ফটিক
ফটিক
শেষ মুহূর্তের মাইক টেস্টিং চলছে। ফ্লাস্কে আনা গরম জল খেয়ে একটু গলা খাকারি দিল সুলগ্না। এবার স্টেজে ওঠার পালা। “সুরতরঙ্গ” নামে একটা গানের দল আছে, সেই দলে গান করে সুলগ্না। তাছাড়া সোলো প্রোগ্রামও করে, কিন্তু সে টুকটাক। আজ “তানসেন মঞ্চ” তে “সুরতরঙ্গ”র গানের প্রোগ্রাম আছে। তারই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। মোবাইলটা সুইচ অফ করে স্টেজে উঠবে, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ! সন্তোষ ফোন করেছে। এইসময়! ও তো জানে সুলগ্নার গানের প্রোগ্রাম সন্ধ্যে ছ’টা থেকে। তাও এভাবে ফোন করার মানেটা কি!!!
- হ্যালো, আর দু তিন মিনিটের মধ্যে স্টেজে উঠতে হবে। কি ব্যাপার, তাড়াতাড়ি বল। এখন ফোন করলে হঠাৎ!
- একটা আর্জেন্ট ব্যাপারে লগ্না, ফটিক আবার-ও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তুমি প্লিস প্রোগ্রামটা শেষ হলেই চলে এসো। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে তো।
- আচ্ছা।
একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিল সুলগ্না।
গতবার যখন কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছিল তখন ডাক্তার বলে দিয়েছিল এই শেষবার, এরপর আবারও কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলে আর হয়তো কিছু করার থাকবে না। ধন্যবাদ জানিয়ে সুস্থ ফটিককে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সন্তোষ আর সুলগ্না।
গলার কাছে একরাশ হতাশা এসে দলা পাকিয়ে রয়েছে। সুলগ্না সত্যিই জানেনা ফটিককে আর সুস্থ করে তোলা সম্ভব কিনা। গলায় দলা পাকানো হতাশাগুলো কখন যে চোখের জলে পরিণত হয়েছে তা খেয়ালও করেনি সুলগ্না।
মঞ্চে তখন আলোর রোশনাই, দর্শকদের মধ্যে উৎসাহের জোয়ার। টেকনিশিয়ান দাদারা স্টেজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তারগুলোকে গুছিয়ে নিচ্ছে। সৌমিকদা তবলায় টোকা মেরে দেখে নিচ্ছে টুকটুক শব্দ করে। মানালীদি হারমনিয়ামটা বার করল বাক্স থেকে। সহ গায়ক-গায়িকারা কেউ চোখ বন্ধ করে মনঃসংযোগ করছে, কেউ বা ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে দেখে নিচ্ছে নিজেকে কেমন লাগছে। এই ব্যস্ততার মাঝে সুলগ্নার চোখের জলের ফোঁটাকে পাত্তা কে আর দেবে! শুধু ব্যাক স্টেজের বাল্বের আলো সেই চোখের জলের ফোঁটায় প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে তখন।
- কিরে লগ্না! স্টেজে উঠবি না? সবাই উঠে পড়ছে তো।
- হুমম রে চ।
- এনি প্রবলেম?
- না, না। চ।
- সন্তোষদা আসেনি বলে মন কেমন করছে বুঝি?
- আরে না রে, আমি কমপ্লিটলি ফাইন। চ, স্টেজে উঠি। পর্দা খুলছে।
সুরে, ছন্দে, তালে প্রোগ্রাম শুরু হলো। কোরাস সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে “সুরতরঙ্গ” দর্শকদের মন জয় করে নিচ্ছে এবারও।
সুলগ্নার বারবার ফটিকের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু তার প্রভাব মঞ্চে যাতে না পড়ে সে চেষ্টারও কোনো ত্রুটি রাখছে না। যখন মঞ্চে শেষ সংগীত “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে” পরিবেশিত হচ্ছে, বারবার সুলগ্নার গলা বুজে আসছে কান্নায়। আজও প্রোগ্রামে আসার আগে ফটিক, সুলগ্নার কোলে বসে এই গানটা শুনিয়েছে সুলগ্নাকে। সুলগ্না তখন ফটিককে কথা দিয়েছে এই গানটা আজ অনুষ্ঠানে খুব ভালো করে গাইবে। তাই হয়তো চোখ ছলছল করলেও সুলগ্নার গলায় কৃত্রিম আনন্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অনুষ্ঠান শেষে আর একটুও সময় নষ্ট করল না সুলগ্না। ব্যাগটা নিয়েই ছুট লাগালো, ট্যাক্সি নিয়ে নেবে।
- এই লগ্না, এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? এখানে ডিনারের ব্যবস্থা আছে তো। করে যাবি না?
- না রে, তোরা কেউ আমার প্যাকেটটা নিয়ে নিস।
- কি হয়েছে বল। আমরা যদি কিছু হেল্প করতে পারি।
- তোরা বুঝবি না রে। আমি আসি, কেমন।
- আমাদের তো আর বন্ধু ভাবিস না। ভাবলে ঠিকই বলতিস।
থেমে দাঁড়ালো সুলগ্না। পেছন ফিরে তাকালো, চোখেমুখে অসহায়তার ছাপ। সুলগ্না জানে কারণটা জানলে সবাই হাসাহাসি করবে। আর না বললে হয়তো বন্ধুত্বের প্রশ্নটা আরো বেশি তীব্র হবে। বড্ড দোটানায় পড়েছে ও।
সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো সুলগ্না। হাসির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একরাশ হতাশা, বেদনা, ক্রন্দন। বন্ধুত্ব রক্ষার খাতিরে সুলগ্না উত্তর দিল
- না রে। বন্ধু বলে ভাববো না কেন! এরম বলিস না।
- বন্ধুর বিপদে বন্ধু দাঁড়াবে না তো কে দাঁড়াবে! বল লগ্না।
- ফটিক…
কথা শেষ করতে পারলো না, ঢোক গিলল সুলগ্না।
- ফটিক? সেটা আবার কে রে?
চোখে জল চলে আসে সুলগ্নার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলগ্না উত্তর দেয়
- বাদ দে না রে। আসলে আমার রেডিওটা খারাপ হয়ে গেছে। ওটাকে সারাতে হবে।
সবাই বেশ হতবাক হল সুলগ্নার কথা শুনে। কেউ কেউ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়িও করলো। দু একজন হেসেও উঠলো।
- মানে? একটা রেডিও সারাতে হবে। তার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছিস! কাল সকালে সারাস। বাই দ্য ওয়ে, এখনকার যুগে রেডিও কে শোনে?
চোখ বন্ধ করে প্রশ্বাস নিল সুলগ্না। অত্যন্ত রূঢ়ভাবে দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চস্বরে তারপর জবাব দিল
- আমি শুনি। কিছু বলার আছে তোদের? আজ মানালীদির ছেলে কিংবা তৃপ্তির বাবা কিংবা শর্মিষ্ঠার হাসব্যান্ড অসুস্থ হলেও ঠিক এই কথাটাই বলতি তো? কাল সকালে ডাক্তার দেখাস। বলতি না, জানি আমি। ফটিকের ক্ষেত্রে কেন বললি? কারণ তোদের মনে হয় ও একটা পুরোনো আমলের বস্তু। কিন্তু আমার কাছে ও জীবিত। ও-ই আমার বাবা, ও-ই আমার বন্ধু। ও-ই আমার সন্তান। ও-ই আমার প্রেমিক। আর কিছু বলবি?
- সন্তোষদা জানে তোর প্রেমিকের ব্যাপারে?
কোনো উত্তর না দিয়ে মেকআপ রুমের দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল সুলগ্না। বন্ধ দরজার ভেতর থেকে হাসির খিলখিল শব্দ ভেসে আসছে। শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই ছুটে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলো সুলগ্না। হাত দুটো জড়ো করে ঠাকুরের কাছে ফটিকের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে চোখ বন্ধ করল ও। তারপর স্মৃতির সরনী বেয়ে পারি দিল নিজের বাল্যবেলায়।
খুব ছোট তখন সুলগ্না। ঠাকুমা রেডিও চালিয়ে বসে থাকত। কিছু বুঝত না, কিন্তু হাঁ করে রেডিওতে চলা গান শুনতো ও। যখন কোনো কারণে কেঁদে ফেলত ছোট্ট সুলগ্না, তাকে নিমেষে শান্ত করার জন্য বাড়ির বড়রা রেডিওটা অন করে দিত। ওমা! বেমালুম কান্না ভুলে ছোট্ট সুলগ্না তখন মন দিয়ে রেডিও শুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। তারপর যখন একটু বড় হল সুলগ্না, রেডিওতে গান বাজলে তার সাথে সাথে নিজেও গলা মেলানোর চেষ্টা করতে শুরু করল ও। সেসব দেখে ওকে গানের স্কুলে ভর্তিও করা হল। বারো বছরের জন্মদিনে ঠাকুমা যখন জিজ্ঞেস করল, “কি গিফট চাই দিদিভাই?”, সুলগ্না তখন বলেছিল “তোমার রেডিওটা দেবে ঠাম্মা? আমি খুব ভালোবাসি যে রেডিওটাকে”। তখন থেকেই রেডিওটা সুলগ্নার। তারপর যত সময় এগিয়েছে, সুলগ্নার সাথে রেডিওর বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে। বাড়ি থেকে বাধাও এসছে, “পুরোনো রেডিও, ফেলে দে”। নতুন মডেলের ভালো রেডিও কিনে দেবার প্রস্তাবও বিনা দ্বিধায় নাকচ করেছে সুলগ্না। একদিন সত্যজিৎ রায়ের “ফটিক চাঁদ” উপন্যাসটা পড়ে ওর মনে হল রেডিওটা ঠিক যেন ফটিক আর সুলগ্না যেন হারুন, দুজনে মিলে একটা নতুন জীবন, নতুন সম্পর্কের স্বাদ মনপ্রাণ ভরে গ্রহণ করছে। সেদিন থেকেই রেডিওটার নাম হল ফটিক। কোনোদিনও কোনো গানের অনুষ্ঠানে কিংবা প্রতিযোগিতায় যাবার আগে ফটিকের কাছ থেকে গান শোনা ওর চাই-ই চাই। এখনো সেই অভ্যেস বিদ্যমান। ছোটবেলার মতো ঘুম থেকে উঠেই ফটিকের গান না শুনলে এখনো কোনো কাজে মন বসে না সুলগ্নার। সন্তোষের সাথে যখন বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন বিয়ের আগে সুলগ্না সন্তোষকে বলেছিল
- শোনো, আমার একটা শর্ত আছে।
- কি গো?
- আমি ফটিককে খুব ভালোবাসি। বিয়ের পরও কিন্তু ওকে আমি অনেকটা ভালোবাসব। আহা! তোমাকেও বাসবো। কিন্তু ওকে একটু বেশিই বাসব।
প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও পরে ব্যাপারটা জানতে পেরে একটু হেসে সায় জানিয়ে সুলগ্নার কপালে আলতো করে চুমু খেয়েছিল সন্তোষ।
স্মৃতিচারণ করতে করতে ট্যাক্সিটা যে অনেকদূর চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সুলগ্না। ফোনটা বেজে ওঠায় সম্বিত ফিরল ওর। সন্তোষ ফোন করেছে। দুশ্চিন্তা মেশানো গলায় ফোন ধরলো সুলগ্না।
- হ্যালো
- আমি ফটিককে নিয়ে রাজু ভাইয়ের কাছে এসেছি। রাজু সারাচ্ছে। ও বলেছে ঠিক করে দেবে। চিন্তা করো না। আর শোনো, ডিরেক্ট রাজুর দোকানে চলে এসো। আমি ফটিককে নিয়ে ওখানেই ওয়েট করব।
স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলল সুলগ্না। কি অদ্ভুত ব্যাপার! ট্যাক্সির রেডিওতেও তখন গান চলছে “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”।