প্রতিশোধ-ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন
প্রতিশোধ-ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন
সকালে লিপির ফোন করার ধরনে বোঝাই যাচ্ছিল যে যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে আছে সে কোনো ব্যাপারে। তার কথা শোনা গেলেও সম্পুর্ণ বুঝতে পারেনি অদম্য যে, সে কি বলছে বা কাকে বলছে। কারণ লিপি কোনো কথাই স্পষ্ট ভাবে বলছিলো না। 'হবে তো, হতেই হবে, নইলে মুক্তি নেই, আর পারছিনা আমি, ভুলটা আমারই, মাকে মানা করতে পারিনি......' এই ধরনের কিছু শব্দই অদম্য শুনেছিল। তারপরই ছুটে গিয়ে ফোনটা কেড়ে নিতেই কলটা কেটে যায়। কল-লিস্ট চেক করে প্রথম যে আননোন নম্বরটা ডায়াল করলো সেটা ইনভালিড। পিছন ঘুরে কাঞ্চয়ালে এক থাপ্পর মেরে বলে, "কার সাথে কথা বলছিলিস বল। এখন আননোন নম্বর দেখিয়ে আমায় বোকা বানাচ্ছিশ"। লিপি এই অত্যাচারের কোনো প্রতিবাদ করেনি। কারণ সে জানে আদম্যর কাছে প্রতিবাদ করা বৃথা। তবে তার সন্দেহবাতিক স্বামীর স্বভাবে সে ক্লান্ত, রিক্ত, বিরক্ত। অদম্য নিজেই নিজেকে সংযত করেছিল তখন। লিপির হাত ধরে টেনে দার করিয়ে রেডী হয়ে থাকতে বলেছিলো। লিপিও রেডী হয়েই ছিল।
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় গাড়িটা হাইওয়ের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে কোন এক স্পূর্তিতে ছুটে যাচ্ছিল। দুটো ক্লান্ত অথচ ফুর্তিলা চোখে লিপি দেখছিল কিভাবে একটু একটু করে পশ্চিমের দিগন্ত রেখায় অস্ত যাচ্ছে সূর্যটা।
যতই তাড়াতাড়ি বেরোক, ফিরতে সেই রাত হয়ে গেলো। হঠাৎই সোয়া দশটা নাগাদ সরকারি ভাবে লকডাউন ঘোষণা করায় যানবাহন বিভ্রাট হয়। কাতারে কাতারে তখন শুধু লরির মেলা রাস্তায়। অবশ্য তাতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই কারণ তারা অদম্যর গাড়িতেই ফিরছিল। কিন্তু লরির ভিড়ে যথেষ্ট দেরি হচ্ছিল। আশ্চর্য রকমের জ্যাম। সেই জ্যামে গাড়িতে বসেই অদম্য গুগল ম্যাপে শর্টকাট খুঁজতে থাকলো। সেই দিকে মাঝে-মাঝে লিপিরও চোখ যাচ্ছিল। কিন্তু শর্টকাট খুঁজে পেয়েও সে খুশি হতে পারলোনা, কারণ সে পাশের সিটে দেখলো লিপি নিজের মোবাইল ফোন থেকে কাকে যেনো একটা সিম্বলিক টেক্সট মেসেজ করেই সেটা ডিলিট করে দিলো। তার মনে হলো তাকে লুকিয়ে লিপির এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার চলছে। যদিও সে জানে লিপি এমন মেয়েই নয়, তবুও তার এক শতাংশ হলেও সন্দেহ হয়। আসলে অদম্যর যে জিনিসটা ভালো লাগে সেটা সে অন্য কারোর সাথে ভাগ করা পছন্দ করেনা। কিন্তু লিপি যে চরিত্রহীনা নয় তার প্রমাণ সে বারবারই পেয়েছে। তবুও তার সন্দেহ এক বিন্দু কমেনি। "কাকে টেক্সট করলে" প্রশ্ন শুনেই লিপি ডানদিকে তাকালো। একজোড়া রক্তবর্ণ চোখ দেখে লিপি ড্যাশবোর্ডের উপর নিজের ফোনটা রেখে দিয়ে বলল, "কই কাউকে না তো"। অদম্য রাগী গলায় বললো, "আমি দেখেছি, বলো কাকে"। লিপি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে বললো, "শর্টকাট কিছু পেলে, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। কখন যে বাড়ি ফিরতে পারবো"। অদম্য কপাল কুঁচকে বললো, "আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে তুমি শান্তির ঘুম ঘুমোবে"। এই বলে লিপির ফোনটা সুইপ আপ করে প্রথমে সেন্ট আইটেম তারপর ইনবক্স চেক করে কোম্পানি মেসেজ ছাড়া কিছুই পেলনা। "বালের ফোন" বলে, ফোনটা ড্যাশবোর্ডের উপর ছুঁড়ে ফেললো। তারপরই গাড়িটা ঘুরিয়ে শর্টকাট ধরলো।
ধূ-ধূ অন্ধকারে শুধু দুটো আলো। গাড়ির সামনের লাইট দুটোকে দুর থেকে দেখলে আশ্চর্য একজোড়া চোখ ছাড়া কিছুই মনে হবে না। লিপি হাত বাড়িয়ে ড্যাশবোর্ডের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিজের মতো ব্যাস্ত হয়ে গেলো। মিউজিকের ভলিউম কমিয়ে অদম্য প্রশ্ন করলো, "এসব কি আবোল-তাবোল সার্চ করছো"। আবোল-তাবোলই বটে, কারণ লিপি যা সার্চ করছিল, সেগুলোর উইকিপিডিয়া ইমেজে দেখা যাচ্ছে শয়তানের লেজ আর ডনার মতোই মানব দেহের একজন পুরুষের গায় একজোড়া ডানা ও লেজ। কিছু ছবিতে বোধয় একজোড়া সিংও আছে, যেগুলো খাড়া উঠে পিছনের দিকে বেকে গেছে। লিপি বললো, "ইনকিউবাস"। অদম্য বললো, "হোয়াট ননসেন্স লিপি! সরকারি ভাবে লকডাউন ঘোষণার সাথে কি তোমার মাথারও লক-আউট হয়ে গেছে"। লিপি বললো, "ইনকিউবাস জানোনা? ডেভিলস চাইল্ড। মাইথোলজি অনুসারে ইনকিউবাস শয়তানের সন্তান। অনেক জায়গায় ইনকিউবাসকে শয়তান আর লিলিথের সন্তান বলা হয়। আবার অনেক জায়গায় স্যামুয়েল আর লিলিথের সন্তানও বলা হয়। এর নারী অনুকরণকে স্যাকিউবাস বলা হয়"। লিপি থামলে অদম্য বলে, "ভাগ্যিস উইকিপিডিয়াটা আবিষ্কার হয়েছিল লিপি, নইলে তোমার মত কিছু ইডিয়েট কিভাবে বাচতো বলতো। যত্তসব রাবিশ রিসার্চ"। কথাগুলো বলে জোরে হেসে উঠলো অদম্য, আর ঠিক তখনই কিজেনো একটা গাড়ির সামনে এসে পড়ল। অদম্য তাড়াতাড়ি ব্রেক কষলো। ছেলেটা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। লিপি একটা হাত অদম্যর হাতে রাখতে তার হুঁশ ফিরল। ও প্রশ্ন করল, "এক্সিডেন্ট করলে নাকি এ.ডি."। অদম্য নিজের ঠোঁটে একটা জিভ বুলিয়ে নিয়ে বললো, "কি বলছো, অ্যাকসিডেন্ট কীকরে হবে। এই ধূ-ধূ প্রান্তরে কোনো প্রাণের চিন্হ দেখতে পাচ্ছো। মানুষ তো দূর একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। এই জায়গায় কি কেউ থাকেনা লিপি। দূর-দূর অব্দি কোন বাড়িঘরও দেখা যাচ্ছে না, খালি ফাঁকা মাঠ"। লিপি উত্তর দেয়, "তুমি যেখানে আমিও সেখানে এ.ডি.। শহরের বাইরে এই নির্জন জায়গায় আমিও তোমার সাথে প্রথমবাড়ই"। অদম্য ব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলো, "তাহলে কেনো মনে হলো গাড়িটা কিছুতে ধাক্কা মেরেছে?" লিপি দেখতে পেল এসি গাড়িতে বসেও অদম্য কুলকুল করে ঘামছে। লিপি কিছু বলতে যাবে তার আগেই অদম্য গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। তাকে দেখে লিপিও বাঁদিকের দরজা খুলে বেরোলো। তাদের সামনে একটু দূরেই কি যেন একটা পড়ে আছে রাস্তার উপরে। অবয়বটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে সেটা একটা মানুষের। অদম্য সেটার দিকে এগোতে গেলে লিপি তাকে বারন করে, কিন্তু সে তো কথা শোনার ছেলে নয়, তাই পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে, দেহটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। তারপর একটু ঝুঁকে বোঝার চেষ্টা করলো শরীরটা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটার দিকে এক হাতে পিস্তল তাক করলো ও অপর হাতে শরীরটাকে চিৎ করলো। চিৎ করতেই গাড়ির ফ্রন্ট লাইটের আলোয় যেটুকু দেখতে পেলো তাতে সে বুঝলো শরীরটা একটা পুরুষের। সম্ভবত লোকটা কোনো সার্কাস কোম্পানিতে কাজ করে, নইলে জোকারের পোশাকে থাকতো না। অদম্য মনে মনে ভাবলো, 'কাজের শেষে ড্রেসটাও ছাড়েনি দেখছি, সবই ইমম্যাচিউর্ড ফেলো'। ততক্ষনে লিপি তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারও একটু-একটু ভয় লাগছে। সে অদম্যকে বলল, "কি করছো, আমার কিন্তু ভয় লাগছে। প্লীজ চলোনা এখান থেকে"। অদম্য উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফিরে ধমকের স্বরে বললো, "আরো দেখো ইনকিউবাস, সাকিউবাস, ডেমন। যত্তসব আনকালচার্ড লোকজন"। লিপি কিছুটা বিরক্তি মাখা স্বরে বলল, "আমি সেজন্য বলছিনা, হাইওয়ে ডাকাতির কথা নিশ্চয়ই শুনেছ"। অদম্য বললো, "ট্রাই টু টক উইথ সাম ম্যাচিউরিটি। এটা হাইওয়ে না সুতরাং তুমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বসো নইলে আরো কটা দাগ তোমার শরীরে পড়বে"। লিপি যেতে গিয়েও গেলোনা। অদম্য এবার তাকে কোপজি ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললো, "অবাদ্ধতা আমার ডিকশনারিতে নেই লিপি"। লিপির কোপজিতে আগে থেকেই অদম্যর অঙ্কিত চিহ্ন আছে। বেশি রাত অব্দি তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার জন্য গতকাল রাত্রেই অদম্য তার হাতে সেই চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। যদিও ঢাকা পোশাক পরার ফলে সেই চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ব্যাথাটা রয়েছে। আর অদম্যর অমানুষিক ভাবে চেপে ধরার ফলে ব্যাথাটা আরো একটু বেড়ে উঠেছে। তীব্র যন্ত্রণায় একফোঁটা জল গড়িয়ে গেলো লিপির চোখ দিয়ে। তারপরই সে বলে উঠলো, "ছাড়ো এ.ডি., কি করছো। আমার লাগছে তো। আর ইউ ইনসেন"। এই কথাতে অদম্যর মাথা আরও গরম হয়ে উঠলো। এমনিতেই তো কার না কার অ্যাক্সিডেন্ট করে বসে আছে। যতোসব পুলিশি ঝঞ্ঝাট, তারমধ্যে লিপির কথায় সে যেন রাগে জ্ঞানশুন্য হয়ে গেল। লিপির কব্জির ব্যথা জায়গাটায় আরো জোরে চাপ দিয়ে বলল, "আর বলবি ইনসেন"। কথাটা বলেই এক টানে বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘুড়িয়ে আনলো তাকে। তারপরই জোকারটার গায় এক ধাক্কা দিয়ে ফেললো এবং অতি কুশ্রী ভাষার উচ্চারণ করে বললো, "যা শুয়ে থাক ওর সাথে"। লিপি ছিটকে পড়লেও বিনা অদম্যর সাহায্যেই উঠে দাড়িয়ে পোশাক ঝেড়ে গাড়ির দিকে যেতে গেলো। তখনই অদম্য বললো, "যখন যেতে বললাম তখন নেকামি করলে, আর এখন নিজেই যাচ্ছ আমায় একা ফেলে। আমি কি এই ভিরান জায়গায় একা থাকবো নাকি"। কথাগুলো শুনে কান্না ভেজা মুখেও লিপির হাসি খেলে গেলো। সে বুঝলো অদম্য সত্যিই ভয় পেয়েছে। ফেশে যাওয়ার ভয়। অদম্যর দিকে এগিয়ে তার হাত ধরে তাকে সাথে যেতে বললো লিপি। অদম্যও বাধ্য ছেলের মতো তার সাথে এগোলো। মাঝে শুধু একবারই পিছন ফিরেছিল, তারপরই লিপির হাত ছেড়ে দৌড়ে গেলো সেই জায়গাটায় যেখানে জোকারটা অ্যাকসিডেন্ট করে পড়েছিল। আবার লিপির কাছে ছুটে গেলো। তার কাঁধ দুটো ধরে বললো, "গেলো কোথায় লোকটা? বেমালুম লাশ হয়ে তো পড়েছিল, এর মধ্যেই উধাও হয়ে গেল কীকরে। পুলিশে খবর দিতে গেলো নাকি। আমার জেল হয়ে যাবে লিপি, আমায় বাঁচাও প্লীজ। আমি আর তোমার গায় হাত তুলবো না। পাও তুলবো না, প্লীজ বাঁচাও। তুমি তো জানো আমি ইচ্ছা করে অ্যাকসিডেন্টটা করিনি। লোকটা এমন আচমকাই গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল তাই বুঝতে পারিনি"। লিপি খুব শান্ত স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো, "আমি তোমায় কতোবার মদ খেয়ে গাড়ি বারণ করেছি; করিনি বলো। তুমি আমার একটাও কথা শোনোনা। তুমি নিজে যেটা ঠিক মনে করো সেটাই করো। আর এখন এসব কথা বলছো"। ভীত কণ্ঠে অদম্য বললো, "কিন্তু এবার কি হবে আমার লিপি, ওই লোকটা তো পুলিশ নিয়ে আসবে। আর পুলিশ আমার কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে চলে যাবে। আমি জেলে যেতে চাইনা। প্লীজ সেভ মি লিপি"। লিপি প্রশ্নক্ত স্বরে বললো, "পুলিশ? মানে, কি বলছো তুমি? কোন লোক। আর কে পুলিশ ডাকতে গেছে। কি বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা"। অদম্য বললো, "আরে ওই জোকারটা লিপি। জার এই গাড়ির সামনে অ্যাকসিডেন্ট হলো"। লিপি কি একটা ভেবে বললো, "রলাক্স এ.ডি. এখন গাড়িতে বসো। আগে আমরা বাড়ি যাই তারপর বাকি কথা হবে। আমি ড্রাইভ করবো"। অদম্যউ লিপিকে ড্রাইভ করতে দিলো। নিজে গাড়ি চালানো তো দূরের কথা, গাড়ির চাবিতেই আর হাত দেয়নি।
ষোলোতে এয়ার কন্ডিশনারটা চলছে। অদম্যর যেনো আজ এত কম রুম টেম্পারেচারেও গরম লাগছে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আধো আলো আধো অন্ধকার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনে মনে জোকারের বডিটা কীকরে উধাও হয়ে গেল আপনা-আপনি সেটাই ভেবে চলেছে। হুশ ফিরল লিপির ডাকে। সে বলল, "তোমার হুইস্কি"। লিপির দিকে ফিরতে দেখে সে হুইস্কির গ্লাসটা তার দিকেই ধরে আছে। উঠে বসে গ্লাসটা নিয়ে বললো, "তোমার ড্রিংক কোথায়"। লিপি বললো, "আমি আর ড্রিঙ্কস করবো না। আই অ্যাম ফুল। অলরেডী দু-পেগ বিয়ার তো নিলাম আর কত"। অদম্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, "মাই ডিয়ার লিপি, কবে এই বিয়ার ত্যাগ করে একটু স্ট্যাটাসে উঠবে তুমি"। এই জার্নিতে লিপি যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল তাই তার আর অদম্যর কোনো বাজে কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। সে বিছানা ছেড়ে উঠতে গেলে অদম্য তার একটা হাত ধরে টেনে তাকে বসতে বলে। সে বলে, "তুমি আমাকে বাঁচবে তো লিপি?" লিপি প্রশ্ন করলো, "সেই তখনও এই কথাটাই বলেছিলে তুমি। কথা থেকে বাঁচানো তোমায়, আর কার থেকে বাঁচাবো। কি যে বলে যাচ্ছ সেই তখন থেকে কিছুই বুঝতে পারছিনা এ.ডি."। অদম্যর মেজাজ আবার বিগড়ে গেলো। সে বলে উঠলো, "এরকম বালের মতো বোকছো কেনো তুমি। জানোনা আমি কিসের কথা বলছি। কার থেকে বাঁচতে চাইছি"। লিপি বললো, "আমি সত্যিই তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছি না এ.ডি., প্লীজ একটু খুলে বলবে তোমার কি হয়েছে"। অদম্যর আরো রাগ হলো, সে বললো, "নেকামি করছো তো। দাড়াও তোমার অনেকদিন ওষুধ পড়েনি, মনে হয় ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে তোমার" বলেই রাত পোশাকের নিচে বক্ষবন্ধনীটা সরিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরলো লিপির বক্ষের নিচে। লিপির মুখ দিয়ে বেদনা দায়ক একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। এই শব্দগুলো লিপির মুখে শুনতে খুব উপভোগ করে অদম্য। যন্ত্রণায় লিপির মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছে না। অদম্য জানে যতই লিপির যন্ত্রণা হক সে তাকে বিছানায় টেনে নিলে, লিপি বারণ করবে না। রিসেপশনের রাত থেকে সেই একই ঘটনা তো ঘটে চলেছে রোজ। প্রথম রাতে অদম্য বেশ খুশিই হয়েছিল কারণ সংযমের ফলে লিপির রক্তপাত হয়েছিল। অক্ষত যোনির স্বাদ লিপি তার জন্যই ধরে রেখেছিল। তবুও লিপির উপর সন্দেহবাতিক ভাবটা তার রয়েই গেছে। হয়তো সেটা তার রূপের জন্য। লিপির সাথে বিছানায় একবার মেতে গেলে অদম্যর কেমন যেনো নেশা লেগে যায়। তার আর মেয়েটাকে ছাড়তেই ইচ্ছা করেনা। লিপিও তাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু আজ তিন মাস হয়ে গেছে তাদের বিয়ের, তাউ লিপি যৌনতায় তাকে সুখ দিলেও তার সাথে বিডিএসএমে কো-অপারেট করতে পারেনা। লিপিকে বিছানায় শোয়াতেই, আজ সে বারণ করলো। ক্লান্তি আর যন্ত্রণা এক সাথে হওয়ায় আজ তার মুড হচ্ছে না। সেকথা অদম্য জানতে পেরেই জিজ্ঞেস করলো, "তোমার কি প্রত্যেক মাসে রেগুলার হচ্ছে না?" লিপি পাল্টা প্রশ্ন করে বললো, "হটাৎ এই প্রশ্ন?" অদম্য বললো, "যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। রেগুলার হচ্ছে, হ্যাঁ কি না?" লিপি ওমনি বললো, "হচ্ছে। ফ্লো-টাও নরমাল"। অদম্য বললো, "তাহলে মুড সুইং হচ্ছে কেনো তোমার। আগে তো কখনো না-না করোনি"। লিপি কথা না বাড়িয়ে উঠতে গেলে, অদম্য তাকে বাধা দিয়ে বলল, "লে ডাউন"। লিপি বললো, "আমার ভালো লাগছে না এ.ডি., আমি সত্যিই খুব টায়ার্ড"। বলেই অদম্যর গলা জড়িয়ে তার কোলে উঠে বসলো। মুখোমুখি তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে। অদম্য মাঝে মাঝে লিপিকে বুঝে উঠতে পারেনা। তার এত যাতনা দেওয়া সত্ত্বেও মেয়েটা কিভাবে কোনো প্রতিবাদ না করে তার সাথে কো-অপারেট করে। এ ও কি সম্ভব? যেকোনো মানুষই তো একদিন না একদিন বার্স্ট আউট করে, কিন্তু লিপি কেনো করেনা। এই চিন্তা করতে করতে অদম্যর নেশা বেড়ে গেলো, হুইস্কির গ্লাসে নয় বরং লিপির চোখের তারায়।
আবার লিপির কথায় তার হুশ ফিরলো। সে বলল, "তুমি তখন কি যেনো বলছিলো? একটা লাশের কথা মোস্ট প্রবাবলি তাই না"। অদম্যর ঘাড়ের উপর লিপির সোজা করে রাখা হাত ধরে সে বললো, "তেমনটাই তো মনে হয়"। লিপি বললো, "আমার একবার মনে হয়েছিলো কোনো কিছুতে ধাক্কা মেরেছ। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই বুঝতে পারলাম যে আমি সম্পূর্ণ ভুল ভেবেছিলাম"। অদম্য আশ্চর্য হয়ে বললো, "ভুল ভেবেছিলে। সচক্ষে দেখেও ভুল ভেবেছিলে। তোমায় ওই জোকারের বডিটার উপরে ধাক্কা মেরেছিলাম। তুমি ওটার উপর পড়েছিল। তাহলে কি তুমি এখন বলবে সেগুলোউ ভুল ছিল"। লিপি বললো, "জোকার? মানে, জোকার কোথা থেকে এলো এ.ডি.? তুমি আমায় পিচের রাস্তার উপর ধাক্কা মেরেছিলে"। অদম্য এবার বিচলিত হয়ে উঠেছে। তার ঘাড়ের উপর থেকে লিপিকে হাত সরাতে বলে সে নিজেই তার হাত দুটো সরিয়ে দিল। লিপি এবার তার চোয়ালে হাত দিয়ে বললো, "কি হয়েছে তোমার? কেনো এরকম করছো এ.ডি.। দেখো আজ কিন্তু তুমিই কো-অপারেট করছো না। পরে এর জন্য আমায় দোষ দিতে পারবে না। আর তুমি যে হালুসিনেট করছো সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি"। অদম্য তার হাত দুটো আবার ধরে নিলো। কিন্তু কোথাও আঁচড়র দাগ খুঁজে পেলো না। যে দাগ গুলো তার চোখে পড়লো, সেইগুলো লিপিকে দেওয়া তারই ক্ষত চিন্হ। অদম্য ভেবে পেলো না, লিপি কেনো তাকে বলছে যে, সে কোনো জোকারকে দেখেনি। অদম্য আরো ভাবলো যে, সে যদি হালুসিনেট করেই থাকে তাহলে তো পিচের রাস্তায় পড়ার ফলে আঁচড়ের দাগ হওয়া উচিত ছিল লিপির হাতে।
ঠোঁটে একটা উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠলো অদম্য। লিপি তখনই তার ঠোঁটের উপর থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলো। অদম্য বললো, "আমিও টায়ার্ড লিপি, আজ থাক"। এইকথা শুনে লিপি তাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে দিলো। লিপি বিছানার এক পাশে সরে যেতেই অদম্য স্লিপারে পা-জোরা রাখলো। বিছানা থেকে নেমে আবার একটা সিগারেট ধরালো। তারপর বিছানার দিকে তাকাতেই অদম্য দেখলো, লিপি মোবাইল নিয়ে বসে আছে। ওর মনে হলো, 'মেয়েটা সেদিনের পর থেকে মোবাইল নিয়ে প্রয়োজনের থেকে বেশি বাড়াবাড়ি করছে। তেইশ বছর বয়সে এসে কচি হওয়ার সখ হয়েছে। সেই সেদিন বোনের সাথে সার্কাস দেখে আসর পর থেকেই কলেজে পড়া মেয়েদের মতো মোবাইল ফেটিশ হয়েছে'। কিন্তু এবার অদম্য তাকে আর কিছুই বললো না, বরং বেডরুম লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেলো। বাসিনে চোঁখ-মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল অদম্য। তখনই বাথরুমের লাইটটা দপ দপ করে অফ্ হয়ে গেলো। দেওয়াল হাতরে, বাথরুমের দরজাটা খুলে, ঘরে পা রাখল অদম্য। অভ্যাস মত বাথরুমের লাইটের সুইচে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো সেটা নিচের দিকে নামানো, অর্থাৎ সুইচ অন করা। সে মনে মনে নিজেকেই বললো, 'তার মানে লোডশেডিং হয়েছে'। কিন্তু লিপিকে ডাক দিতেই কোনো সাড়া পেলোনা। তারপর কিছুটা হুমকি মিশ্রিত স্বরে অদম্য ডেকে উঠল, তবুও বিছানার উপর থেকে লিপির কোন রকম সাড়া পাওয়া গেল না। ঘুটঘুটে অন্ধকার সারা ঘরে বিচরন করছে, ফলে অদম্য কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেওয়াল হাতড়ে বিছানার কাঠটা ধরলো, কিন্তু বিছানায় হাত বোলাতেই লিপির কোন স্পর্শ পেল না। আবার ডাকতে যাবে এমন সময় ঘরের ভেজানো দরজা খুলে হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে লিপি ঘরে ঢুকলো। মোমের আলোয় তার চেহারায় অর্ধেক আলো আর অর্ধেক অন্ধকার বিচরন করছে। মোমবাতিটাকে সে টেবিলের উপর রেখে খাটে উঠে বসলো অদম্যর পাশে। তারপর রাতের পোশাকটা খুলে অদম্যর কোলে উঠে তার মুখোমুখি বসলো। তার গলা জরাতেই, সে পুনরায় বিরক্ত জাহির করলো। সে বলল, "এসব কি হচ্ছে লিপি, একবার তো বারণ করলাম। আর ইউ টু হাই টুডে"। লিপি কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অদম্য আবার বললো, "তুমি বাইরে কখন গেলে? এইতো দেখলাম মোবাইল নিয়ে বসে ছিলে। কচি হওয়ার সখ হয়েছে নাকি?" লিপির কপালে ভাঁজ। সে জিজ্ঞেস করলো, "আরবলো না এ.ডি. বেডরুমে আসতেই গিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎই লোডশেডিং হয়ে গেলো। তাই একেবারে ক্যান্ডেলটা নিয়েই এলাম। অন্ধকারে কিছু দেখতেই পাচ্ছিলাম না। উপর থেকে ফ্লাস লাইট যে জ্বালাবো তারও উপায় নেই। মোবাইলটা সুইচ অফ হয়ে গেছে যে। আর কারেন্ট না এলে চার্জ দিতেও পারবো না"। এবার অদম্যর কপাল কুঁচকে গেল। সে জিজ্ঞেস করলো, "বেডরুমে আসতে গিয়েছিলে মনে? তুমি তো এখানেই ছিলে আমার সাথে"। লিপির মুখে চিন্তার রেখা দেখা গেল। সে বলল, "কই না তো, আমি তো ঘরেই আসিনি। কতক্ষণে আসব সেটাই ভাবছিলাম। তার মধ্যেই লোডশেডিং হয়ে গেল"। অদম্য মেজাজ দেখিয়ে বললো, "তাহলে কি আমি মিথ্যা কথা বলছি। তুমি ছিলেনা তো ওটা কে ছিল, তোমার ভূত"। লিপি তাকে কন্সুল করার চেষ্টা করে বললো, "এত রেগে যাচ্ছ কেন?" অদম্যর মেজাজ একটু কমলো না। সে সেইভাবেই বললো, "বেশি নেশা করে ফেলেছ নাকি। অতিরিক্ত বেশি পেগ মেরে দিয়েছো নাকি। তুমি ছিলে না তো কার সঙ্গে রোমান্স করছিলাম। তাছাড়া হুইস্কির গ্লাসটাও তো তুমি এগিয়ে দিয়েছিল। সব কি ভুলে গেলে নাকি এক মধ্যে। লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে কি তোমার মেমোরির ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে"। লিপি বুঝতে পারলো এবার অদম্যকে ঠান্ডা না করলে তার উপরেই অগ্নি বর্ষণ হতে পারে। তাই সে নিজের ঠোট দিয়ে অদম্যর ঠোট ছুটে গেল। কিন্তু অদম্য উল্টো একটা কান্ড করে বসলো। সে লিপিকে তার কোল থেকে নেমে যেতে বলল। যেটাতে লিপি তার দিকে একটা অবাক চাহনী দিয়ে নেমে গেল তার কোল থেকে।
এখন তারা মুখোমুখি বসে আছে। কিন্তু আজ অদম্যর একটুও মুড হচ্ছে না। কারণটা অবশ্য অদম্য থেকে ভালো করে লিপি জানে, কিন্তু মেয়েটা কিছু বলছে না। আজ হয়তো ওর মনে হচ্ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে। এই মাকড়সার জালের মতো বাঁধন থেকে আজ হয়তো সে মুক্তি পাবে। সত্যিতো মাকড়সার জালই বটে। মায়ের কথা মেয়ে ফেলতে পারেনি, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিন্ন জাতের প্রেমিককে ছেড়ে অদম্যকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে। গিয়েছিল। তবে তাতে সুখী হওয়া তো দূরের কথা, এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পায়নি সে। বিয়ের পর একদিনও সে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেনি। এমন ঘরোয়া মেয়ের এত উশৃঙ্খল জীবনযাপন পোষায় না। তবুও অদম্যর মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু বিয়ের কদিন পর থেকেই অদম্যর আচরণ ঘৃণ্য হতে শুরু করলো। নইলে কি আর এমন একটা নোংরা ব্যাবসায় স্ত্রীকে কে কেউ নামায়। প্রত্যেক উইকেন্ডে নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাকে খদ্দেরের কাছে দিয়ে আসে। অবশ্য অদম্য যা করে সবটাই ব্যাবসার লাভের জন্যে। আসলে যে মানুষটা নিজে নোংরা হয়, সে অন্যকেও তেমনটাই মনে করে। নইলে কি আর এত ভালো মেয়ে পেয়ে তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে। এসব কথা লিপি তার মা-কে বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাতে কোনো ল্যাব হয়নি। তিনি স্পষ্টই তাকে জানিয়েছিল স্বামীর ঘর ছাড়লে সে অন্যত্র কোথাও ঠাই পাবেনা। লিপির সেদিন একবারের জন্য মনে হয়েছিল স্যামুয়েলের সাথে বিয়ে হলে তাকে এভাবে এক্সপ্লইট হতে হতো না। কিন্তু সেটা যে কোনো ভাবে আর সম্ভব না সেটাও লিপি জানে। সে অদম্যর বাকদত্তা বলে নয় বরং তার মায়ের অপছন্দ বলে। তাছারা কোনো মা কেনো চাইবে তার মেয়ের একটা ভিন জাতি, পার টাইম সার্কাস ওয়ার্কারের সাথে বিয়ে করুক। তাই মাকে রাজি করাতে বিফল হয়ে স্যামুয়েলের সাথে সম্পর্ক কাটতে বাধ্য হয়েছিল। তবে মন থেকে তাকে সরাতে পারেনি বলেই সেদিন শোয়ের শেষে কৌতুক পোশাকে থাকা স্যামুয়েলের সাথে কথা বলেছিল। সেই কথা খুব বেশিক্ষন না চললেও তার বোন ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, তার দিদির পক্ষে পুরনো প্রেম ভোলাটা এখনও সম্ভব হয়নি।
অদম্যকে বিছানা থেকে নামতে দেখে লিপি জানতে চায় সে কোথায় যাচ্ছে। উত্তরে সে শুধুই বলে যে, সে ইনভার্টারটা অন করতে যাচ্ছে। এই বলে সে টেবিলের উপর রাখা মোমবাতিটা নিতে গেলো আর ঠিক তখনই মনে হলো কেউ যেনো তার ঘাড়ের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলছে। চোমকে উঠে পিছন ফিরতেই লিপিকে দেখে আর দেখেই চেচিয়ে ওঠে। "মেরে ফেলবে নাকি? এভাবে কেউ ভয় দেখায়?" লিপি কিছুটা তাজ্জব হয়ে বলে, "ভয় কেনো দেখতে যাবো, তুমি একা যাবে অন্ধকারে তাই ভাবলাম আমিও যাই। এবার তুমি না চাইলে আমি যাবো না"। কথা শেষ করে লিপি বিছানার দিকে এগোলো আর অদম্যর মনে হলো কেউ যেনো তার পিছন দিয়ে সরে গেলো। কিন্তু পিছন ফিরতেই আধো আলো আধো অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। এবার ভাবলো লিপিকে বলবে, পরক্ষনেই মনে হলো পুরুষ মানুষের ভিরুতা কোনো নারীর চোখে পড়লে সে আর কোনোদিনও তার আগের জায়গায় ফিরতে পারবে না। আর লিপির সামনে তো কখনোই দেখানো যাবে না যে, সে ভয় পেয়েছে। তাহলেই তাকে আর সম্মান, স্রধ্যা কিছুই করবে না লিপি। হয়তো তাকে আর মানবেই না। অবশ্য লিপির চোখে তার প্রতি যে ঘৃনা আছে সেটা তাকে লিপি কোনোদিনই বুঝতে দেয়নি। তাই জন্যেই বোধয় আজকের সুদিনটা মেয়েটার জীবনে আস্তে চলেছে।
মোমবাতিটা নিয়ে লিপির দিকে ফিরতেই অদম্যর মনে হলো খাটের ওপাশে একটা কালো ছায়া নিচু হয়ে গেল। এক্ষুনি খাটের নিচে তাকালেই তাকে দেখা যাবে। অদম্য মনে মনে ভাবলো চোর নয়তো। পরমুহূর্তেই রাগে মাথার চুল ছিরে নিতে ইচ্ছা করলো নিজের। লিপির একটা বাহু চেপে ধরে তাকে এক টান দিয়ে দার করলো। দাঁত চিবিয়ে বললো, "এসব নাটক করা বন্ধ করো। কি করছো বলো তো। বয়স কি দিন-দিন কমছে তোমার। বোকার মতো মোবাইল নিয়ে বসে আছো। কিছু দিন যাবত মোবাইলে খুব ইন্টারেস্ট হয়েছে দেখছি তোমার"। লিপি নিজেকে অদম্যর থেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে বললো, "তুমি যে মাঝে মাঝে কি করো, দেখে আমি অবাক হয়ে যাই"। অদম্য পাল্টা বললো, "আর তোমার মোবাইল ফোন নিয়ে যা বেস্ততা দেখছি তাতে তো আমি হতবাক"। অদম্যর হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর দ্বিতীয় বারের ব্যার্থ চেষ্টার পরে অদম্য বললো, "কি ব্যাপার বললে না তো। এত ইন্টারেস্ট মোবাইলের প্রতি কেনো। জিগোলো-টিগোলো ভাড়া করছো নাতো"। লিপি এবার আর নিজের বিরক্তি লুকালো না। সে বলল, "আসলে কি জানো তো এ.ডি., যে মানুষটা নিজে যেমন সে অন্যকেও তেমনটাই ভাবে। তুমি মানুষটা যে অত্যন্ত নোংরা, অত্যন্ত নিকৃষ্ট তাই অন্যকেও তুমি তেমনটাই ভাববে সেটাই তো কাম্য"। অদম্য তেরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। লিপির এলোমেলো চুলের গোছা ছাড়িয়ে দৃষ্টি পিছনে চলে গেলো তার। সেখানে একজোড়া রক্তিম চোখ জ্বলন্ত ভাটার মতো জ্বলছে। সেইদিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না অদম্য। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো সে। কিছুটা পিছিয়েও গেলো। এর ফলে খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকে অদম্যর পোশাকহীন পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। ঝুলন্ত পর্দাটাও সেই হাওয়ার তালে
তাল মেলাতেই এক অজানা ভয়ে অদম্যর হাত থেকে মোমবাতিটা পড়ে গেলো। আর সাথে সাথে আলোর শেষ বিন্দুটা নিভে গেলো। এবার লিপিই বলে উঠলো, "কি যে করো তুমি। আমার কাজ বাড়ালে শুধু শুধু"। অদম্যর কিন্তু কানে কোনো কথাই গেলো না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ভাটার মতো জ্বলন্ত চোখ দুটোর দিকে। লিপির যেনো অনুভবই হচ্ছে না তার পিছনের অবয়বের আবির্ভাবে। মোমের টুকরোগুলো কুড়িয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় অদম্যর মোবাইলটা বেজে উঠলো। কিন্তু তার সেই সম্মহনিত দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে ফোন রিসিভ করার ক্ষমতাটাও ততক্ষনে লোপ পেয়েছে। একজোড়া জ্বলন্ত ভাটা যেনো তার জ্ঞ্যান-বুদ্ধি লোপ পাইয়ে, চিন্তা-ভাবনার শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। অতএব তার ফোনটা লিপিই চেক করলো। স্ক্রীনে ইভার নামটা চোখে পড়তেই তার মনি-জোরা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। গল্ফ গ্রীনের একটা অ্যাপার্টমেন্ট-তো ইভার নামেই লিখে দিয়েছিল তার স্বামী। মাঝে-মাঝে যেতোউ সেখানে। লিপি সবটাই জানত, তবুও প্রতিবাদ করেনি কোনোদিন। দুজনকে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও দেখেছিল সে, তবুও কোনরকম স্পর্ধা দেখায়নি সে। বরং সে যাতে স্পর্ধার কোনরকম সাহস না পায় তাই অদম্য তাকে বিনা স্পর্ধায় স্পর্ধা দেখিয়ে যৌনব্যবসায় নামিয়েছিল। এতে ব্যাবসায় লাভও ছিলো, অদম্যর সাইড ইনকামও হচ্ছিল। এমন সময় বাঁদিকের বুক চেপে ধরে অদম্য মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার যে কার্ডিয়াক প্রবলেম আছে সেটা লিপি জানতো। ফলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সে ফোনটা রিসিভ না করেই টেবিলের উপর রেখে বেডরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর মেন পাওয়ার সুইচটা অন করে দিয়ে বেডরুমে ফিরে এলো। আলোয় এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জ্বলন্ত ভাট
ফাটা আসলে কিছুই না, জোকার পোশাকে লাল লেন্স পরে একটি পুরুষ অবয়ব। তার চোখের সামনেই লিপি পরিষ্কার করে দিল জায়গাটা। একবিন্দুও গোলিত মোম আর পরে রইলো না।
পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়নি লিপিকে, কারণ ডাক্তারের রিপোর্ট অনুযায় হৃদরোগটি অদম্য বন্সানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলেবেলাতেই পেয়েছিল। তাই তার মৃত্যু যে আতন্ত উত্তেজনারই ফলে হয়েছে, সে আর এমন অস্বাভাবিক কি। পুলিশ লিপিকে ক্লিন চিট দেওয়ার পরে সে তার মায়ের কাছে ফিরে যায়নি। অদম্যর বাড়িতেই থাকে। যদিও মেয়ে বিধবা হওয়ার পর তার মা চাইনি সে কোন বিজাতীয় পুরুষকে বিয়ে করুক, তাউ এইবার সে মেয়ের ভালোবাসাকে তার জীবন থেকে সরায়নি। সে নিজে বিয়েতে উপস্থিত না থাকলেও, দূর থেকে মেয়েকে আশির্বাদ করেছিল, যাতে সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখী জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু তার বোন আর তার প্রিয় ঠিকই উপস্থিত ছিলো দিদির দ্বিতীয়বারের বিয়েতে। যতোই হোক তাদের এই মিলনে তারও-তো কিছুটা ভূমিকা আছে।
রাত্রে নিজের বিছানার উপর আধশুয়া অবস্থায় একটা সাহিত্যের বই ঘাটছিল। হটাৎ ফোন রিং হতে মনটা সরে গেলো বইয়ের থেকে। স্ক্রিনে প্রিয়মের নাম দেখে রিসিভ করলো। মনে মনে ভাবলো দিদির সাথে যা হয়েছে মা আর আমার ব্যাপারে প্রেম্বিরোধি হবেনা। ফোন রাখতে ভোর চারটে দশ বাজলো। বইটা বন্ধ করতে গিয়ে যে পৃষ্ঠায় চোখ পড়লো, সেখানে অ্যডম, লিলিথ আর স্যামুয়েলসের ছবি ছিল। ছবির নীচে লেখা, 'লিলিথ ইজ সাইটেড অ্যস হ্যাভিং বিন ব্যানিশ্ড ফ্রম ডি গার্ডেন অফ ইডেন ফর নট কম্প্লাইন এন্ড ওবেইং অ্যডম'। এ কাহিনী অনেকের অজানা হলেও সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে লাবণ্য জানে। অ্যডমকে ছেড়ে ইডেন ছেড়ে চলে যেতেই তার স্যামুয়েলের সঙ্গে দেখা হয় এবং সে তাকে তার পর্যাপ্ত সম্মান দেয়। ইতিহাসের পাতায় লিলিথকে খারাপ দেখালেও আসলে সে তার অধিকার প্রাপ্তিটুকুই চেয়েছিল, যে সে অ্যডমের থেকে কোন অংশে কম নয়, বরং তাঁর সমকক্ষ। এই কাজে সে স্যামুয়েল তার সাহায্যসঙ্গী হয়েছিল। কিন্তু বিচারকই যেখানে নিরপেক্ষ নয় সেখানে বিচার আশা করাই বোকামি। অতএব স্যামুয়েলের সঙ্গেই লিলিথ ঘর বাঁধে। সেই ঘর লালসার বা অসমতার নয় বরং ভালোবাসার হয়। লাবণ্যর হঠৎ মনে হলো, 'দিদির নাম লিপি, স্যামুয়েল দা-র নাম স্যামুয়েল ম্যাথিউস আর ইডিয়ট টার নাম অদম্য। দিদিভাইয়ের হাফ লাইফ হেল করেছে। তার মানে লিপি অর্থাৎ লিলিথ, স্যামুয়েল দা স্যামুয়েলই আর ইডিয়ট-টা অ্যডম। নামের কি মিল। সত্যিই কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাহলে এইভাবেই কি অ্যডমদের থেকে প্রতি জন্মে লিলিথরা প্রতিশোধ নেয়, আর তাদের সহযোগিতা করে স্যামুয়েলরা'।