Chitta Ranjan Chakraborty

Tragedy Others

3  

Chitta Ranjan Chakraborty

Tragedy Others

পিন্ডি

পিন্ডি

5 mins
235



চৌরাস্তায় ঠিক মাঝখানটায় উত্তর-দক্ষিণ করে বাঁশের মাচানের উপর একটি কাপড় পেতে তার ওপর শুইয়ে রেখেছে ঝন্টুর মৃতদেহ। দুপাশে রাখা আছে কয়েকটি আম কাঠের ডাল। আর ওর পাশে বসে আছে যশোদা। রাস্তা দিয়ে যত গাড়ি যাচ্ছে, লোক যাচ্ছে, কয়েকজন ছেলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছে, মৃতদেহ সৎকারের জন্য একটু সাহায্য করুন। পথচলতি মানুষেরা যে যা পাচ্ছে মৃতদেহের পাশে ছুড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।গাড়ি গুলির ড্রাইভাররাও নোট কয়েন ছুড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর একজন লোক একটু পরপর মৃতদেহের পাশে দেওয়া নোট কয়েন গুলি তুলে নিয়ে যাচ্ছে পাশে বসে থাকা প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই যশোদা সব দেখছে কিন্তু কিছু বলছে না অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণকায় শরীর, মানুষের দেওয়া ছেঁড়া কাপড় আর চটের বস্তায় শরীর ঢাকা। সারা শরীর নোংরা ,দুর্গন্ধ, হাত পা ফেটে দগদগ করে রক্ত বের হয়ে জমাট বেঁধে আছে। তার ওপর কালো মাছি ভনভন করে উঠছে। কোঠর গত চোখ দুটি, মুখের চামড়া গুলো ভাঁজ ধরে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরি হয়েছে।


যশোদার একসময় স্বামী-সংসার সব ছিল।কালের প্রবাহে নিষ্ঠুর সময় তার সব কেড়ে নিয়ে গেছে। বিয়ের কয়েক বছর পর একটি মেয়ে হয়েছিল, পাঁচ বছর বয়স হতেই সে মারা যায়। তারপর একদিন কঠিন জ্বরে স্বামীও মারা যায়। তারপর মধ্যবয়সী যশোদা মানুষের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করতো। কিন্তু একদিন কাজ করতে করতে কলতলায় পড়ে গিয়ে তার ডান পা ভেঙে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা করালেও পুরোপুরি ঠিক হয়ে ওঠেনি। তারপর জীবনের পরিহাস, সে কাজ হারায়, অবশেষে ভিক্ষাবৃত্তির পেশায় ভাঙ্গা পায়ে ভর দিয়ে সারা শহরময় ঘুরে বেড়ায়। রাতেরবেলা আশ্রয় বলতে ফুটপাত। ঝড়, বৃষ্টি, গরম, শীত সবটাই কাটে ওর ফুটপাতে। দোকানদার, পথচলতি মানুষ যা দেয় তাই দিয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করে। ফুটপাতে থাকতে-থাকতে আরেকজন ভিখারি বন্ধু জুটে যায়, নাম তার খাদিজা বেগম। তার কোলে একটি বাচ্চা। যশোদার সাথে ফুটপাতে ভিক্ষা করে। সহৃদয় মানুষদের দেওয়া পুরনো কাপড় পরে আর দোকান গুদামে পরিতক্ত কাপড়, চটের বস্তা কুড়িয়ে এনে বিছানা করে থাকে।


খাদিজার ছেলে ঝন্টু যশোদা কে দাদি বলে ডাকে। সেও বাবুদের কাছে, দোকানে দোকানে হাত পেতে ভিক্ষা করে। কখনো কখনো কোন হৃদয়বান মানুষ ভিখিরিদের ডেকে নিয়ে খাওয়ান অথবা ফুটপাতেই খাবার দিয়ে যান। সেদিনই যশোদারা পেট পুরে তৃপ্তি করে মাছ, মাংস, বিরিয়ানি, মিষ্টি খেতে পায়।আর সারা বছর হাত পেতে যা পায় তা দিয়ে চাল ডাল নুন কিনে বাজারে ফেলে দেওয়া সবজি কুড়িয়ে এনে দুটি মাটির হাঁড়িতে যশোদা আর খাদিজা বিবি একসঙ্গে রান্না করে খায় ফুটপাতেই দোকানের বড় বারান্দার চালার নিচে বিছানা পেতে শুয়ে থাকে। সকাল হলে ওই বিছানা হাড়ি গুটিয়ে ফুটপাতের একটি নিরাপদ জায়গায় রেখে দেয়। মাঝখানে কয়েকদিন খাদিজা ওর আত্মীয়ের বাড়ি যাবে বলে ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। একদিন সকালে ঝন্টু এসে বলে দাদি, মা আর নেই। মা বিষ খেয়ে মারা গেছে। যশোদা শুনে হতবাক। বলে এমন কি হয়েছিল যার জন্য খাদিজা আত্মহত্যা করল। ঝন্টু বলে বাবা এসে মায়ের কাছে টাকা চায়। প্রচন্ড ঝগড়া করে, মাকে ধরে ভীষণ মারে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তাই মা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঝন্টু আরো বলে, আমাকেও ভীষণ মেরেছে। আমি নাকি ওর ছেলে নই তাই আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবো। ভিক্ষে করে এনে তোমাকে দেব। বড় হলে আমি রোজগার করে তোমাকে খাওয়াবো। তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না। এই বলে যশোদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। যশোদাও কাঁদে। কান্না থামিয়ে যশোদা বলে, কাদিস নে তুই আমার সাথে থাকবি, আমি তোকে মানুষ করব। তুই আর কোথাও যাবি নে।

সেই থেকে ঝন্টু যশোদার সাথে থাকে, একসাথে ভিক্ষে করে, একসাথে ছেড়া চট গায়ে দিয়ে ঘুমায়। একদিন ঝন্টু এসে কেঁদে বলে, আমি ভিক্ষে চাইতে আমাকে ধরে মেরেছে এক বাবু। বাবু বলে, কাজ করে খেতে পারিস না? তোর বাবা-মা নেই? তুই স্কুলে যাস না কেন? আমি কতবার বললাম, আমার বাবা-মা নেই, আশ্রয় নেই, ফুটপাতে থাকি তবুও সে বিশ্বাস করল না। আমাকে মেরে তাড়িয়ে দিল।ঝন্টুকে আদর করে যশোদা বলে, কাদিস নে, এসব আমাদের কপালে লেখা। আমরা ভিখারি তাই আমরা হাজারবার সত্য কথা বললেও বাবুরা কেউ বিশ্বাস করে না।

এমনিভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পর। এই মাঘ মাসে কদিন আগে থেকে ঝন্টুর ভীষণ জ্বর, কাশি। মাঘ মাসের শীত, তার মধ্যে পাঁচ দিন ধরে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছেনা। প্রচন্ড ঠান্ডা। এদিকে ঝন্টুর জ্বর বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড শীতে আর জ্বরের তাপে কাঁপতে থাকে। গতকাল রাতেই ওর শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। যশোদা ওর গায়ের ছেড়া কম্বল, চটের বস্তা ঝন্টুর গায়ে জড়িয়ে দেয়। তবুও ঝন্টুর শরীর গরম হয় না। এত রাতে কি করবে যশোদা ভেবে পায়না। আস্তে আস্তে ঝন্টু যেন নেতিয়ে পড়ছে। অবশেষে যশোদা ঝন্টু কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।

জ্বরে কাতর ঝন্টু সারা রাত কাঁপতে থাকে আর আবোল তাবোল বকতে থাকে। বারবার মা মা বলে চিৎকার করে, অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে যশোদা। কিন্তু কোন কিছুতেই ঝন্টু থামেনা। যশোদা আরো জোরে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ মা ডাক থেমে যায়। নিথর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ঝন্টু। ওর শরীর আরও বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। যশোদা চমকে ওঠে। বারবার গায়ে নাড়া দিয়ে ডাকতে থাকে ঝন্টু, ঝন্টু বাপ আমার। কিন্তু কোন সাড়াই মেলে না। চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে ঝন্টু যশোদার কোলে।

সকাল হলে ক্লাবের ছেলেরা খবর পেয়ে চলে আসে ফুটপাতে। ঝন্টুর দেহ সৎকার করবে বলে যশোদা কে নিয়ে ঝন্টুর মরদেহ রাস্তায় রেখে দেয়। মানুষের সহানুভূতি থেকে অর্থ তোলার জন্য রাস্তার মাঝে শুইয়ে দিয়ে যশোদাকে বলে, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি ঝন্টু তোর ছেলে। পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করলে বলবি আমার ছেলের সৎকারের জন্য এদের আমিই ডেকেছি। একদম অন্য কথা বলবি না। ওখানে বসে থাকবে তোকে 100 টাকা দেবো ,মুড়ি দেবো আর দু কেজি চাল, হাফ কিলো ডাল কিনে দেব। ছেলেরা বলে ঝন্টুর দেহ সৎকার করবো বলেই কাঠ কিনতে টাকার দরকার, ধুপ ধুনো, বাঁশ কিনতে হবে, তুইতো টাকা দিতে পারবি না।তাইতো রাস্তায় ওর দেহ রেখে টাকা তুলে সৎকার করব। যশোদা বলে, ও তো মুসলমান ওকে পুড়ে দেবে? ছেলেরা বলে, আরো ভালো হলো, ওকে একেবারে গোরস্থানে নিয়ে কবর দিয়ে দেব। এমন সময় একজন ছেলে কাগজের ঠোঙায় করে মুড়ি, বাতাসা, আর এক বোতল জল এনে যশোদা কে দিয়ে বলে নে খা। অনেক বেলা হয়েছে, তোর তো খিদে পেয়েছে, খেয়ে নে। যশোদা বলে, আর কত দেরি হবে? ছেলেটি বলে দেরি নয় ক্লাবের সেক্রেটারি এলেই আমরা ওকে নিয়ে যাব। দুজন ছেলে বলাবলি করে, হারু দা কে ফোন কর, আর বেশি সময় রাস্তা আগলে রাখা যাবে না। পুলিশে খবর হলে ঝামেলা হবে।

ক্ষুধায় কাতর যশোদা মুড়ি বাতাসা খেতে খেতে একবার ওদের দিকে তাকায় আবার খাবারের দিকে তাকায় আবার ঝন্টুর নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। ভাবে সে আজ সঙ্গীহারা। ঝন্টু টা পাশে থাকতো, দাদি বলে ডাকত। চিরদিনের মত সে ডাক শুনতে পাবোনা। আজ থেকে ফুটপাতের ঝন্টুর জায়গাটি ফাঁকা থেকে যাবে, আর কেউ শোবে না। আজ থেকে বন্ধু হারা স্বজনহারা যশোদা, তাকে একাই থাকতে হবে। আজ থেকে সমস্ত ফুটপাতটি যেন যশোদার একার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy