Drishan Banerjee

Tragedy

2  

Drishan Banerjee

Tragedy

পরাণ সখা(তৃতীয় পর্ব)

পরাণ সখা(তৃতীয় পর্ব)

6 mins
8.2K


এর পর মামাবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছাটাই কেমন চলে গেছিল। আস্তে আস্তে পড়াশোনায় ডুবে গেছিলাম। একান্তে মিলুর কথাই মনে পড়তো। আর কোনো মেয়ে ওকে সরিয়ে কাছে আসতে পারে নি। আজও মিলু ই আমার একাকীত্বের সঙ্গী। আমার বিভিন্ন লেখায় মিলু বারবার ফিরে এসেছে।বড় হয়ে মিলুর অনেক খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু ওপার বাংলায় ও যে কোথায় হারিয়ে গেছিল.........

 

শ্রী সব জানতো। ও আর প্রকাশ ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।প্রকাশ আর শ্রী দুজনেই আমার সাথে কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে একসাথে পড়েছে। আমি তখন লেখালেখি শুরু করেছি একটু আধটু। শ্রী আর প্রকাশ আমার প্রথম পাঠক। আমার লেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতো ওরা। আমি কল্পনার সাথে রঙ মিশিয়ে মিলুকে নিয়ে লিখে যেতাম আমার গল্প। পড়া শেষ করে একটা স্কুলে ঢুকেছি, সাথে চলছে লেখালেখি। প্রকাশ সরকারি চাকরীতে ঢুকেছিল। আর শ্রী একটা প্রাইমারী স্কুলে।

সেদিন ছিল আমার প্রথম বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। পার্কষ্ট্রিটে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বই প্রকাশ হল, অনেক লেখকদের সাথে পরিচয় হল। শ্রী আর প্রকাশ এসেছিল।সামনেই ওদের বিয়ে। 

আমাদের তিনজনের বাড়িই দমদমের দিকে। রাত হয়ে যাওয়ায় ট্যাক্সি নিয়ে ফিরছিলাম। দমদমের দিকটা তখন খুব ফাঁকা ফাঁকা ছিল, এতো বাড়ি ঘর ফ্ল্যাট ছিল না। বিটি রোডের উপর হঠাৎ একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের ট্যাক্সিটার উপর উঠে এসেছিল। আর কিছুই মনে নেই...... সব অন্ধকার।

 

জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালে , আমার মাথায় আর কোমরে লেগেছিল। কলার বোনটা সরে গেছিল, ভাঙ্গে নি কিছু । ড্রাইভার আর প্রকাশকে বাঁচানো যায় নি। ওরা দুজনেই ডান দিকে বসেছিল। পিষে দিয়েছিল ট্রাকটা ওদের। শ্রী এর কোনো শারীরিক ক্ষতি না হলেও মানসিক ভাবে ও পুরো ভেঙ্গে পড়েছিল। বিয়ের মাত্র তেইশ-দিন আগে প্রকাশ এ ভাবে চলে যাবে, ও মানতে পারছিল না। ও কাঁদে নি, বোবা হয়ে গেছিল যেন। ওকে দু দিন পরেই ছুটি দিয়েছিল। আমাকেও পাঁচদিনের দিন ছুটি দিল। আমার বই প্রকাশের আনন্দ যে এভাবে আমার প্রিয় বন্ধুদের জীবন নষ্ট করে দেবে ভাবি নি। আমিও কেমন হয়ে গেছিলাম। দোতলায় আমার ঘরে শুয়ে বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চেয়ে থাকতাম সারাক্ষণ। নিজেকে অপরাধী মনে হতো। এই ঘরে আমরা তিনজন কতো আড্ডা মেরেছি, আমার লেখা নিয়ে কত কি বলেছে ওরা আমায়। আমার আনন্দে সামিল হতে গিয়ে ওদের জীবনে এমন অন্ধকার বয়ে আনবে ভাবি নি কখনো!!

 

তিনদিন পর শ্রী এসেছিল। আমার খাটের পায়াটা ধরে একভাবে আমায় দেখছিল। ওর চোখে কোনো জল দেখি নি। এক অদ্ভুত দৃষ্টি। আমায় যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়েছিল আজ আর মনে নেই। তবে আমি ও অপরাধীর মতো বসেছিলাম। ওর দিকে তাকাতেই পারছিলাম না কেন জানি ।

বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রী বলল -"আসি রে........"

ওর বলার মধ্যে কি যেন একটা ছিল। কানে কেমন যেন বিঁধেছিল কথাটা। সম্বিত ফিরতেই দেখি ও বেরিয়ে যাচ্ছে। ডেকেছিলাম -"শ্রী, দাঁড়া"। বলে। ও দাঁড়ায় নি। মনটা কেমন কু ডাকছিল। লাফ দিয়ে উঠে ওকে টেনে ঘরে এনেছিলাম। বলেছিলাম -"কোথায় যাবি বল? আমি ছেড়ে আসবো। " 

ও আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে করুন হেসে বলেছিল-"চাইলেই কি ধরে রাখা যায়? আমি কি পারলাম রে বেঁধে রাখতে?"

-"জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমরা কি করতে পারবো বল, ভগবানের উপর কারো হাত নেই রে।"

আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল শ্রী, বলেছিল -"আমিও ফুরিয়ে যেতে চাই রে। আমি ওর কাছেই ভাল থাকবো। "

-"কি যা তা বলছিস তুই। ওখানে যাওয়া যায় না এভাবে।"

ঐ প্রথম ওর চোখের কোনে জলবিন্দু দেখেছিলাম। বড়বড় দু-ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছিল। আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম আশ্বাস দেওয়ার জন্য। ঐ টুকুতেই ও গলে গেছিল যেন। ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করেছিল। এই কদিনে যত দুঃখ কষ্ট ওর অন্তরে জমা হয়েছিল সব উজাড় করে দিচ্ছিল ও আমার কাছে। আমি চুপ করে বসে ছিলাম। ওকে কেঁদে হাল্কা হতে দিচ্ছিলাম।

 

কিছুক্ষণ পর ও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল ও প্রকাশের চিহ্ন বহন করছে, কিন্তু বাড়িতে জানাজানি হওয়াতে সবাই চাইছে ও বাচ্চাটা নষ্ট করুক, কারণ অবিবাহিত মেয়ের এই মা হওয়া সমাজ মানবে না। ও নাকি বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রকাশের বাড়িও গেছিল। প্রকাশের বাবা মায়েরা কয়েকদিন আগেও শ্রীকে বাড়ির লক্ষ্মী ভাবতেন, আর এই ঘটনা শোনার পর ওকে আশ্রয় দিতে পারে নি।নিজেদের বংশধরকে স্বীকার করতে ওনাদের সামাজিকতায় বেধেছিল। চোখের জল মুছে শ্রী বলেছিল -"আমি যদি এই বাচ্চার জন্ম দিই, হয়তো চাকরীটাও থাকবে না। প্রকাশ নেই বলে ওর বাচ্চার বেঁচে থাকার অধিকার ও নেই। শুধু ওর নাম আইনত আমার সাথে জোড়েনি বলে এই ভালবাসা মিথ্যা!! সবাই সব জেনেও এই বাচ্চাকে বাঁচতে দেবে না....... আমার কাছে আর কোনো পথ নেই।"

 

কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম নিজেরাই জানি না। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁক দিয়ে রাস্তার গ্যাসের আলো চুঁইয়ে ঘরে ঢুকে এক আলো আঁধারীর ছবি এঁকেছিল। আমরা আলো জ্বালাতেও ভুলে গেছিলাম সেদিন। ঐ মৃদু আলোয় শ্রীর মধ্যে এক মা কে নতুন করে দেখেছিলাম। এক মা তার সন্তানের মধ্যে দিয়ে নিজের ভালবাসার শেষ চিহ্ন কে বাঁচাতে চাইছিল। আমিও আমার ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম আমার লেখালেখির মধ্যে। মিলুকে ছাড়া কাউকে জীবনসঙ্গী করবো না প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের মনেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রকাশের আর শ্রীর কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

 

শ্রীর হাতটা ধরে বলেছিলাম -"আমার সব কথা তুই জানিস, মিলুকে আমি ভুলতে পারবো না৷ তুই আমার প্রিয় বন্ধুর ভালবাসা, আমার প্রিয় বান্ধবী তুই, যদি বিশ্বাস করিস ,তবে প্রকাশের শেষ চিহ্ন কে আমি আমার পরিচয় দিতে রাজি। সমাজের চোখে তোকে অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের দায় নিতে হবে না। সমাজের সব প্রশ্নর উত্তর আমি দেব যদি তুই আমায় বিশ্বাস করিস।" শ্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। বলেছিল -''কিন্তু তোর পরিবার আমাকে মেনে নেবে ?"

-"আমি বোঝাতে চেষ্টা করবো সবাইকে। আর না মানলে আমরা নিজেদের মতো করে সব করে নেবো। তবু তোকে একা ছাড়বো না।"

 

বাবা মা মানে নি, বোনের বিয়ে হয় নি তখনো। মা বলেছিল আমি এসব করলে বোনের বিয়ে হবে না আর। কারণ শ্রী- রা দে। আমরা ব্রাক্ষ্মন।আর সবাই জানত ও প্রকাশের বাগদত্তা। এত তাড়াতাড়ি এভাবে ওকে বিয়ে করলে লোকে খারাপ চোখে দেখবে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় ছিল না। তিনদিন পরে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ভাড়া বাড়িতে উঠে গেছিলাম আমরা।

 

শ্রী এর সাথে আমার বিয়ে হলেও মিলুই থেকে গেছিল আমার অন্তর জুড়ে। শ্রী নিজেও কখনো সেই জায়গা নিতে চেষ্টা করে নি। শ্রী ছিল আমার ভীষণ ভাল বন্ধু। ওর সাথে আমার বিয়েটাও একটা সুন্দর সম্পর্ককে সমাজের চোখে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না। শ্রী তাতেই খুশি ছিল। ওর ছেলে আকাশ ছিল আমাদের দুজনের প্রাণ। আকাশের মধ্যে আমরা প্রকাশের ছায়া খুঁজে পেতাম। আকাশকে নিয়েই বাকি দিন গুলো কেটে গেছিল। শ্রী আর আমি ভাল বন্ধুই থেকে গেছিলাম সারা জীবন।আকাশ বড় হওয়ার পর ওকে শ্রী আর আমি জানিয়েছিলাম প্রকাশের কথা। ও কিন্তু আমাদের অসম্মান করে নি কখনো। বাবা মা হিসাবে আমাদের ভালবেসেছে সবসময়। শ্রী মাঝে মাঝে মিলুর খোঁজ করতে বলতো । আমিই জানতাম না কোথায় খুঁজবো.....

 

আকাশ বিদেশে পড়তে চলে যাওয়ার পর শ্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হাই প্রেশার ছিল ওর। একদিন ঘুমের মধ্যে ও চলে গেছিল চির শান্তির দেশে, প্রকাশের কাছে। আকাশ নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল এরপর। বৌমা আমার খুব ভাল। ওরা বহুবার আমায় ওদের কাছে নিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছিলাম। মিলুর স্মৃতি নিয়ে একাই থাকতে চেয়েছিলাম ।

 

পর্নার মধ্যে কি এক আকর্ষণ ছিল, মনে হত আমি মিলুর ছায়া দেখতে পেতাম। বারো তেরো বছরের চঞ্চলা কিশোরীর সাথে এই মধ্যবয়সী নারীর কেমন যেন একটা মিল আমি উপলব্ধি করতাম। যদিও পর্না মিলুর চেয়ে একটু ছোট ছিল তবুও, আমার কেমন লাগত। মাঝে মাঝে ভাবতাম সেই ছোট্ট মেয়েটা আমায় কি এখনো মনে রেখেছে!!(চলবে)

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy