পরাণ সখা(প্রথম পর্ব)
পরাণ সখা(প্রথম পর্ব)


রোজকার মতো বড় ঝিলের ধারে আমার নির্দিষ্ট গাছের গুঁড়িতে এসে বসেছিলাম। বিকেলের এই সময়টা খুব সুন্দর হাওয়া ছাড়ে। ঝিলের জলে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে। আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে এটুকু সময় আমার নিজস্ব। একটু পরে লাল বলের মতো সূর্যটা আস্তে আস্তে ঝিলের জলে সিঁদুর গুলে অস্ত যায় ঐ গাছগুলোর পিছনে। নাম না জানা পাখীরা এসে গান শোনায়। আমি নিজের মতো করে উপভোগ করি সময়টা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে, আমি আস্তে আস্তে ঘরে ফিরি।
আজ কদিন হল আমার এই নিরিবিলি অবসর যাপনের জায়গায় এক নতুন অতিথির আগমন ঘটেছে।ঝিলের ওধারে একটা বড় পাথরের উপর এসে বসে সে। একমনে ঝিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার মতোই সন্ধ্যা হলে উঠে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আমার পাশের টাওয়ার ময়ূরাক্ষীর পাঁচ তলায় ওনার ফ্ল্যাট। নতুন এসেছেন।
এই আবাসনে মোট পাঁচটা টাওয়ার। নাম গুলো মহানন্দা, ময়ূরাক্ষী, তিস্তা, তোর্সা, কংসাবতী, আবাসনের নাম সোনার তরী। আমি থাকি তিস্তার তিনতলায়। একমাত্র ছেলে বিদেশে। গিন্নি গত পাঁচ বছর আগেই টা টা করে চলে গেছে। গত দু বছর আগে শহরের কোলাহলের থেকে দূরে থাকবো ভেবে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছি। এই আবাসনে বেশির ভাগই আমাদের মতো অবসর প্রাপ্ত, সবার ছেলে মেয়ে বাইরে।
এই আবাসনে একটা উপাসনা কক্ষ আছে, এছাড়া লাইব্রেরি ক্লাব সবই আছে। কিন্তু আমার ভাল লাগে ঐ ঝিলের ধার। সন্ধ্যায় সবাই যখন আড্ডা মারে ক্লাবে বা নিচের পার্কে, আমি ঘরে বসে ল্যাপটপে সাহিত্য চর্চা করি। বিভিন্ন গ্ৰুপে কচিকাঁচাদের লেখা পড়তে ভালই লাগে। মাঝে মধ্যে স্কাইপে ছেলে বৌ আর নাতির সাথে আড্ডা দিই। কিন্তু কদিন ধরে আমার এই জীবনযাত্রায় একটা ছন্দপতন ঘটিয়েছে ঐ নবাগতা। দূর থেকে ওকে রোজ দেখি আর একটা অন্যরকম কৌতূহল , একটা অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করি। মনে মনে রোজ ভাবি আলাপ করবো কিন্তু কেমন একটা সংকোচ আর দ্বিধার দোলায় দুলতে থাকি।
সেদিন হঠাৎ সুযোগ এসে গেল সকাল বেলা। আমি আবাসনের ভেতরেই প্রাতঃভ্রমণ করছিলাম। অনেক খোলা জায়গা এই আবাসনের ভেতর। ঝিলটা পাক খেয়ে ফুলবাগানের সামনে এসে দেখি উনি বসে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই জানালাম -"সুপ্রভাত" । উনিও হেসে শুভেচ্ছা জানালেন। নমস্কার জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। উনিও নিজের পরিচয় জানালেন মিসেস মধুপর্না চক্রবর্তী। আমার নাম শুনে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন উনি। বললেন -" আপনার লেখার সাথে আমার পরিচয় আছে। আমি আপনার ভক্ত বলতে পারেন।" ওনার চোখের ভাষা আরো কিছু বলতে চাইছিল যেন।দু একটা সৌজন্য মূলক কথাবার্তা হল। বাড়ি আসতে আসতে ভাবছিলাম ওনাকে কি আগেও কোথাও দেখেছি!!! কেন জানি মনের কোনে একটা মেঘের আড়ালে ঝাপসা একটা মুখ উঁকি দিচ্ছিল।
বিকেলের জন্য অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছিলাম। একটু তাড়াতাড়িই আজ চলে গেছিলাম আমার প্রিয় জায়গায়। একটু পরেই ওনাকে আসতে দেখলাম। একটু দূরত্ব রেখেই ওধারের পাথরে রোজকার মত বসলেন উনি। কিন্তু আমি পারলাম না উঠে ওনার সামনে যেতে। কি এক অজানা সংকোচে বসেই রইলাম ওখানে। রোজকার মতো সন্ধ্যা হল। যে যার মতো ঘরে ফিরলাম। ফিরেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুই ভাল লাগছে না। আমার কিচেনের পাশের বারান্দায় দাঁড়ালে ওনার বারান্দাটা দেখা যায়। কিছুক্ষণ দেখার চেষ্টা করলাম। তারপর নিজেরই কেমন বোকাবোকা লাগল ব্যপারটা।
মনটা ঘোরাবার জন্য ফেসবুক খুলে বসলাম। কিন্তু মন কিছুতেই বসছিল না। একবার অকারণে নিচের থেকে ঘুরে এলাম। ময়ূরাক্ষীর পাঁচ তলায় পল্লব বাবু থাকেন। ভাবলাম একবার ঘুরে আসি। কিন্তু কি মনে করে গেলাম না আর। রাতটা কেমন ঘোরের মধ্যে কাটল। পরদিন সকালে আবার দেখা....
আজ উনিই হেসে শুভেচ্ছা জানালেন। একটু দূরত্ব রেখে বসলাম। দু চারটে সৌজন্য মূলক কথা, জানলাম ওনার দুই ছেলেই বিদেশে। স্বামীকে হারিয়েছেন অল্প বয়সে। উনি কিছুদিন ছিলেন ছেলেদের কাছে। তবে ভাল লাগে নি দেশের বাইরে। অবশেষে ফিরে এসেছেন এখানে। উনি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রে কিছু পরিচিতি ছিল এখানে। তাই শেষ বয়সটা এখানেই কাটাতে চান। নিজের সঞ্চয় দিয়ে এই মাথা গোজার ঠাঁইটা করে নিয়েছেন।
আমিও বললাম আমার কথা। অবসর কাটাতে এসে এই জায়গার প্রেমে পড়ে গিয়ে এই আবাসনে থাকার সিদ্ধান্ত।
বিকেলে আবার দেখা সেই ঝিল-পারে। সেদিন একটু হাসলাম। একবার ভাবলাম ওনার পাশে গিয়েই বসি....... কিন্তু মন বলল সেটা ঠিক নয়।
এভাবেই বন্ধুত্বের শুরু। গত দেড় মাসে রোজ বিকেলে উনি এসেছেন ঝিলের ধারে। আমিও গেছি। আমাদের না বলা কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে পাখীর কলতান শুনেছি দুজনে। আস্তে আস্তে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছিল । আজকাল আমরা একসাথে বসেই প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যার আগমন দেখি। রোজকার আলাপচারিতায় আপনি থেকে তুমিতে পৌঁছেছিল ধীরে ধীরে। এই শেষ বয়সে এসে এই বন্ধুত্বকে কি নাম দেব নিজেরাই জানতাম না। আবাসনের সবাই আমাদের খেয়াল করতো বুঝতে পারতাম। শুধু সামাজিক আভিজাত্যের জন্য কেউ হয়তো কিছু বলতো না।
একদিন বিকেলে পর্না নিজেই আমায় বলেছিল একটু সোনাঝুরির দিকে যাওয়ার কথা। আমাদের আবাসন থেকে হেঁটেই যাওয়া যায় সোনাঝুরি। ওর সঙ্গী হয়ে সেদিন দুজনে সোনাঝুরির সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম। দিনটা শনিবার ছিল। খোয়াইয়ের হাট বসেছিল। একটা গাছের গুঁড়িতে বসে বাউল গানের সুরে হারিয়ে গেছিলাম আমি। ফেরার পথে পর্নার গলায় শুনেছিলাম গুরুদেবের গান।ও গাইছিল
-".... আমার হৃদয়,
তোমার আপন হাতের দোলে..."(চলবে)