Sayantani Palmal

Classics

2  

Sayantani Palmal

Classics

প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত

11 mins
859


  " উফফ, আর পারছি না। আজ এত কাজের চাপ ছিল, ভীষন টায়ার্ড লাগছে।" ক্লান্তি ভরা কণ্ঠ হিমেলের। বালিশটা নিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়ে সে। দিয়া গালে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, " জানো, তোমাকে একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। লাস্ট উইকে নয়াপুর থেকে তোমার ঐ ধীমান কাকার ছেলে এসেছিল। তুমি তখন অফিস বেরিয়ে গেছ।"

"দীপ্ত এসেছিল! কেন?" অবাক হয় হিমেল।

" আরে টাকাপয়সা চাইতে।" তাচ্ছিল্য ভরে বলে দিয়া।

" কিসের টাকাপয়সা?" হিমেল জানতে চায়।

" ধীমান কাকার নাকি খুব অসুখ। ডাক্তার অনেক কস্টলি টেস্ট দিয়েছে। আরও কি কি সব বলে যাচ্ছিল আমার এত শোনার সময় ছিল না। অফিস বেরোবার তাড়া ছিল তখন।"

" তুমি টাকা দিয়েছ?"

" পাগল হয়েছ নাকি! এরকম জ্ঞাতিগুষ্টি সবাইকে হেল্প করতে হলে তো হয়েই গেছে। তাছাড়া ওখানে বাবার কাছে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে বলল। দাদাও নাকি আবার আলাদা করে একহাজার দিয়েছে। তাহলে কোন লজ্জায় আবার এখানে আমাদের কাছে চাইতে এসেছে কে জানে। আমি সটান বলে দিয়েছি আমাদের হাতে এখন টাকাপয়সা নেই। কিছু হবে না।"  

" আর ইউ ম্যাড! আমাকে কিছু জিগ্যেস না করে তুমি নিজে নিজে ডিসিশন নিয়ে নিলে! আবার আমাকে জানাচ্ছোও এতদিন পরে!" চিৎকার করে উঠলো হিমেল।

" কি অদ্ভুত এতে এত রিয়াক্ট করার কি আছে?" দিয়াও পাল্টা রেগে ওঠে। 

" তুমি , তুমি বুঝবে না।" হিমেল নিজের মাথার চুল খামচে ধরে।

" আমার বুঝে কাজ নেই। এদিকে বলছ ফ্ল্যাট, গাড়ী এসবের জন্য এত টাকা চলে যাচ্ছে প্রতি মাসে আর অন্যদিকে দান খয়রাতির শখ উঠছে। ওখানে বাবা-দাদা মিলে ছহাজার টাকা তো দিয়েছে। তুমি না দিলে কি হয়ে যাবে?" দিয়া ফুঁসে ওঠে। 

হিমেল আর কিছু বলে না। সত্যিই দিয়ার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। দিয়া উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়েছে। রাত গভীর হয়। দিয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু হিমেলের চোখে ঘুম আসে না। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় হিমেল। তারায় ভরা শান্ত রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণে একফোঁটা জল জমা হয় তার।


   " বাহ, তুই এসেছিস। আমরা ভাবলাম তুই ইস্কুল থেকে বেরোতেই পারবি না।"

" আরে টিফিনের সময় টুক করে চলে এসেছি। কেউ বুঝতেই পারবে না।" 

" সত্যি হিমেল আমাদের সাথে থেকে থেকে তোর উন্নতি হচ্ছে।" হিমেলের পিঠ চাপড়ে বলল মাধব। 

" চল চৌধুরীদের আমবাগানে।"

 ছয়জন ছেলের দলটা চলল চৌধুরীদের আমবাগানের উদ্দেশ্যে।

 নয়াপুর গ্রামের হেমন্ত রায়ের দুই ছেলে, হীরক আর হিমেল। তিন বছরের ছোট-বড় দুই ভাই। হেমন্ত বাবুর সার-বীজের ব্যবসা আর সেই সঙ্গে জমি জায়গায়ও অনেক। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার। হেমন্ত বাবু ছেলেদের কোনও কিছুর অভাব রাখেননি। নয়াপুর হাইস্কুল মাধ্যমিক পর্যন্ত তাই হীরক মাধ্যমিকের পর মামাবাড়ি চলে গেছে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ভীষন ভাব। হীরক যতদিন বাড়িতে ছিল হিমেল দাদার সঙ্গে সঙ্গেই থাকত কিন্তু হীরক মামাবাড়ি যাওয়ার পর থেকেই হিমেল যেন লাগাম ছাড়া ঘোড়া হয়ে গেল। তার বন্ধুবৃত্তটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে লাগলো। গ্রামের যত দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেদের সাথে তার ভাব জমে উঠলো। এইসমস্ত ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যত বাড়তে লাগলো পড়াশোনার সাথে তত দূরত্ব তৈরি হতে লাগলো হিমেলের। হেমন্তবাবু ব্যবসা আর চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হন আর হিমেলের মা সাদামাটা মানুষ সারাদিন সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা দুই ছেলের ওপরই ছিল তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। তাই হিমেল খুঁটি উপড়ানো বাছুরের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। স্কুল যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে আড্ডা দেয়। কখনও আবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে তার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে অপকর্মে যোগ দেয়।


  সেদিন চৌধুরীদের আমবাগান থেকে ফেরার সময় তালপুকুরের পাড় ধরে আসছিল হিমেল। গোপনে যাতায়াতের পক্ষে এই রাস্তাটা আদর্শ। তালপুকুরের পাড়ে নানাধরনের গাছের সমাবেশ। হঠাৎ মৃদু স্বরে কিছু কথোপকথন কর্ণগোচর হল হিমেলের। কৌতূহল বশত কথাবার্তার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে পূর্ব পাড়ের বটগাছটার নীচে আবিষ্কার করল ধীমানকাকা আর ঘোষ পাড়ার মিনুপিসিকে। হিমেলদের অনেক বড় জ্ঞাতি সেইসূত্রে ধীমান হিমেলের কাকা হয় সম্পর্কে। ধীমানকাকা আর মিনুপিসি দুটিতে হাত ধরাধরি করে আত্মমগ্ন হয়ে বসে আছে। ওদের দেখে হিমেলের মনে হলো যেন পদ্মপাতার ওপর দুটি শিশির বিন্দু টলমল করছে। সদ্য কিশোর হিমেল তখন বেশি কিছু না বুঝলেও নারী-পুরুষের চিরন্তন আকর্ষণ তার শরীরে-মনেও কড়া নাড়তে আরম্ভ করেছে তাই সে ওদের বিরক্ত না করে নিঃশব্দে ওখান থেকে সরে এল। তার তাড়াও ছিল স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। সব ছেলেরা বাড়ির পথ ধরেছে। তাকেও একই সময়ে বাড়ি ঢুকতে হবে। এই ভাবে বেশ চলছিল হিমেলের। মাধব, পচা, কার্তিক, লখু আর অতিন এই পাঁচজনের সাথে বেশ চলছিল তার নিষিদ্ধ অভিযান। কখনো আমবাগানে তো কখনও আবার ভাঙা মন্দিরের পেছনে চলত তাদের কর্মকাণ্ড। প্রথম ধোঁয়ার স্বাদ পেয়েছিল হিমেল এই ভাঙা মন্দিরের চাতালে। প্রথম টানটা অবশ্য সুখের হয়নি। কেশে-টেশে একসা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু নেশা বড় বিষম বস্তু জড়িয়ে ধরতে বেশি সময় নেয় না। এখন হিমেল অনায়াসে পরপর দুটো সিগারেট টেনে ফেলে। এইসব খরচাপাতির জন্য তাকে কোনও চিন্তা করতে হয় না। আজকাল তার খাতা-কলম একটু বেশিই লাগে। মায়ের কাছে টাকা থাকে পেতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। তারওপর মাঝেমাঝে আদরের ছোটছেলে মায়ের কাছে বায়না করে যে স্কুল থেকে ফেরার পথে রঘু ময়রার দোকানের লাড্ডু খেতে ইচ্ছে করে কিংবা কাঠি আইসক্রিম। ছেলের এসব আবদার ফেলবেন এমন মা সরমা নন তাই বড় আনন্দে আছে হিমেল। ইদানীং আবার তারা এক অন্য ফুর্তির সন্ধান পেয়েছে। লখুই খবরটা এনেছে। সুরেন দত্তর বাড়িটা গ্রামের একপ্রান্তে। চারিদিকে গাছ-পালায় ঘেরা মস্ত বাগান। বাগানের বেড়ার ধারে ছোট্ট একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর। বাড়ির লোকেরাই সেটা ব্যবহার করে। পুকুরের পরেই বেড়া আর বেড়ার ওপাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল মত। লখু একদিন ওই জঙ্গলে কুল পাড়তে গিয়ে দেখেছে সুরেন দত্তের ছেলে সুদেশের নতুন বউ প্রায় উদোম হয়ে পুকুরে চান করছে। গাছের আড়ালে থাকা লখুকে সে খেয়াল করেনি তাছাড়া সে বোধহয় ভাবেও নি যে ওই সাপখোপের আড্ডায় কেউ থাকতে পারে। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই লখু তার চক্ষু সার্থক করে। একদম নাকি সিনেমার দৃশ্যের মত। ফর্সা টুসটুসে বউটা নাকি বেলা সাড়ে বারোটা-একটার দিকে চান করে। হিমেল ছাড়া দলের বাকিদের বয়স বেশি। বার দুই-তিনেক করে ফেল করেছে সবকটা। লখুকে সবাই মিলে ধরেছে এমন মজা শুধু একলা নিলে হবে না তাদেরকেও সঙ্গী করতে হবে। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া হিমেলের শরীরেও বয়ঃসন্ধি সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করেছে। লখু যখন উত্তেজিত হয়ে বউটার মসৃন পিঠ আর ডাবের মত দুটো স্তনের বর্ণনা দেয় হিমেলের মনে হয় সে যেন কোনও রহস্য পুরীর গল্প শুনছে। শেষে একদিন ঠিক হলো স্কুলের নামে বেরিয়ে যাওয়া হবে নিষিদ্ধ অভিযানে। হিমেলের এই গল্পের মাঝে উপকাহিনী মত মাঝে মাঝে দেখা মেলে ধীমানকাকা আর মিনুপিসির। হিমেল বাড়ি ফেরার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথটাই বেছে নেয় আর সেই তালপুকুরের পাড়ের বটগাছটার নীচেই কপোত-কপোতির মত মাঝে মাঝে দেখা মেলে ওদের। নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর ওরা খেয়াল করতে পারে না হিমেলকে। সে অবশ্য নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে। কোনও দিন ওরা খুব নীচু স্বরে কথা বলে। কথাগুলো পরিস্কার শোনা না গেলেও হিমেলের কানে মৌমাছির গুঞ্জনের মত গুনগুন শোনায় আবার কোনও দিন হাতে-হাত রেখে দুজনে দুজনের চোখের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে যেন মনে হয় পৃথিবীতে ওরা ছাড়া আর কারুর অস্তিত্ব নেই। এইভাবে দুজনে দুজনের চোখের মাঝে অনন্তকাল ধরে হারিয়ে যাবে ওরা। একেকদিন আবার মিনুপিসি ধীমানকাকার কাঁধে মাথা রেখে ধীমান কাকার বাহুটা শক্ত করে ধরে তালপুকুরের জলে রোদের খেলা দেখে। দুপুর বেলা এদিকে জনপ্রাণীও আসে না তাই ওরা বেশ নিশ্চিন্তে থাকে। একদিন হিমেল লখুদের ওদের কথা বলতে কার্তিক বলল, " এত বহুত বাসী খবর। রায় পাড়ার ধীমান রায় আর ঘোষপাড়ার মেয়ে মিনুর মধ্যে আশনাই চলছে।"



   বউটা আস্তে আস্তে জলে নামছে। নিজেদের বাগানের মধ্যে পুকুর তায় আবার আশেপাশে বাড়িঘর নেই। ওদের বাড়িতেও মাত্র কটি প্রাণী। সুরেন দত্তরা স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-বৌমা আর সুরেন দত্তর বিধবা মা। দুপুরবেলা এই সময় আবার মেয়েরা ছাড়া বাড়িতে কেউ থাকে না তাই বউটা নির্দ্বিধায় গায়ের কাপড় সরিয়ে তেল, সাবান মাখে ভালো করে। আজও ঘাটের পাথরের ওপর বসে বউটা পোরোল জালি দিয়ে নিজের গলাটা ভালো করে ঘষছে। সাবানের ফেনার স্রোত তার গলা থেকে গড়িয়ে নেমে আসছে অর্ধ উন্মুক্ত বুকের ওপর। হিমেল হাঁ করে দেখছে। নিম্নাঙ্গে সিক্ত কাপড় জড়ানো অর্ধ নগ্ন নারী শরীর তার কিশোর মনে একটা ঘোরের সৃষ্টি করেছে। সে শুধু দেখেই চলছে একঢাল ভেজা চুল, কচি পাতার মত মুখ, উন্নত বক্ষ, নির্মেদ তলপেট কোমরের ভাঁজ…...। 

" আঃ।" প্রথমে পচার গলার আওয়াজ তারপর কার্তিকের। মুগ্ধতার আবেশ ছিন্ন করে হিমেল দেখল বিপদ আসন্ন। অসাবধানতাবশত মাধব একটা মৌচাকে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ফেলেছে ফলস্বরূপ এক ঝাঁক মৌমাছি ধেয়ে আসছে তাদের দিকে কিন্তু তারা যেটা খেয়াল করেনি সেটা হলো এর চেয়েও বড় বিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো। সেদিন সুরেন দত্তরা স্বামী-স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। সুদেশ তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে এসে ঠাকুমার কাছে যখন শোনে বউ পুকুরঘাটে তখন নতুন বউয়ের সাথে স্নান করার লোভে সেও পুকুরঘাটে হাজির হয়েছে। মৌমাছির কামড়ের জ্বালায় হিমেলরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ। সুদেশের বউ তাদের দেখতে পেলেও চিনতে পারত না কিন্তু সুদেশের কাছে তারা কেউ অচেনা নয় তারওপর সে ওদের আওয়াজ শুনতে পেয়ে বেড়ার ধারে ছুটে এসেছে। তার যা বোঝার সে বুঝে ফেলেছে।



  খামারের খড়গাদার আড়ালটা সিগারেট খাওয়ার জন্য বেশ আদর্শ। হিমেলের সুখটান ছিন্ন হলো একটা গলার ডাকে," হিমেল।" হিমেল চমকে দেখে সামনে ধীমান কাকা। ধীমান কাকা চিরকালই শান্ত প্রকৃতির। হিমেল কোনও দিন উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি তাকে। হাতের সিগারেটটা পেছন দিকে লুকবার ব্যর্থ প্রয়াস করে হিমেল বলে, " কিছু বলবে?"

" তুই সিগারেট খাচ্ছিস?" হিমেল একথার কোনও জবাব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। ধীমান কাকা আবার প্রশ্ন করে," তুই সেদিন দত্তদের বাগান ধারের জঙ্গলে কার্তিকদের সাথে ছিলি?" হিমেল একথারও কোনও জবাব দেয় না। ধীমান কাকা তখন ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, " দ্যাখ, হিমেল। তুই রায় বংশের ছেলে। আমাদের বংশের একটা সম্মান আছে। আশেপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষ আমাদের সম্মান করে তুই কি করে গ্রামের সবচেয়ে বাজে ছেলেগুলোর সাথে মিশে এমন একটা কান্ড ঘটালি! সুদেশ আমার বন্ধু ও যখন এসে আমাকে তোর কথা বলল আমি বিশ্বাস করতে পারি নি কিন্তু একটু খোঁজখবর করতেই তোর সম্বন্ধে যা সব শুনলাম আমার মাথা ঘুরে গেল আর সেগুলো যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ তো নিজের চোখেই দেখলাম। নতুন বউ তাই সুদেশ ব্যাপারটা নিয়ে হল্লা করেনি কিন্তু ও যদি আর পাঁচজনকে বলত তাহলে তোর বাবার সম্মানটা কোথায় থাকতো ভেবে দেখেছিস? হিমেল ভালো কথা বলছি বাবা এই দুষ্ট সঙ্গ তুই ত্যাগ কর নাহলে শেষ হয়ে যাবি। আমি তোর বাবাকে কিছু বলছি না এখন তুই শুধরে যা।" হিমেল ফস করে বলে বসলো, " তুমি যে মিনুপিসির সঙ্গে তালপুকুরের পাড়ে বসে থাকো তার বেলা?" চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ধীমান কাকা মৃদু হেসে বলল," বয়সটা একটু বাড়ুক স্বর্গ আর নরকের তফাৎটা নিজেই বুঝতে পারবি।"

ধীমান কাকা অল্প কথার মানুষ আর কিছু না বলে চলে গেল বলাই বাহুল্য হিমেল তার কথাগুলো এককান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিল। কয়েকদিন পর ধীমানকাকা আবার হিমেলকে সাবধান করলেন কিন্তু বিপথে যে একবার গেছে সহজে যে সে পথে আসতে চায় না। বারবার বিফল হয়ে ধীমান কাকা শেষে বাধ্য হয়ে সবকথা হিমেলের বাবাকে জানালো। হিমেলের বাবা স্কুলে এবং গ্রামে খোঁজখবর নিয়ে ছেলের বর্তমান স্বরূপ জেনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রাগে অগ্নিশর্মা হেমন্তবাবুর বেতের লাঠি আছড়ে পড়লো হিমেলের পিঠে শুধু তাই নয় তার প্রতিটি পদক্ষেপে নজরদারী শুরু হলো। স্কুল যাতায়াত বাদ দিলে হিমেল একপ্রকার গৃহবন্দী হয়ে পড়ল। নিজের এই অবস্থার জন্য সে সর্বত ভাবে দায়ী করল ধীমানকে। ক্রোধান্ধ হিমেল প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজতে লাগলো। হিমেলদের বাড়ি পেরিয়ে ধীমানদের বাড়ি। একদিন দুপুরবেলা হিমেল স্কুল থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকতে যাবে এমন সময় পিয়ন এসে জিগ্যেস করল, " ধীমান রায়ের বাড়ি কোনটা?" পিয়ন ছেলেটির বাড়ি দূরে কোথাও। নতুন চাকরি তাই এগ্রামের সবকিছু এখনও চিনে উঠতে পারে নি। নয়াপুর গ্রামটাও বিশাল। হিমেল এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। অম্লান বদনে বলল, " আমি ওনার ভাইপো হই। উনি তো বাড়ি নেই আমাকে দিয়ে দিন চিঠিটা।" সরল বিশ্বাসে পিয়ন ছেলেটি পোস্টকার্ডটা হিমেলকে দিয়ে দিল। নিজের অজান্তেই সে একটা মানুষকে সারাজীবনের জন্য নিঃস্ব করে দিল। পোস্টকার্ডটা পাঠিয়েছিলেন ধীমানের মেসোমশাই। উনি ওনাদের গ্রামের স্কুলে ধীমানের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। পত্রপাঠ ধীমানকে তার বাবাকে নিয়ে সেখানে যেতে বলেছেন। তখনকার দিনে ম্যানেজিং কমিটিকে ধরে এইভাবে স্কুলে চাকরি হত। দেরী হলে সমস্যা হতে পারে একথাও লেখা ছিল চিঠিতে। হিমেলের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে যায়। চারপাশে কেউ নেই। পোস্টকার্ডটা কুচি কুচি হয়ে হারিয়ে যায়। সেযুগে এত ফোনের ছড়াছড়ি ছিল না বিশেষ করে গ্রামের দিকে সেকারণে ধীমানের সেই চাকরি আর হয়নি। সে সময় মত না পৌঁছনোয় অন্য একজনের ভাগ্য খুলে যায়। ভাগ্য ভালো হিমেলের সেই পিয়ন ভালো চাকরি পেয়ে নয়াপুর ছেড়ে চলে যায় অল্পদিনের মধ্যেই ফলে হিমেলের অপকর্মের কোনও সাক্ষী থাকে না।এরপর ধীমানের জীবনে আরেক দুর্যোগ নেমে আসে। মিনুর বিয়ে ঠিক হয়ে যায় এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। বাবা-মায়ের ফিসফাস আলোচনা থেকে হিমেল এটুকু বুঝতে পারে মিনুপিসি বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না কিন্তু তার বাবা চাকরি করা ছেলে ছেড়ে দিয়ে ধীমান কাকার মত বেকারের সাথে বিয়ে দিতে রাজি নয় তাই মিনুপিসি এখন সম্পূর্ণ গৃহবন্দি। একদিন নববধূর সাজে অন্য একজনের হাত ধরে মিনু নয়াপুর ছাড়ল পেছনে ফেলে গেল তালপুকুরের পাড়ের কিছু মিঠে দুপুর আর সর্বহারা একটা মানুষকে। চাকরি আর ভালোবাসার মানুষ দুই হারিয়ে ধীমান সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ল। বরাবরই সে নরম প্রকৃতির। সাদা আম্বাসেডর গাড়িটা যখন পথের ধুলো উড়িয়ে মিনুকে পর করে নিয়ে যাচ্ছিল। উদ্ভ্রান্তের মত সে পথ ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়েছিল ধীমান তারপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল পথের ওপরেই। তার বন্ধুরা এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ধীমান আর হিমেল দুজনের জীবন দুদিকে বয়ে যায়। বছরভর পড়াশোনা না করায় হিমেল ক্লাসের পরীক্ষায় খুব খারাপ ফল করায় তাকে পিসিবাড়িতে রেখে আসা হয়। হেডমাস্টার পিসেমশাই খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। পিসেমশাইয়ের তত্বাবধানে হিমেলের পড়াশোনা শুরু হয়। হিমেলও ক্রমশ নিজের ভুল বুঝতে পেরে লেখাপড়ায় মন দেয়। ক্রমে স্কুল শেষ করে কলেজে ঢুকলো। তারপর এম বি এ করে ব্যাংকে চাকরি, দিয়ার সঙ্গে প্রেম,বিয়ে জীবন অত্যন্ত মসৃণ ভাবে এগিয়ে চলছে হিমেলের। হিমেলের দাদা হীরকও পাশ করার সাথে সাথে নয়াপুর হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। সে নয়াপুরেই থাকে। হিমেলরা ছুটিছাটায় নয়াপুর গিয়ে হৈ হৈ করে কয়েকদিন কাটিয়ে আসে। অন্যদিকে ওইসব ঘটনার অল্পদিনের মধ্যেই ধীমানের বাবা-মাও অসুখ করে মারা যান। দাদারা ভালোমানুষ ধীমানকে ঠকিয়ে ভালো ভালো জমি-জায়গা, পুকুর সব নিয়ে নেয়। অল্প কিছু ভাগে পায় ধীমান। দাদাদের মুখের উপর সে কিছু বলতেও পারে না। দাদারা সবাই পৃথক সংসার পাতে। ধীমান সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। তার বন্ধুরা দেখেশুনে তার একটা বিয়ে দেয়। ধীমান কাকার বিয়ের খবর শুনে হিমেলের মনে প্রশ্ন জেগেছিল মিনুপিসিকে ভুলে পারবে ধীমান কাকা তার বউকে ভালোবাসতে কিংবা মিনুপিসিই কি পেরেছে তার স্বামীকে সম্পূর্ণ রূপে মন দিতে। ধীমান চাকরি-বাকরীর চেষ্টা করলেও তার আর চাকরী হয়নি। একসময় বয়সও সঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। ভাগে পাওয়া অল্প জমিতে চাষাবাদ করে কায়ক্লেশে তার দিনাতিপাত হয়। চিরকালের রোগাসগা ধীমান বেশি খাটা-খাটুনিও করতে পারে না। এইভাবেই চলছিল জীবন কিন্তু তাও একদিন স্তব্ধ হয়ে গেল।





চিতার লেলিহান আগুন ডুবন্ত সূর্যের সাথে মিশে যাচ্ছে। দীপ্ত শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। একটা জিনিসই ভগবান ধীমানকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তার ছেলে দীপ্ত বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী। ছেলেটা এবছর মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। বহু কষ্টে ভর্তির টাকা জোগাড় করেছিল কিন্তু বাবার অসুখে সব চলে গেছে। সবাই বলাবলি করছে যে এবার জমিতে লাঙ্গল করাই ওর নিয়তি। কথাটা শুনে হিমেলের বুকটা মুচড়ে উঠলো।



  

   ভাঙ্গা দাওয়ায় ছেলেকে পাশে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বসেছিল রমা। তাদের জীবনটাও বোধহয় ধীমানের চিতার আগুনের সাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

একটা আওয়াজ পেয়ে রমা জিগ্যেস করে উঠলো, " কে? কে ওখানে?" টর্চের আলো এসে পড়ল দাওয়ায়

“ কাকিমা, আমি হিমেল। আজ থেকে তোমার আর দীপ্তর সব দায়িত্ব আমার। দীপ্তকে ডাক্তার আমি করবই।”

“ আমিও তোমার সাথে আছি।” হিমেলের পাশে এসে দাঁড়ালো দিয়া। ধীমানের মৃত্যুর খবর পেয়ে নিঃসীম মনঃকষ্ট সহ্য করতে না পেরে হিমেল যখন নিজের সমস্ত অপকর্মের কথা দিয়াকে জানায় সেও মনস্তাপে ভুগতে থাকে সেদিন দীপ্তকে টাকা না দেওয়ার জন্য।

রমা আর দীপ্ত অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। হিমেল চোখটা বন্ধ করে ফেলে, " ধীমান কাকা, তোমার সারাটা জীবন আমি নষ্ট করে ফেলেছি। জানি আমার ক্ষমা নেই। দীপ্তর জীবনটা সাজিয়ে দিয়ে আমি যেন একটু প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics