STORYMIRROR

Manasi Ganguli

Tragedy Others

4  

Manasi Ganguli

Tragedy Others

প্রিয়বন্ধু

প্রিয়বন্ধু

5 mins
343

 

 প্রিয়বন্ধু 

   

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় "গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ"। তাই সবার বাগানে যেমন গোলাপ ফোটে না তেমনি সবার কপালে এই বিশেষ জাতের মানুষ অর্থাৎ বন্ধু জোটে না। যার জোটে সে ভাগ্যবান, কারণ একজন প্রকৃত বন্ধু তাকে ছাড়ে না কখনও সুখে, দুখে, শোকে। বন্ধুত্ব হল নির্মল একটি সম্পর্কের নাম, যার কাছে জীবনে অনেক কিছুই অকপটে মেলে ধরা যায়, যাকে বিশ্বাস করা যায়। এমন বন্ধুত্ব খুব কম মানুষই পায়।

    জীবনের বিভিন্ন বয়সে কত বন্ধু আসে যায়, আর যে থাকে চিরটিকাল হাতটি ধরে, প্রকৃত বন্ধু সে-ই। আমারও জীবনে এমন অনেক বন্ধু আসা যাওয়া করেছে, তাদের কেউ কেউ আজও তাদের জায়গা করে রেখেছে মনের মাঝে। কতদিন তাদের দেখি না, যোগাযোগ নেই, তবু তাদের কথা মনে আসে মাঝে মাঝে। ভালো লাগে, খুব ইচ্ছে হয় যোগাযোগ করতে, হয় না। তাই বর্তমানে যাদের পেয়েছি তাদের সঙ্গেই মজা করে কাটাই কিছু ভাললাগার ক্ষণ। বস্তুতঃ আমি খুবই বন্ধুবৎসল, আবেগপ্রবণ, হৃদয় দিয়েই চলি, আর তাই হয়ত আঘাতও পাই বারে বারে।

     কেজি থেকে ফোর অবধি একটা স্কুলে পড়ার পর বাবা যখন অন্য স্কুলে ভর্তি করলেন তখন কয়েকজনের জন্য খুব মন খারাপ হত, রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুমের মাঝে কেঁদেছিও কত।এরপর অন্য স্কুলে প্রথমে কারো সাথে ঠিক বন্ধুত্ব হচ্ছে না আস্তে আস্তে কয়েকজন হল। এভাবে ক্লাস নাইনে যখন শাড়ি পরে স্কুল যেতে হত পৌঁছালেই ছুটে আসত মুনমুন। ও খুব পরিপাটি করে শাড়ি পরতে পারতো এসেই আমাকে ঠিক করে পরিয়ে দিত শাড়ি। আগে বন্ধুত্ব তেমন ছিল না এভাবেই ও আমার মন জয় করে নিল। কী হলো জানি না, হঠাৎই মুনমুন মারা গেল। আমরা ক্লাসের সবাই শ্মশানে গিয়েছিলাম। সেই একবারই আমার শ্মশান যাওয়া আর এত কেঁদেছিলাম যে পরনের স্কার্টটা নাকের জল, চোখের জলে ভারী হয়ে গিয়েছিল। এখন লিখতে লিখতেও চোখ আমার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

     আবার আরেকজনের কথা না বললেই নয়, যাকে আমি প্রিয় বন্ধু ভাবতাম। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি করে এল, আগে থেকেই স্কুলে বন্ধু ছিল কিন্তু কাছাকাছি আশায় বন্ধুত্ব গভীর হল। আমি ওকে অনেকভাবে সাহায্য করতাম। ওর বাবা টিউশনের টাকা দিতে চাইতেন না। বাড়িতে নিজে পড়তে বলতেন, আমি বহুবার ওর টিউশনের টাকা দিয়ে দিয়েছি ও যখন পেরেছে শোধ করেছে। করবে কিনা তা নিয়ে আমার মাথাব্যথাও ছিল না, বন্ধুর জন্য দিয়েছি। একবার ওর পক্স হলে ও বাড়ীর উপরের ঘরে একা থাকত কেবল বোনেরা কেউ গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসত। আমি রোজ স্কুল থেকে ফিরে কী ক্লাস হল এসব খবর দিতাম, কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে গল্প করতাম যাতে ওর একা না লাগে। সেসময় ওর মাও ছোঁয়াচ লাগার ভয়ে ওর ঘরে বিশেষ যেতেন না। অসুস্থ হলে সংসার চলবে কী করে তাই। তবে রোজ যাওয়াতেও আমার কিছু হয়নি। তখন ক্লাস ইলেভেন, আমাদের তখন নাইন-টেন-ইলেভেনের পুরো সিলেবাসের ওপর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা হত। পরীক্ষার কিছু আগে রিভিশন করব বলে খাতা বার করতে গিয়ে দেখি উইতে সব ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। দেখেই কেঁদে ফেললাম। আমাদের তিনশ বছরের পুরনো বাড়ি, তখনকার মাটির গাঁথনি। একটা দেয়াল আলমারিতে আমার সমস্ত সাবজেক্টের তিন বছরের খাতা ভাগ ভাগ করে রাখা ছিল, যা আর পড়ার অবস্থায় নেই। কী আর করব, দুর্ভাগ্যকে মেনে নিলাম। সব সাবজেক্ট শুধু বই থেকেই পড়ব কিন্তু অঙ্ক খাতাগুলো ওর কাছে চেয়েছিলাম যদি পাল্টে পাল্টে দেয়। তিনবছরের পুরো সিলেবাস করে ফেলা তো তখন সম্ভব নয় তাই। সে বলেছিল,"আকাশের চাঁদ হাতে দিতে পারি, খাতা দিতে পারবো না"। সেদিন চিনেছিলাম বন্ধুকে। তবু ওকে ত্যাগ করিনি, মেনে নিয়েছিলাম।

     এরপর কলেজে গিয়ে পাঁচজনের একটা গ্রুপ হয়েছিল আমাদের। প্ল্যান করে এক রঙের শাড়ি পরা, কোনোদিন সবাই এক বিনুনী, কোনোদিন দুই বিনুনী বাঁধতাম চুলে। সবাই একরকম, ভাবতাম আমরা খুব বন্ধু। এবারও ভুল ভাঙলো। তখন প্রচন্ড ফ্যারেঞ্জাইটিসে কষ্ট পাই, ঢোক গিলতে পারি না, গরম জল মিশিয়ে জল খেতে হয়, সারাদিন কিছু খেতে পারি না। কলেজে আগে ঝালমুড়ি, ফুচকা, এটা ওটা খেতাম সবাই মিলে। তখন কিছু খাই না, কথা বলি কম কষ্ট হয় বলে। এক বন্ধুর বাড়ি ছিল কলেজের কাছে ও ভালো ভেবেই নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়ী। অনেক বারণ করা সত্বেও ওর মা আমার জন্য লুচি ভেজে দিয়েছিলেন। আমি তখন বাড়িতে ফেনা ভাত, গলানো সুজি এসব ছাড়া খেতে পারছি না। উনি বুঝলেন না আমার অসুবিধা। ওনাকে দোষ দেওয়া যায় না, মা তো, ভাবলেন আমার কষ্ট হচ্ছে খিদের জন্য। চেষ্টা করেছিলাম খেতে ওনার আন্তরিকতায়, কিন্তু পারিনি আমি। কোনোরকমে একটুকরো বহুক্ষণ মুখে রেখে গিলতেও গলায় লাগছিল। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। আমার সেই বন্ধুর কাছে এটা তার মায়ের অপমান মনে হয়েছিল। এরপর ও ইচ্ছাকৃত একদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল অপমানের শোধ তুলতে। বাড়ীতে কেউ এলেই মা কিছু খাবার দাবার দিতেন। ও সেটারই অপেক্ষা করছিল। আর মা খাবার দিয়ে যাবার কিছু পরই না খেয়ে উঠে গিয়েছিল। আমি সব বুঝতে পারলাম ওর সেদিন আসার উদ্দেশ্য, কিছু বলিনি। গলি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়েছিলাম। তারপর আর নিজেই ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখিনি। ও ও আর আমার ধারে কাছে আসতে পারেনি। সেটা ছিল কলেজের শেষের দিকে, তাই সে স্কোপও বিশেষ ছিল না। পরে বোধ হয় নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু আমি যে একবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি অমন বন্ধুত্ব থেকে তাই আর ফিরে তাকাইনি।

    ছোটবয়সে পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল, আমারই সমবয়সী সে। পড়াশোনা করত না, আর ওর সঙ্গেই আমি যখনই সুযোগ পেতাম গুলি খেলতাম। পরে বড় হয়ে ছেলেটি চুরি করতে শুরু করে এবং তার জন্য জেলও খাটে আর এই নিয়ে আমার ভাইবোনেরা আমার সাথে মজা করত খুব।

    তবে আমরা চার বোন খুব বন্ধু বরাবরই। একসাথে লুডো, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ছোটবেলায় গাদি, কবাডি খেলা। অন্যান্যরাও থাকতো সাথে যদিও। তার সঙ্গে ছিল হাসি, মশকরা, খুনসুটি, ঝগড়া, মারামারি, তর্ক। আর এগুলো বেশী ছিল আমার আর দিদির মধ্যে। আমরা দুজন পিঠোপিঠি, যখন স্কুলে ভর্তি হই ছোট বোনটি সবে জন্মিয়েছে। দিদি আর আমি একসাথে সেই আজন্মের সাথী। দিদি আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এন্ড গাইড, দিদি আমার মুশকিল আসান। মাত্র দু'বছরের বড় হয়েও আমার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরত আর আমিও অক্ষরে অক্ষরে ওকে অনুসরণ করতাম। একসঙ্গে স্কুল যাওয়া, একসঙ্গে এক জায়গায় টিউশন যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে একসাথে খেলা, এক ঘরে এক টেবিলে পড়তে বসা। স্কুলে কী হল, পরে কলেজে সারাদিন কী হল, দু'জন দু'জনকে না বলতে পারলে পেট ফুলে মরে যেতাম। সেইসব বলা হলে পড়া শুরু হত।তাছাড়া, রাত্রি দুটো আড়াইটা পর্যন্ত জেগে পুজোর আগে শাড়িতে ফল লাগানো, ততদিনে আরো দু'জনও বড় হয়ে উঠেছে। কত গল্প, কত মজা, সে ভারী খুশির দিন ছিল। এক এক করে বিয়ের পর সব ছিটকে গেলেও ফোনেই কাটত বোনেদের সঙ্গে বহু সময়। আর দিদির সঙ্গে তো কথাই নেই, শুরু হলে এক দেড় ঘণ্টা যে কোথা দিয়ে পেরিয়ে যেত! বন্ধু বিচ্ছেদ আমার কপালে, তাই সেই দিদিও বিনা নোটিশে, আজ থেকে ১৩ বছর আগে মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে এক রাতে শুয়ে সকালে আর উঠল না। আমার প্রিয় বন্ধু, আমার অভিভাবক, আমার গাইড চলে গেল আমায় ছেড়ে। এ ব্যথা প্রতি মুহূর্তে আমায় বাজে। এ বন্ধুবিয়োগ মেনে নিতে পারিনি আজও।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy