নলজাতক ধারাবাহিক
নলজাতক ধারাবাহিক
ঊনবিংশ পর্ব
মায়াজালের ভুলভুলাইয়ায় পড়ে রূপেশ্বর এখন নিজেই বন্দী । বন্দী অনিরুদ্ধ, সঞ্চারী এবং ডাক্তার সরকারও । উন্মুক্ত শুধু ঋতাভরী দেবী এবং তাঁর মৃত পুত্র ভূপেশ ।
ঋতাভরী দেবী ফোন করলেন থানায় । তাঁর বাড়িতে কিছু দুষ্কৃতি চড়াও হয়েছে । তাঁর একমাএ পুত্রকে মেরে ফেলেছে।
ভূপেশের মৃতদেহটা পড়ে আছে কাদামাখা অবস্থায় । রূপেশ্বর দেখছে। লাশ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে দেখে সেই বিস্ময় বালককে স্মরণ করল ।
তার চেয়েও ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এই মায়াবী । অবশ্যই শক্তিশালী নইলে যে বয়সে মুখের বুলি পরিষ্কার উচ্চারিত হয় না - এই শিশু তো পাকা খেলোয়াড়ের মত এক একটা চাল দিয়ে যাচ্ছে আর রূপেশ্বর সেই জালে আকন্ঠ ডুবে আছে ।
তথাপি নাক মুখ এখনও ঢাকেনি । সেইজন্য শেষ মরীয়া চেষ্টা করতে লাগল । দুর্ভাগ্যক্রমে পিস্তলটা খুইয়েছে । এখন বাহুবলটুকুই ভরসা ।
কিন্তু তারই বা উপায় কি ? নল তো এখন তার হাতের বাইরে ।
রূপেশ্বর মনে মনে যাদুমন্ত্র কপচাতে লাগল । কিছু পরে তার বিশাল শরীরটা একটা ভয়াল টেরেন্টুলার রূপ নিল । লোক চক্ষুর আড়ালে মাটি বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল।
দরজার প্রান্তে এসে যাবে নল তাকে পায়ে পিষে ধরল ।
খালি পায়ে টেরেন্টুলার বিষাক্ত রোঁয়া জ্বালা ধরিয়ে দিতেই বালক অন্য পা দিয়ে তাকে চেপে ধরল । টেরেনটুলারূপী রূপেশ্বর একটি পাঁচ বছরের বালকের ভারে পরিত্রাহী চিৎকার জুড়ে দিল ।
এমন সময় ক্ষুদি বাউরি তার ছেলেকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ।
- কুথায় আমার লালা ? আমার পরাণের পরাণ। আমি এতদিন পূজা করে এসেছি; আজ লালাকে নিজের চোখে দেখব বলে সেই গাঁ থেকে হেঁটে আসছি ।
উপস্থিত সকলেই দেখল স্বয়ং শ্রীহরি বালকের রূপ ধরে মিটিমিটি হাসছে । পায়ে তার অসহ্য জ্বালা । তবুও মুখে হাসি লেগে আছে ।
ঋতাভরী দেবী এসে ক্ষুদির সঙ্গে লালার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
বালক বলল - বুড়ীমা ! তোমরা সবাই ভালো আছো তো ?
দু'চোখের জল মুছতে মুছতে বুড়ি ক্ষুদি এতটাই মোহিত হয়ে গেল যে তার মুখ দিয়ে কথাই বের হল না ।
- বুড়ীমা ! এই লোক দুটোকে চিনতে পারছ ?
ক্ষুদি এদিক সেদিক চেয়ে অনিরুদ্ধকে দেখে বলল - এ যে বামুন ঠাকুর গো !
নল বলল - আর এই লোকটা?
বুড়ী বলল - আর তো কাউকে চিনতে পারছি না বাপ !
নল বুঝতে পেরে টেরেন্টুলার উপর থেকে নেমে বলল - এইযে এই লোকটা !
ক্ষুদি অবাক হয়ে বলল - অ মা! এ যে একটা মাকড়সা গো। তুমি ওকে ছোঁওনি তো বাছা ! খুব বিষাক্ত।
নল বলল - তাই বটে ! শুধু বিষাক্তই নয়, প্রাণঘাতী।
বলে টেরেন্টুলার উপর থুতু ছুঁড়ে ফেলল । অমনি টেরেন্টুলা রূপান্তরিত হল রূপেশ্বরে ।
বালক বলল - বুড়ীমা ! দেখ তো এবার চিনতে পার কি না !
ক্ষুদি চিনে ফেলল - অ পোড়ার বামুন ! আমাকে বেঘর করেও তোর শান্তি হয় নাই । ইখেনে এয়েছিস এদের সব্বনাশ করতে ?
পুলিশ এসে গেল । নলের নির্দেশ মত রূপেশ্বর, ডাক্তার বাবু এবং অনিরুদ্ধকে গ্রেপ্তার করল ।
নল বলল - সাবধানে পুলিশ কাকু । এ দুটো আস্ত শয়তান খুনিও । এদের থানায় নিয়ে গিয়ে যথেষ্ট খাতির করবে ।
রূপেশ্বরের যাবতীয় যাদু বালকের পদস্পর্শে বাষ্পের মত উড়ে গেছে । এখন সে একজন দেহধারী মানুষ ।
নল বলল - নিয়ে যাও এদের । আর কোন কারিকুরি করতে পারবে না । আমার সঞ্চারী মা থানায় গিয়ে ওদের নামে অভিযোগপত্র জমা দিবে ।
ঋতাভরী দেবী নলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন ।
- তুমি তো স্বয়ং হরি হে দাদুভাই। আমার ভূপেশকে বাঁচিয়ে দাও ।
সঞ্চারীও অনুরূপ অনুরোধ করল ।
নল একমুখ হাসি দিয়ে বলল - দিদা ! জন্ম আর মৃত্যু মহাকালের নির্দেশে হয় । তার কোন ব্যতিক্রম করা যায় না । যে চলে গেছে ; সে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে গেছে । এটাই সারাৎসার । অতএব বুকে ধৈর্য্য ধর । সইবার ক্ষমতা অর্জন কর ।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন ঋতাভরী দেবী। বিনা অপরাধে এমন শাস্তি তাঁকে পেতে হল কেন !
সঞ্চারীও কেঁদে চলেছে । ভূপেশকে সে ভুলতে পারছে না । যদিও নকল ভূপেশকে সে বিয়ে করেছিল । আসল ভূপেশের প্রতি ভালোবাসা অটুট থেকে গেল ।
( ক্রমশ )