রাখীর রাখী পূর্ণিমা
রাখীর রাখী পূর্ণিমা
গতকাল রাতে জেঠাতো বোন রূপা রঙ বেরঙের সুতোর সমাহারে একগুচ্ছ রাখী তৈরী করে রেখেছে। আজ রাখী পূর্ণিমায় ও তার দাদা বিশাল ও আদরের ছোট্ট ভাই দুলালের হাতে রাখী পরাবে। ওরাও তাকে গিফ্ট করবে, চকলেট মিষ্টি খাওয়াবে। কি আনন্দ আজ রূপার মনে! শুধু রূপা কেন? সকল ভাই-বোনের মনে আজ আনন্দের জোয়ার বইছে, ব্যতিক্রম শুধু রাখীর ক্ষেত্রে।
রূপার আনন্দ দেখে রাখী বলল --- "সত্যি, রূপা তুই বড় ভাগ্যবান, তোর দু'জন ভাই আছে। কি আনন্দ তোর মনে! আমার, আমার ........।" রাখী আরো কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারেনি, এখানেই থেমে গেলো। ওর দু'চোখ থেকে দু'ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। "কী বলতে চাস তুই? আমার ভাই কি তোর ভাই নয়? যা রাখী, তুই রাখী তৈরী কর। কাল আমারা দু'জন মিলেই আমাদের দুই ভাইকে রাখী পরাবো।"--- রূপা রাখীকে বলে। "হ্যাঁ, তাতো পরাবই। আসি!" বলে রাখী নিজের ঘরে চলে গেল।
রাখী ও রূপা সমবয়সী, ওরা একই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ওরা দু'জন কাজিন এবং খুব ভালো বান্ধবী। বিশাল রূপার বড় ভাই, সে কলেজে পড়ে আর দুলাল ছোট, ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। রাখী একা, ওর ভাই বোন নেই। তবে হ্যাঁ, রাখীর একটা জময ভাই ছিল। নাম ছিল গৌরব। নামে যেমন তেমনই ও রাখীদের পরিবারের গৌরব ছিল। খুবই সুন্দর চেহারা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল তার। আজ থেকে চার বৎসর পূর্বে এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই দিনের মাথায় মাত্র ১২ বছর বয়সে মারা যায় সে। ওর মা-বাবা আর কোনো সন্তান নেন নি। সেই থেকেই রাখী একা হয়ে গিয়েছে।
বিশাল ও দুলাল রাখীকে গৌরবের অনুপস্থিতি বুঝতে দিতে চান নি। ওরা দুজনই রাখীকে নিজের বোন রূপার মতই ভালোবাসে। ভাই বোনের কোনো অনুষ্টান রাখীকে রেখে ওরা করেনা। এরকম অনুষ্টানে রূপার সাথে রাখীকে অংশগ্রহণ করতেই হয়। রাখীর মা-কাকীমা ও তাকে ওদের সাথে অংশগ্রহণ করতে বলে। হ্যাঁ, রাখীও অংশগ্রহ করে তবে শুধুমাত্র সকলের কথা রাখার জন্য, মন থেকে নয়। আজও রাখী তার মা ও রূপার কথা রাখতে সে রঙিন সুতো দিয়ে রাখী বানিয়েছে জেঠাতো ভাই বিশাল ও দুলালকে পরাবে সেই সাথে গৌরবের ফটোফ্রেমে ও একটা রাখী পরিয়ে দিবে। হ্যাঁ ঠিক সময়ে দুই ভাইকে প্রথমে রূপা পরে রাখী রাখী পরিয়ে দিল। রাখী প্রতিবারের মতো এবারো বিশাল ও দুলালের হাতে রাখী পরিয়ে নিজ ঘরে এসে ঘরের দেওয়ালে ঝুলানো গৌরবের ফটোফ্রেমে একটা রঙিন রাখী ঝুলিয়ে দিল। গৌরবের ফটোতে রাখী ঝুলিয়ে দিয়ে --- "ভাই দেখ! তোর জন্য কী সুন্দর রাখী বানিয়েছি।" মনে মনে একথা বলে রাখী রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
বিছানায় শুয়ে রাখী ওর ভাই গৌরবের কথা ভাবতে থাকে। দু'জন যমজ ভাই-বোন ছিল। একই শ্রেণিতে পড়ত, এক সাথে খেলত। দু'জন কতই দুষ্টোমি আর ঝগড়া করত। তার মধ্যে দু'জনের মধ্যে কত যে ভালোবাসা ছিল। রাখীর মনে পড়ে অনেক বছর ধরে সে তার ভাই গৌরবের হাতে রাখী পরাতো। সে নিজে রাখী তৈরী করতে পারতোনা, মা তাকে তৈরী করে দিতেন সে পরাতো। গৌরবও তার জন্য চকলেট কিনে আনত। রাখী পূর্ণিমার দিনে গৌরবের উজ্জ্বল মুখখানা রাখীর সামনে ভাসতে থাকে। রাখীর মনে পড়ে আজ থেকে চার বছর পূর্বের গৌরবের জীবনের সর্বশেষ রাখী পূর্ণিমার দিনটা। ঐ দিন রাখী জীবনের প্রথমবার নিজের হাতে রাখী তৈরী করেছিল গৌরবের জন্য। ঐ রাখীটা গৌরবের মন মতো হয়নি বলে পুরো দিন রাখীর সাথে কথা বলেনি, রাখী প্রতিজ্ঞা করেছিল পরের বছর ভাইকে তার মনমতো রাখী তৈরী করে পরাবে কিন্তু বিধাতার বিধানে সে সৌভাগ্য আর রাখীর হয়নি। পরের বছরের রাখী পূর্ণিমা আর গৌরবের ভাগ্যে জুটেনি। আজ রাখী অনেক সুন্দর করে রাখী তৈরী করতে পারে কিন্তু গৌরবের সেই হাতটা আর নেই।
ভাইয়ের স্মৃতিতে কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাখী কবে যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ওর মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে রাখী চোখ খোলে দেখল সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে।
