Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Classics

4.6  

Sanghamitra Roychowdhury

Abstract Classics

পিতৃপরিচয়

পিতৃপরিচয়

5 mins
914


গোটা গ্রাম জুড়ে হুলুস্থূল কাণ্ড। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনে নাকি ট্রেনে কাটা পড়েছে গ্রামেরই এক যুবক। পুলিশ থানায় খবর গেছে। থানা থেকে মেজোবাবু এসেছেন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে। রেলে কাটা পড়লে সে ব্যাপারে তদন্তের দায় যদিও জিআরপি পুলিশের, তবুও এই অঞ্চলের থানা থেকে পুলিশ এলেন... কারণ এখানে কোনো স্টেশন নেই, শুধুই পাশাপাশি পাতা রেলের লাইনজোড়া আর তার দুধারে একটা করে গেট। সে গেট আবার নড়বড় করে। তাই সরিয়েই মানুষ নিজে এবং গরু মোষ ছাগল নিয়েও দিব্যি রেলের লাইন পারাপার করে, কখন যে হুস করে দৈত্যের মতো ট্রেন এসে পড়বে, তার একচিলতে তোয়াক্কা না করেই। আগেও দু-একবার দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে কোনোক্রমে বেঁচে গেছে। তবে এবারে আর শেষরক্ষা হয়নি। রেললাইনের ধারের দূরের মাঠে গরুর রাখালি করতে আসা ছেলে ছোকরারা গিয়েই খবর দিয়েছে থানার পুলিশ বাবুদের। আর পুলিশ থানা থেকে মেজোবাবুকে পাঠানো হয়েছে, সঙ্গে থানার জমাদার গোবিন্দলাল।


ঘটনাস্থলে লোক গিজগিজ করছে। কোনোরকমে তারই ফাঁক দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে গোবিন্দলাল ভিড় সরিয়ে মেজোবাবুকে দেখার ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর মেজোবাবুর পেছনে পেছনে গোবিন্দলাল নিজেও মাথাটা গলিয়ে ভীমরুলের চাকের মতো ভিড়ের মাঝখানে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। পেটের মাঝখান দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। দেহ দুটুকরো। ও দৃশ্য চোখে দেখার মতো নয়। কিন্তু তাও কি আশ্চর্য সবাই দেখছে, হায় হুতাশ করছে। কিন্তু একঝলক দেখেই গোবিন্দলাল দুহাতে বুক চাপড়ে গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো, "ও ভগমান গো, এ আমার কী সব্বোনাশ কল্লে গো... আমার মা-মরা একমাত্র ছেলেটাকে তুমি তুলে নিলে কেন গো? আমি কী অপরাধ করিচি তোমার কাচে গো...!" গোবিন্দলালের এই গগনবিদারী বিলাপেই স্পষ্ট আসল ঘটনাখানা। গোবিন্দলালের একমাত্র মা-মরা ছেলে গোপাল রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে।



মেজোবাবু গোবিন্দলালকে সামলে নিয়ে কোনোক্রমে ভিড়ের মাঝখান থেকে বার করে নিয়ে গ্রামের দু-চারজনের সহায়তায় থানায় ফেরত নিয়ে যান। মাইল তিনেক দূরের স্টেশনের জিআরপি থানায় খবর পাঠানো হয়। থানার কেউ তাকাতেই পারছে না গোবিন্দলালের থমথমে মুখের দিকে। প্রাথমিক ধাক্কায় গোবিন্দলাল বুকফাটা আর্তনাদ কিছুক্ষণ করার পরে থেমে যায়। থেমে যায় মানে একেবারেই থেমে যায়। চুপচাপ দূরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শুধু। চোখদুটি লাল টকটক করছে জবাফুলের মতো। চোখের কোলে শুকনো জলের ধারা। কী অমানুষিক পাথরের মতো কঠিন সেই দৃষ্টি! দেখলে বুকের মধ্যেটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। গোপালের দেহ জিআরপি থানা থেকে হাসপাতালের ময়নাতদন্তের মর্গ হয়ে ছাড়া পেতে পরেরদিন বিকেল। গোবিন্দলাল আর ছেলের সে মৃত মুখ দেখতে চাইলো না। গ্রামের ছেলে বুড়োরা আর পুলিশ থানার সহকর্মীরা মিলে দাহকাজ করে এলো। গোবিন্দলালের আর কাজে মন নেই। না ঘরে, না থানায়। কোনোদিন খায় মুড়ি চিঁড়ে শুকনো সাকনা কিছু। কোনোদিন বা শুধু একঘটি জল। দিন পার হয়ে যেতে থাকলো এভাবেই। গোবিন্দলাল আর ঘরে রাঁধে বাড়ে না। আগে বাপ-ব্যাটার সংসারের সবই যে দুজনে মিলে করতো। সেই আঁতুরে ছেলেকে রেখে গোপালের মা চোখ বুঝেছিলো সূতিকাজ্বরে। সেই থেকে গোবিন্দলালই গোপালের বাপ, গোবিন্দলালই গোপালের মা। গোপালের বিয়েও ঠিক হয়েছিলো। এই চৈত্র মাসটি পেরোলেই বৈশাখের মাঝামাঝি বিয়ের দিন ছিলো। সব কেড়ে নিলেন ভগবান। গোবিন্দলালের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।



গোপালের বিয়ের ঠিক হয়েছিলো যে মেয়েটির সাথে তারও বাপ-মা গত হয়েছে বহুকাল। কাকা কাকির সংসারে মানুষ। গোপালদের গ্রামেরই মেয়ে। মেয়েটির কপালে বড় দুঃখ। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হতে না হতেই হবু স্বামীর মাথা খেয়ে বসলো। গাঁ-ঘরে এ একটা বড়ো খবর বটে। এমন অলক্ষুণে মেয়েকে কে বিয়ে করবে? কে তাকে ঘরের বৌ করবে? মেয়েটি ঝিম ধরে দিনকতক বসে রইলো। তারও নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। চোখের জল চোখে শুকিয়েছে, মুখখানি এতোটুকু হয়ে গেছে। মেয়েটির মরণি নাম বুঝি এবার সার্থক হতে যায়। এক ভরসন্ধ্যায় মরণি গ্রামের শেষমাথায় পালপুকুরে ঝাঁপ দিলো। হাবুডুবু খাচ্ছে দেখে কেউ একটা এসে গ্রামে খবর করলো... মরণি ডুবে যাচ্ছে। হৈ হৈ করে ছুটলো সব লোকজন। গোবিন্দলালের কানেও এসেছে কথাটা। তবে মরণি মরেনি বটে, বেঁচেও মরমে মরে রইলো।



ঘটনার মাস চারেক পরে একদিন আবার জোর খবর উড়তে লাগলো গোটা গ্রাম জুড়ে। গোপালের বাবা গোবিন্দলাল নাকি মরণিকে বিয়ে করে এনে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে ঘরে তুলেছে। গ্রাম জুড়ে ছিছিক্কার। এ কেমন বাপ? ছেলে মরার শোক না কাটতেই ছেলের বাগদত্তা মেয়েকে বিয়ে করে এনে ঘরে তুললো? আর মরণিরই বা কি আক্কেল? এসব দেখে গ্রামের অল্পবয়সী ছেলেপুলেরা কি শিক্ষা পাচ্ছে? গ্রামে পঞ্চায়েত বসলো। ডাক পড়লো সেই সভায় গোবিন্দলাল এবং মরণি দুজনেরই। গ্রামের লোকের দাবি যে ওদের দুজনাকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে হবে। বেশ কথা। গ্রাম সভাও এমনই কিছু বিচার শোনাতে চায়। গ্রামের বুড়োবটের তলায় পঞ্চায়েত সভা বসেছে। গ্রামের সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভিড় সেখানে জায়গাটাকে ঘিরে। কিন্তু যাদের জন্য এতো লোক সমাগম পঞ্চায়েত বিচারসভা ঘিরে, তাদেরই দেখা নেই। প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়... কয়েকজন ছেলেছোকরাকে পাঠানোর ব্যবস্থা চলছে গোবিন্দলাল আর মরণিকে তুলে আনার। ঠিক তখনই দেখা গেলো হন্তদন্ত হয়ে গোবিন্দলাল আসছে। সবাই থমকালো। মরণি কই?



গোবিন্দলাল এসে হাত জোড় করে দেরির জন্য ক্ষমা চায়। তারপর হাত জোড় করেই বলে, "বাবুমশাইরা, আজ সকাল থেকে মরণির বড়ো ব্যথা উটেচে। ঘরে তো মেয়েমানুষ কেউ নাই। তাই দাই জোগাড় করে রেখে এলুম। আমার তো আর কেউ নাই। বৌটা তো কোনকালে গেচে। জোয়ানমদ্দ ব্যাটা সেও গেলো। এখন ব্যাটা বীজটারে রেকে গেচে মরণির গভ্যে। সেটিকে যেতে দিই ক্যামোন করে বলেন বাবু? বাচ্চাটার একটা পিতৃপরিচয় তো লাগবে। তাই মরণিকে ঘরে এনে তুললুম মাতায় সিঁদুর দিয়ে। নইলে যে লোকে মরণিরে মন্দ কতা কইবে বাবুরা। আমি এখুন যাই বাবু, পেত্থম পোয়াতি কিনা। বড্ড কাতরাচ্চে। আমার গোপালের বীজ আসতেচে মাটিতে... সেকি আর য্যামোন ত্যামোন কতা? আমার আর মোট্টে সময় নাই বাবুমশাইরা।" কপালে দুহাত ঠেকিয়ে গোবিন্দলাল বিদায় নিলো। যেমন হন্তদন্ত হয়ে সে এসেছিলো, তেমনই হন্তদন্ত হয়েই সে চলে গেলো। 



গোটা গ্রাম নীরব। এক অশিক্ষিত গ্রাম্য বৃদ্ধ এ কেমন কথা শুনিয়ে গেলো? সত্যিই তো আজও যে সর্বত্র একটি শিশুর পিতৃপরিচয়টা বড়ো জরুরি। তবে কি বিচার হবে এখন গোবিন্দলালের ও মরণির? গোবিন্দলালের মানসিকতা ও সিদ্ধান্তের বিচার করার মানুষ গ্রামে ছিলো না... কারণ এমন মানবিক বোধের মানুষের কোনো বিচার হয়ই না। গ্রামসুদ্ধু সবাই প্রার্থণা করে মরণি আর তার সন্তান সুস্থ থাকুক। গোবিন্দলাল ফিরে পাক তার স্নেহের সম্পদ। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract