ঐ মহিলা বসেছিলেন। কিন্তু কাকা যত এগোচ্ছিলেন, বাইক আপনাআপনি স্লো হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল যেন বাইকের উপর ওনার কোন কন্ট্রোল নেই। বাইক রাস্তার ধারে দাঁড়ানো মহিলার কাছে আসতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল। এই মহিলাও আগের মহিলার মতই শাড়িপরিহিতা ছিলেন। উনি কাকাকে বললেন, “আমার ছেলেটার শরীর খারাপ। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও না”।


শুনে কাকা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে ওনার বাইকের পেছনে বসে থাকা মহিলাও একই কথা বলেছিলেন। কাকা হেডলাইটের আলোয় ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন, এই মহিলা তো সেই মহিলাই, যাকে উনি কিছুক্ষণ আগে লিফট দিয়েছিলেন। আচমকা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই ওনার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওনার বাইকের পেছনে কেউ ছিল না। ওনার গলা শুকিয়ে যেতে লাগল, গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না।


কাকা ঐ মহিলাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করার সাহসেই কুলোল না। কাকা বুঝতে পেরেছিলেন, উনি কোন ভূতুড়ে জায়গায় এসে পড়েছেন। ঐ মহিলা আবার বললেন, “আমার ছেলেটার শরীর খারাপ। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও না”।


কাকা ওনার কথার কোন জবাব দিলেন না। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। উনি বাইক স্টার্ট করার চেষ্টা করছিলেন, স্টার্ট নিচ্ছিল না। তখন ঐ মহিলা নিজেই এসে কাকার বাইকের পেছনে বসলেন আর বাইক সাথে সাথে স্টার্ট নিয়ে নিল আর চলতে শুরু করল।


কাকার মনে হচ্ছিল যেন বাইক আপনাআপনি চলছিল। এই ঘটনায় কাকার হাত পা কাঁপতে লাগল। উনি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন আর শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। আরও কিছুদূর সামনে এগোনোর পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।


কাকা সামনে রাস্তার ধারে দেখতে পেলেন, ঐ মহিলা বাইক থামানোর জন্য হাত দেখাচ্ছেন। ঐ একই কাঁচের চুড়িওয়ালা হাত, ঐ একই শাড়ি। কাকা বুঝতে পারছিলেন না, ওনার সাথে এসব কী ঘটছিল! ভয়ে শরীরে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল।


এবার আর পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হল না। উনি বাইকের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলেন, বাইকের পেছনে কেউ নেই। কোন এক ব্যুহের মধ্যে কাকা ফেঁসে গিয়েছিলেন। উনি ঘুরেফিরে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসছিলেন এবং ঐ একই মহিলার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।


আবার একবার কাকার বাইক ঐ মহিলার সামনে এসে আপনাআপনি থেমে গেল। এবার ঐ মহিলা রাগের স্বরে বললেন, “তোকে এতবার বলছি, কথা কানে যাচ্ছে না? আমার ছেলেটার শরীর খারাপ। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দে। নাহলে তোকে মেরে ফেলব”। এ কথা বলে ঐ মহিলা আবার এসে বাইকের পেছনে বসতে গেলেন।


কাকা ভয়ে বাইক থেকে নামার চেষ্টা করছিলেন। উনি কাঁপছিলেন, তাই হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। বাইকও রাস্তার ধারে কাত হয়ে গেল।


তখন ঐ মহিলা কঠিন দৃষ্টিতে কাকার দিকে তাকালেন। কাকা কাঁপতে কাঁপতে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন। হাত জোর করে ঐ মহিলার সামনে মিনতি করছিলেন, “আমাকে যেতে দাও। যেতে দাও। আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?”


মহিলার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। উনি ভীষণ হিংস্রভাবে কাকার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাগে ফুঁসছিলেন। কাকা হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, ওনার মাথা বেয়ে রক্তের ধারা বইতে লাগল এবং সমস্ত মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে কাকা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে ওখান থেকে পালাতে লাগলেন। দৌড়তে দৌড়তে হাইওয়ের দিকে যেতে লাগলেন। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস ছিল না। রাস্তায় কোনরকমে একটা গাড়িকে হাত দেখিয়ে লিফট নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।


বাড়ি ফিরে ওনার প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। ওনার অবস্থা খারাপ দেখে বাড়ির লোকেরা যখন জানতে চাইল, তখন উনি রাস্তায় দেখতে পাওয়া ঐ মহিলার কথা বললেন। পুরো ঘটনা শুনে বাড়ির লোকেরাও ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে কাকার কয়েকজন বন্ধু মিলে বাইক খুঁজতে বেরিয়েছিল। কাকার কথামত ঐ জায়গায় পৌঁছাবার পর ওরা দেখতে পেল, বাইকটা রাস্তার ধারে স্ট্যান্ড করা আর কিছু লোকজন আশেপাশে ভিড় করেছিল। স্থানীয় লোকজন হয়ত ভেবেছিল, কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে আর পুলিস কেসের ঝামেলা হতে পারে। তাই কেউ বাইকে হাত লাগায় নি। বন্ধুরা কাকার সাথে আগের রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনা ওখানকার লোকেদের সঙ্গে শেয়ার করার পর জানতে পারল, ঐ মহিলা ওদের গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন। বছরখানেক আগে ঐ মহিলার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল আর ঐ মহিলা ডাক্তার ডাকতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। আর যখন ফিরছিলেন তখন রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কায় ঐ মহিলার মৃত্যু হয়। ভীষণ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল আর মহিলার মাথায় প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু ঘটেছিল। রাস্তায় যে জায়গায় ঐ মহিলাকে দেখা গিয়েছিল, ঐ স্থানেই মহিলার মৃত্যু ঘটেছিল। ঐ গ্রামের কিছু লোকজন রাত্রিবেলা যাতায়াত করার সময় এর আগে কয়েকবার ঐ রাস্তায় মহিলাকে দেখেছেন। তাই গ্রামের লোকজন এই ঘটনার কথা জানতেন এবং রাতে ওরা এই রাস্তাটি এড়িয়ে চলতেন।   


এ ধরনের ভৌতিক ঘটনার প্রভাব এত প্রবল হয় যে, ঘটে যাবার পরও মানুষের উপর তার রেশ থেকে যায় এবং মানুষ অনেকসময় মানসিক বিকৃতির শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু কাকার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর উনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। আসলে ঐ মহিলার আত্না অতৃপ্ত ছিল; উনি নিজের বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। কারণ, আত্মাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই আত্মার সেই ইচ্ছে অপূর্ণই রয়ে যাচ্ছিল। এই কারণে কাকা যখন ঐ মহিলার খপ্পরে পড়েছিলেন, তখন ওনার মনে হচ্ছিল যেন এক অদৃশ্য লুপে ফেঁসে গিয়েছেন। বাইক চালিয়ে এগিয়ে যাবার পরেও একই জায়গায় ফিরে আসছিলেন এবং ঐ মহিলাকে বারবার দেখতে পাচ্ছিলেন।


আমার বন্ধুর কাকা এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, তবু আজও যখন সেই রাতের ঘটনার কথা গল্প করে শোনান, ওনার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror