ফিরিঙ্গি জামাই
ফিরিঙ্গি জামাই
সকাল থেকেই এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে, থামা থামির নাম নেই। বিধু খুড়ো বাজারের ব্যাগ হাতে একবার ঘর আর একবার বাড় করছেন। তখন থেকে শুধু ভাবছেন, বৃষ্টি একটু কমলেই বেড়োবেন কিন্তু বৃষ্টি কমার নামই নিচ্ছেনা। এদিকে খুড়ি তখন রান্নাঘরে লুচি, সাদা আলুর তরকারি, কড়া পাকের নারকোলের নাড়ু করতে ব্যস্ত। বিধু খুড়ো হাতে থাকা বাজারের লম্বা লিস্টটা দেখছেন একবার করে আর চশমাটাকে নাকের ডগায় বসিয়ে বারবার ওঠানামা করছেন, আর বিড়বিড় করে চলেছেন আপন মনে। কারন আজ তার অনেক গুলো গ্যাঁটের কড়ি খরচ হবে, খুড়ি যা লিস্ট দিয়েছে ! এমনিতেই বিধু খুড়ো খুব কৃপণ, নয় নয় করে পাড়ার সবাই সে কথা জানে, এবং মনে প্রানে বিশ্বাসও করে, কারন দূর্গা পূজোর সময় বিধু খুড়োর কাছ থেকে একশো টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা যায়নি কোনো বছর। কিন্তু আজ আর কৃপণতা করা যাবেনা, কারন জামাই ষষ্টি বলে কথা,তার ওপর বিদেশ থেকে আসছে একমাত্র ফিরিঙ্গি জামাই। সে.. নাকি আবার বাঙ্গালী খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। তাই খুড়ির স্পষ্ট কথা আজ মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই, ফল,মূল সব গুছিয়ে আনতে হবে। বছরের একটা দিন জামাই ষষ্টি, তারপর একটাই জামাই কত আদরের।
বৃষ্টিটা একটু কমতেই বিধু খুড়ো বাড়ির বহু পুরনো চাকর হারুকে সঙ্গে নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ঘন্টা দুয়েক বাজার ঘুরে চার ব্যাগ ভর্তি করে শাক, সবজি, মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই, ফল, মূল কিনে নিয়ে রিক্সা করে বিধু খুড়ো যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন পাড়ার সব লোক অবাক বিস্ময়ে চেয়ে ছিল বিধু খুড়োর দিকে। পাড়ার লোক যেন বিশ্বাস করতেই পারছেনা বিধু খুড়োর এ... হেন আচরন। অবশ্য হারুর ও আজ চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে বিধু খুড়োর বাজার করা দেখে। কোনোক্রমে খরচের হিসেব কষতে কষতে মাথা ঠান্ডা রেখে বিধু খুড়ো বাড়ি ঢুকলেন, সাথে সাথে খুড়ি ব্যাগ পত্র নিয়ে রমলাকে নির্দেশ দিল কাটাকুটি, ধোয়া...ধুয়ি করতে। রমলা বিনা বাক্যব্যায়ে, সমস্ত কিছু নিয়ে রান্নাঘরে চলেগেল।
--------বিধু খুড়ো সবে একটু ফ্যানের হাওয়ায় বসে বিড়ি ধরালেন সুখটান দেবেন বলে, কিন্তু সেটাও.... হলনা!!!
-----------খুড়ি বলে উঠলেন, তোমাকে একবার আবার বাজার যেতে হবে,.......!!!
-----------বিধু খুড়ো একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন কেন???? এত বাজারেও তোমার শান্তি হয়নি আমি আর একটা টাকাও খরচ করতে পাড়বোনা তোমার ফিরিঙ্গি জামাই আদরের জন্য!!!! সকাল থেকে অনেক টাকা খসে.. গেছে আমার।
---------খুড়ি চোক পাকিয়ে বলে উঠলেন, তা..... টাকা গুলো সঙ্গে নিয়ে কি.... তুমি স্বর্গে যাবে। বিয়ের পড় থেকে কোথাও বেড়াতে গেলাম না, দামী শাড়ি কিনলাম না, গয়না গড়ালাম না, আমোদ আহ্লাদ কিছুই করা হলোনা, শুধু টাকা খরচের ভয়ে, তাহলে এত টাকা জমিয়ে তোমার কি... লাভ হলো শুনি, খুড়ি কাঁদতে বসে পড়লেন।
---------বিধু খুড়ো গলা খাঁখাড়ি দিয়ে বললেন, আহা ঠিক আছে... ঠিক আছে... আর কাঁদতে হবেনা, তা কিসের জন্য বাজার যেতে হবে শুনি...???
-----------খুড়ি চোখের জল মুছে বললেন, ঐ.... আমাদের মোড়ের মাথায় একটা বড় শপিংমল হয়েছেনা, কি সব ব্রান্ডেড জামা কাপড় পাওয়া যায়, ওখান থেকে মেয়ে জামাইয়ের জন্য কিছু কিনে আনতে হবে, জামাই বিদেশি তাই বিদেশি পোশাক দিতে হবে তাই না..।
----------বিধু খুড়ো ধড়পড় করে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, না না ও সব জামা কাপড়ের অনেক দাম, ওসব হবেনা আমার অত ক্ষমতা নেই!!!
------খুড়ি বলে উঠলেন, আরে মান সম্মানের ব্যাপার আছেতো একটা নাকি...!!! সব সময় সবকিছুতেই টাকার হিসেব কষলে হবে...!!
---------খুড়ো বলে উঠলেন কিসের মান সম্মান হ্যাঁ.... তোমার জামাই ফিরিঙ্গি সাহেব কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজা, মহারাজা তো... আর নয়!!!
-----------খুড়ি বললেন, এই প্রথম জামাই আমার আসছে কত দূর থেকে, এই রকম করোনা তুমি, যদি আমার কথা না.... শোন তাহলে আমি মেয়ে জামাইয়ের সাথে চলে যাব বিদেশে, বলে রাখলাম, তখন তুমি তোমার এই টাকা ধুয়ে জল খেও আর পড়ে থেকো। আমার এখন তোমার সাথে কথা বলার অত সময় নেই, যেটা বললাম সেটা যেন মাথায় থাকে। খুড়ি রাগ দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন, রমলা... এই রমলা... তোর কাজ হলো!!!! রান্না বসাতে হবে তো...দেরী হয়ে যাচ্ছে।
---------বিধু খুড়ো বিড়িটা নিভিয়ে দিলেন মুখটা যেন বিস্বাদ হয়ে গেল। আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বসে পড়লেন বিধু খুড়ো, তারপর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা কটা বার করে গুনে আবার পকেটে রেখে জোরে বলে উঠলেন, তা.... এক কাপ চা.... পাওয়া যাবে না..., জামাই আসবে বলে আজ আমার কপালে কোন কিছুই জুটবেনা নাকি!!!
----------খুড়ি চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে, জোড় শব্দ করে টেবিলে রেখে বললেন, এই যে চা..., আমার সব কাজ আমি ঠিকই করি, বলতে হয়না।
----------বিধু খুড়ো বলে উঠলেন, আচ্ছা একটা কথা বলোতো আমায়....???
---------খুড়ি বললেন কি..... কথা...???
---------বিধু খুড়ো বললেন, তোমার ফিরিঙ্গি জামাই বাঙ্গালী খাবার পছন্দ করে তুমি বললে তাইতো...???
---------খুড়ি বললেন হ্যাঁ.... মেয়ে তাইতো বলল, খুব ভালোবাসে নাকি বাঙালি খাবার খেতে!!!
--------বিধু খুড়ো বললেন, তাহলে আমি বলি কি....জামাই এর জন্য বাঙালি পোশাক পাজামা পাঞ্জাবি নিয়ে আসি বরং, কোনদিনও এই রকম পোশাক পড়েনি খুব পছন্দ হবে কি.... বলো???
---------খুড়ি কিছুক্ষন ভেবে বললেন, ঠিকই বলেছো তাই করো... তাহলে ।
---------খুড়োর বিঃস্বাদ হয়ে যাওয়া মুখটায় হঠাৎ করে চায়ের স্বাদটা ভালো লাগল। চা.... টা শেষ করে খুড়ো বাজার থেকে মেয়ের জন্য শাড়ি আর জামাই এর জন্য পাজামা পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে আসলেন।
****************************************
ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁতে না... ছুঁতেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গাড়ি। খুড়ো খুড়ি হাসি মুখে বাইরে বেড়িয়ে আসলেন। কিন্তু জামাইকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন!!! কারন জামাই হাফপ্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
---------খুড়ি ফিসফিস করে খুড়োর কানে বললেন, বলছি জামাইকি ফুল প্যান্ট পড়তে ভুলে গেছে নাকি গো....!!!
---------খুড়ো বললেন না.... গো না.... ওরা এই রকমই পোশাক পড়ে ছোট... ছোট...!!!
খুড়ি আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ে জামাইকে ভীতরে নিয়ে গেলেন। মেয়ের দেখাদেখি জামাইও খুড়ো খুড়িকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল।
---------খুড়ি মাথায় হাত দিয়ে আর্শিবাদ করে বলে উঠলেন, বেঁচে থাকো বাবা... বেঁচে থাকো।
--------জামাই কি... বুঝল কে জানে, হঠাৎ করে বলে উঠল বাআবাআ.. মিনস ফাদার, আই অ্যাম নট ইউর ফাদার, আই অ্যাম ইউর সান ইন... ল।
----------খুড়ি অবাক বিস্ময়ে জামাই এর দিকে চেয়ে রইলেন।
---------খুড়ো হাসতে হাসতে খুড়ির কানে ফিসফিস করে বললেন, তোমার জামাই ভেবেছে তুমি ওকে বাবা বলছ।
---------খুড়ি আবার বলে উঠলেন না....না বাবা আমি জানি তুমি আমার জামাই...,
----------জামাই কি বুঝল কে....জানে এক মুখ হাসি হেসে বলল, জ্যাম্যায়ই,,,
---------খুড়ি কথা না... বাড়িয়ে ওদের বসতে বলে রান্নাঘরে গেল।
কিছু ক্ষনের মধ্যে খুড়ি খাবার দাবার সাজিয়ে গুছিয়ে মেয়ে জামাইকে বসালো, ষষ্টির ফোঁটা দিয়ে পাখার বাতাস করে, হাতে সুতো যেই বাঁধতে যাবে তখন জামাই বলে উঠল.....
----------হ্যোয়াট ইস দিস মম.....!!!
----------খুড়ি জামাই এর কথায় বিষম খেল,
-----------বিধু খুড়ো বলে উঠলেন, ওটা মা ষষ্টির ধাগা হাতে বাঁধতে হয়....!
-----------জামাই বলে উঠল মারদাঙ্গা...
---------খুড়ি বললেন না....না বাবা মারদাঙ্গা নয়, তুমি হাতটা দাও আমি বেঁধে দিই এটা হাতে তাহলেই হবে।
--------মেয়ে পাস থেকে সমস্ত কিছু ভালো করে বুঝিয়ে দিল জামাইকে।
---------খুড়ি বলে উঠলেন নাও বাবা খাওয়া শুরু করো।
জামাই খাবার গুলো দেখতে লাগল ভালো করে।
----------খুড়ো বলে উঠলেন, খাও,,,, খাও.... আজ অনেক টাকা খসেছে আমার, বাজার করতে গিয়ে, ইলিশ ভাপা, চিংড়ির মালাইকারি, কষা মাংস সব একদিনে করা চাই, এখন এই ফিরিঙ্গির পেটে হজম হলেই হলো।
---------জামাই খুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল, হোয়াট আর ইউ টকিং ড্যাড..??
---------খুড়ো দাঁতে দাঁত চেপে বলল, নাথিং সান... নাথিং, আর বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, কি আর বলব,এখন বলার কিছু নেই শুধু হিসাব করা ছাড়া।
জামাই একটা একটা করে খাবার প্লেট থেকে তুলছে আর নাম বলার চেষ্টা করছে কিন্তু জামাইএর মুখে খাবারের নামগুলো শুনে অদ্ভুত রকম লাগছে খুড়ির, মনে হচ্ছে খাবার গুলো সব এক সাথে মিশে জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে।
---------খাওয়া দাওয়া মিটতেই জামাই খুড়িকে জড়িয়ে ধরে হাতে একটা চুমু দিয়ে বলল, ওয়াও ওয়াও ডেলিসিয়াস ফুড ইউ কুকিং মম। আই লাভ মালাইক্যারি, অ্যান্ড আই অলসো লাভ ইউ।
--------খুড়ির তখন মনে মনে ভাবছে, কি করে জামাই এর কাছ থেকে পালাবে।
খুড়ির অবস্থা দেখে মেয়ে আর খুড়ো তখন হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যাক খাওয়া দাওয়ার পর্ব ভালো ভাবেই মিটে গেল। খুড়ি মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরে বিশ্রাম করতে গেল। আর বিধু খুড়ো আরামকেদারায় বসে সুখটান দিতে লাগল।
-----------হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ আসল হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়ার ড্যাড...???
----------বিধু খুড়ো দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, বিড়ি খাচ্ছি বাবা, একটু শান্তিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে, তা.... এটাও কি তুমি খাবে???
--------জামাই কিছু না.... বলে, খুড়োর হাত থেকে অর্ধেক বিড়িটা নিয়ে টান দিতে লাগল।
--------জামাইয়ের কান্ড দেখে, বিধু খুড়োর চক্ষু চড়ক গাছ।
-------জামাই হাসতে হাসতে বলে উঠল, দিস ইস নাইস, প্লিজ... গিভ মি ওয়ান...!!
--------খুড়ো বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল এবং জামাই এর হাতে একটা বিড়ির গোটা প্যাকেট তুলে দিল।
********
সময় স্রোতে পার হয়ে গেল এক সপ্তাহ। বিধু খুড়োর এখন মাথা পাগলের মত অবস্থা, একদিকে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি বাজার করা জামাই আদরের জন্য, আর তার ওপর প্যাকেট প্যাকেট বিড়ির জোগান তাও আবার জামাই এর জন্য। তার সাথে বিধু খুড়োর আরামকেদারাও এখন জামাই এর দখলে। একটু বসে শান্তিতে সুখটান দেবে তারও উপায় নেই বিধু খুড়ো এখন শুধু মনে মনে ভাবছে ফিরিঙ্গি জামাই কবে বিদায় হবে বাড়ি থেকে।
.
