Md Zakir Hussain

Crime Others

4.7  

Md Zakir Hussain

Crime Others

যৌতুক

যৌতুক

4 mins
667


চিঠিটা হাতে পেয়ে রহিম মিয়া অত্যন্ত আনন্দিত।বিয়ের ১ মাস ১৫ দিনের মাথায় এই প্রথম চিঠি পাঠিয়েছে উনার সদ্য বিবাহিত আদরের বড়ো মেয়ে রুবিনা খাতুন ওরফে রুবি।

                    

       রুবি বিজয়পুর গ্রামের দিন মজুর রহিম মিয়ার মেয়ে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তারা পাঁচ বোন, ভাই নেই। অর্থাৎ রহিম মিয়ার পাঁচটি কন্যা, ছেলে সন্তান নেই। রুবি সবার বড়ো। দরিদ্রতার দায়ে ও পড়া শুনা বেশি করতে পারেনি, মাত্র নবম শ্রেণি পর্যন্ত। অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, সুশ্রী মেয়ে। ওর কোনো এফেয়ার্সও ছিল না। পরিবারিক এবং সামাজিক রীতিতে মাত্র ষোলো বছর বয়সে নিজ গ্রাম থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে সৈয়দপাড়া নামক একটা গ্রামের মৃত জব্বার আলীর ছেলে আবুল হুসেন ওরফে আবুর সাথে ওর বিয়ে হয়। আবু এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বাড়ির পাশের বাজারে একটা ছোট দোকান আছে তার। আবু ও তার ছোট ভাই মবু একই দোকানে থাকেন। তাদের বাবা মারা যাওয়ার তিন বৎসর হতে চলছে। ওরা দুই ভাই, মা এবং একটি ছোট বোন নিয়ে সুখের সংসার। এই সুখের সংসারের একজন সদস্য হয়ে আজ থেকে দেড় মাস আগে আগমন ঘটে রুবির। এই দেড় মাসের মধ্যে রুবি একবার নাইওর এসে তিন‌ দিন থেকে গিয়েছে। রহিম মিয়া ও মেয়ের বাড়িতে দু'বার গিয়েছেন, বেশ ভালোই চলছে। উনার শেষ যাওয়াটা আজ থেকে বিশ দিন পূর্বে। এর পর আর রুবির সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি, কারণ রহিম মিয়ার ঘরে কোনো মোবাইল নেই, রুবির ও ব্যক্তিগত কোনো মোবাইল নেই। অন্য কারো মোবাইল দিয়ে আবুর মোবাইলে ফোন করলেও সে ঘরে থাকেনা বলে রুবির সাথে কথা হয় না।

       

         ঐ দিন রুবির চিঠি পেয়ে আনন্দিত হয়ে উনার স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে ডেকে বললেন, দেখ আজ আমাদের রুবি চিঠি পাঠিয়েছে। ফাতেমা বলেন-- "ও তাই, একটু জোরে পড়ো-গো আমিও শুনব।" রহিম মিয়া পড়তে শুরু করলেন --- 

"প্রিয় বাবা, প্রথমে আমার সালাম গ্রহণ করবেন, মাকেও সালাম জানাবেন। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। জানো বাবা, বিয়ের প্রথম দিন রাতে আপনার জামাই আমার হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছেন সারা জীবন আমার পাশে থাকবেন, সুখে দুঃখে আমার সাথেই থাকবেন। শ্বাশুড়ি, ননদ, দেবর সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। সব মিলে অত্যন্ত সুখের সংসার ছিল। কিন্তু বাবা, তুমি না কি ওদের বলেছিলে যে এক মাস পরে যৌতুক দিবে? তাই যেদিন এক মাস হয়েছে সেদিন থেকেই শ্বাশুড়ি বিশ্রী ভাষায় আমাকে ও আপনাকে গালি দিচ্ছেন। আপনার জামাইকে বললে উনি বলেন--- যৌতুকটা দিয়ে দিলেইতো ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। বাবা, আজ শ্বাশুড়ি মা আমাকে যৌতুকের জন্য মেরেছেন, ননদ ও অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে। তুমি খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করো বাবা। ইতি--- আপনার আদরের রুবি।"

   

          চিঠিটা পড়ে রহিম মিয়া ও উনার স্ত্রী উভয়ই হতবাক। কী করবেন? উনিতো বলেন নি যে এক মাস পরে যৌতুক দিবেন, তা ওদের বলেছে ঘটক মশাই। কিন্তু তাতে কী? ঘটক মশাইর কোনো দোষ নেই, উনি ওরকম না বললে হয়তো বিয়েটা হতোই না। আজকাল কি যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয়? রহিম সাহেব চিঠি রেখে ভাবতে লাগলেন এবার কী করা যায়। উনার সম্পত্তি বলতে বাড়ির ভিটে ছাড়া মাত্র এক বিঘা জমি রয়েছে, চাষ হলে তিন মাসের ভাতের জায়গা। এটা বিক্রি করলে যৌতুক দেওয়া যাবে। কিন্তু এই একমাত্র জমিখণ্ড বিক্রী করে দেবেন? বিক্রি করে না হয় রুবিকে যৌতুক দিলেন, কিন্তু বাকি চারটা মেয়ে? এসব ভাবছেন, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেননা না।

        

         পাঁচ দিন পর, বিয়ের ১ মাস ২০ দিনের মাথায় রুবি আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে --- "বাবা, আপনি চিঠি পেয়েও কিছু করেন নি। জানো বাবা দিন‌‌ দিন আমার উপর অত্যাচার বেড়েই চলছে। কাল তোমার জামাই আমাকে মেরেছে। বাবা তুমি তাড়া তাড়ি কিছু একটা করো। ইতি --- তোমার রুবি।" চিঠিটা পড়ে রহিম মিয়ার চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসল। নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্ট বাবা বলে অনুভব করলেন। উনি আর স্থির থাকতে পারেননি, ঠিক করেন জমিটা বিক্রী করে যৌতুক দিবেন। তাই ঐ দিন রাতেই পাশের বাড়ীর প্রতিষ্টিত ব্যবসায়ী জুনেদ সাহেবকে সবিস্তারে ঘটনাটি বলে জমি বিক্রীর কথা বলেন। জুনেদ সাহেব এক সপ্তাহ পরে টাকা নিতে বলেন। রহিম মিয়া অপেক্ষায়। এক সপ্তাহ পরে টাকা এনে যৌতুক দিবেন। মেয়ের সংসার সুখের হবে। একথা জানিয়ে রহিম মিয়া রুবিকে একটা চিঠিও পাঠিয়েছেন কিন্তু সেটা আবুর কাছেই এসে পৌঁচেছে এবং সেটা খাম বন্দি হিসাবেই রয়ে গেছে। খুলেও দেখা হয়নি। রহিম মিয়ার চিঠি! আবু পড়ার প্রয়োজন মনে করেনি। রুবিকেও কিছু জানায় নি।

           

          আরো পাঁচ দিন পর, বিয়ের ১ মাস ২৫ দিনের মাথায় রুবির আরেকটি চিঠি --- "বাবা, আমি জানি তুমি কিছু করতে পারবে না, তোমার যৌতুক দেওয়ার মতো সামর্থ নেই। কিন্তু বাবা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আমাকে এখান নিয়ে যাও বাবা, নিয়ে যাও। নতুবা...........। ইতি।" রহিম মিয়া ভাবছেন এইতো আর তিন-চার দিন পরেই যৌতুক নিয়ে মেয়ের বাড়ি যাবেন। মেয়ে সুখের সংসার গড়বে।

           

         আজ রুবির বিয়ের দু'মাস পূর্ণ হয়েছে। জমি বিক্রির টাকা পেয়ে রহিম মিয়া গতকাল যৌতুক কিনে এনেছেন আজ এগুলো নিয়ে মেয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। যৌতুক পাওয়ার পর মেয়ে ও মেয়ের বাড়ির সকলের সন্তুষ্টজনক হাস্যোজ্জ্বল চেহারা কল্পনা করে উনি অত্যন্ত খুশি। নিজেকে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবাদের মধ্যে একজনকে বলে মনে করেছেন। রাস্তায় বাজার থেকে উনি মেয়ের জন্য কার্টন ভর্তি করে মিষ্টি-মিটাই কিনলেন। দুপুর প্রায় ১২ ঘটিকার সময় রহিম মিয়া যৌতুকের গাড়ি নিয়ে রুবির ঘরের উঠানে হাজির। যৌতুকের গাড়ি উঠানে রেখে উনি ঘরে ঢোকে রুবির শ্বাশুড়ির সাথে সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করেন--- "আমার রুবি কই?" "এইতো ওর রুমেই আছে।" ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন। রুবির রুমের দরজা বন্ধ। রহিম মিয়া --- "রুবি ও রুবি" বলে কয়েক বার ডাকলেন, কোনো সাড়া নেই। ধাক্কা মেরে দরজা খুলে দেখলেন--- ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে এক মরদেহ ঝুলছে। হ্যাঁ, ভালো করে চেয়ে দেখলেন, উহা উনার রুবির নিথর দেহ। "রুবিইইই! মা! দেখ, যৌতুক নিয়ে তোর বাবা এসেছি। দেখ মা, একবার চোখ খোল।" এই বলে রহিম মিয়া কাঁদতে শুরু করলেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime