সকালবেলার ফুল (শেষ পর্ব)
সকালবেলার ফুল (শেষ পর্ব)
সুদীপ্তর সাথে ও.সির ভালোই পরিচয় আছে। সেই রাতেই সে তাকে ফোন করে সব কথা খুলে বলল। সব শোনার পর তিনি বললেন
" সবটাই শুনলাম তবু কিছু ফরমালিটিস থেকেই যায়। আপনি কালকে থানায় এসে রিপোর্ট করে যান।"
সকালে সুদীপ্ত রিপোর্ট লেখাতে গেল ও.সি বললেন
" কাল আপনি যে ফোন নম্বরটা আমায় দিয়েছিলেন সেই ব্যাপারে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি বেশ কয়েকদিন আগে এই নম্বরের সিমকার্ড মিসিং হয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়েছিল। আর আপনি যাকে সন্দেহ করছেন সেই ব্যক্তিই ডায়েরী করে । ব্যাপারটা বেশ জটিল। কারণ
কিডন্যাপার এরকম কাঁচা কাজ করবে বলে আমার মনে হয় না।তিনি আরো বললেন
এই ছেলেটিকে যদি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিই তবে এই মুহুর্তে আর কোন ব্যক্তিকে আপনার সন্দেহ হয়?"
" নাহ্ আর কারোর কথা তো মনে আসছে না।"
"ঠিক আছে। দ্বিতীয় বার যদি ফোন আসে আপনি কথা বলবেন আর আমরা লোকেশনটা বোঝার চেষ্ঠা করবো। করণীয় যা কিছু আমাদের সহকর্মীরাই করবে।"
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল সুদীপ্ত বাড়িতেই আছে। ভাবল সরলাদেবীর ঘরটা অনেকদিন অপরিষ্কার হয়ে পড়ে আছে। তাই বিছানার পাল্টালো, বালিশ রোদে দিল। বিছানা পরিষ্কারের সময় ম্যাসট্রেসের নীচে সরলাদেবীর হাতে লেখা একটা চিঠি খুঁজে পেল।
স্নেহের সুদীপ্ত,
" যে কথাটা মুখে বলতে পারি নি। আজ তোকে লিখে জানাছি। কিছুদিন আগে কুমারেশ এসেছিল এই বাড়িতে। জিভের জড়তার জন্য তোকে সব কথা বোঝাতে পারতাম না। তাই তোকে বলতে আয়াকে আমিই বারণ করেছিলাম। শরীরের যা অবস্হা বুঝতে পারছি দিন বোধহয় ফুরিয়ে এলো। তাই কাগজ আর কলমের সাহায্য নিলাম। কুমারেশ সেদিন আমাদের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের দলিলে সই করে দিতে বলেছিল। আমি করি নি। ওটা তোর জন্য রইল। একটা সময় ওর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবাকেও অবিশ্বাস করেছিলাম আর ওনার সব সম্পতি আমার নামে লিখে দিতেবাধ্য করেছিলাম । ভালো মানুষ ছিলেন শেষপর্যন্ত তাই করলেন। আর আমি পাপের শাস্তি পেলাম। কুমারেশ বিশ্বাসঘাতকতা করলো । মিথ্যে বলে আমাকে দিয়ে সব কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিল। তখন আমি আর কুমারেশ কেউই এই ফ্ল্যাটটার কথা জানতাম না। তোর বাবাই হয়তো ওইটুকু আমাদের হাত থেকে বাঁচাবেন বলে কাগজগুলো সরিয়ে রেখেছিলেন। তারপর হার্ট অ্যার্টাকে উনি চলে গেলেন। এর জন্য পরোক্ষ ভাবে আমিই দায়ী ছিলাম। আমার ধারণা কুমারেশ কোনভাবে দলিল টা চুরি করেছে। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেছে। সে হয়তো কোন ক্ষতি করতে পারে। সাবধানে থাকিস। আর একটা মারাত্মক অন্যায় স্বীকার করার আছে বাবা। বিদেশ থেকে ফেরার পর তোকে আমরা মিথ্যে বলেছিলাম । শ্রেয়া মারা যায় নি। তবে এখন কোথায় আর কিভাবে আছে কোন খবরই জানি না।
তুই চলে যাওয়ার পর আমি ওকে তোর বাবার সামনে কুলটা প্রমাণ করাই । অবশ্য এ ব্যাপারে কুমারেশ আমায় সাহায্য করেছিল । পুরো ঘটনাটা এমন করে সাজিয়ে ছিলাম তোর বাবা শেষে নিজেই ওকে তাড়িয়ে দিলেন। আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার মেয়ে বাড়ির বউ হোক চেয়েছিলাম। আর সেটাই ছিল কারণ । শ্রেয়াকে লেখা তোর পাঠানো
চিঠিগুলো আমিই ছিঁড়ে ফেলতাম। আর ফোন করলে ডিসকানেক্ট করে দিতাম। ভগবানের মার বোধহয় একেই বলে যে আমি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতাম সেই আমিই একদিন কুমারেশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ফোন করে তোর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম। পারলে ক্ষমা করে দিস।"
ইতি - ছোট মা
চিঠিটা পড়ার পর সুদীপ্তর মনে হয়
" তবে এ কাজ কুমারেশের নয় তো।"
সকালে সুদীপ্ত আর একবার থানায় যায়। তাদের বাড়িতে কুমারেশের যাতায়াত বেশী ছিল তাই তার অনেক ছবি ও ছিল। তার মধ্যে একটি ছবি নিয়ে ও.সিকে বলে এই লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তার মায়ের লেখা চিঠির সব কথা খুলে জানালো। তিনদিন পর পুলিশ কুমারেশকে খুঁজে বার করলো আর তিথিকে উদ্ধার করে। কুমারেশ গ্রেফতার হওয়ার পর সুদীপ্ত
নিজের ভুল বুঝতে পারে । শ্রেয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফোনও করে। কিন্তু শ্রেয়া তার সাথে কথা বলল না। অন্য নম্বর থেকে ফোন করলে তার গলা শুনে সে ফোনটা কেটে দিল।
এরপর তিথি আর সোহম নিয়মিত দেখা করতো এই ব্যাপারটা সুদীপ্ত জানতো তাদের কোন বাধা দিল না। সোহম তিথি কে জানিয়েছিল তার ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর যেদিন সে প্রথম কলেজ যায় (কিডন্যাপের দিন) সেদিন সোহম তার সাথে দেখা করতে কলেজে গিয়েছিল। তার বন্ধুদের জিজ্ঞেসও করেছিল তিথি কখন কলেজ থেকে বেরিয়ে ছিল কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারে নি। সে তার ফোনে অনেকবার কল করেছিল। প্রতিবারই সুইচ অফ বলছিল।
মোবাইল হারানোর এবং তিথির সাথে দেখা না হওয়ার পর থেকে সোহম তার ছোটবেলার বন্ধু সায়নের বাড়িতেই বেশ কয়েকদিন আছে। সে চেয়েছিল তার মা তারজন্য চিন্তা করুক, কষ্ট পাক তাই সে সায়নকে বলেছিল
"মা যদি তোকে জিজ্ঞেস করে আমার কোন খবর জানিস কিনা বলবি তোর সাথে আমার অনেকদিন দেখা হয় নি।"
তবু সায়ন শ্রেয়াকে সব কথা জানিয়ে দিয়েছিল। সোহম তাদের বাড়িতে আছে জেনে শ্রেয়াও নিশ্চিন্ত হলো।
একদিন সোহম আর সায়ন অফিস থেকে আলাদা দুটো স্কুটিতে ফিরছিল। সোহমের স্কুটি অ্যাকসিডেন্ট করলো। সায়ন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে শ্রেয়াকে ফোন করে। আর তিথিকে ও জানালো। তিথি সুদীপ্তর সাথে সেই হাসপাতালে গেল। তার আগেই শ্রেয়া আর তমাল সেখানে পৌঁচ্ছে গেল। শ্রেয়া দূর থেকেই তমাল কে চিনতে পেরে মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছিল। শ্রেয়া ভাবল
" কি সাংঘাতিক মানুষ এই সুদীপ্ত । পাশে তো তিথি রয়েছে তারমানে তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এখানে তার কী প্রয়োজন! ভগবান যা করেন ভালোর জন্যই করেন তার সাথে বিয়ে হলে হয়তো কপালে চরম দুর্গতি ছিল।"
সুদীপ্ত নিজেই এগিয়ে এসে তমালকে জিজ্ঞেস করলো
" এখন কেমন আছে?"
শ্রেয়া পাশেই ছিল। সে কোন কথাই বলল না। তমাল বলল
" রক্তপাত প্রচুর হয়েছে। নার্স বলেছে রক্ত জোগার করতে হবে। তাই একজনকে ব্লাড ব্যাঙ্ককে পাঠিয়েছি। "
যাকে রক্ত আনতে পাঠানো হয়েছিল কিছুক্ষণ পর সে এসে বলল
" নেগেটিভ গ্রুপের কোন রক্তই নেই।"
শ্রেয়ার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। তমাল বলল
" তবে এখন কী উপায়?"
একজন নার্স এসে বলল
" রক্ত এনেছেন?"
শ্রেয়া আর তমাল দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সুদীপ্ত এগিয়ে গেল । নার্সকে বলল
"কোন গ্রুপের রক্ত চাই বলুন তো?"
"সেকি ওনাদের আমি তো বলেছিলাম। তার মানে এখনো রক্তের জোগার হয় নি। এতো দেরী করলে পেশেন্টকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে।"
সুদীপ্ত নিজের পরিচয় দিল। সেও একজন ডাক্তার।
সোহমের রক্তের গ্রুপ জানার পর সুদীপ্ত তাকে রক্ত দেয়। তিনদিন পর সোহম কিছুটা সুস্হ হয়ে ওঠে। একদিন আকস্মিকভাবে সুদীপ্ত আর শ্রেয়া হাসপাতালে পরস্পরের মুখোমুখি হলো। সোহমকে রক্ত দিয়ে বাঁচানোর জন্য যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের প্রয়োজন ছিল তা তমাল আর শ্রেয়া দুজনেই আগে জানিয়েছে ।তাই শ্রেয়া সৌজন্যবোধের খাতিরে হাল্কা হাসি মুখে রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। সুদীপ্তই প্রথমে কথাটা শুরু করলো।
" শ্রেয়া তোমার সাথে একটু কথা ছিল।"
" হ্যাঁ বলো ওদের বিয়ের ব্যাপারে।"
" এই বিয়ে সম্ভব নয়।"
"সেটাই তো জানতে চাইছি কেন অসম্ভব?"
কারণটা শ্রেয়া কিছুতেই বলতে চাইলো না। চলে যেতে চাইলে পথ আটকালো সুদীপ্ত। শেষে বাধ্য হলো শ্রেয়া তাকে সত্যিটা জানাতে। শুনে সুদীপ্ত বেশ খানিকটা সময় চুপ করে রইল। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে বলল
" বুঝলাম তোমার আপত্তির কারণটা। কিন্তু শ্রেয়া তিথি আমার সন্তান নয়। দেশে ফিরে এসে আমি প্র্যাকটিস শুরু করি। একদিন এক পেশেন্ট আমার কাছে গর্ভপাত করাতে আসে । এইসব করাটা বেআইনী। তার প্রেমিক তাকে ঠকিয়েছে।তার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন পথ নেই। আমাকে ভ্রুণহত্যার জন্য অনেক অনুরোধ করে । শেষে আমি রাজিও হয়েছিলাম। কিন্তু তাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। এখন এসব করলে তার জীবন সংশয় হতে পারে। তাই তাকে সন্তান প্রসবে রাজি করালাম। আর বলেছিলাম আমি তার পাশে আছি। সেই সন্তানই হলো তিথি।সন্তান প্রসবের সাতদিন পর তিথির মা মারা যায়। সেই থেকে আমি ওর বাবা - মা দুই-ই হলাম। "
সুদীপ্ত শ্রেয়ার কাছে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের ক্ষমা চেয়ে নেয়। আর বলে তমাল আমাদের শুধু বন্ধু নয় ভগবান। সোহমের ওপর সমস্ত অধিকার শুধু ওরই আছে।
কথাগুলো শোনার পর সুদীপ্তর প্রতি যে রাগ , বিদ্বষ যে জমা ছিল মুহূর্তে তা গলে যায় তার। সুদীপ্ত আরো বলল
" সোহম আর তিথির বিয়ের পর ভাবছি বিদেশে গিয়েই থাকবো। এখানেকার ফ্ল্যাট দুটো ওদের নামেই করে দেব। একা মানুষ কাজের মধ্যেই দিন গুলো ঠিক কেটে যাবে। যদি কখনো ফিরতে ইচ্ছে হয় ওরা তো রইল।"
শ্রেয়া ঘুমোচ্ছিল। সকালবেলায় সোহম আর তিথির সাত বছরের
ছেলে টিনটিন ডাকলো
" ও ঠাম্মি ওঠো না । দেখবে চলো গেটের সামনের ফুল গাছটায় কি সুন্দর একটা পাখি বসে আছে।"
শ্রেয়ার ঘুম ভেঙে গেল। হাল্কা হেসে বলল
" তাই নাকি?"
" তাড়াতাড়ি চলো ।" আদুরে গলায় টিনটিন বলল।
" দাঁড়াও যাচ্ছি দাদুভাই । তাড়াতাড়ি কোন কাজ করতে পারি না । পায়ে যে বড্ড ব্যথা । "

