STORYMIRROR

কবিতা মালা

Tragedy Inspirational Others

4  

কবিতা মালা

Tragedy Inspirational Others

নষ্ট মেয়েমানুষ

নষ্ট মেয়েমানুষ

4 mins
182


আমি মিতুন,প্রথমে আমার পরিচয় সকলের জানা দরকার । ব্যাঙ্গালোরে থাকি, ওখানেই বড় হওয়া আর পড়াশোনা। মা বলে আমার জীবন বোধ ভীষণ কম , বন্ধুবান্ধবের সাথে হৈ হৈ করে কাটিয়েছি এতোকাল। মা প্রায় জোর করে পাঠালো কলকাতায় দিদুনের বাড়ি। আমার মামা আর দাদুন দুজনেই উকিল তাই এ বাড়িতে অনেক মানুষের যাতায়াত। দাদুন অবশ্য একাজে অবসর নিয়েছে কিন্তু আমার বুজম ফ্রেন্ড কাম মামা প্র্যাকটিস করে বাড়িতে বেশ নামও করেছে। আমার মায়ের আশা এখানে থাকলে আমি জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠব।


    এখানে আসার পর বেশ কেটে গেছে একটা মাস । মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় মা, বাপীর জন্য যদিও ফোনে যোগাযোগ হয় প্রায়ই। ওখানের বন্ধুদের খুব মিস করি। মনখারাপী মেঘ যখন ছেয়ে ফেলে আকাশটা দিদুনের খোলা বরান্দায় এসে দাঁড়াই ,এই ডিসেম্বরের পৌষালী মিঠে রোদ আদর দিয়ে ভুলিয়ে দেয় শোক।


    এই বাড়িটা থেকে কিছুটা দূরে টালির চালের পর পর অনেক গুলো ঘর। দূর থেকে দেখলেও বোঝা যায় সেখানে অনেক গুলো পরিবার পাশাপাশি বাস করে। ইদানিং লক্ষ্য করি একটিসাতাশ আঠাশ বছরের তরুণী আমাকে মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে দেখে, চোখে চোখ পড়তেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

মেয়েটিকে দেখার আগ্রহ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে , ভালোই বুঝতে পারছি। একটু বেলা বাড়তেই বই পড়ার অছিলায় বারান্দায় এসে বসি। মাঝে মধ্যে উঁকি ঝুঁকিও মারি দেখতে না পেলে। একদিন সে দেওয়ালের আড়ালে একবৃদ্ধাকে চান করাচ্ছিল। আমি যে খুঁজছি বুঝতে পারে তাই একটু লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম, একটা মেয়ে আর একটা মেয়েকে দেখতেই পারে - এই ভেবে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্ঠা করি।


 এমন করে আরো কতকগুলো দিন কেটে যায়। মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া, মামার বন্ধুদের সাথে পিকনিক যাওয়া , মায়ের মামার বাড়ি দিদুনের সাথে কয়েকটাদিন কাটিয়ে আসা, কলকাতার বিভিন্ন শপিং মল, যাদুঘর, রেঁস্তোয়া কোন কিছুই বাদ থাকে না। তারমধ্যেও তরুণীটির সম্পর্কে জানার আগ্রহ কমে নি। লক্ষ্য করি, সকালে উঠে মুখ বুজে দৈনন্দিন কাজ কর্ম সারে, দেখলে মনে হয় মেয়েটা বুঝি বোবা। চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে তার পরিচর্যাও করে। 

 আর একটি বিষয় ভারি অদ্ভুত লাগে পাড়ার মানুষগুলো যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে ঘরটার সামনে এসে নাকে রুমাল আবার কেউ আঁচল চাপা দেয়। কৌতুহল বাড়তে থাকে, তারা কিসের গন্ধ পায়? ওখান দিয়ে যাওয়ার সময়।


এখানে এসেছি অনেকদিন হলো, শীত, বসন্ত দুটো ঋতু পার হয়েছে । এখন কালবৈশাখীর সময়, বিকেলে মাঝে মাঝেই ঝড় ওঠে। জামা গুলো কেমন রঙচটা হয়ে গেছে তাছাড়া এগুলো অনেক দিন ধরে ব্যবহার করছি, এখানে এসেছি অনিচ্ছায় তাই আসার আগে মার্কেটিং করি নি। ঠিক করলাম আজ একাই নিউ মার্কেট যাব। যখন ফিরছি কাজল মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলেছে সঙ্গে ঝোড়ো হওয়ার দাপট , বাস থেকে নেমে তারই মধ্যে হাঁটা শুরু করলাম কিন্তু বৃষ্টি নামায় সেই টালির চালের ঘরগুলোর একটার দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালাম। বাকি ঘর গুলোর দরজা বন্ধ ছিল, সেই তরুণীটিতার ঘরের কপাট খুলে একটা ছাতা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে ।আমি ছাতাটা নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সবে জিজ্ঞাসা করতে যাবো কবে ফেরত দিতে হবে ছাতা, ততক্ষণে কপাট বন্ধ করে দিয়েছে। খানিকটা বৃষ্টি থামলে সেই ছাতা নিয়েই ফিরে এলাম।


দিন তিনেক পর ছাতাটা ফেরত দেওয়ার জন্য ওদের দরজায় কড়া নাড়লাম, মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল তখন প্রায় সন্ধে, ওরা সবাই তখন জলখাবার খাচ্ছে। আমাকেও চা বিস্কুট দিল। এক বৃদ্ধা ,মনে হলো মেয়েটির শাশুড়ি কথায় কথায় আমার কিছুটা পরিচয় জেনে নিল ,তবে আমার মায়ের ইচ্ছেটুকু বেমালুম চেপে গেলাম। ঘরের কোণায় বসে থাকা লোকটা সামনে রাখা কাপটি হাতড়ানো দেখে মনে হলো সে অন্ধ। সেই ফুটফুটে ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ায়, ওর আমি একটা ক্যাডবেরী দিই আর নাম জিজ্ঞাসা করতে বলে গোগোল ওর নাম। কিছুটা সময় কেটে গেল নানান কথা বলতে, তবে সেদিন মেয়েটি র সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না।


দ্বিধা কেটে যেতে অনেকবার ওদের বাড়িতে গেছি। গোগোলকে কিছু না কিছু উপহার দিতাম। ওর সাথে সময় কাটাতাম। মেয়েটি সংসারের কাজকর্ম করতে করতে আমাদের সঙ্গ দিত কিন্তু ব্যক্তিগত কোন কথা বলত না। একদিন ফিরে আসার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম "তোমার নাম কী গো? "সে স্মিত হেসে বলল" এ পাড়ায় আমাকে সকলে নষ্ট মেয়েমানুষ বলে ডাকে। " বলে সে ভেতরে চলে গেল। সব কথার প্রতি উত্তর হয় না তাই সেদিন চুপ থাকলাম। সেই সময় অন্যঘর থেকে তার শাশুড়ি তাকে ডাকছে ,"জবা ও জবা আমার অনেক বেলা হয়ে গেল চানের জল কী তোলা হয়েছে?"


ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাওয়ার দিন আসন্ন। প্রতিদিনের মতো যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি দেখি জবা দূর থেকে ইশারায় কিছু বলতে চাইছে আমাকে একদিন পরে গেলাম ওদের বাড়িতে। আজ সে যেন অন্য মানুষ নিজের কথা বলতে উদগ্রীব প্রথমটা একটু অবাক হয়ে ছিলাম। তার সমস্ত সংকোচ , দ্বিধা মুহূর্তে ধুলোয় মিশে গেল। আমার হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল "তোমাদের ওখানে একটা চাকরী দেবে আমায়। এই নরক যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি চাই। " আমি তাকে শান্ত করলাম, একজায়গায় বসিয়ে তার জীবন ইতিহাস 

শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি।


গল্পটা ছিল , জবা ভালোবেসে বিয়ে করে ,বাড়ির অমতে । প্রথম কয়েক বছর তারা ভালোই কাটছিল। তার স্বামী বাজির কারখানায় কাজ করত, মালিকের বেশ কাছের লোক ছিল। দুর্ঘটনায় তার স্বামী অন্ধ হয়ে যায়, মালিকের নখ, দাঁত বেরিয়ে পড়ল অবশ্য কারখানা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে তাকে নিয়োগ করা হয়। রোজ কাজে না গেলেও মাসের টাকাটা বাড়িতে পৌঁছে যায়। বিনিময় ছিল মালিককে খুশি করা আর বিসনেস যাতে আরো বড়ো হয় তাদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গদান। এ ব্যপারটা সকলেরই অবগত ছিল পাড়ার লোকের,তারা প্রথম প্রথম আপত্তি জানায় পরে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে নাকে চাপা দিয়ে হাঁটে তার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন যায়।তার জন্য কতোটা করতে পারবো জানি না তবে চেষ্ঠাটা জারি থাকবেই।


জবা ,এই সমাজ আর সমাজের মানুষের কাছে যাইহোক না কেন , আমার কাছে বাঁচার গল্পের নায়িকা হয়েই চিরকাল থাকবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy