নৃশংস সেই রাত
নৃশংস সেই রাত
উফফ্ মার জন্য না প্রত্যেকবার ট্রেনটা প্রায় মিস হতে হতে বাঁচে ঊষীর। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবে... সত্যি মাকে নিয়ে আর পারা যায়না। লাস্ট মোমেন্টে মা'র যত্তো গুরুতর কথা মনে পড়ে। ব্যাগটা ঠিকমতোন গুছিয়েছে কিনা, টিকিট নিয়েছে কিনা, ওষুধপাতি নিয়েছে কিনা, বমি হলে কি করবে, জ্বর আসলে কি হবে... বাপরে বাপ ! কোনোরকমে ছাড়া পেয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগিয়েছিল সে। সাথে সাথেই একটা ক্যাব পেয়ে যাওয়ায় নেহাৎ পৌঁছাতে পারলো সে।
ট্রেনে উঠেই মনটা কিন্তু খুব ভাল হয়ে যায় ঊষীর। এইরকম রাতের ট্রেনে কোথাও যেতে খুব ভাল লাগে তার। সময়টা যে কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরই পাওয়া যায়না। বাজে এখন রাত নটা। যাবে নিউ জলপাইগুড়ি। সকালে পৌঁছাবে। ঊষীর সীট জানলার পাশে বাঁদিকে লোয়ার বার্থ। কাঁধের ব্যাগটা রেখে একটু রিল্যাক্স করে বসতেই সামনের দিকে চোখ গেল তার।
তার উল্টোদিকে একটা লোক আপার বার্থে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। রাত নেহাত কম হয়নি, কমপক্ষে ট্রেনের পক্ষে তো নয়ই। কিন্তু ঊষীর কেন জানি খুব বদ-অভ্যেস, তার আবার ট্রেনে একেবারেই ঘুম আসেনা। ঘুম ঘুম ভাব থাকে, কিন্তু যেই ঘুমাতে যাবে, দুলুনির চোটেই হোক বা যেই কারণেই হোক.. ঘুম আর তার হয়না। তাই সে বেশ কয়েকটা গল্পের বই নিয়ে এসেছে সাথে।
তার সীটটা ছিল প্যাসেজের পাশেই, তাই তার খুব ভাললাগার গেটের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ানোর অপশনটাও ছিল খোলা। বাকি সীটের উল্টোদিকের মাঝখানে এক মধ্যবয়সী মহিলা.. যাকে শুরুর থেকেই তার খুব গম্ভীর লাগছিল। ঊষী একবার হাই করেও উত্তর দুরস্ত, হাসিও ফেরত পায়নি। তার পাশেই একজন ওই মহিলার ঠিক বিপরীত ধর্মী লোক, তার দিকের আপার বার্থের.. সারাক্ষণ তার হ্যা হ্যা হাসি আর বকবকের চোটে ঊষীরও বেশ বিরক্তি লাগতে লাগলো। মহিলা তো ভস্ম করে দেওয়ার ভঙ্গীতে বার কয়েক তাকালেন।
ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ ৪০ - ৪৫এর মধ্যে। ফরসা গায়ের রঙ, চোখে চশমা। এমনি পোশাক আশাকে বেশ যত্নবান বলেই মনে হয়, শুধু হাসিটা বাদ দিয়ে। ওই দু এক কথার পরই বেশ শব্দ করে হাসি.. ঊষীরও বেশ বিরক্তই লাগছিল। এই যেমন একবার তার দিকে আর একবার ওই মহিলার দিকে তাকিয়েই বললেন,"আপনারাও সব ওদিকেই যাচ্ছেন তো.. হে হে.. ভাল হল, খুব গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে.. হ্যাঁ হে হে হে....''এই একটা কথার মধ্যে যে এতো হাসির কি হল, তা ঊষী অনেক ভেবেচিন্তেও বের করতে পারলো না। শুধু মহিলার ওনার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ দেখতে পেল।।
হাসির আওয়াজ মাঝে মাঝে এতো হতে লাগলো, যে ঊষীর মনে হল তা বুঝি দূর দূরান্ত অব্দি পৌঁছে যাচ্ছে। তাতে মহিলার নীচের বার্থের ছেলেটা, মুখ দেখলেই বোঝা যায় বাঙালি না, সেও পর্যন্ত অবাক হয়ে এদিকে বেশ কতকবার তাকালো। তারই বয়সের কাছাকাছি, ওখানে পড়ে টড়ে বোধহয়। তার দিকের মাঝের বার্থ কিন্তু তখনো ছিল খালি। অনেক্ষণ হাবিজাবি বিষয়ে মনোনিবেশ করা হয়েছে মনে করে ঊষী হেডফোনটা কানে লাগালো... আর মাঝে মাঝে নিজেও হাল্কা গুনগুন করতে লাগলো। তাতে হিমাংশুবাবু ওরফে হাসিবাবু বারকয়েক তাকালেও সে আর মাথা ঘামালো না। চোখ বন্ধ করে পিছনদিকে মাথা এলিয়ে দিল। এরকম করে কতোক্ষণ চলেছে তা ঠিক খেয়াল নেই তার, তবে এর পরেই এমন এক ঘটনা ঘটেছিল... যা বোধহয় তার সারা জীবন মনে থাকবে।।
কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় কারেন্ট চলে গিয়েছিল ট্রেনে। তার চোখ লেগে গিয়েছিল একটু। মে মাস, একটা গরমের অস্বস্তির মধ্যে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল!! উঠতেই একটা হইচই.... পালালো পালালো ধর ধর ! ঊষী তো কিছু বুঝেই উঠতে পারছেনা, কে পালালো কি ব্যাপার ! এতো আওয়াজের মধ্যে কিছু বোঝাও যাচ্ছেনা। এমনিতে সে খুব ভিতু না, কিন্তু এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে যারপরনাই অবাক হল। কারেন্ট ফিরে আসতে না আসতেই যা দেখল তাতে তার হাড় হিম হয়ে গেল!! এবারে আর শুধু অবাক নয়, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল। দেখল দূরে কোথাও না, কাছে একদম কাছে তার পাশেই চিৎ হয়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত অবস্থায় পড়ে আছেন এক অচেনা ভদ্রলোক। বুকে আমূল ছুরি বিঁধানো অবস্থায়।বয়স ৫০-৫২ তো হবেই। এ কে!! একে তো দেখেনি, তবে এ কোত্থেকে এল? ঊষী অবাক হয়ে দেখতে
লাগলো লোকটার নিস্পন্দ মৃতদেহ।
একা সে নয় হিমাংশুবাবু সহ বাকি সকলেও বসে আছে হতবাক হয়ে। আশপাশের অন্য কামরার লোকজনও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেউই বুঝে উঠতে পারছেনা চলন্ত ট্রেনের মধ্যে কি করে এমন হল ! ঊষী জানতে পারলো ইনি হলেন সেই আপার বার্থের ভদ্রলোক, যাকে ওঠার পর থেকেই আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছে। আরও একটি তথ্য আবিষ্কৃত হল.. পরিচয় হল ইন্সপেক্টর হিমাংশু চক্রবর্তীর সাথে!! দ্বিতীয় চমক। জানা গেল যার পিছনে ধাওয়া করে তিনি এতোদূর এসেছেন,ইনি এই ভদ্রলোক প্রাণকৃষ্ণ বটব্যাল। সন্দেহ ভবানীপুর এলাকার হারাণ গুপ্ত নামক কোনো ব্যবসায়ীকে খুন করে তিনি এই ট্রেনে এসে উঠেছিলেন। সম্ভবত: পালানোর উদ্দেশ্যে।।
এতো সব ঘটনা একই দিনে.. উফফ্ আর যেন ভাবতে পারেনা ঊষী। যেন ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মতো কোনো রহস্য গল্পের মধ্যে ঢুকে আছে মনে হল। যেই হিমাংশুবাবু বললেন এবারে উনি সবাইকে জেরা করবেন.. ঊষী বেশ নড়েচড়ে বসল, একটু ভয়ও পেল। সেও যে বাদ পড়বে না!! যদিও শেষ পর্যন্ত উনি বিশেষ কিছু জিগ্যেস করলেন না তাকে.. কারণ তিনি খেয়াল করেছিলেন বেশীরভাগ সময়টাই ঊষী ঘুমিয়ে ছিল। বাকিদেরও জেরা করা শুরু করলেন। প্রধানত: একই কথাই শোনা যেতে লাগলো সবার থেকে যে,উনি আসা থেকেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন.. তাই ওনার মুখটা পর্যন্ত ভাল করে কেউ দেখেনি!! কারেন্ট যাওয়ার একটু আগে উনি প্রথমবারের জন্য নেমে একবার বাথরুম যান। গাড়ি তখন দাঁড়িয়েছিল নৈহাটি জংশনে। তাও যদিও কামরাটি শীততাপনিয়ন্ত্রিত,তাও অতো মোটা একটা কম্ফর্টার জড়িয়ে রাখার কোনো সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। উনি বাথরুম থেকে আসতে না আসতেই সাথে সাথে কারেন্ট যায় এবং তার পরই এই ঘটনা।।
জেরা চলতে চলতেই অনেকটা পথ পার করে আসেন তারা। পরের স্টেশনেই হিমাংশুবাবুর ফোন পেয়ে লোকাল থানার সহযোগীতায় প্রাণকৃষ্ণবাবুর বডি যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির লোক বলতেও সেরকম কারুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে তা পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়। ট্রেন চলতে থাকে আবার নিজের গতিতে। অনেকটা পথ পার হলে হঠাৎ হিমাংশু বাবু ঘোরেন ওই মহিলার দিকে। তাকিয়েই তীরের মতো প্রশ্ন,"আচ্ছা ম্যাডাম, যেই সময় এই কান্ডটা হয়, আপনি ঠিক কি করছিলেন বলতে পারেন....??
"কেন কি আবার করব এখানেই বসেছিলাম আপনাদের সামনে।
একটু হাসলেন আমাদের ইন্সপেক্টর.. "সত্যিই কি তাই, অনিমাদেবী ওরফে অনিমা বটব্যাল ?'' কামরায় যেন বাজ পড়ল!!
থরথর করে কাঁপতে থাকেন অনিমাদেবী.. "বলতে কি চান আপনি.. হ্যাঁ.. আর আমার নাম অনিমা গুপ্ত, অনিমা বটব্যাল নয়.. জানেন আপনার নামে আমি মানহানির মামলা করতে পারি, জানেন?''
শ্বাস রুদ্ধ করে সব গিলছে ঊষী। এমন ঘটনা চাক্ষুষে তার জীবনে অন্তত প্রথম!!
এবার বেশ চিবিয়ে চিবিয়েই বললেন হিমাংশু বাবু.."হ্যাঁ তা আপনি করতেই পারেন.. অনিমাদেবী ওরফে অনিমা বটব্যাল বা গুপ্ত। তবে আপনার ওই ভবানীপুরের বাড়ির সামনে গত তিনদিন যে আমাদের লোক বসিয়েছিলাম তা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারেননি না ? তা আর বুঝবেনই বা কি করে, গত কয়েকদিন ধরেই যে আপনার প্রাক্তন স্বামীর সাথে বসে হারাণ বাবুকে খুনের প্ল্যান কষেছেন দুজনে মিলে.... খুন করেওছেন। অবিশ্যি এটাই প্রথম নয়, এর আগেও বোধহয় বেশ কয়েকটা এমন কেস হয়েছে... কি তাইতো ! ভালবাসার অভিনয় করে বিয়ে আর তারপর সম্পত্তি গয়না নিয়ে উধাও!! তা এবার বোধহয় ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে একটু মন কষাকষি লেগেছিল... তাই না ? তার জেরেই এই কান্ড। আপনার গলা পেয়েই কিনা উনি আর উপর থেকে নামার সাহসই করেননি। আর ভাগ্য দেখুন... ঠিক সেই সময়ই কারেন্ট গেল!! সাথে আনা ছুরিটা একদম আমূল বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন বলুন,উনি একটা আওয়াজ পর্যন্ত করার সময় পাননি। আসলে আপনি তো অভ্যস্ত.. ঠিক এভাবেই তো হারাণবাবুকে....''
অনিমাদেবী আর কিছু বলতে পারলেন না। মুখটা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। কথা হল জলপাইগুড়ি নেমেই পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হবে তাকে। মা ফোন করেছিল.. এই বিষয়ে আর বিষদ কিছু না বলে, জীবনের খাতায় এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা যোগ করে তার একটা পিঠের ব্যাগ আর ট্রলি নিয়ে ট্যাক্সির লাইনে এসে দাঁড়ালো ঊষী।।