প্রেম ও শরীর
প্রেম ও শরীর
ওকে সবাই কালু বলেই ডাকে।অনেক বছর হল এখানে রয়েছে।রিক্সা চালায়।পরিশ্রমটা বেশি করে বলেই হয়তো শরীরে এতটুকু মেদ নেই।পেশিগুলোও হাড় থেকে ঝুলে পড়েছে।অথচ তার খুব বেশি বয়স না।পঁয়তাল্লিশ---এ আর এমন কী!
তার স্ত্রী মানু।পাঁচ ঘরে বাসন মাজে।শোনা যায় তাদের কোন সময় একটা সন্তান হয়েছিল।জন্মের সাথে সাথেই মারা যায়।তারপর আর হয়নি।একটা নারীর যা আকর্ষণীয়,মানুর মধ্যে তার একটাও নেই।রূপেও বিশ্রী।আর গায়ের রঙটাও কুচকুচে কালো।
সকাল হলেই স্বামী,স্ত্রী নিজেদের পেশায় বেরিয়ে পড়ে।সূর্যের আলো ঢলে পড়ার সাথে সাথে তারাও নিজেদের বাসায় ফিরে আসে।এক টুকরো টালির ঘর।বর্ষায় হয়তো ফাঁক বেয়ে জলও ঢোকে।তার সামনে অল্প মতো ফাঁকা জায়গা।সন্ধে হলেই মানু নড়বড়ে খাটুলীটা ছোট আঙনে বের করে রাখে।
জয়ীর প্রথমটাই ইচ্ছে ছিল না এই পাড়াতে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার।চারিদিকে গরীব লোকের বাস।ছোট-ছোট ঘর। তাদের মাঝে এই বিল্ডিংটাই একমাত্র অত উঁচু।আট তলা বিল্ডিং।তারা সাত তলায় থাকে।ফ্ল্যাট দেখতে এসে বড় ভাল লেগে গিয়েছিল।জানলা খুললে কোলকাতার অনেকটা জায়গা দেখতে পাওয়া যায়।এখানে ছাড়া-ছাড়া হাইরাইজগুলো।তাই হাওয়াও ঢোকে প্রচুর।সেই থেকে রয়ে গেল।জয়ী নিজে ব্যাঙ্কের সেল্স ম্যানেজার।আর স্বামী অরুনাভ মেডিসিন কম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে আছে।দুবছর হল বিয়ে হওয়া।এখনো বাচ্চা-কাচ্চা আসেনি।তারা ভেবেছিল,কিছুদিন এনজয় করবে।তারপর বাঁধন।তার আগে নয়।সেটা ওই বিয়ের এক বছরেই শেষ।এখন নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
জয়ী আজকাল সন্ধে ছটার মধ্যেয় ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে।তারপর যতটুকু পারে রান্না করে।আগে অভ্যেস ছিল না।এখন কিছু-কিছু পারে।অরুনাভ'র আসতে দেরী হয়।
ডালটা কুকারে বসিয়ে টিভিটা অন করে বসতেই একটা ডাক জয়ীর বুকে যেন টোকা দিল।ব্যস্ত পায়ে ছুটল জানলার কাছটায়।
"...কই গো রূপসী...
...কানা তোমার বাজায় বাঁশি।
ও...আমার সজনী প্রিয়া গো
আমি তোমায় ভালবাসি,তুমি আমার হিয়া গো।"
জয়ী রোজ দেখে।কানু রিক্সাটা স্ট্যান্ড করেই রাস্তা থেকে গান জুড়ে ঘরে ঢোকে।তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নিত্য-নতুন গানের কলি ধরে।প্রত্যেক কলিতেই প্রেম একেবারে উপচে পড়ে।মানু সে সবকে গা করে না! মাঝে একবার চা দিতে এসে ধমক দিয়ে বলে যায়,
"বলি তোমার পেটে মাল পড়লেই মানুর প্রতি প্রেম একেবারে উথলে পড়ে বুঝি?আশেপাশে ভদ্রলোকেরা বাস করে।সে কথা ভুলে যাও নাকি?রোজ,রোজ তোমার রসের গান শুনতে আমার ভাল লাগে না।চা টা খেয়ে চুপচাপ খাটুলীতে শুয়ে পড়ো।খাবার হলে ডাকব।"
কালু তার কথাকে আমল দেয় না। প্রেমের নেশায় তখন সে কেষ্ট হয়ে যায়।নড়বড়ে পায়ে অদ্ভূত ছন্দ তুলে মানুর একটা হাত ধরে আবার গেয়ে ওঠে,
"--রাগ করো না সজনী
ফুলফিতা দিব,
আমার যত সুখ দিয়ে
তুমার দুঃখ লিব গো.. তোমার দুঃখ লিব।"
মানুর ঠোঁট লাল হয়ে আসে।বুকের ভেতরটা আনন্দে মাতাল হয়ে যায়।তবু বলে ওঠে,
"মাতলামী আর কাকে বলে!আমি যাই।ছাড়ো তো।"
মানুর বুকটা প্রতি সন্ধ্যায় নতুন করে উদ্দীপিত হয়।আসলে সে যতই স্বামীর এ সকল জিনিসকে মাতলামী বলে গালাগাল দিক না,ঘোর তার মনেও লাগে---স্বামীর অকৃত্রিম ভালবাসার।অত আনন্দ তো শারীরীক চাহিদা পূরণেও নেই!
একটা ভাঙা ঘরের ছোট আঙনে জয়ী প্রতিদিন একটা সুখী দাম্পত্ত্য জীবনের জন্ম হতে দেখে।বড় ভাল লাগে তার।আর তখনই সে বড় বিষন্ন হয়ে পড়ে।তার ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে। প্রতিটি কোণায় অত রঙ!
অত স্বাচ্ছন্দ্য!....অথচ কোন প্রাণ নেই।খাওয়া-দাওয়ার পর অরুনাভও প্রতিদিন এক পেগ করে গলায় ঢালে।সে শুধু তার শরীরের চাহিদাটা বাড়ানোর জন্য।তারপর একটানা অনেকক্ষণ ধরে তার নরম শরীরটার উপর প্রতিশোধ তোলে।তাতে ভালবাসা কম মনের জ্বালাটাই জয়ী বেশি টের পায়।
একদিন জয়ী শখ করে অরুনাভের কাছে দাবী রেখেছিল এক কলি প্রেমের গান শোনার।অরুনাভ ইংলিশ গানের দুটো কলি আওড়েই শরীরী যুদ্ধে লেগে পড়েছিল।
জয়ীর একবিন্দুও ভাল লাগেনি।
-----সমাপ্ত-----