প্রতিবাদী হাসান
প্রতিবাদী হাসান
প্রতিদিন প্রভাতের মতো আজো চা-নাস্তা শেষ করে হাসান কাগজ কলম নিয়ে লেখার টেবিলে কি যেন লিখতে বসল। কিন্তু না, ও কিছুতেই লিখতে পারছে না, গতকাল রাতের ঘটনা তার চেতনায় অতি ক্ষিপ্র ভাবে বার বার কষাঘাত করতে লাগল। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ উত্তেজিত হয়ে উঠে হাসান। স্থির করে এর প্রতিবাদ করতেই হবে - তার মত উচ্চশিক্ষিত যুবক যদি এরকম সামাজিক ব্যধির প্রতিবাদ না করে তাহলে সমাজে নারী নির্যাতন বেড়েই চলবে।
হাসান এম.এ. পাশ করে স্বল্প বেতনে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করে, আরো দু-চারটে প্রাইভেট টিউশন আছে। সাকরির চাকরির জন্য অনেক এপ্লাই করেছে, ইন্টারভিউ দিয়েছে কিন্তু এখনো চাকরি জুটেনি। শিক্ষিত বেকারের খাতায় তার নাম থাকলে কী হবে, ওর প্রতিবাদী প্রবন্ধ গুলো ইতিমধ্যে এলাকার বিদগ্ধ মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফেসবুকেও তার জনপ্রিয়তা প্রচুর - দুইটি আইডি রয়েছে একটির "হাসান আহমেদ মজুমদার" অপরটি "প্রতিবাদী কলম" নামে। উভয় আইডির বন্ধুর সখ্যা অনেক আগেই পাঁচ হাজার পূর্ণ হয়েছে, ফলোয়ার ও প্রচুর। তার প্রতিবাদী প্রবন্ধ গুলো "প্রতিবাদী কলম" নামক আইডি থেকে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। অনেক সময় বিভিন্ন সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে ও প্রকাশিত হয়। সকল ধরণের সামাজিক ব্যাধি এবং সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সে লিখে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পাঞ্চায়েত নেতা, পুলিশ প্রশাসন, আমলা কেউ বাদ যান নি তার প্রতিবাদের কলম থেকে। শুধু লেখালেখিতে নয় প্র্যাকটিকেলে ও সে প্রতিবাদ করে, সামাজিক ব্যাধি নির্মূলের চেষ্টা করে। এলাকায় সে প্রতিবাদী হাসান নামেই পরিচিত। তাহার এই সামাজিক চেতনা বোধ আজো তাকে ঘরে বসতে দেয় নি। গতকাল রাতের ঘটনার প্রতিবাদে খাতা কলম রেখে ঘর থেকে ঝড়ের বেগে রওয়ানা হয় থানার উদ্দেশ্যে।
গতকাল রাতের ঘটনা এখনও তার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। গতকাল রাতে সে এলাকার প্রতিষ্টিত ব্যবসায়ী আহমেদ সাহেবের বাড়ী থেকে টিউশন করে ফিরছে, রাত সাড়ে নয়টা বাজে। গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। নির্জন পথ। তার বাড়ী পৌঁছার একটু আগেই মস্তাক মিয়ার বাড়ী। এই বাড়ীর পাশে আসা মাত্রই বাড়ী থেকে ভেসে আসা একজন নারীর আর্ত চিৎকার শুনে কাল বিলম্ব না করে দৌড়ে বাড়ীর ভিতর ঢুকল হাসান। দেখতে পেল মদ্যপ মস্তাক মিয়া তার স্ত্রীকে প্রহার করছেন। পাশের ঘরের তিন-চার মেয়ে লোক মস্তাক মিয়াকে আটকানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। মস্তাকের বৃদ্ধ, অসুস্থ মা নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে করে বলছেন "হারামের বাচ্চা বউকে মেরে ফেলল, কেউ ওকে বাঁচাও"। হাসান অনেক কষ্টে মস্তাকের হাত থেকে তার বউ সুমিকে রক্ষা করে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সুমি হাসানের সহপাঠী, উচ্চতর মাধ্যমিকে একসাথে পড়েছিল এর পর আর দেখা হয়নি। সুমির বিবাহ হাসানের গ্রামে হলেও হাসান এ বাড়িতে কোনো দিন আসেনি তাই দেখা হয়নি। দীর্ঘ আট বৎসর পর আজ দেখা হয়েছে। সুমি কাঁদছে এবং চিৎকার করে করে বলছে - "হাসান ভাই, আজ তোমার কারণে আমার প্রাণ রক্ষা হয়েছে। আমি এ হারামজাদার সাথে আর ঘর করতে চাই না, ভাত বাড়তে দেরি হওয়ায় আমাকে এত মার মারল। পুলিশে কেস করতে হবে, তুমি আমাকে সাহায্য করবে"। হাসান সুমিকে আশ্বস্ত করে বলল - "এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে, তুমি আজ এই ঘরেই শুয়ে পড়ো, কাল সকালে আমি পুলিশ নিয়ে আসব, তোমার ঔষধের ও ব্যবস্থা করব"। সুমি তার কথাতে সায় দিল। হাসান বাড়ী মুখে রওয়ানা হল।
বাড়ী পৌঁছতেই হাসানের বড় ভাই চিৎকার করে বললেন - "এত রাত কোথায় ছিলি? তোকে নিয়ে আর পারা গেল না।" হাসান নিশ্চুপ। বৌদি ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন - "এখন এসেছ? যাও রান্নাঘরে খাবার রাখা আছে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।"
সুমিকে দেওয়া কথা মতো হাসান থানায় গিয়ে বিস্তারিত ঘটনা বলে পুলিশকে সঙ্গে আসার অনুরোধ জানালো। পুলিশ প্রথমে আসতে রাজী না হলেও পরে অ.সি. সাহেব ভাবলেন - যদি হাসানের সঙ্গে না আসেন তবে আগামীকাল পত্রিকায় "পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতির জন্য দেশে নারী নির্যাতন বাড়ছে" শিরোনামে প্রবন্ধ বেরিয়ে পড়বে। তাই অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও অ.সি. সাহেব আরও চারজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হলেন মস্তাকের বাড়ীতে।
অ.সি. সাহেব মস্তাক মিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন - "গতরাত তোমার বাড়ীতে কী হয়েছিল?" মস্তাক বিস্ময়ের সুরে বললেন - "কই? আমার বাড়ীতে? না স্যার, আমার বাড়িতে কিছুই ঘটেনি।" অ.সি. সাহেব হাসানের দিকে থাকাতেই হাসান বলল - "স্যার, উনি মিথ্যা বলছেন, উনার স্ত্রী সুমিকে জিজ্ঞাসা করুন।" সুমিকে জিজ্ঞাসা করার পর সুমি হাসানের দিকে এক পলক থাকিয়ে মাটির দিকে চেয়ে দীর্ঘ ছয় বছরের অর্ধাঙ্গ মস্তাকের ভালোবাসাকে বুকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দিল - " না স্যার, গতকাল আমার বাড়ীতে কিছু হয়নি।" হাসান নির্বাক। অ.সি. সাহেব আদেশ করলেন - "মিস্টার দাস, পুলিশে ফলস্ ইনফরমেশন দেওয়ার অপরাধে ওকে গ্রেপতার করুন।" গ্রেপতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় হাসান পেছনে ফিরিয়ে আরেক বার সুমির দিকে তাকায়।