পুতুল নাচ
পুতুল নাচ


প্রিয় ডায়েরি,
নববর্ষের এই সময়টাতে আমার মন সবসময় ফিরে যেতে চায় অতীতে, আমার মামারবাড়িতে। আমার মামারবাড়ি ডায়মন্ডহারবারে। বর্তমানে অবশ্য সবাই হাওড়াবাসী। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্তই আমার দাদু ডায়মন্ডহারবারেই ছিলেন।সেই সূত্রে আমরাও ওখানেই যেতাম।বিশেষত এই পয়লা বৈশাখে আমার মামারবাড়ির ওখানে আমাদের যাওয়া ছিলো অবধারিত। আর এই যাওয়ার মূল আকর্ষণ ছিলো পয়লা বৈশাখের গোষ্ঠমেলা ও তার পুতুল নাচ। চৈত্র সংক্রান্তির দিন এই মেলা শুরু হতো, আর তিনদিন ব্যাপী এই মেলা হতো।পয়লা বৈশাখের পরের দিন পর্যন্ত এই মেলা চলতো। মেলার মূল আকর্ষণ ছিলো পুতুল নাচ। একসময় গ্ৰাম বাংলা দাপিয়ে বেড়ানো মনোরঞ্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই পুতুল নাচ।
যা আজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দাপটে বিলুপ্তপ্রায়। সেইসময় ওই গোষ্ঠ মেলায় কোনো কোনো বছর যাত্রাপালারও আয়োজন করা হতো। তবে যাত্রাপালার আসর তৈরি করা ব্যয়সাপেক্ষ ছিল সেই সময়। তাই বিকল্প হিসাবে পুতুল নাচের আসর সাজানো হতো। এই পুতুল তৈরি হতো আমার দাদুর নাটমন্দিরের দালানে। প্রথমদিকে মাটি আর কাঠ দিয়েই তৈরি হতো এই পুতুল। উপরে রঙ তুলি দিয়ে মুখের অবয়ব তৈরি করা হতো। আর নীচে কাপড় দিয়ে পোশাক পরানো হতো বিভিন্ন ভাবে। চুল তৈরি হতো পুকুরের কচুরিপানার শিকড় দিয়ে।
পরবর্তী কালে এই পুতুল শোলা আর হালকা কাঠ দিয়ে বানানো হতো। তারপর সেগুলো কে গল্পের ধরণ অনুযায়ী কাপড়, অলংকার এইসব দিয়ে সজ্জিত করা হতো।সূক্ষ্ম তার আর সুতোর ব্যবহার করে এই পুতুল দের নাচানো হতো। যাত্রাপালার ঢঙেই সংলাপ আর অট্টহাসির মিশ্রনে আসর হয়ে উঠতো মোহময়। মঞ্চের একপাশে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাদক বসতো।আর কালো কাপড়ে ঢাকা মঞ্চের উপর থেকে সংলাপ আর গানের সাথে মিল রেখে অসাধারণ নৈপুন্যতার সাথে সূক্ষ্ম সুতার সাহায্যে পুতুল নাচাতো শিল্পীরা। আমার মতে পুরো প্রদর্শন টাই একটা টিম ওয়ার্কের মতো। বাদকের বাজনা, শিল্পীর দক্ষতা, আর পুতুলের নাচ সবমিলিয়ে একটা অসম্ভব সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রচনা করতো, যা এককথায় অবর্ণনীয়। মনে হতো জড় পুতুল গুলির মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। তালপাতার বাঁশীর আওয়াজও এই পুতুল নাচের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। পুতুল নাচে একদিকে যেমন রাধাকৃষ্ণের লীলা, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী তুলে ধরা হতো, ঠিক তেমনি অপরদিকে সামাজিক কিছু প্রতিচ্ছবিও থাকতো। যেমন নারীশিক্ষা, দাম্পত্য কলহের সমাধান, বাল্যবিবাহ রোধ এইসমস্ত।
আসলে জীবনের কিছু ঘটনা কখনও ভোলা যায় না। এই পুতুল নাচ দেখাও আমার জীবনের এরকমই একটি দর্শনীয় ঘটনা, যা আমার স্মৃতিপটে চিরকাল আঁকা হয়ে থাকবে।