পিহুর জানলা
পিহুর জানলা
খাতার উপরে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল পিহু, টের পায়নি এক্কেবারে। ঘুম যখন ভাঙলো, তখন মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়েছে। পশ্চিম দিকের গরাদ লাগানো দীর্ঘ জানলাটা দিয়ে ফিরফির করে বয়ে আসছে হিমেল বাতাস। সেই হাওয়ার স্পর্ষণে কাঁপ ধরে না ঠিকই, কিন্তু গায়ের রোমে রোমে খেলে যায় আর্দ্রতার ছোঁয়া। বিগত চারদিন এদিকটায় ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভিজে বাতাস এখনও ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে।
ঝিম ধরা ভাব কাটিয়ে পিহুর অবসন্ন মন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে শুক্লপক্ষের ঝকঝকে গোল চাঁদ। বাইরেটা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। রুপোলি ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায় পিহুর, দূরদূরান্ত অবধি দেখা যায় ফাঁকা প্রান্তর। একটা মেঠো রাস্তা চলে গেছে তার বুক চিরে। তারপর শুরু হয়েছে আমলকী বন। বোধহয় সেখান থেকেই কোন নিশাচর ডাকছে, রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে বার্তা দিচ্ছে তার জাগরণের। পিহুর জাগরণের।
খাতাটা এখনও খোলা, হাতে পেনটা ধরা। অনিচ্ছাকৃত ঘুমের আগে কি লিখেছিল, সেটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না পিহু। ঘুমজড়িত লেখা এতই অস্পষ্ট যে নিজের ওপরে বড্ড রাগ হলো। কি দরকার ছিল, রাত জেগে উপন্যাস লেখার। এদিকে অর্ধজাগরণের মধ্যে হাবিজাবি লিখে সময়ও নষ্ট হলো আবার ঘুমেরও দফারফা হলো। কতবার ভেবেছে, এবার থেকে জানলাটা বন্ধ করে তবে লিখতে বসবে। কিন্তু তাও দেখ! কোনও রাত্রেই সেই কথা খেয়াল থেকে না। বাইরে বেরোনোর আকাঙ্ক্ষায় যে কত রাত্রি নষ্ট করেছে, অসমাপ্ত রয়ে গেছে কতগুলো পাণ্ডুলিপি, তার হিসেব পিহু কাকে কিভাবে দেবে? প্রকাশকেরা হন্যে হয়ে ফোন করে করে শেষে ক্ষান্ত দিয়েছে। আজকাল আর ফোন বাজে না, কেউ তাড়া দেয় না লেখা চেয়ে। তবু পিহুর বড্ড তাড়া, নামিয়ে ফেলতে চায় না বলে উঠতে পারা অক্ষরদের। শব্দের স্রোতে বয়ে চলা রুষ্ট নদীর জোয়ারে জোয়ারে বানভাসী প্লাবন ডেকে এনে ভাসিয়ে দিতে চায় উপন্যাসের চরাচর। অনেক বলা বাকি, তবু বলা হয় কই? কখন যে ঘুমের রাজ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, পাণ্ডুলিপি আর শেষ হয়না। শব্দ থেকে অক্ষরে ছাড়াছাড়ি হয়ে নদী ভাঁটা দিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে উৎসের দিকে।
'ফিরররর, ফিরররর, ফিরররর' বুঝি এক অতীন্দ্রিয় ফড়িং অনবরত পিহুর অন্যমনস্কতা কাটাতে চায়। ও কে জানলায়? কাকে একটা জানলায় দেখে সহসা চটক ভাঙে পিহুর। এত রাতে ওর ঘরের জানলার গরাদ ধরে কে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে? ওই মেঠো রাস্তা দিয়ে তো এত রাতে লোক চলাচল করে না। ছ্যাঁত করে ওঠে পিহুর বুকটা।
কি এক অমোঘ আকর্ষণে কুর্শি ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় জানলার দিকে।
"কে আছিস ওখানে? কে? কে?"
"ও দিদিমণি, বান আসছে। শিগগির বের হও। এখনই ঘর বাড়ি সব ভেসে যাবে, চল চল উঁচু মন্দিরে গিয়ে উঠি..." রমেন বলা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে যায়।
"বান আসছে? বান? কিন্তু তাহলে আমার পাণ্ডুলিপির কি হবে গো?" আর্ত্বস্বরে চিৎকার করে ওঠে পিহু।
"প্রাণে বাঁচো পাগলী দিদিমণি, তারপর জড় কাগজের কথা ভেবো" পিছনে না তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে উচ্চস্বরে জানান দেয় রমেন।
কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পিহু। ওর আজীবনের সৃষ্টি সব এই ঘরের সর্বত্র সংরক্ষিত। প্রতিটি গাঁথা ইট, প্রতিটি আসবাব, লাল মেঝের বিস্তৃতি, আলমারির তাক এরা সবাই ওর গল্পের ঝঙ্কার তোলে। যাদের সৃষ্টি করার জন্য সৃষ্ট হয়েছে পিহু, তাদের ছেড়ে চলে যাবে? নিজে অবহেলিত হয়ে অবহেলার লাঞ্ছনায় ওদের ফেলতে মন চায় না, হোক না নির্জীব গল্প ওরা। তাহলে উপায়?
উপায় ভাবার আগেই আসে আরও জনা দশেক লোক। সবাই ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। মহা কোলাহল তুলে ওরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে জানান দেয়, প্রাণে বাঁচতে এখনই সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়তে হবে, হবেই। দোটানায় পড়ে পিহু। যার অনেক ছোটবেলা থেকেই কেউ নেই অথচ ভরা আলমারিতে অগুনতি সৃষ্টি আছে, তার বুঝি এমন দোটানায় পড়া মানায়! এখনও যে তারা পৃথিবীর আলো দেখেনি, সাদা পাতায় স্বাধীনতা পায়নি, পাঠকের মনে প্রবেশ করেনি। ওই শোনা যায় গর্জন! আসছে, বান আসছে! পাণ্ডুলিপি প্রায় শেষের পথে, আর মাত্র দু'কলি লেখা বাকি। কলমটা ফের হাতে তুলে নেয় পিহু। ফের লিখতে বসে।
অনেকক্ষন কেটে যায়, প্রহরের পর প্রহর হয় পার। একসময় পিহুর হুঁশ ফেরে। কই আর কারও সাড়াশব্দ পাচ্ছে না তো? বান কি এসেছিল? আছড়ে পড়া চাঁদের আলোয় পিহু দেখে জানলার বাইরে কেউ কোথাও নেই, কেউ আর ডাকতে আসছে না। সব শূন্য, সর্বত্র স্থাণুবৎ প্রকৃতি। কেউ কি আদৌ বানের খবর নিয়ে এসেছিল? না কি সবটাই পিহুর কল্পনা? একসময় ভোর হয়। শেষ না হওয়া উপন্যাসের ওপর অযত্নে মাথা এলিয়ে দেয় পিহু।
***
পিম্মি বড্ড ছটফটে হয়েছে আজকাল। মাত্র আট বছর বয়স, কিন্তু এখনই দেখ কেমন পাড়া বেড়ানী হয়েছে! মায়ের ডাকাডাকি না শোনার ভান করে এক ছুটে চলে যায় মিনতি মাসীর বাড়ি, বুলিদের বাড়ি, অয়ন জেঠুর বাগানে, আরও কোথায় কোথায়... হাজার বারণ সত্ত্বেও কথা শোনেনা একরত্তিটি। বকলে বলবে, ওরা তো আমার পাড়াতুত স্বজন। ছোট মুখে ভারি ভারি কথা শুনে গোল গোল চোখ পাকিয়েও নরম হয়ে যায় ওর মা, অঞ্জুদেবীর মনটা। প্রতিবেশীরাও বলে, আহ্, আসুক না, ওইটুকু মেয়ের হাসিখুশি কথাবার্তা শুনলে তো আমাদেরও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ঝর্নার মতন উচ্ছল, পাহাড়ী নদীর মত স্বচ্ছ!
পিম্মির কিন্তু বিশেষ একজন বন্ধু আছে। তার কাছে গেলে পিম্মি এক্কেবারে শান্ত হয়ে যায়। চুপটি করে শোনে তার সমস্ত কথা। সে আর কেউ নয়, পিহু। প্রায়ই তার বাড়ির সামনে, ওই যেখানে সেই দীর্ঘ জানলাটা রয়েছে, সেখানে গিয়ে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে পিম্মি। আবদার করে পিহু মাসীকে গল্প শোনাতে। হাজার ব্যস্ততা থাকলেও, পিহুর থেকে গল্প শোনা চাইই চাই। পিহুরও হয়েছে ভাল। আর কোনও স্রোতা না থাকলেও, এই একটি স্রোতা যে ওর সমস্ত লেখা মন দিয়ে শোনে, সেই জন্য ও ছোট্ট মেয়েটির কাছে চির-কৃতজ্ঞ।
সেদিন পিম্মির স্কুলের উঁচু ক্লাসের দিদি ওলি ওকে ওই জানলায় দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে থমকে দাঁড়াল। সামনের বাগান আগাছায় ছেয়ে গেছে। এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ উকিল রুনারায়নের বাড়ি আজ কঙ্কালসার। ইট পলেস্তারা সব খসে পড়ছে।অসংখ্য জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এইসমস্ত স্তূপীকৃত জড়বস্তু ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে একটা দুটো কুসুমিত বৃন্ত। বহুকাল এই বাড়িতে কেউ থাকে না। এই বাড়ি নিয়ে শোনা যায় এক অভিশপ্ত কাহিনী, যা ছোট-বড় সকলেরই জানা।
"এই পিম্মি, ওখানে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছিস? সরে আয়!" হাত নেড়ে ঘনঘন ইশারা করে ওলি।
"কি হলো ওলি দিদি? ডাকছ কেন?" পিম্মি নির্বিকার। ওখান থেকেই সারা দেয়, তবুও জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এক পাও নড়ে না।
"আয় বলছি, আয় এখানে এখুনি। খুব দরকার আছে" ওলি ইশারা করে আবারও।
"কি হয়েছে বল?" নাচতে নাচতে এসে ওলির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে পিম্মি।
"কার সাথে কথা বলছিস ওখানে?" জিজ্ঞাসা করে ওলি।
"কেন, পিহু মাসীর সাথে। আমি তো প্রায়ই এখানে আসি, কথা বলি। জানো, কত গল্প শোনায় পিহু মাসী আমাকে? আমি তো আগের সপ্তাহে স্কুলে 'বাংলা গল্প লেখো প্রতিযোগিতা'য় মাসীর বলা একটা গল্পই লিখে দিয়ে এসেছি" মুখ চেপে হাসে পিম্মি।
বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে ওঠে ওলির। এখনই এই মেয়েটাকে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। অঞ্জুমাসিকে সব বলতে হবে। রুদ্রনারায়নের একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন পিহু। কিন্তু সে তো বহুকাল আগের কথা। শোনা যায়, অল্প বয়স থেকে অসুস্থ পিহু ম্যাট্রিকের পর থেকে আর স্কুলে যেতে পারেনি। বাড়িতেই হয়েছিল তার সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা। অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটি হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে উঠত প্রচন্ড। তখন কেউ তাকে সামলাতে পারত না। অল্পবয়সে মাতৃহারা পিহু একেই অসুস্থ, তায় এরকম আচরণে অনাদৃত হতে শুরু করল নিজের বাপের কাছে। শোনা যায়, একসময়ে তার পাগলামি এমন বেড়ে গিয়েছিল যে তাকে ঘরে বন্দী করে রাখতে হত। আনমনেই সে স্বপ্ন দেখত বিখ্যাত হওয়ার, লোকসমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার, অনেক রোশনাইয়ের মধ্যে থেকে সকলের মন জয় করে নেওয়ার। তাই বুঝি তার স্বপ্নজগতে হাজারো প্রকাশক তার হদিস পাওয়ার, তার পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত।
একসময়ে লোকে বলতে লাগল, গৃহহীন জানলার পিহু। যে ঘরে পিহু আটকা থাকত, এক দীর্ঘ জানলা ছাড়া আর কোনও জানলা বা দরজা ছিল না সেই ঘরের। বুঝি সে এক স্বতন্ত্র দ্বীপের বাসিন্দা। রুদ্রনারায়নের বৃহৎ বাড়িতে থেকেও মেয়েটার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। শুধু ওই জানলা দিয়েই পিহু আসা-যাওয়া করা মানুষদের সাথে ডেকে ডেকে কথা বলত। কিন্তু কারুরই যে বেশিক্ষণ সময় নেই, সবার মেলা কাজ পড়ে আছে। অগত্যা, শেষে ওই খাতার পাতাতেই মনোনিবেশ করত পিহু। তারপর যেদিন বান এল, সেদিন ওই অবরুদ্ধ কারাগারের দরজা খুলে দেওয়ার মতন কেউই আর অবশিষ্ট ছিল না বাড়িতে। রুদ্রনারায়ন
অনেক আগেই গত হয়েছিলেন। তাঁর যে খুড়তুতো বোন এসে দেখভাল করতেন, তিনবেলা জানলা দিয়ে খবর ঠেলে দিতেন পিহুর, তিনিও বয়সের ভারে বাতগ্রস্ত আর নিষ্কর্মা হয়ে উঠছিলেন। সেই রাত্রেই ইতি টানলেন যবনিকার। পিহুর কি হলো সে খবর কেউ রাখেনি। বানভাসী গ্রামে বেশিরভাগ ঘর দেউলিয়া হয়ে গেল। যতদিনে সবাই একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসতে লাগল, ততদিনে রুদ্রিনারায়নের বাড়ির কথা আর পিহুর কথা সবাই ভুলেই গেছে।
কিন্তু পিম্মি সেই বহুবছর আগের ওই বদ্ধ পাগলী মহিলার সাক্ষাৎ পেল কি করে? পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওলি দেখে, জানলার মরচে ধরা গরাদের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। কেউ কোত্থাও নেই।
পিম্মিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও, সেই রাত্রে পরীক্ষার পড়ার চাপে আর ওদিকমুখো হতে পারে না ওলি। পরদিন সকালে খবর পায় পিম্মির খুব জর। কিন্তু জর গায়ে সে মেয়ে যে কোথায় উধাও হয়ে গেছে, তার খবর মেলে না। তাড়াতাড়ি পৌঁছয় ওদের বাড়িতে, জানান দেয় গত সন্ধ্যার কথা। যতক্ষণে পিম্মিকে রুদ্রনারায়নের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে আনা হয়, ততক্ষনে সব শেষ। লেখিকা কোনও এক অমোঘ আকর্ষণে ডেকে নিয়েছে তার একমাত্র ছোট্ট স্রোতাকে।
***
ক্যাঁচ শব্দে দরজাটা খুলে যায়। অরিন্দম ভেতরে ঢুকে বাকিদের ইশারা করে হাত দিয়ে। ভেতরে গুটিগুটি পায়ে ঢোকে শাহানা আর আরিফ।
"এই এত বড় বাড়ির প্রায় সবটাই ভগ্নপ্রায়। কিন্তু দেখ, কি মজবুত এই ঘরের প্রতিটি থাম!" আরিফের গমগমে গলায় কেঁপে ওঠে ঘরের ভেতরটা।
"সত্যি, বাড়িটা সবদিকে কঙ্কালসার কিন্তু এই একটা ঘর কি করে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? প্রলয় হয়ে গেলেও হয়ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে" আওয়াজটা মিলিয়ে যায় শাহানার।
কয়েকজন কলেজপড়ুয়া বন্ধু মিলে বহরমপুরে পিকনিক করতে এসে হঠাৎই খুঁজে পায় একটা বাগানবাড়ি। বহুবছরের জরাজীর্ণ বাড়ি দেখে ঘুরে ফিরে অন্দরমহল দেখার লোভ সামলাতে পারে না অরিন্দম।
"এই এলাকা দিয়ে বান বয়ে গেছে বহুবছর আগে। বাড়িটা অভিশপ্ত" সতর্ক করেছিল কতজন আঞ্চলিক মানুষ। "বাড়ির মালকিন বেজায় পড়ুয়া মানুষ ছিল। সাথে উন্মাদও। দিন রাত কোথাও বেরোত না বলে শোনা যায়। সারাদিন লিখে যেত। কোন স্রোতা ছিল না জানেন। পাঠকবিহীন অক্লান্ত লেখিকা। দাবী করত প্রকাশকের জ্বালায় তাকে একের পর এক লিখে যেতে হতো, এতই সমাদৃত আর সম্মানিত সে পাঠককূলে। আমরা তো জন্মে তার কোনও বই পড়িনি। নামও শুনিনি। পিহুলিকা সান্যাল - নাম শুনেছেন? না তো? বললাম না? পাগলীকে নিজের বাপ ঘরে আটকে রাখতে বাধ্য হতো। কোনোদিন চিকিৎসায় লাভ হয়নি। সে অবশ্য বহু বছর আগের কথা, আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শোনা। লোকমুখে চলে, বানভাসী হয়েছিল এই পুরো এলাকা। না বেরোতে পেরে ঐখানেই আটকা পড়ে আছে আজও। ওদিকে পা দেবেন না দাদাবাবু, ওই বাড়ির ভেতরে কি আছে আমরা কেউ জানি না"
আর সকলে পিছু হঠলেও, জেদ চেপে গিয়েছিল অরিন্দমের। সঙ্গত দেয় শাহানা আর আরিফ। এই তিনজন সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে মানুষ, অসম্ভব জেদী আর তেমনই বেপরোয়া। এমন একটা জায়গায় না গিয়ে থাকা যায়? চড়ুইভাতিতে এসে এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হাতছাড়া করা যায়?
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের ভেতর হঠাৎ একফালি আলো দেখে একটা দেওয়ালের দিকে সন্তর্পনে এগিয়ে যায় শাহানা। ভেতরে আরেকটা ঘর! তিনজনের সমবেত চেষ্টায় ধাক্কাধাক্কি করে সেই ঘরের দরজাও ভেঙে ফেলে ওরা। এই ঘরটা অনেকটা বাইরের ঘরের মতন। ঘরের বিন্যাসও ঠিক আগের ঘরের মতন। এই ঘরেও পরের পর সাজানো আলমারি আর তার ভেতরে সাজানো বই। নিঃসন্দেহে, এই বাড়ি বইয়ের খনি। এমন মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল, মানা মুস্কিল।
"ওই দেখ, আরও একটা ঘর! পরের পর ক্রমাগত এতগুলো ঘর? কই বাড়ির বাইরে থেকে দেখে তো একবারও মনে হয়নি যে পরপর এত সংখ্যার ঘর থাকতে পারে?" একটু আড়ষ্ট শোনায় আরিফকে।
"হ্যাঁ, আমারও এবার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। খেয়াল করে দেখেছিস, একটা আলমারিও খোলা যাচ্ছে না? দরজা মড়মড় করে ভেঙে ফেলা গেলেও সব কাঠের আলমারি লোহার মতন শক্ত। এখানে আর বেশিক্ষণ থেকেই বা কি করব?" এবার বলে শাহানা।
"ও কি?" একটা থরথর করে কাঁপতে থাকা আঙ্গুল তুলে অরিন্দম দেখায় সামনের দিকে। বিশাল বড় একটা গরাদ দেওয়া খোলা জানলা। সেখান দিয়ে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে একটা দীর্ঘ টেবিলের ওপর। সেই টেবিলে ছড়ানো ছেটানো কাগজপত্রের ওপর পড়ে আছে একটা কলম। পড়ে আছে না, নড়ছে, নড়ছে পাতার ওপর। খসখস খসখস করে আসছে তার আওয়াজ। হওয়ায় ভেসে লিখে চলেছে অবিরত।
আর্তনাদ করে ওঠে শাহানা। হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যায় ওরা ঘর থেকে। একের পর এক দরজা পার হয়, কিন্তু সেই ক্রমানুসারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একের পরে আরেকটা ঘর আর শেষ হতে চায় না। আসার সময়ও এতগুলো ঘর ছিল কি?
হঠাৎ থেমে যায় আরিফ। হাঁটুতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে থাকে। তারপর পাগলের মতন অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তোলে ঘর। স্তম্ভিত শাহানা আর অরিন্দম জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে।
"আমরা কোথাও বেরোতে পারছি না। এই ঘরের কোনও বেরোনোর দরজা নেই। শুধু একটা জানলা আছে মাত্র। ওই দেখ, একই ঘরের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছি আমরা। টেবিলের ওপর লিখে চলেছে কলম আর জানলার বাইরে, গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে, সেই কখন থেকে"
***
ফের জেগে ওঠে পিহু। আজ মাথার মধ্যে বড্ড কোলাহল। চোখ খুলে কষ্টেসৃষ্টে তাকিয়ে দেখে, আবারও রাত্রি এসে হাজির। আবার আরেকটা দিন চলে গেল। লেখা হলো না সমাপন। কলম তুলে নেয় পিহু। ওই তো, পিম্মি এসে গেছে, ওর একনিষ্ঠ স্রোতা। আজ ওকে ঘরে আসতে বলতে হবে। একদিনও ভেতরে আসে না মেয়েটা।
তখনও নিশুতি রাত। জানলার বাইরে বয়ে চলেছে আকাশগঙ্গা আর গঙ্গা, না মেশার সমান্তরাল স্রোতে। এই বিশ্বজগতে কে কার প্রকৃত পাঠক? কেউ নয়, কেউই তো নয়...।
সমাপ্ত।।

