স্বাধীনতার সুখ
স্বাধীনতার সুখ
"এই ছেলে, তোর নাম কী? তুই কেন প্রতিদিন এমন করোস?" --- একদিন আমি ৯-১০ বছরের এই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম যাকে আমি প্রতিদিন রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখি এবং যে প্রতিদিনই আমার সামনে এসে কাতর কণ্ঠে বলে --- "আমরা ক্ষুধার্ত বাবু। আমাকে একটু সাহায্য করুন।"
আমার বাড়ী যদিও একটি গ্রামে তবুও কর্মসূত্রে জেলার সদর শহর শিলচরেই বাস করি। এখানে অফিসের পাশেই একটি ঘরে ভাড়া থাকি। এই ভাড়াঘর থেকে অফিসটা খুব কাছে বললেই চলে। পায়ে হেঁটে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিট সময় লাগে। আমি প্রতিদিন পায়ে হেঁটেই অফিসে যাই। এই নতুন অফিসে জয়েন করার আমার এখনো একমাস হয়নি। এই দিনগুলিতে প্রায় প্রতিদিনই এই ছেলেটির সাথে আমার দেখা হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ওকে এক টাকা বা দু'টাকার এক দুটো কয়েন ও দেই। কোনো কোনো দিন "খুচরা নেই, সর আমার সামনে থেকে" বলে তাড়িয়েও দিই। আজ মেজাজটা এমনিতেই খারাপ। সকাল সকাল গিন্নীর সাথে একটু ঝামেলা হয়েছে। তার পর পথিমধ্যে এই ছেলেটা সামনে আসতেই মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আমি ঝাঝালো কণ্ঠে উপরোক্ত প্রশ্ন গুলো করলাম।
"আমার নাম শাহে সুলতান। আমি আর কী করবো বাবু? এ ছাড়া যে আমার উপায় নেই। আমার বাবা নেই। ঘরে অসুস্থ মা আর একটা ছোটো বোন রয়েছে। আমরা ক্ষুধার্ত বাবু, ভিক্ষা করে যে সামান্য পাই তাতে কিছুই হয় না।" --- কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে একদমে এতগুলো কথা বলার পর ছেলেটি থামল। অতঃপর তাহার ময়লাযুক্ত টি-শার্টের এক কোনা দিয়ে চোঁখের জল মুছে নিল।ছেলেটির পরিবারের অবস্থা বুঝতে পেরে আমার মনটা বিচলিত হল। তবুও আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম -- "মিথ্যে বলছিস না তো?" শুনেছি, বড়ো বড়ো শহরে নাকি কিছু বাবুদের অধীনে ভাড়াটিয়া ভিখারি ছেলে মেয়ে থাকে, এরা নাকি ভিক্ষা করে বিকেল বেলা বাবুর কাছে জমা করে, তাই বললাম। "মিথ্যা বলবো কেন বাবু, খেতে পেলে কি ভিক্ষা করতাম। আপনি একদিন আমার সাথে আমার ঘরে আসেন, দেখতে পারবেন আমাদের অবস্থা।" --- ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল। "হ্যাঁ, অবশ্যই যাবো।" --- বললাম। দেখলাম ছেলেটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। "সত্যি যাবেন বাবু? কবে যাবেন?" --- আনন্দিত হয়ে ও প্রশ্ন করল। "হ্যাঁ, যাব। এই রবিবারে।" আমি কোনো চিন্তা না করেই এই কথাটি বলে একটা পাঁচ টাকার কয়েন ছেলেটির হাতে দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
ঐ দিন পুরো দিনইৎআমি ছেলেটির কথাই ভাবতে থাকলাম। আহা! কী সুন্দর একটা নাম! "শাহে সুলতান" অর্থাৎ বাদশাহের বাদশাহ। কী দারুন নাম! অথচ ছেলেটি পথের ভিখারী। আচ্ছা ছেলেটি যা বলেছে তা কি সত্য? মনে মনে ভাবছি --- আমি যে ছেলেটিকে বললাম, সত্যি কি ওর বাড়ীতে যাওয়া উচিত? গিয়ে কী লাভ হবে? না গেলে কী যায় আসে? একটা ভিখারী ছেলেকে বলেছি। এসব ভাবতে ভাবতে সিন্ধান্তে পৌঁছলাম --- আমি একটা অফিসের বস আর এই ভিখারী ছেলেটির কথায় ওর বাড়ীতে যাব? না, আমি যাব না।
রবিবার ছুটির দিন তাই ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়। ঐ রবিবারেও ঘুম থেকে উঠে দেখলাম প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে না করতেই কে একজন ঘরের সদর দরজায় কড়া নাড়ল। বিরক্তি নিয়েই দরজাটা খুলতেই দেখি ঐ ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। "কী রে? তুই এখানে কেন?" উচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। "বাবু আজ রবিবার। আপনি বলছিলেন না রবিবারে আমার বাড়ী যাবেন। তাই নিতে আসলাম। রাস্তায় অনেক্ষণ অপেক্ষা করে আপনি বেরোচ্ছেন না তাই বাড়ীতেই ঢুকে পড়লাম।" ছেলেটি বলল। "আমি যাব না রে, আমার কাজ আছে। তুই যা, তোর কাজ কর।" -- একটা মিথ্যা কথা বলে ছেলেটিকে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করলাম। "পিলিজ এরকম করো না বাবু, আপনিই তো বললেল যাবেন। আমি মা'কে ও বলেছি আপনি আমাদের বাড়ী যাবেন। পিলিজ আসুন।" নাছোড়বান্দা ছেলেটির সাথে আর পারা গেল না। আমি একটা টি-শার্ট আর প্যান্ট পরে ছেলেটির সাথে রওয়ানা হলাম। এদিকে লক্ষ্য করলাম গিন্নী অত্যন্ত বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি এসব দেখেও না দেখার ভান করে "এই আমি আসছি" বলেই বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বেরিয়ে আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম --- "এই তোর বাড়ী কত দূর? হেঁটে যাওয়া যাবে না কি রিক্সা লাগবে?" "বেশি দূরে নয় বাবু, আমিতো প্রতিদিনই হেঁটে আসি। আপনিও হেঁটেই যেতে পারবেন।" --- ছেলেটি বলল। দুজন হাঁটতে শুরু করলাম, পুরো ৩৫ মিনিট হাঁটার পর এই শহরেরই চতুর্সীমার ভিতরেই একটি দূর্গন্ধময় গলির একপ্রান্তে বিরাট এক আবর্জনার স্তূপের কিনারে একই সারিতে চার-পাঁচটা কুঁড়ে ঘরের একটির সামনে গিয়ে ছেলেটি থামল। ছেলেটি ঘরে প্রবেশ করে আমাকে প্রবেশ করতে বলল। আমি ঘরে ঢুকলাম। যেমন ছেলেটি বলেছিল ঠিক তেমনই অবস্থা। খুব শোচনীয়। ওরা আমাকে বসতে বলল, জল খাবার খেয়ে আসতে বলল। ওদের সামর্থ অনুযায়ী হয়তো কিছুটা প্রস্তুত করেছে। কিন্তু আমি এই ঘরে টিকতে পারলাম না, দূর্গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলাম। ভাবছিলাম আসার সময় এতদূর আর হেঁটে আসব না, রিক্সায় আসব। কিন্তু এই সব মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে পায়ে হেঁটে কবে যে ঘরের সামনে এসে পৌঁছলাম তা নিজেরই অজানা।
এর পরেও ছেলেটিকে নিয়মিত রাস্তায় পাই। এখন আমি দু-এক টাকার কয়েনের পরিবর্তে পাঁচ-দশ টাকার নোট বা কয়েন দেই। এভাবেই চলছে। এর দু'মাস পর হঠাৎ করে ছেলেটি উদাও। রাস্তায় আর দেখা যাচ্ছেনা। মনে মনে অনেক খুঁজছি কিন্তু ছেলেটির কোনো খবর নেই। এর আরো একমাস পর আজ এক বন্ধুর সাথে একটা হোটেলে চা পান করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম এই ছেলেটিই এই হোটেলে ওয়েটারের কাজ করছে। ছেলেটি আমাকে দেখে চিনতে পারল। আমার সামনে এসে বলল --- "বাবু, আমি এখন এই হোটেলে কাজ করি।" "খুব ভালো। তোমাকে টাকা দেয়?" আমি বললাম। "হ্যাঁ, বাবু। আমাকে দু'বেলা খাবার দেয় হয় এবং মাসে ১৫০০/- টাকা দেয়।" "খুব ভালো।" -- আমি বললাম। কিন্তু দেখলাম ওর মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম --- "তোমার এই চাকরিটা পছন্দ নয়?" ও নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছু বলেনি। ওর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম তার এই চাকরিটা কোনোমতেই পছন্দ নয়। কারণ সে এখন পরাধীন। আগে ভিক্ষা করলেও সে স্বাধীন ছিল এখন তার সেই স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে।
