STORYMIRROR

Dola Bhattacharyya

Tragedy Others

3  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Others

পুত্রস্নেহ

পুত্রস্নেহ

5 mins
196


সুপ্রিয় চৌধুরীর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ অনেক বছর আগে। একমাত্র ছেলে সুভাষ, বৌমা নয়ন ও নাতনী রিমি কে নিয়ে সংসার। মেয়ে নীলার বিয়ে হয়েছে কাছেই। প্রায়ই সে বাবার কাছে আসে, এবং নানা রকম অশান্তির সম্মুখীন হয়। ভাইয়ের স্ত্রী প্রায়ই অভিযোগ করে ননদের কাছে, তার বাবার সম্পর্কে। সেগুলো তাকে চুপ করে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করলেই ভাই বলে, নিয়ে যা না বাবাকে, তোর কাছে যত্নে থাকবে। নীলার সত্যিই কোনও উপায় নেই নিজের বাবাকে নিজের কাছে রাখার। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি, ননদ, জা, ভাসুর, দেওর কেউই মেনে নেবেন না সেটা । তাই কিছু বলতে পারে না। 


ইদানিং সুভাষ ও নয়নের মনে হয়েছে, বাবার তো সুগার আছে। তাই যতটা সম্ভব কম খাওয়া দরকার। তাতে সুগারটা বাড়তে পারবে না। সেইজন্য ওরা একটা ডায়েট চার্ট করেছিল। সকালে চা আর দুটো নোনতা বিস্কুট, দুপুরে একমুঠো ভাত আর একটু আলুভাতে, আর রাতেও একমুঠো ভাত আর সাথে সেই একটুখানি আলুসেদ্ধ ।একদিন নীলা বলল, রাতেও ভাত! আর শুধু আলু কেন! অন্য সব্জি একটু দিতে হয় তো। 


সুভাষ বলে, কি করে কিনবো? জামাইবাবুর মতো প্রতিমাসে মোটা টাকা মাইনে তো আমি পাই না আমি । তিন চার মাস বাদে একমাসের মাইনে পাই । তাতে ওই চাল আর আলুটুকু কেনা যায় , আর বাকি পয়সা যায় ধার মেটাতে। মাইনে হয়না কেন তা বোঝে না নীলা। চাকরি করছে, আর তার মাইনে হবে না প্রতিমাসে! তিন চার মাস বাদে হলেও একমাসের মাইনে কেন! ওই তিন চার মাসের মাইনেই তো পাবে। এ কি সব বলছে! 

নীলা বলল, যাই হোক না কেন, একটা সুগারের রোগীর ডায়েট এটা হতে পারে না। ঠিক আছে, বাবার খাবার দায়িত্ব তবে আমি নিলাম। 


পরদিন থেকেই বাবা আসতে শুরু করল দুপুরে। কি খারাপ চেহারা হয়ে গেছে মানুষটার। দেখলে কান্না আসে। হাজার বলা সত্ত্বেও বাবা এখানে খেতে রাজি হলেন না। খাবার নিয়ে চলে গেলেন। কদিন পর বাবা বলতে শুরু করলেন, জানিস মা, খাচ্ছি যখন, তোর ভাই বলছে, খাও খাও, খুব ভালো মন্দ খেয়ে নাও। আর আমরা আলুসেদ্ধ ভাত খাই। তবে অসুখ হলে কিন্তু দিদি নয়, এই আমরাই করব। শুনে অবাক নীলা। সামান্যই ভাত, ডাল, একটুখানি সব্জি আর একপিস মাছ। এটা নাকি খুব ডালো খাবার! এদিকে শাশুড়িও ঝামেলা করছেন। আমাকে কম ভাত দাও, মাছ টা আর দিও না, তোমার বাবা তো খাবেন। আমার ছেলের তো আর পয়সার গাছ নেই যে দানছত্তর খুলে বসবে। বৃদ্ধার নীচতা দেখে নীলা স্তম্ভিত। বলে, আমার বাবা কে একটু খেতে দিচ্ছি বলে এমন কেন করছেন মা? শাশুড়ি বলেন, সবদিকে ছড়ানোর মতো অত টাকা নেই ফুলুর। তাই বলছিলাম, তোমার বাবাকে তো খেতে দিতেই হবে। তাই আমি নাহয় একটু কমই খেলাম। নীলা ভাবে, তার স্বামী একজন হাই স্কুলের টিচার, নিজের পরিবারের সাথে নিজের শ্বশুর মশাই কে একবেলা খাওয়াতে হলে সত্যিই কি খুব অসুবিধা হয় ওনার ! কই, উনি তো কিছু বলেন না! তাহলে মায়ের এমন মনে হচ্ছে কেন? 


কদিন বাদে বাবা বললেন, নাঃ। এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমার ভাই বলছে, দুপুরে খাবার পাঠালে সবার জন্যই পাঠাতে হবে। তুমি এক কাজ করো। সবার জন্যই খাবার পাঠাও। 

নীলা বলে, সেটা সম্ভব নয় বাবা। সুপ্রিয় নিষেধ করেন, তাহলে আর তুমি খাবার পাঠিও না। 


এর কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় নতুন উৎপাত। সুভাষের শ্বশুর, শাশুড়ি এসে সুপ্রিয় কে বলেন, বাড়িটা আপনি আপনার ছেলে বৌমার নামে লিখে দিন। এত বড় বাড়ি তো দরকার নেই ওদের, এ বাড়ি ওরা বিক্রি করে দেবে। টাকাটা ওদের ই থাকবে। আর আমার তো অনেক জমি রয়েছে। একটুকরো জমি আমার মেয়ে কে তো দেব আমি। সেখানে ই একটা ঘর তুলে নিয়ে ওরা থাকবে না হয় । 


  সুপ্রিয় বেয়াই এর কথায় রাজি হলেন না। তাতে ওদের আক্রোশ আরো বাড়ল। সুপ্রিয়র যেখানে যা টাকা ছিল সমস্ত ছেলের নামে লিখে দিতে হল , মানে দিতে বাধ্য হলেন। কারণ বেয়াই মশাই বলেছিলেন, হয় বাড়ি টা ওদের নামে লিখে দিন। আর নাহলে আপনার জামাই কে বলুন, আপনার ছেলেকে যেন মাসে মাসে কুড়ি হাজার টাকা করে যেন দেয়। এদের অবস্থা তো ভালো নয়। আর আপনার জামাই হাই স্কুলের টিচার। মোটা টাকা মাইনে পায়। এই টাকাটা সে দিতেই পারে। ভবিষ্যতে এই বাড়ি যখন বিক্রি হবে, তখন আপনার মেয়ে তো তার ভাগ ছেড়ে দেবে না ।সুতরাং তাকে তো কিছু দিতেই হবে। সে শুধুই নেবে, আর কিছুই দেবে না, এ তো হয় না। 


নীলার স্বামী দেবল সব শুনে বললেন, কিছুই ওরা করতে পারবে না। তুমি শুধু কখনো ওদের কোনও কাগজে সই করবে না। 


শেষ পর্যন্ত সুপ্রিয় কে ওরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চেষ্টা করল। নীলা তখন এখানে ছিল না। প্রতিবার পুজোর পরে ওরা বেড়াতে যায়। সেই সময়টায় ওরা কাজটা হাসিল করতে চেয়েছিল। পারেনি। অশান্তির সময়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান সুপ্রিয়। আর জ্ঞান ফেরেনি। এই ঘটনায় পাড়ার লোক চড়াও হয় বাড়ি তে। তাদের দাবি, অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে মানুষ টাকে। নীলা না এলে ওনার সৎকার হবে না। খবর পেয়েই ট্যূরের সব প্ল্যান বাতিল করে দেবল । তৎকালে ফিরতি ট্রেনের টিকিট কেটে ফেরার পথে রওনা দেয় । 


ট্রেনের দুলুনিতে কখন ঘুম এসে গিয়েছিল নীলার। হঠাৎ মনে হল, বাবা যেন বলছে, তাড়াতাড়ি আয় মা। তোর ভাই কে বাঁচা। ওর খুব বিপদ। তুই কিন্তু ওকে ক্ষমা করে দিস। আর তোর কাছে একটা জিনিস চাইব। দিবি তুই? নীলা বলে, কি বাবা? অস্পষ্ট হয়ে যেতে যেতে সুপ্রিয় বলেন, একটুখানি আগুন। 


ঘুম ভাঙতেই দেখে, সকাল হয়ে গেছে ।আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে ই হাওড়ায় ঢুকে পড়বে। 


বাড়ির সামনে পৌঁছে নীলা দেখল, অনেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেতর থেকে খুব চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। ভেতরে ঢুকে দেখে, সুভাষ আর নয়ন অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক লোক ঘিরে রেখেছে ওদের। একটা সময়ে বহু মানুষের উপকার করেছেন সুপ্রিয়। তাই অনেক মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন । সেই মানুষ কে নিজের ছেলের হাতে মারও খেতে হয়েছে। পাড়ার লোক কিছু বলতে এলে ওরা বলে দিত, আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাবেন না। এমনকি সুভাষ নীলাকেও শাসিয়েছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে জামাইবাবুর পেছনে লোক ফিট করে দেব, হাত পা ভেঙে ফেলে রেখে দেবে। তখন ভালো হবে তো। লজ্জায়, ঘেন্নায় একথা কারো সাথে শেয়ার করতে পারেনি নীলা। 


নীলাকে দেখেই সবাই হইচই শুরু করল, তোর বাবাকে ওরা মেরেই ফেলল দ্যাখ ।এবারে কি করবি! তুই একবার বল, তারপর ওর মজা দেখাচ্ছি। পুলিশের রুলের গুঁতো না খেলে বুঝবে না কি করেছে ও। নীলার কানে তখনও বাজছে স্বপ্নের ভেতরে বাবার বলা কথা গুলো, ওকে তুই বাঁচা। 


শান্ত স্বরে বলে ও, ভাই এর শাস্তি পরে হবে। বাবা কে আর আটকে রেখো না তোমরা। এবার বিদায় দাও। 

শ্বশানে এসে এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয় নীলা। তোমরা যদি সবাই অনুমোদন করো, তাহলে বাবার মুখাগ্নি আমি করব। সকলেই রাজি হল। ভাইয়ের সামনেই নীলা বাবার মুখাগ্নি করল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন চিতায় শায়িত সুপ্রিয় চৌধুরী কে ঘিরে। আর সেই চিতাগ্নি কে সাক্ষী রেখে শপথ নিল নীলা, আজ থেকে আমার ভাই এর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক রইলো না । কখনও তোমরা আমাকে আর তোমাদের পাশে পাবে না। এই বাড়িটা বিক্রি হতেও আমি দেব না। আমার বাবার বাড়ি, আমার বাবারই থাকবে।কখনও কোনো কাগজ তোমরা আমাকে দিয়ে সই করাতে চেষ্টাও করবে না। এতক্ষণ বাদে কান্নায় ভেঙে পড়ল নীলা। সকলেই নিশ্চুপ। দেখতে দেখতে ঘন্টাখানেক কেটে গেল। আগুন নিভে এসেছে প্রায়। সুপ্রিয় চৌধুরী বলে আর কেউ রইলো না। পড়ে রইল শুধু কয়েক মুঠো ছাই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy