ওয়ার্ক ফ্রম হোম
ওয়ার্ক ফ্রম হোম
নিত্যদিনের অফিস যাত্রার অভ্যাস ত্যাগ হয়েছে অনেক দিন। ঘরবন্দী হয়ে পরে আছি মাস তিনেক। এ যন্ত্রণা থেকে কিছুটা মুক্তি পাই ও দেশে থাকলে তবু ।আমি আমার ঘর থেকে কাজ শুরু হয়েছে আমার শোবার ঘরের ভোল পাল্টে গেছে। বিছানাটাই এখন আমার দপ্তর ভরে গেছে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ফাইলপত্র, কিছু বই, নোট খাতা, কাপপ্লেট, প্লেট রাখার ম্যাট, বিস্কুটের ডিবে, জলের বোতল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে। যেখানে চলতে থাকে কাজ আর খাওয়া। শোওয়া ও ঘুমের জন্য আমি একটা সোফা ব্যবহার করতে শুরু করলুম। দিনের পর দিন বিছানার ওপরের চাদর পাল্টানো হয় না, তেল চিটচিটে হয়ে গেলো। সোফায় পড়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য বেশি ব্যবহারে সেটি আর আমার ভার সহ্য করতে পারলো না, একটি পায়া ভেঙে গেলো। নতুন করে একটা মজবুত সোফার আমি অর্ডার দিয়ে স্থানীয় দোকানে। ও কথা শুনে হাসলো খুব সকালে হাঁটার অভ্যাস ছিলো ওর সাথে, কিন্তু এখন তো ছাদে হাঁটা চলা হয়না। ওয়াকার কিনবো ভেবেছিলাম কিন্তু , কথাটা শুনে কাকা কাকিমার মুখ বেঁকানো দেখে কেনা হয়ে উঠলো না। এমনিতে দামি গাছ কিনি বলে , একটু আধটু কথা শুনতে হয়। আমার নাকি বড়োলোকি সখ হয়েছে।
সোফাটা এনে তারা হাজির করলো কিন্তু কিছুতেই আমার দরজা দিয়ে সেটা ভেতরে গলানো গেলো না। আমার অবস্থার কথা শুনে ও রিপ্লাই করলো"তোর মতন স্বাস্থ্যবান বলে এমন অবস্থা।" ও কথাতেই প্রথমে তারা দুজন এসেছিলো, আরো লোক আনতে হলো তখন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।
ও কিভাবে জানি না আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ক ফর্ম হোম ব্যবস্থায় আট ঘন্টার জায়গায় কাজটা করতে হয় দশ বারো ঘন্টা। বাড়িতে বসে কাজ করার শারীরিক ধকল ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য ও কিছু সময় ব্যয় করে আঁকা শুরু করতে বললো। বাড়ির লোক এবার ভাবতে শুরু করলো , পাগল হতে শুরু করেছি কারণ মাঝে মাঝে পুরানো হারমুনিয়াম গান গাইলাম, কোন শ্রোতা নয় নিজের জন্য। আমার যে কিছু হয়নি, এটা আমি তাদের বুঝিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও তারা বুঝলো কিনা জানিনা, উপরন্তু আমার দিকে কেমন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো সবাই।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর ফলাফল কিনা কে জানে! কম্পিউটারে একটানা কাজ করতে গিয়ে নিজেকে মনে হলো, একটি নির্জন দ্বীপে আমি একাকী রয়েছি। এঘর ওঘরের মধ্যে পার্থক্যকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের এপার আর ওপার। কাজের মধ্যে যখন গভীরভাবে প্রবেশ করি তখন এটাও মনে হলো চোখের দুটো বল চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে অবস্থান করছে। চোখে হাত দিয়ে বুঝতে পারি, না না, সেগুলো যথাস্থানে রয়েছে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে একা আমি হইনা কখোনো।ওর সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ঘরা ফেরা করে চারপাশে। ওর কথা মনে না পরলেও। ও করা ম্যাসেজ গুলো আমাকে ওর কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও সব সময় রিপ্লাই দিই না। কারন প্রেমে পড়া বারণ।
তবে ওকে মিস করি খুব , মুখে না বললেও ও সেটা বুঝতে পেরে। আমাদের সম্পর্কটা মন দেওয়া নেওয়ার সীমান্তে দাঁড়িয়ে। মনের কথা না বললেও সব কথাই বুঝতে পারি দুইজনেই। ওকে শুধু আমি মিস করি এমনটা নয়।
বাড়িতে বসে কাজ করে করে আমি ,মানুষজনকে খুব মিস করি। মানুষের সাথে কাজ করার একটা আলাদা মজা আছে। জুম কলের সাহায্যে সতীর্থদের সাথে মিটিং করে সেই অভাব মেটে না। নামেই জুম , নিজেকে এতো ছোট একটি চৌকোর মধ্যে দেখে বেশ অদ্ভুত লাগে। ক্লান্ত ক্লান্ত লাগলে ওর কথা মনে পরে। বলতে পারেন ,বাড়িতে থেকে কাজ করে মানুষ কীভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে!
কলিগরা ক্লান্ত। মানুষগুলোকে দেখে আমার হতাশার থার্মোমিটারের পারদ আরও চড়ে যায়। মিটিং করার জন্য ই-মেল করা, মিটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া, বসের কাছ থেকে কাজ নেওয়া, মিটিং শেষের পর কাজের ফিরিস্তি নোট করা, পরবর্তী মিটিংয়ের বিষয় ঠিক করা প্রভৃতি করতে গিয়ে সেদিন কাজের সময় সামান্যই বেঁচে থাকে। শুতে শুতে রাত হয়ে যায়। প্রিয় মানুষের সাথে কথাও বলতে পারি না।
মিটিংয়ে যারা হাজির থাকি তাদের মধ্যকার গুমরে থাকা অবসাদ, পরিমাপ করলে দেখা যেতো সেটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।কন্ঠনালী তার। ছাপ থাকে।বাড়িতে বসে আমাদের কোম্পানিকে যে আউটপুট দিই তা অনেকটাই ফোলাফাপা, মানে বেশি। অফিস যেতাম তখন এর সিকিভাগ দিতাম না। এখন বাড়িতে আমি যে পরিমাণ চুপচাপ থাকি তাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন অফিসে গেলে, কথা বলতে ভুলে যাবো হয়তো । ভুলে যাবো অফিসের সেই নির্ধারিত ড্রেসটা পরতে। কেউ হয়তো যাবো হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে আবার কেউ বা যাবো খালি গায়ে। এইভাবে চলতে থাকলে আগামীদিনের মায়েরা যখন তার শিশুকে হাত ধরে মিউজিয়ামে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তারা সেখানে একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলবেন, “ঐ দ্যাখো ঐটা হলো একটা অফিসের ছবি যেখানে আছে কিছু আলোকিত কক্ষ, কিছু মানুষ কয়েকটি কম্পিউটারের সামনে বসে একাগ্রচিত্তে কি যেন দেখছে।"
মঙ্গল কাব্য যতোই চাঁদ সদাগর , ধনপতি সাগরের গল্প থাকুক।বাঙালি মানে ৯টা ৫টা ডিউটি করে মাছভাত খেয়ে, স্টার জলসা আর পাড়ার মোড়ে আড্ডা দিয়ে দিন কাটাবে। যাইহোক ও কথা দিয়েছে তবুও, পয়লা বৈশাখের আগে ফিরে আসবে দেশে। ব্যবসা শুরু করা ঝুঁকি নিতে চায় ও, একটু সময় দিতে পারে যাতে আমাকে , কিন্তু যেটা জানতে পেরে কথা বলতে বন্ধ করেছি আমি। বলছি যা কথা হবে সামনাসামনি দেখা হলে।
যদিও অনর্গল কথা বলতে চাই আমি ওর সাথে । তবু বলছিনা কারণ! প্রেমে পড়া বারণ
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
