Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Classics

4.0  

Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Tragedy Classics

প্রথম দেখা মৃত্যু

প্রথম দেখা মৃত্যু

5 mins
11.9K



আমি চাঁদনী। চাঁদনী চ্যাটার্জী। হোস্টেলে থাকি।


ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষে হোস্টেল থেকে বাড়ীতে এসেছি। ডিসেম্বরের শেষের কনকনে ঠাণ্ডায় একদিন সকালে দাদু ডাক্তারখানায় গেলো রোগী দেখতে। রোগী দেখে দুপুরের আগে বাড়ীতে এসে আর কিছু খেতে চাইলো না। কোনোরকমে জামাকাপড় বদলে গিয়ে নিজের ঘরে শুতে গিয়ে দাদু ডাকলো। ছুটতে ছুটতে গেলাম দাদুর কাছে। আমার হাতে দাদু স্টেথোস্কোপটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, "দিদিভাই, পঞ্চুকে দিয়ে এসো এটা। রেখে আসতে ভুলে গেছি।" আমি দাদুর হাত থেকে স্টেথোস্কোপটা নিয়ে নিজের কানে লাগিয়ে নিজের বুকের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে শুনতে লাফাতে লাফাতে দাদুর ডাক্তারখানা ঘরে চলে গেলাম। গিয়ে কান থেকে স্টেথোস্কোপটা খুলে দাদুর কম্পাউন্ডার পঞ্চুকাকার হাতে দিয়ে আবার লাফাতে লাফাতে ফিরে এলাম বাতাবিলেবু গাছতলায় কেটে রাখা এক্কাদোক্কার ছকে। তারপর খেলতে শুরু করলাম আবার। সঙ্গীসাথী বলতে আমার থেকে দুবছরের বড়ো পিসতুতো দিদি রাণুদি, একবছরের ছোট পিসতুতো বোন মুন্না, আর আমাদের বাড়ীর রান্না পিসির মেয়ে বুড়ি।


যদিও শীতকাল ছিলো, তবুও অনেকক্ষণ ধরে রোদে লাফালাফি করার জন্য প্রথমে মায়ের, তারপরে ঠাম্মার, তার খানিক পরে জ্যেঠিমার বকুনি খেলাম। শেষমেশ সেজোপিসিমা কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে খাবার ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। বড়মা ওখানে বসে ছিলো উঁচু টুলটায়, ঘোষণা করলো, "যে যে দুপুরে ঘুমোবে না, সে সে আচার পাবে না। হাত তোল কে কে ঘুমোবি?" আমি বাদে সবাই হাত তুলে দিলো বেমালুম। এদিক ওদিক তাকালাম আমি। কী ভীষণ বিশ্বাসঘাতকতা! অথচ আগেই সবাই মিলে কথা হয়েছিলো যে দুপুরে বড়োরা ঘুমোলে আমরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরবো। আমার আসলে দুপুরে ঘুমোতে একদম ভালো লাগে না। হোস্টেলে কেউ কেউ ঘুমোয় ঠিকই রবিবার দুপুরে, কিন্তু আমি তাদের দলে নেই। আমি আর আমার প্রিয় বন্ধু শোভা আর আরো কয়েকজন মিলে আমরা দুপুরে খেলি... কখনো লুডো বা দাবা, আবার কখনো ম্যাপে জায়গা খুঁজে বের করা, বা ওয়ার্ড মেকিং, অথবা ছড়ার খেলা... সবাই রোটেশনালি এক লাইন করে ছড়া লিখে লিখে একটা মজার লিমেরিক তৈরি। নিদেনপক্ষে সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একটাই গল্পের বই পড়া, আর কে কত স্পিডে একেকটা পৃষ্ঠা শেষ করতে পারে তার কম্পিটিশন করা। এখন এদের এই আচারের লোভে ঘুমোতে যাওয়া দেখে মনে হলো এই কয়েকটা দিন কেন যে হোস্টেল বন্ধ থাকে... কে জানে! যাকগে মরুকগে, ঘুমোক ওরা... আমি ঠিক করলাম দাদুর ঘরের জানালার চওড়া ধাপিতে বসে গল্পের বই পড়বো। আমি আসলে জানতাম, আমি না ঘুমোলেও বড়মা লুকিয়ে হলেও আমার মুখে ঠিক একটুকরো আচারের আম গুঁজে দেবেই।



একটা গল্পের বই... আমার সর্বকালের প্রিয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "আরণ্যক"। ছোটকাকার বইয়ের আলমারি থেকে বইটা নিয়ে নিঃশব্দে গুটি গুটি পায়ে সন্তর্পণে গিয়ে দাদুর খাটের পাশের জানালাটার চওড়া ধাপিতে বসে পড়লাম। খুব আস্তে আওয়াজ না করে পাতা ওল্টাচ্ছি। দাদু কপালের ওপরে আড়াআড়ি হাত রেখে শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে মনে হয়। আওয়াজ না করলে বকবে না। পড়ছি... ডুবছি আরণ্যকের অরণ্যে। খুব যে বুঝতাম ঐ বয়সে তা নয়... কিন্তু বইটার লাইনে লাইনে আমি হারিয়ে যেতাম। মনে মনে ঘুরে বেড়াতাম লবটুলিয়া ফুলকিয়া নাড়া-বইহারের জঙ্গলে জঙ্গলে। ঝরনার জল খেতাম, বুনো ফল কুড়োতাম, ঘাস ফুলের গন্ধ শুঁকতাম, ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেতাম। আমার পাশেই যেন দাঁড়িয়ে আছে ধাতুরিয়া... ঘাড় ঘোরালেই আমি দেখতে পাবো। সবটাই মনে মনে। কী যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা ছিলো! সেদিনও ধাতুরিয়ার জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানার আওয়াজ পাচ্ছিলাম পড়তে পড়তে। আওয়াজটা ধীরেধীরে বাড়ছিলো। খুব হাঁফাচ্ছে আজ ধাতুরিয়া... হঠাৎ একটা খটকা লাগলো। ঐ নিঃশ্বাসের শব্দে একটা কোঁ-কোঁ শব্দ মিশছে না? বেশ জোরে জোরে। ঘরের মধ্যেই আওয়াজটা! দাদুর খাট থেকে! বইটা মুড়ে বন্ধ করে রেখে ঝুঁকে পড়লাম দাদুর মুখের ওপরে, "দাদু, ও দাদু, কী হয়েছে তোমার? ও দাদু..."! কোনো সাড়াশব্দ নেই... শুধু ঐ কোঁ-কোঁ করা ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া।



দাদুর ঘর থেকে লাফ দিয়ে ছুটলাম খাবার ঘরের দিকে। ঠাম্মা, মা, জ্যেঠিমা, বড়মা, পিসিমা... সব বড়োরা খেতে খেতে গল্প হাসাহাসি করছে। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে বড়মাকে ডাকলাম, "বড়মা, শিগগির চলো। দাদু কোঁ-কোঁ করছে খালি। ডাকলাম তাও সাড়া দিলো না।" বলেই আবার ছুটলাম দাদুর ঘরে। আমার পেছনে হুড়মুড় করে সবাই ছুটে চলে এসেছে দাদুর ঘরে... বাড়ী জুড়ে হৈহৈ হট্টগোল। পঞ্চুকাকার ডাক পড়লো... একঝলক দেখেই ছুটলো অভিলাষ কাকাকে ডাকতে। অভিলাষ কাকা দাদুর খুব প্রিয়... লোকাল হাসপাতালের ডাক্তার। বড়মা আর সেজো পিসিমা ছুটোছুটি করে পাড়ার কাকুদের ডেকে এনে পিসিমাদের, জ্যেঠু, বাবা, আর ছোটকাকাকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করলো পাঠিয়ে পাঠিয়ে। আমাদের ছোটদের মুখে কোনো কথা নেই। দাদুর পাশে গিয়ে আবার আমি ডাকলাম, "দাদু, ও দাদু, কী কষ্ট হচ্ছে?" দাদু ঐরকম কোঁ-কোঁ আওয়াজ করেই বললো, "প্রাণের পঅঅ..."! আমার কেন জানিনা মনে হলো দাদু ঐ গানটা শুনতে চাইছে। দাদু নিজেই শিখিয়েছিলো আমাকে গাইতে। আমার গলার কাছটায় ব্যথা করে উঠলো, তাও আমি গাইতে চেষ্টা করলাম... কিছুতেই সুরটা লাগছিলো না... গলা কাঁপছিলো খুব... ঐ ঠাণ্ডাতেও দাদুর কপালে বিনবিনে ঘাম। ঠাম্মা দাদুর পায়ে হাত বোলাচ্ছে। আমি দাদুর ডানহাতটা দুই হাতের মুঠিতে ধরে আছি, দাদুও আলতোভাবে ধরেছে আমার হাত, গাইলাম ধীরেধীরে...


"আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে

বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।

সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে--

ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।

সে চলে গেল, বলে গেল না-- 

সে কোথায় গেল ফিরে এল না।


সে যেতে যেতে চেয়ে গেল, কী যেন গেয়ে গেল--

তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে।

সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে, 

চাঁদের আলোর দেশে গেছে,

যেখান দিয়ে হেসে গেছে, 

হাসি তার রেখে গেছে রে--

মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।


আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।

সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর।

সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর।

কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল,

ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেল।

হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এলে রে--

কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে॥"


শেষ লাইনে পৌঁছতে না পৌঁছতেই আমার হাতে ধরা দাদুর হাতের আলতো চাপ আলগা হলো। দাদুর চোখে কী গভীর প্রশান্তির হাসি... কপালের বিনবিনে ঘাম গড়িয়ে এসেছে একপাশে। অভিলাষ কাকা এসে পৌঁছেছে কখন যেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অভিলাষ কাকা দাদুর হাতটা ভাঁজ করে দাদুর বুকের ওপরে রাখলো, আর দাদুর চোখদুটো হাতের পাতায় ছুঁইয়ে যত্ন করে বন্ধ করে দিলো অভিলাষ কাকা। ঠাম্মা দাদুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে নুইয়ে বসে আছে স্ট্যাচুর মতো। আর সেজোপিসিমা, জ্যেঠিমা আর মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি দাদুর বিছানা থেকে নেমে একপা দুপা করে গিয়ে বড়মার ঘরের কোণে লুকিয়ে বসে রইলাম। তারপর বাড়ীভর্তি লোকজন, অত হৈহৈ রৈরৈতেও আমি আর বেরোইনি বড়মার ঘর ছেড়ে। পিসিমারা, বাবা, জ্যেঠু, ছোটকাকা কাকিমা সবাই এসে পৌঁছতে পৌঁছতে পরেরদিন সকাল হয়ে গেলো। আমাকে কেউ ডাকেনি। বড়মা একবার আমাকে একগ্লাস দুধ খাইয়ে বাথরুমে ঘুরিয়ে গায়ে চাপা দিয়ে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। বড়মার ঘর থেকেই আমি হরিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম... এটা পরিচিত আওয়াজ। অনেকবার শুনেছি রাস্তাঘাটে। এর মানেটা আর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতটা জানি। সেই শব্দে আমার বুক ফেটে জোয়ারের জলের মতো কান্না বেরিয়ে এলো। দাদুর কথাগুলো মনে পড়লো। তিনদিন আগে "পথের পাঁচালী" পড়ে দুর্গার চলে যাওয়াটা ভালো লাগেনি বলাতে দাদু বলেছিলো, "মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য... মৃত্যু অবধারিত অনস্বীকার্য। তবে কেবলমাত্র শেষ বা কেবলই পরিসমাপ্তি কি? না... তা নয়। মৃত্যু আবার নবীন জীবনের সূচনা। মৃত্যু আসলে পরবর্তী প্রজন্মকে জায়গা ছেড়ে দেবার প্রক্রিয়ামাত্র।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract