নস্টালজিয়া-এক অনন্য প্রাপ্তি
নস্টালজিয়া-এক অনন্য প্রাপ্তি
চারিদিকে তীব্র দাবদাহ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য জ্বালাময়ী কিরণ বিচ্ছুরণ করছে। বইছে উত্তপ্ত বাতাস যেন একরাশ আগুনের হলকা নিয়ে। সবাই চাইছে একপশলা বৃষ্টি। কিন্তু অগ্নিময় আকাশে একচিলতে মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। এই হল গ্রীষ্মকাল,সংস্কৃতে যাকে বলে নিদাঘ।
আমাদের স্কুল লাইফে নিদাঘের একটা আলাদা তাৎপর্য ছিল। সেইসময়টা পরীক্ষা শেষ হত মার্চের শেষে আর এপ্রিল জুড়ে ছুটি। সেই ছুটির আমেজই আলাদা। পরীক্ষান্তের পর দুসপ্তাহ তো পড়াশোনার কোনো বালাই নেই,একেবারে ঝাড়া হাত পা। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার পর ভোরের সোনালী রৌদ্রে মাঠের সবুজ ঘাস যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। ছুটে যেতাম সেই মাঠে। অবশ্য তার আগেই সেখানে হাজির হয়ে যেত আমার মতো ফাইভ সিক্সের কচিকাঁচাদের দল ব্যাট বল আর উইকেট নিয়ে। শুরু হত ক্রিকেটের মর্নিং সেশন। আর প্রত্যেকেই সেখানে প্রফেশনাল। ফিল্ডিং বা ক্যাচ মিস করলে ক্যাপ্টেন যা বকাঝকা করত কে বলবে তখন এটা পাড়ার কচিকাঁচাদের খেলা! অনেকে তো বাড়ি থেকে বিস্কুট আর জলের বোতলও নিয়ে আসত।এইভাবে কখন বেলা গড়িয়ে নটা হত ,কেউ খেয়ালই করত না। খেয়াল করত তখন যখন মাঝে মাঝে দর্শকরা যখন উত্তেজিত হয়ে খেলা বন্ধ করে দেয় তেমনই পাড়ার কয়েকজনের মা বা দাদু এসে খেলা বন্ধ করে দিত। একজন মিলিটারি দাদু তো তাঁর নাতিকে বলেই দিয়েছিলেন,"এবার যদি সাতসক্কালেই তোকে মাঠে দেখি ,তাহলে একদম ডাণ্ডা দিয়ে মেরে ঠাণ্ডা করে দেব। জানিসই তো,আমি আর্মির লোক। সবসময় খালি টো টো। পড়াশোনার বালাই নেই কোনো। চল বাড়িতে।" রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যাওয়া দাদুকে কে বোঝাবে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে।
দুপুরে কাঁচা আমের টক ডাল আর এঁচোড় কি কাঁচকলার সুস্বাদু তরকারি দিয়ে দারুণ খাওয়া দাওয়া। তারপর ঘুম বা টিভি,বিকেল সাড়ে চারটে থেকে আবার মাঠে খেলা। সকালে যখন বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তিবোধ বাড়ত,বিকেলে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠে( আমাদের বাড়িটা একটু গ্রামের দিকে ছিল) হু হু করে বইত শীতল বাতাস।স্বাদ এনে দিত স্বস্তি আর মুক্তির। মাঝেমাঝেই আশেপাশের ঝোপজঙ্গলে বল হারিয়ে যেত। আর যখন বল পাওয়া যেত না তখন সেই নিদাঘ অপরাহ্ণের গোলাপী আলোয় সবুজ প্রান্তরে বয়ে চলা ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে গোল হয়ে সবাই একসাথে বসে শুরু হত গল্প। সেইসব গল্পের বিষয়বস্তু কোনো রূপকথার গল্প,ব্যাটম্যান ,শক্তিমান বা শশশ কোয়ি হ্যায়।ধীরে ধীরে দিগন্তকে রক্তিম রঙে রাঙিয়ে অস্ত যেতেন দিবাকর। আকাশের এক কোণে একফালি চাঁদ।।ফুরফুরে মুক্ত বাতাসের মধ্যে সেই গো
ধূলির রক্তিমায় আমাদের শৈশব যেন মুক্তির গান গাইত।দূরে মসজিদের আজান আর শেয়ালের ডাক আর বাঁশবন হাতছানি দিত এক রহস্যে ঘেরা অতীন্দ্রিয় জগতের দিকে।
রাতে দাদুর কাছে শুনতাম পুরাণ আর রূপকথার গল্প।
কোনো কোনো বিকেলে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যেত। ধেয়ে আসত কালবৈশাখী। কালবৈশাখী শুরু হওয়ার আগে অম্বরে ঘনকৃষ্ণ জলধরের পটভূমিতে ধু ধু খোলা মাঠে ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে সময় কাটানো দারুণ ব্যাপার। একজন দাদা তো একদিন বলেই দিয়েছিল,"দেখলি তো,ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের থেকে এখানের প্রকৃতি কম রোম্যান্টিক নয়। এই ওয়েদারে খেলতে দারুণ লাগছে।"
ক্লাস এইট নাইনে পড়ার সময় গল্পের সময় শক্তিমান আর শাকালা কা বুম বুম এর গল্পের জায়গা নিল সহপাঠী আর সহপাঠিনীদের প্রেমকাহিনী। তখন আমাদের বয়ঃসন্ধিকাল,চোখে রোম্যান্সের ছোঁওয়া ,রক্তে মিশে গেছে অ্যাডভেঞ্চার। তখন হৃদয়ে বাজছে ' দিল তো পাগল হ্যায়',হৃদয়হারিণী যেন মাধুরী দীক্ষিত।
তখন আমিও কৈশোরের অমোঘ নিয়মে শুচিস্মিতার প্রেমে পড়েছি। আমাদের এই নির্বাক প্রেমের সাক্ষী শুধু গভীর রাতের ফুরফুরে হাওয়া আর একলা চাঁদ। এরপর টেন,ইলেভেন,টুয়েলভ কখন ঝড়ের মতো কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। শুচিস্মিতার সাথেও আর দেখা হত না।বিরহের তীব্রতায় অন্তরে তীব্র দাবদাহ,প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ হয়েই চলেছি।
এরপর কলেজে উঠে ফিজিক্স অনার্স নিলাম। ম্যাথের জন্য ভর্তি হল প্রফুল্লস্যারের কাছে। গরমের ছুটিতে কলেজ বন্ধ। স্যার রাতের ব্যাচ বন্ধ করে সকালে পড়াতে শুরু করলেন।ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছটা ছুঁইছুঁই। সোনালী রোদের আলোয় সাইকেল নিয়ে ছুটতাম স্যারের বাড়ির দিকে। আর সকালের একরাশ তাজা হাওয়ার মতো মাঝে মাঝে পথেই দেখা হত শুচিস্মিতার সঙ্গে। এখানেই যে ওদের বাড়ি। এভাবেই আবার শুরু হল 'Infatuation Turns To Love' এর গল্প।বিরহ যেমন দগ্ধ করে,তেমন হারানো প্রেমকে ফিরে পাওয়া সেই জ্বালা জুড়িয়ে দেয়।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। সেই সবুজ মাঠ আর নেই,সেখানে গজিয়েছে ফ্ল্যাট। মার্চ মাসের শুরুর দিকে যেখানে শোনা যেত কোকিলের কূজন,সেখানে যানবাহনের যান্ত্রিক কোলাহল। হারিয়ে গেছে শৈশব। হারিয়ে গেছে বিকেলের সোনা রোদ। কিন্তু কোথাও না কোথাও এখনো সদর্পে বিরাজ করছে প্রকৃতি,সদর্পে বিরাজ করছে ভালোবাসা।
আজ বহুদিন পরে যাচ্ছি প্রফুল্লস্যারের বাড়ি। জানি না আবার দেখা হবে কিনা শুচিস্মিতার সাথে!বহু পরীক্ষাই ফার্স্ট হয়েছি,লেখালেখিতেও বহু পুরস্কার জিতেছি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারে সেরা প্রাপ্তি আজকেই পেতে চলেছি।