পুরানো অ্যালবাম
পুরানো অ্যালবাম
জিনিয়া হঠাৎ করেই আমার জীবনে নিয়ে বেশি খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তবে ওনার কি মতলব জানি না! তবে ওনার এ বাড়িতে মাঝে মাঝেই আসায় বাবা মা একটু খুশী হয়, সেটা আমার ভালো লাগে। যদিও সবাই বলছে ওনি আমাকে পছন্দ করে , তাই মা বাবার উৎসাহটা আরো বেশি। তবে আমি আপনি থেকে "তুমিতে" নিয়ে যেতে পারি নি সম্পর্কটাকে।
আমাদের আলাপ একটা সাহিত্যের আড্ডা থেকে। উনি ভালো বাচিক শিল্পী। ছোট ছোট গল্প, কবিতা, দিয়ে কন্টেন ভিডিও বানায়। ও সব বিষয়ে আলোচনা করতে, আর বিভিন্ন গ্রামের থেকে আমার সংগ্রহের পুতুল , হাতের কাজ দেখাতে , দুই একদিন এসে এখন মা বাবার ভালো বন্ধু হয়েছেন। মাঝে মাঝেই এসেছেন বাড়িতে ।
আজ আবার আমার ভাই বৌ রূপাকে নিয়ে প্লান করেছে আমার পড়ার ঘরটা গোছাবে ওরা। ওনাকে বাঁধ দেবার উপায় নেই। কারণ আমি খুব অগোছালো। আমার কাছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পুতুল আছে।বেনীপুতুল ,গ্লাভস পাপেট, স্ট্রিং পাপেট বা সুতো পুতুল, রড বা স্টিক পাপেট কিংবা ডাঙের পুতুল।রাজস্থানের কাঠপুতলী , অন্ধপ্রদেশের কোন্ডাপল্লীর পুতুল থেকে জাপানি কাবুকি পুতুল। কিন্তু আগোছালো বলেই দেখাতে পারি না। তুলে ধরতে পারিনা, আমাদের জাতীর উজ্জ্বলতম শিল্পের নির্দশন গুলো হারিয়ে ফেলেছি আমরা একটু যত্নের অভাবে।
গোছাতে গোছাতে কলেজ লাইফের আমার তৈরী করা হারানো পুরানো অ্যালবামটা পেয়ে গেলো উনি।একটা অ্যালবাম মানেতো কিছু ছবি নয় , অনেক অনেক গল্প , স্মৃতি ভিড়। বিকালের চায়ের আড্ডা জমে গেলো সেই সব গল্প গুলো নিয়ে। কিন্তু শেষ ছবিটা চুপ করিয়ে দিলো সবাইকে।
অরিন্দম শীল এখন বিখ্যাত পরিচালক। সেইদিন যদিও ছিলেন ঘর থেকে পালিয়ে আসা জুনিয়র আর্টিস্ট। অভিনেতা হবার স্বপ্ন ছিলো ওর। আমার মা এ বাড়িতে থাকতে দিলো ওকে। ওর বাবা মা অবশ্য গোপনে ওর জন্য টাকা পয়সা পাঠাতো। নয়তো বাবা মা তো আমার ভাইকেই পড়াতে পারেন ইংরেজি মিডিয়ামে পয়সা অভাবে। আর অরিন্দম তো নায়ক হতে এসেছিলো এ শহরের। ওর জন্য দামি দামি পোশাক, শরীর চর্চা ও শরীর ঠিক রাখতে দামি দামি খাবার কি জোগান দিতে পারতাম না। তবে প্রথম দুই এক মাস আমার চালিয়ে ছিলাম বোধহয়। আর এক মাত্র বন্ধু ছিলো ও তাই আমার ভালোবাসার গল্পটা ও একমাত্র ওই জানতো।
মনে আছে আমার এক পূজাতে আমার পছন্দের জামা কিনে দিয়েছিল আমার বাবা মা। সে বছর বাবার আর জামা কেনা হয়নি। তাই জীবনের সব পরিস্থিতিতে নিজের চাওয়া পাওয়া ত্যাগ করতে শিখেছিলাম। তাই ভালবাসাটা আমার কাছে বিলাসীতা ছিলো। তবে তবু ভালোবাসা ছিলো। জামার কথা প্রথমে বললাম কেন ভালোবাসার গল্পঃ শুরুতো।জানেন পোশাক অনেক সময় অর্থনৈতিক পরিচয় বহন করে। আমি কলেজে পড়ুয়া তখন। একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ের ভালো লাগতো। স্কুল ইউনিফর্ম কোন পরিবারে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় বলে না। যাইহোক আমি ওকে দেখাতাম ওও আমাকে দেখতো। আমার দেখাটাও ওর যে ভালো লাগতো।তা বলে দিতো ওর হাসি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা হাসি। ওই একবার দুই হাসিটা দেখতেই আমি বাসস্ট্যান্ড দাঁড়িয়ে থাকতাম ওর জন্য।
একদিন ওর জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছি। সজল দাঁড়িয়ে আছে আমার সাথে। ও ওর কাউন্টার সিগারেট আমাকে ধরি বললো। "একটান দে মেয়েদের ইমপ্রেস করতে দেখিস না নায়করা কিভাবে সিগারেট খায়। "আমি সিগারেট প্রথম বার টানতে গিয়ে ভীষন ভাবে কাশতে শুরু করলাম। ওই প্রথম মেয়েটা মানে মনামী আমার কাছে এলো । সিগারেটটা ঠোটে থেকে নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে সজলকে দুইচারটে কথা শুনিয়ে দিলো। আর বুঝিয়ে দিলো। সিগারেট খেলেই মেয়েরা ইমপ্রেস হয় না। মেয়ে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই চায়না।
আমরা যখন কাউকে ভালোবেসে ফেলি তখন কিন্তু তার অর্থনৈতিক অবস্থার খোঁজ খবর রাখি না। আর মনামী যে বড়লোকের মেয়ে সেটা আমি কোনদিন বুঝতে পারি নি। জানতে পারলাম যখন ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। তবে আমি হয়তো ওকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু করে নি। কারণ ওর পাত্র ছিলো অরিন্দম। বিশ্বাস ঘাতক করেছে বললবো না। জীবন যুদ্ধে সফলতা অর্জন করা অনেকের কাছে শেষ কথা। ওর কাছে বন্ধুত্ব থেকে সফলতা অর্জন করাটা বড়ো ছিলো তাই হয়তো ওর জীবনে প্রথম ছবির পরিচালক তথা প্রযোজকের মেয়ে মনামীকে বিয়ে করেছিলো। তবে ওদের ভালোর জন্যই আমি শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম বছর তিনেকের জন্য। এখন ওদের খবর আর রাখি না।
কথাগুলো শোনার পর ,জিনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।" আমি আপানার মুখ থেকে জানতে চেয়েছিলাম দিদিয়াকে ছেড়ে হঠাৎ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটা কি। আপনি জানেন কি , দিদিয়া আর এ পৃথিবীতে নেই। অরিন্দম দা আপনাকে বিশ্বাসঘাতকতাই করছে। আপনি জানতে না আপানার সাথে অরিন্দমদার বন্ধুত্বের কথাটা দিদিয়া জানতো। তাই আপনাকে একটা খবর জানতে দিদিয়া বলেছিলো ওকে। ও সেই খবরটা মেসো মশাইকে জানিয়ে দেয়। এবং বদনামের হাত থেকে রক্ষা করার অজুহাত দেখিয়ে বিয়ে করে মহানুভব হয়ে মেসোর সব ব্যবসা দখলদারী করে। দিদি সব কিছুই বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারে নি কারণ আপনি আপনার বন্ধুর ভালো ভবিষ্যতের কথা ভেবে শহরে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।"
আমার চোখ জল ভরে যেতে। উনি আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন "এই চোখের জল বলে দেয় আপানার কোন দোষ ছিলো না। কিন্তু ভুল ছিলো। ভুল করলে তা সংশোধন করতে হয় হা হুতাশ করে লাভ হয় না।"
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম " এখন আর কি সংশোধন করবো ভুলের , সব তো শেষ..."
উনি বললেন " জীবনটা একটা ছোট গল্পের মতো শেষ ভাবলেও শেষ হয় না... দিদিয়া আপনার সন্তানকে জন্ম দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। ওকে আমি মানুষ করছি। তবে আমার মনে হলো ওর বাবার ভালো বাসা পাবার অধিকার আছে। মেসো মারা যাবার পর আরিদম দা বাবুয়ার ওপর খারাপ ব্যবহার টা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ওকে নিজের কাছে নিয়ে গেছি কিন্তু ও বারবার বলে, সবার বাবার ভালো ওর বাবা কেন এতো খাবার কেন? তাই আমি চাই ছিলাম ও ওর আসল বাবাকে ফিরে পাক।"
আমি বললাম" আচ্ছা বাবার ভালো বাসা পেলেই কি ওর সব পাওয়া হবে? আপনি পারবেন কি আমার পাশে সাথে থাকতে ওর মা হয়ে ? আমার ঘরটা নয় জীবনটাও গোছানার লোক চাই।"
,
