Suchismita Chakraborty

Horror Others

3  

Suchismita Chakraborty

Horror Others

নকশীকাঁথা

নকশীকাঁথা

17 mins
147



বেশ কিছুদিন হইহট্টগোলের পর হঠাৎ করে বাড়িটা যেন নিঝুম শ্মশানপুরীতে পরিণত হয়েছে।শীত আসছে।অলস দুপুরে বিয়ানকা একটা চাদরে ফুল তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।সব তো ভালোয় ভালোয় কেটেই গেল, তবুও যেন মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করেই চলেছে। বৌভাতের দিন তোড়ার পেছনে এক মুহূর্তের জন্য কাকে দেখল?ফুলদিদা? কিন্তু কেন? এটা কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস?


লাহাবাড়িতে বিয়ানকা প্রথম যেদিন বউ হয়ে এল,সে দিনটার কথা চেষ্টা করেও কেউ ভুলতে পারবে না।বাড়ির সকলের প্রিয় ফুলদিদা সেদিনই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন।কিন্তু সত্যিই কি তিনি পৃথিবীর মায়া, সর্বোপরি এই সংসারের মায়া ত্যাগ করতে পেরেছিলেন? বিয়ানকার কেন যেন মনে হয় ফুলদিদা তার আসেপাশেই আছে।বৌভাতের দিন কতটুকুই বা আর সাক্ষাৎ হয়েছিল,তবুও বিয়ানকার চিবুক ধরে চুমো খেয়ে বহুকষ্টে ঠোঁটদুটো নাড়িয়ে কানের কাছে এসে বলেছিলেন “ সবকিছু বেঁধে রাখিস নাতবৌ,আলগা ছাড়লেই সব শেষ!” বলে নিজের সাতনরী হার বিয়ানকার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।ফুলদিদার অসুস্থতার কারণেই শ্বশুরমশাই তড়িঘড়ি প্রাঞ্জল আর বিয়ানকার বিয়েটা সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৌভাতের রাত পেরোতে না পেরোতেই বাড়িতে শোকের পরিবেশ ছেয়ে এসেছিল। তাও রক্ষে, ফুলদিদা তার প্রিয় নাতির নাতবউ তো দেখে যেতে পেরেছিল।বিয়ানকার মনে হয়,ফুলদিদা দেখে গেলেও ছেড়ে যেতে পারেননি পুরোপুরি। সেইভাবে কোনোদিন বিয়ানকার ভয় না লাগলেও কোনো কিছু অঘটনের আগে আগে ফুলদিদা বিয়ানকাকে দেখা দিতেন। 


জন্মের প্রায় পরপরই বিয়ানকার মা মারা যান।বাবা প্রাণতোষবাবু বলতে গেলে একা হাতেই মেয়েকে মানুষ করেছেন।দূর সম্পর্কের এক পিসি মাঝে মাঝেই এসে থাকত বটে, কিন্তু বিয়ানকার শৈশব কেটেছে মা বিহনেই।প্রাণতোষবাবু শেক্সপিয়ারের অন্ধ ভক্ত ।তাই বাঙালি বাড়ির মেয়ের নামও দিলেন ওঁর নাটকের চরিত্র থেকে ‘বিয়ানকা’।অপছন্দ হলেও কেউ বলার নেই।বিয়ানকার অবশ্য তাতে কোনো আপত্তি ছিল না।কিন্তু বাবা যখন আদর করে ‘বিনু’ বলে ডাকত,বিয়ানকার সেটাই বেশি ভালো লাগত।মা না থাকার কারণে ছোট থেকেই একা একা থেকে বিয়ানকা অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল।যদিও প্রাণতোষবাবু মেয়ের এই কল্পনাপ্রবণতাকে বিশেষ প্রশ্রয়ই দিতেন এবং বলতেন “বিনু মা আমার একদিন বড় আর্টিস্ট হবে...”। 

যদিও বিয়ানকার আর্টিস্ট হওয়া আর হয়ে ওঠেনি,কিন্তু হাতের যে কোনো কাজে সে ছিল বিশেষ পারদর্শী।কেউ কোনো দিন শিখিয়ে পড়িয়ে না দিলেও বিছানার চাদরে,পশমিনা শালে নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলতে ফুল,পাতার বাহারি নকশা।এই হাতের কাজ দেখেই তো বিয়ানকার শ্বশুরমশাই একবাক্যে বিয়ানকাকে এই লাহাবাড়ির বউ করে এনেছিলেন। বিয়ানকার মা ছিল সূচীকর্মে পারদর্শী আর সেই গুণই বিয়ানকাও পেয়েছিল।

বিয়ের পর পর শাশুড়িমা বিয়ানকাকে কিছুই করতে দিতেন না।নতুন বৌ আগুনের ধোঁয়ায় কালিতে রঙ পুড়ে যাবে বলে নিজেই সবকিছু করতেন।তাতে অবশ্য বিয়ানকার ভালোই হতো।সত্যি বলতে রান্নাবান্না সেরকম কিছু জানতও না।ঘরে বসে নকশীকাঁথায় ফুল তুলত।ফুটিয়ে তুলত রামায়ণ মহাভারতের উপাখ্যান।

এমনই এক অলস দুপুরে প্রাঞ্জল অফিসে।শ্বশুরমশাই ভাতঘুমে আচ্ছন্ন।শাশুড়িমা পানের বাটা পেতে অন্দরমহলে সহায়িকাদের সাথে হাল্কা ঠাট্টা মস্করায় মত্ত। তাদের হাসির আওয়াজ মাঝে মাঝেই কানে আসছিল। বিয়ানকা সবেমাত্র সূঁচের দুইফোঁড় দিয়েছে, হঠাৎ মনে হল কাঠের আলমারির পিছন থেকে কেউ যেন উঁকি দিচ্ছে।বিয়ানকা চোখ তুলে চকিতে বলে উঠল-“কে ওখানে?” কোনো সাড়াশব্দ নেই।সে আবার নিজের কাজে মন দিল। মিনিট দুই-তিন পরে আবার যেন মনে হল ঐ আলমারির পেছন থেকে কেউ যেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে এবারও কাউকে দেখতে না পেয়ে,হাতের কাপড়টা বিছানায় নামিয়ে রেখে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে আলমারির পেছনটায় গিয়ে উঁকি দিল।প্রথমে ভেবেছিল রান্নামাসি রমার ছোট্টো ছেলেটা দুষ্টুমি করে বোধ হয় আলমারির পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে।

কিন্তু না,আলমারির পেছনে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের আলো কোনোমতেই সেখানে পৌঁছোয় না।বিয়ানকার মনে হল এই অন্ধকারের অদ্ভুত এক মাদকতা আছে। আলমারির ঐ আঁধার যেন বিয়ানকাকে দু-হাত বাড়িয়ে ডাকছে।চোখের পলক না ফেলে বিয়ানকা ঐ আঁধারের হাতছানিতে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল।মনে হচ্ছে যেন স্যাঁতস্যাঁতে কতগুলো সিঁড়ির ধাপ ক্রমশ নীচে নেমে চলেছে।কী আছে এই পাতালপুরীতে?মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেছে বিয়ানকা।নাকে একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে।এই গন্ধটা বিয়ানকার খুব চেনা। ছোটোবেলায় যখন মায়ের ঘরটায় ঘুরঘুর করত,তখন এই গন্ধটা বাতাসে ভেসে আসত।বাবাকে বললে বলত “মা তো তোর আসেপাশেই আছে রে মা...”

কতগুলো ধাপ নেমে এসেছে বিয়ানকার কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎই মনে হল ফুলদিদা যেন সিঁড়ির বেশ খানিকটা নীচের ধাপে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আর পাশে তার মা।দুজনেই হাত নেড়ে নেড়ে বিয়ানকাকে বলছে-“চলে যা, আর নামিসনা বিনু,আর নামিসনা”।


-“বৌমা ও বৌমা,আলমারির পেছনে কি করছ মা?কিছু পড়ে গেছে”?

সত্যিই তো,এইভাবে আলমারির পেছনে ও ঢুকল কীভাবে? বিয়ানকা খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

“না,মা,আসলে মনে হল যেন..” বলতে গিয়েও সামলে নিল।

-“ও মা,কী সুন্দর নাম লিখেছো...ভারি সুন্দর হয়েছে।এটা আমার বুঝি?”

-নাম? কার নাম?” বিয়ানকা অবাক হয়ে দেখল যে নকশীকাঁথাটায় ও ফুল,পাতা সবেমাত্র তুলতে শুরু করেছিল,সেটাতে সুন্দর করে বাহারি নকশায় তার শাশুড়ির নাম লেখা “কাদম্বিনী”।

বিয়ানকা তোতলে গিয়ে শুধু মাত্র বলল-“এই সবে শুরু করলাম...”

-“বাহ্,তুমি তাড়াতাড়ি শেষ করে দিও,আমি ওটা হাল্কা শীতে গায়ে দোব”।


সেই কাঁথা আর বিয়ানকার শাশুড়ির গায়ে দেওয়া হয়ে ওঠেনি।ঘটনার ঠিক দুই দিন পরেই শাশুড়ি মা’র তুমুল জ্বর এল।ডাক্তার,হসপিটাল ,হাজার টেস্ট করেও জ্বর কিছুতেই ছাড়ে না।জ্বরের মধ্যে ভুল বকতে থাকে কাদম্বিনী।

-“সব সময় বেঁধে রেখো মা,আলগা ছাড়লেই সব শেষ!” চমকে ওঠে বিয়ানকা। ঠিক এই কথাগুলোই ফুলদিদা বলে গিয়েছিল না মৃত্যুশয্যায়?এই কথার মানে কী?কী আলগা ছাড়বে না বিয়ানকা?কিছুই মাথায় ঢোকে না।

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ফুলদিদা আর শাশুড়িমা দুজনেই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করলেন।বিয়ানকার ভাগ্যে বোধ হয় মাতৃসুখ নেই।বিয়ানকা নিজেকেই অপয়া ভাবতে শুরু করে। প্রাঞ্জল তাকে অনেক বোঝায়।

-“জীবন মৃত্যু কারোর হাতে নেই বিনু।কারোর দোষ বা গুণেও সেটা হয় না।যার যতটুকু সময় বাঁধা,সে ততটুকুই পাবে। সুতরাং তোমার নিজেকে দোষারোপ করার কোনো অর্থ হয় না”।

-“সময় বাঁধা থাকে বল প্রাঞ্জল?” বলে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে বিয়ানকা। বেঁধে রাখতেই তো বলেছিল ফুলদিদা,মা... কিন্তু কী?

হঠাৎ মনে পড়ল সেই নকশীকাঁথাটার কথা। আলমারির পেছনের ঐ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে যেটায় শাশুড়িমা’র নাম ফুটে উঠতে দেখেছিল,সেটাতো আর হাতই দেওয়া হয়নি।অদ্ভুত এক ভয়ে সে কথা কাউকে বলেও উঠতে পারেনি বিয়ানকা। কেউ কী বিশ্বাস করবে?

নকশীকাঁথায় নাম ফুটে ওঠার সঙ্গে কী শাশুড়ি মা’র মৃত্যুর কোনো যোগ আছে?সব ভাবনা গুলিয়ে যায় বিয়ানকার।কাঁথাটা সেইদিন যে কোথায় রেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারে না।আলমারিটার দিকে চোখ যেতেই কেমন যেন গা’টা ছমছম করে উঠল।অথচ এই আলমারি থেকেই তো দিনরাত কাপড় বের করে পরছে।কই তখন তো কিছু মনে হয় না! ধীরে ধীরে আলমারিটার দিকে এগিয়ে পেছনের ফাঁকে মুখ বাড়াতেই দেখতে পেল ঐ নকশীকাঁথাটা আলমারির পেছনেই পড়ে আছে।সেদিনের মতো তো অত অন্ধকার লাগছে না পেছনটা।বেশ তো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।কোথায় সিঁড়ি? কিচ্ছুটি নেই।তবে কী মনের ভুল ছিল? নকশীকাঁথাটা তুলে নিয়ে যত্ন করে তুলে রেখে দিল বিয়ানকা।সূঁচটা আলগাই লাগানো ছিল সুতোর সাথে।সেটাতে ভালো করে গিঁট বেঁধে বাক্সতে ভরে রাখল।ঐ কাঁথাটা আর সম্পূর্ণ করা হয়ে ওঠেনি।


বছর দুয়েক পর কোল আলো করে এল শিঞ্জন।এখন আর একা লাগেনা বিয়ানকার।সারা দিন ছোট্ট পুতুলটার গায়ের গন্ধ শুঁকে,তাকে স্নান করাতে,সাজাতে গোছাতে,খাওয়াতেই সময় কোথা দিয়ে পার হয়ে যায়।আজকাল আর সেলাই ফোঁড়াই করারও সময় পায় না।শাশুড়ি মা’র ঘটনাটার পর থেকে আর কাঁথা সেলাই করতে সাহস পায় না বিয়ানকা।শিঞ্জনের যা দরকার সব দোকান থেকে কিনেই আনা হয়। প্রাঞ্জল বহুবার বলেছে “তুমি এত ভালো সেলাই করতে পারো,তা সত্ত্বেও বাবুকে কেনা জিনিসে শোয়াচ্ছো?” সময় পাইনা বলে এড়িয়ে গেছিল বিয়ানকা,তবু আসল কথা বা ভেতরের ভয়টার কথা প্রাঞ্জলকে বলে উঠতে পারেনি। দেখতে দেখতে তিনটে বছর পার হয়ে গেল। ছোট্ট শিঞ্জন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে।দুপুরগুলোয় আবার একা বিয়ানকা।

বহুদিন পর একটা চাদর নিয়ে কাশ্মিরী নক্শায় ফুল তুলতে শুরু করল বিয়ানকা। বিকেলে শিঞ্জন ফিরে এলে ওর সাথে বাগানে গিয়ে খেলা করে,প্রজাপতি ধরে,দোলনা দোলে।চাদরটা প্রায় শেষই হয়ে এসেছে।আর দুটো দুপুর বসলেই শেষ হয়ে যাবে। সেলাই করলে মনটাও বেশ ভালো থাকে।ধীরে ধীরে মন থেকে ভয়টাও কেটে এসেছে। সেদিনের পর থেকে তেমন কোনো অঘটন এখনো পর্যন্ত ঘটেনি।

চাদরটা শেষ করেই একটা সুন্দর সোয়েটার শুরু করবে ঠিক করেছে বিয়ানকা। কয়েকদিন ধরে শরীরটা ঠিক জুতসই লাগছে না।মাঝে মাঝেই মাথাটা ঘুরে উঠছে।তার মধ্যে শিঞ্জনের দস্যিপানা দিন দিন বেড়েই চলেছে।প্রাঞ্জলকে বলতে সঙ্গে সঙ্গেই সে ডাক্তার দেখায়।ডাক্তার সমস্ত কিছু দেখেশুনে খুশির খবরই দেন।বিয়ানকা দ্বিতীয় বার মা হতে চলেছে।লাহাবাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

এবার আর বাজারের জিনিস নয়।দুপুরবেলায় বিয়ানকা নিজের হাতে ছোট্ট ছোট্ট সোয়েটার,মোজা,টুপি সমস্ত বুনতে থাকে।একের পর এক নকশীকাঁথায় ঘর ভরে ওঠে।ছোট ছোট জিনিসগুলোর গন্ধে অনাগত এক স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে থাকে বিয়ানকা। নিজের ভেতর থেকেও যেন একটা 'মা মা' গন্ধ উথলে ওঠে।অনেকটা সেই আগে পাওয়া গন্ধের মতো না?চমকে ওঠে বিয়ানকা।না,না, খুশির সময়ে ওসব কথা মনেও আনতে নেই।শিঞ্জনকে ডেকে বিয়ানকা বলে-

“তোর কি চাই বাবু?ভাই না বোন?”

-“একতা থোত্তো ডল...বোনু”

মিষ্টি হেসে বিয়ানকা বলে, “তাই হবে”।

-“আল কত কাঁতা কব্বে মাম্মা?ছব বোনুর?...এতা আমাল” আধো আধো বুলিতে কথাগুলো বলেই শিঞ্জন একটা লাল রঙের কাঁথা নিয়ে দৌড়।শিঞ্জনের দৌড়নোর দিকে দেখতে গিয়ে হঠাৎ করেই মনে হল শিঞ্জন যেন কোনো খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।এক পা এগোলেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।

-“দাঁড়া,দাঁড়া পড়ে যাবি...” বলতে বলতেই ছোট্ট শিঞ্জন হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়, কিন্তু হাওয়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ দুটো হাত এসে যেন শিঞ্জনকে ধরে ফেলল।একঝলক ফুলদিদা যেন হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল।শিঞ্জন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাটিতে বসে পড়েছে।বিয়ানকা হাতের সূঁচসুতো আলগা ফেলেই ছুটে এসে শিঞ্জনকে জড়িয়ে ধরল।

-“লাগেনি তো সোনা?”

-“এত্তুও লাগেনি..”

‘বলেছিলাম,আলগা ছাড়িস না...’ কথা কটা যেন হাওয়ায় ভেসে এসেই মিলিয়ে গেল।

শিঞ্জনকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে সূঁচসুতোর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল বিয়ানকা।নতুন কাঁথাটায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “ফুল্লরা”। মেয়ে হলে এই নাম দেবে ভেবে রেখেছিল সে আর প্রাঞ্জল দুজনে মিলে।এই নাম তো আর কেউ জানে না।বিয়ানকা নিজেও তো এই নাম কাঁথায় লেখেনি।তবে কি আবার...


দুই দিনও পেরোলো না।শুকনো মেঝেতেই হঠাৎ পা মচকে পড়ে ফুলের মত ফুল্লরাকে হারাল বিয়ানকা।ডাক্তার কনফার্ম করেছিলেন,কন্যাসন্তানই ছিল।ভয়ে রীতিমতো কুঁকড়ে গেল বিয়ানকা।এ কী হচ্ছে তার সাথে? প্রাঞ্জলকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেও ও মনের বিভ্রম বলে নস্যাৎ করে দিয়েছে।কিন্তু বিয়ানকা জানে,ফুলদিদা আসে।সতর্ক করতে আসে।কিন্তু কীভাবে এই মৃত্যু গুলোকে রুখবে বিয়ানকা?এর উত্তর এখনো অজানা।


সেলাই করা বিয়ানকা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।শিঞ্জন সোয়েটার বানিয়ে দিতে বললেও বিয়ানকা কিনেই আনে।শিঞ্জন বড় হচ্ছে।আর সন্তান নেওয়ার চেষ্টাও করেনি বিয়ানকা।এদিকে শ্বশুরমশাইয়ের বয়স বাড়ছে।আজ সুগার লো তো কাল প্রেশার হাই, এভাবেই চলছে।শিঞ্জনই দাদুর বুড়ো বয়সের খেলার সাথী।শিঞ্জনও দাদাই বলতে অজ্ঞান। একদিন অফিস বেরোনোর সময়ই প্রাঞ্জলের জামার বোতাম গেল ছিঁড়ে।

-“বিনু, শিগগির আমার বোতামটা লাগিয়ে দাও।দেরী হয়ে যাবে অফিসের...”

বিয়ানকা খুঁজে পেতে সূঁচসুতো নিয়ে আসতে আসতে মনে হল যেন ঘরগুলোর কোনো শেষ নেই।সে একটার পর একটা ঘর পেরিয়েই চলেছে,কিন্তু ঘর শেষ আর হচ্ছে না। কিছুতেই সে প্রাঞ্জলের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারছে না।দূরে কোথাও থেকে যেন প্রাঞ্জলের গলা ভেসে আসছে- “তাড়াতাড়ি কর বিনু,বাবার কষ্ট হচ্ছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে..”

কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থেকেও বিয়ানকা বুঝতে পারে আবার বোধ হয় কোনো অঘটন ঘনিয়ে আসছে।ঐ তো ঘরগুলোর ভেতর থেকে ফুলদিদা,মা,ফুল্লরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে- “ বেঁধে রাখো,বেঁধে রাখো।আলগা ছেড়ো না...”

হাতের সূঁচ সুতোটার দিকে নজর গেল বিয়ানকার।কি মনে হতে খুব ভালো করে একটা গিঁট লাগাল।সঙ্গে সঙ্গেই যেন সে আগের অবস্থায় ঘরের ভিতরে ফিরে এল। প্রাঞ্জল দুই কাঁধ ধরে ওকে একটা নাড়া দিয়ে বলল –“ সূঁচ সুতো আর লাগবে না।যাও,ঝট্ করে একগ্লাস জল নিয়ে এস।বাবা এখন ঠিক আছেন”।

বিয়ানকা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো রান্নাঘর থেকে নিমেষের মধ্যে জল এনে দিল।

-“কী হল বিনু?আবার ভয় পেয়েছো?বাবা তো এখন বিপদমুক্ত”।

-“আমি বেঁধে দিতেই সব ঠিক হয়ে গেল জানো?”

-“কী বেঁধে দিলে?”

-“কেন,সূঁচ সুতোটা...”


-“সূঁচ সুতো?সে আবার কী?”

-“হ্যাঁ,গো।ফুলদিদা,মা সবাই বলল তো,আলগা না ছাড়তে।যতবারই অঘটন গুলো ঘটেছে, প্রতিবারই আমার হাতে সূঁচ সুতো ছিল,আর প্রতিবারই ফুলদিদা আমায় সাবধান করেছে। বেঁধে রাখতে বলেছে।আমিই বুঝতে পারিনি জানো...আজ ঐ সূঁচসুতোটায় কষে গিঁট লাগাতেই বাবা ঠিক হয়ে গেলেন”।

-“কী আজেবাজে বলছো বিনু...”

-“আমি সত্যি বলছি প্রাঞ্জল”


একটা মাইল্ড অ্যাটাক।অল্পের উপর দিয়েই ঝড়টা গেছে।বিকেলে ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর শ্বশুরমশাই জিজ্ঞেস করলেন,

-“বৌমা,তুমি সকালে সূঁচসুতো নিয়ে কি একটা বলছিলে বল তো?”

-“ও কিছু না বাবা..”

-“না,না, বলই না...জানার দরকার আছে।এই সূঁচ সুতোর কি কম বৃত্তান্ত আছে আমাদের পরিবারে!”

-“তাই নাকি?”

বিয়ানকা সেই বিয়ে হয়ে আসার দিন ফুলদিদার সাবধান বানী থেকে শুরু করে আলমারির পেছনের অন্ধকার সিঁড়ি,শাশুড়িমার নাম লেখা কাঁথা,ফুল্লরার না আসা এবং সেদিনের ঘটনা,এক এক করে সবঘটনা শ্বশুরমশাইকে সবিস্তারে বর্ণনা করল।

সব শুনে বৃদ্ধ দেবেশ লাহা চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলেন।তারপর ধীরে ধীরে মুখ খুলে যে ঘটনার কথা বললেন,তা বিভীষিকা বললেও বোধ হয় কম বলা হয়। দেবেশবাবুর বাবারা ছিলেন তিন ভাই।দেবেশ বাবুর বাবা সবথেকে বড় এবং তার পরের ভাই হিসেব মতো মেজো হওয়া উচিৎ।কিন্তু জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মিলিয়ে মেজো হয়ে গেল ফুলকাকা।এবং ওঁর স্ত্রীই হলেন দেবেশের ফুলকাকী বা প্রাঞ্জলের ফুলদিদা।ফুলকাকা কম বয়স থেকেই ছিলেন বেপরোয়া,বেহিসাবি।ফুল কাকী সুন্দর সেলাই করতে বলে প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ফুলকাকা ওঁকে বিভিন্নধরনের সূঁচের একটা কালেকশন উপহার দিয়েছিলেন।উপহার নিতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কোনো প্রকারে সেটা ফুলকাকীর হাতে থেকে পড়ে ছিটিয়ে যায়।উপস্থিত এক ঘর নিমন্ত্রিত অতিথিদের সামনেই কাকা কাকীকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেন।ফুলকাকার এই বদমেজাজী স্বভাবের জন্য ফুলকাকী ওঁকে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। কিন্তু ছোটোকাকা এবং ফুলকাকী সমবয়সী হওয়ায় তাদের মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল।এর থেকেই ধীরে ধীরে সংসারে সন্দেহের বীজ বপন শুরু হল।বাড়তে থাকল অশান্তি।ছোটো ছোটো কারণে ফুলকাকীকে মারধোর একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হল।

-“জানো বৌমা,ফুলকাকীও ঠিক তোমার মত সারা দুপুর বসে সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজ করত।কী সুন্দর সুন্দর সব নকশীকাঁথা,চাদর,রুমাল বানিয়ে দিতে আমাদের।কিন্তু মনে একফোঁটা শান্তি ছিল না।ফুলকাকা মিছিমিছিই ছোটোকাকাকে নিয়ে কাকীকে সন্দেহ করত।

-“ছোটোকাকা এখন কোথায় বাবা?”

-“সে আর নেই”।

-“মানে?মারা গেছেন?”

-“মারা গেছেন না মেরে ফেলা হয়েছিল,তার আজও অজানা”।

-“কী বলছেন বাবা!” আঁতকে ওঠে বিয়ানকা।

কিছু সময় নিয়ে দেবেশবাবু বলতে থাকেন,

-“ফুলকাকী একবার একটা লাল রঙের রুমালে ছোটো কাকার নাম সুন্দর নকশা করে ছোটো কাকাকে উপহার দিয়েছিল।সেইটা কোনোভাবে গিয়ে পড়ে ফুলকাকার হাতে।সন্দেহের বীজ যেখানে পোঁতা সেখানে এই ‘জল’ অনুঘটকের কাজ করল। সেই সন্দেহের বীজ ডালপাতা ছড়িয়ে মহীরুহে পরিণত হল এবং ফলস্বরূপ শুরু হল অকথ্য অত্যাচার”।

-“মারধোর?”

-“শুধুই মারধোর তো একরকম; আমি তখন খুব ছোট।শুনেছিলাম ফুলকাকী সেসময় সন্তানসম্ভবা ছিল।ঐ অবস্থায় ফুলকাকা কাকীরই কাঁথা সেলাইয়ের বড় সূঁচ দিয়ে অহরহ আঘাত হেনেছিল কাকীর উদরে”।

বিয়ানকা আঁতকে উঠে কান চেপে ধরল-“উফ্ঃ,মা গো...”

-“ফুলকাকার সন্দেহ ছিল ঐ সন্তান ছোটোকাকার।সন্দেহ কেন দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল বলা ভালো।তারপর থেকে ফুলকাকী সেলাই ছেড়ে দিয়ে সব সূঁচ ভালো করে সুতো দিয়ে গিঁট বেঁধে কোথাও ফেলে দিয়েছিল।ফুলকাকীর সেই সন্তান আর পৃথিবীর আলো দেখেনি।পেটের মধ্যেই মারা যায়।দুঃখে অপমানে ছোটোকাকা ঘর ছাড়ে।কিছুদিন পর ছোটোকাকার রক্তাক্ত দেহ পাওয়া যায় রেললাইনের ধারে।পুলিশ তদন্ত করে দুর্ঘটনা বললেও আমাদের বিশ্বাস ছিল ছোটোকাকাকে নিশ্চিত হত্যা করা হয়েছিল।বাবা ফুলকাকাকে বাড়ি ত্যাগ করতে বলেন।

চেষ্টা করেও ফুলকাকার কোনো শাস্তি হয়নি।পুলিশের সাথে ভালো যোগসাজশ ছিল।আর ফুলকাকীও সেসময় দুঃখে পাথর হয়ে গিয়েছিল।কাকার বিরুদ্ধে কোনো বয়ানই দিলনা”।

-“ফুলদাদু এখনো কি..”

-“নাঃ,আর বেঁচে নেই।শুনেছি বাড়ি ছেড়ে গিয়ে কোনো এক বাজে মহিলার পাল্লায় পড়েছিলেন।বছর কয়েক পর কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান”।

-“বেশ হয়েছে...না মানে...”

-“পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল বৌমা।চরম শাস্তি উপরওয়ালাই দিয়েছেন।তবে অভিশাপ রয়ে গেছে।ঐ সূঁচসুতো পিছু ছাড়েনি”।

-“মানে?”

-“ফুলকাকার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে ফুলকাকীর মধ্যে কিছু মানসিক বিকৃতির লক্ষণ প্রকাশ পায়।ফুলকাকী যখন তখন সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নাকি শুধু সূঁচ সুতো দেখতে পেতো।সূঁচ গুলোকে ভালো করে বেঁধে রাখতে বলত।পেটের যন্ত্রণায় কাতরাত মাঝে মাঝেই”।

-“মনের উপর খুব চাপ পড়েছিল”।

-“সে তো অবশ্যই।ঐ রকমভাবে সন্তান হারানো...

আমাকে ভীষণ ভালোবাসত কাকী।আর পাপান হওয়ার পর তো আর কথাই নেই। সারাদিন ওকে নিয়ে পড়ে থাকত।বলতে গেলে একরকম আগলে রাখত।কাকীর সবসময়ই মনে হতে যেন কোনো এক কালো ছায়া এই বাড়িকে ঘিরে রেখেছে”।

-“ফুলদিদার উপর দিয়ে তো ঝড় বয়ে গিয়েছিল বাবা।এটুকু বিকৃতি বা আতঙ্ক তো আসতেই পারে।কিন্তু আমি সূঁচ সুতো হাতে নিলেই ফুলদিদা দেখা দিচ্ছেন,আর একটা না একটা অঘটন ঘটছে...এটা কেন বাবা?”

-“কী জানি! হয়ত কাকী তোমার মাধ্যমে কিছু বলতে চাইছেন”।

-“সূঁচ নিয়ে ফুলদিদার মনে যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল,তা বেশ বুঝতে পারছি”।

-“হুম”

-“আচ্ছা বাবা,ফুলদিদার ঐ সূঁচের বান্ডিলটা বা সেলাইয়ের বাক্স পাওয়া গেছিল?”

-“নাঃ, কাকী পরে আর বলতেও পারেনি ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল আর আমরাও আর ওটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি”।

-“তবে আমি এখন সূঁচ সুতোর মাহাত্ম্য বুঝে গেছি বাবা...ফুলদিদা প্রতিটা বিপদের আগেই আমায় সাবধান করছিলেন।আমিই বুঝতে পারিনি।

সূঁচগুলো আলগা না রেখে গিঁট দিয়ে রাখলেই বিপদগুলো এড়ানো যেত বাবা। প্রতিবারই নাম লিখে ফুলদিদা আমায় সতর্ক করেছিলেন কিন্তু এত অকস্মাৎ সব ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে আমি ...”

বিয়ানকা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

-“নিজেকে মিছিমিছি দোষ দিও না বৌমা।এখন থেকে সাবধানে থেকো আর পাপানকেও সাবধানে থাকতে বোলো”।

-“ও তো বিশ্বাসই করছে না বাবা”

অনেকক্ষণ ধরে একটানা কথা বলায় দেবেশবাবু বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন।দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আরাম কেদারাটায় গা এলিয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুজলেন।


কখন কী ঘটে এই ভয় থাকলেও সমস্ত ঘটনা শ্বশুরের কাছ থেকে জানার পর এখন মনে অনেকটা সাহস এসেছে।বিয়ানকা সেলাই করে বটে,কিন্তু এখন আর সূঁচসুতো কখনোই আলগা ফেলে রাখে না।সবসময় ভালো করে গিঁট দিয়ে বাক্সে ভরে তবেই ওঠে।তবে কাঠের মস্ত আলমারির পেছনটায় মাঝে মাঝেই যেন মনে হয় কিছু একটা নড়ে উঠল।কখনো মনে হয় ঐ আলমারির আড়াল থেকে কেউ যেন বিয়ানকার উপর নজর রাখছে।তবে ভয় লাগে না।বিয়ানকা জানে,যেই হোক্,তার ক্ষতি সে করবে না।


বেশ কিছু বছর নির্বিঘ্নেই কেটেছে।শিঞ্জন ধীরে ধীরে স্কুল পেরিয়ে কলেজ,তারপর চাকরি আর এখন বিয়ে।বয়সজনিত কারণে দেবেশ বাবুর শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছে না।নাতবৌ দেখে যেতে পারলে মনে শান্তি।তাই প্রাঞ্জল আর বিয়ানকা বেশ কম বয়সেই শিঞ্জনের বিয়েটা দিয়ে দিলেন।এখন ও মাত্র ছাব্বিশ।অল্প আপত্তি থাকলেও দাদাইয়ের কথা ভেবে দেরি করল না।আর পাত্রী যেখানে নিজের পছন্দের সেখানে আর চিন্তা কী! সেই কলেজের সময় থেকেই তোড়াকে সকলে চেনে।ও যে এ বাড়ির বউ হয়েই আসবে,তাও পূর্বনির্ধারিত।তাই দুই বাড়ির সম্মতিতেই ভালোয় ভালোয় সমস্ত অনুষ্ঠান মিটে গেল।

এতদিন বাড়িটা আত্মীয়পরিজনে ভরপুর ছিল।প্রাঞ্জলের খুড়তুতো,জ্যাঠতুতো ভাইবোন, তাদের ছেলেপুলে মিলে বাড়িটা গমগম করছিল।কিন্তু বৌভাত পেরোতে না পেরোতেই যে যার আস্তানায় রওনা দিয়েছে।সবারই তো অফিস-কাছারি,স্কুল আছে।এত আনন্দময় পরিবেশ,কিছু সময়ের পর সবাই চলে যেতে কেমন যেন সব ঠাণ্ডা পড়ে গেছে।

দ্বিরাগমন থেকে ফিরে তোড়া যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে,আর শিঞ্জনও ভালো করে কথা বলছে না।তোড়াকে অনেক করে জিজ্ঞেস করায় শুধু বলেছে, “বিয়ের পর শিঞ্জন সন্দেহবাতিক হয়ে পড়েছে মামনি।বাপেরবাড়িতে একদিন পূর্ণিমারাতে নৌকাবিহারে গিয়েছিল দুজনে।তারপর থেকেই শিঞ্জন কেমন যেন অদ্ভুত বিহেভ করছে”।একথা শোনার পর থেকে বিয়ানকার মনের ভেতরটাও কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।

তোড়ার জোরাজুরিতে অনেক দিন পর আবার সেলাই নিয়ে বসেছে বিয়ানকা।হাল্কা হাল্কা উত্তুরে হাওয়ায় পরিবেশ বেশ মনোরম।কিন্তু বিয়ানকার চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে ফুলদিদার মুখ।বৌভাতের দিন বরবধূ যে সিংহাসনে বসেছিল,বিয়ানকার কেন যেন মনে হচ্ছিল ঠিক তার পেছনেই ফুলদিদা বারবার দেখা দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন।প্রাঞ্জলকে তিনি নিজের প্রাণের থেকেও ভালোবাসতেন,সেখানে তার একমাত্র ছেলের বিয়ে,ফুলদিদা তো আসবেনই।তবু যেন কোনো এক অজানা আশঙ্কায় বিয়ানকার অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রতিবারই কোনো না কোনো বিপদের আগেই ফুলদিদা দেখা দিয়েছেন।বিপদটা ঠিক কোন দিক দিয়ে আসবে,সেটা সম্পূর্ণ অজানা।


-“ও মা..আঁ..আঁ..”

হঠাৎ একটা আকস্মিক চিৎকারে সমস্ত চিন্তার জাল ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরে এল বিয়ানকা।‘এ তো তোড়ার গলা।কি আবার বিপদ হল কে জানে...’

দৌড়ে যেতে গিয়েও থমকে গেল সে।আগে হাতের সূঁচটায় ভালো করে গিঁট বেঁধে চাদরের এক কোণায় আটকে তারপর পা বাড়াল।তোড়ার ঘরে ঢুকে দেখে সে এক হুলুস্থূল কান্ড।বাথরুমে যেতে গিয়ে ‘তোড়াদেবী’ আরশোলা দেখে অমন ছিল চিৎকার করে আপাতত খাটের উপর ব্রেক ডান্স করছেন। তোড়ার অবস্থা দেখে বিয়ানকা হেসে লুটোপুটি।

-“আমায় দেখে খুব হাসি পাচ্ছে না মামনি?দাঁড়াও তোমাকেও আমি ভয় দেখাব...”

-“আমার কিছুতেই ভয় নেই।তুই কিসে ভয় দেখাবি?” হাসতে হাসতে বলে বিয়ানকা।

-“কেন,ভূতের ভয় দেখাব।ভূতে সবাই ভয় পায়”।

-“আমাকে ভয় পরে দেখাস,আপাতত তুই নেমে আয়।সন্ধ্যায় ভোম্বলরা আসার কথা।চল রান্নাঘরে আমায় হেল্প করবি।গরম গরম সিঙ্গাড়া ভেজে দেব ওদের।এখন দুজনে মিলে খোলাগুলো গড়িয়ে রাখি চল”।

তোড়া মুখ কাঁচুমাচু করে নেমে গুটিগুটি পায়ে বিয়ানকার সাথে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।ভোম্বল হল শিঞ্জনের দূরসম্পর্কের খুড়তুতো ভাই।ওদের বাড়ি শিঞ্জনদের কাছাকাছিই কিন্তু ভোম্বল বিদেশে থাকায় বিয়ের সময় আসতে পারেনি।এখন কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরতে বিয়ানকা ওদের এ বাড়িতে ডেকেছে।

সন্ধ্যায় লাহাবাড়িতে বেশ একটা ছোটোখাটো আনন্দের আসর বসেছে।যার মধ্যমণি নতুন বউ তোড়া এবং ওদিকে বিদেশ ফেরত ভোম্বল।ভোম্বল শিঞ্জন আর তোড়ারই বয়সী।‘ভোম্বল’ নামটা কেউ বললেই তোড়া ফিক্ করে হেসে ফেলে।যদিও নামের সাথে ভোম্বলের কোনো মিলই নেই।লম্বা দোহারা গড়নে বিদেশের জল হাওয়া পড়ায় চাকচিক্য বেড়েছে বই কমেনি।বিয়ানকা ভোম্বলের মা’কে বলে,

-“দিদি, আমার কাজ তো মিটে গেল।দেশে যখন ফিরেছে এবার ভোম্বলকেও ধরে একখান বিয়ে দিয়েই দাও। সেই ছোটোবেলাকার গোলুমোলু ভোম্বল আমাদের এখন কেমন স্মার্ট হয়ে গেছে বলতো...”

কপট রাগের স্বরে ভোম্বল বলে,-“আমি স্মার্টই ছিলাম কাকিমণি।শিঞ্জনটা ক্যাবলা বরাবরের...”

-“এ্যাই, আমার বরকে একদম ক্যাবলা বলবে না” তোড়া ক্ষেপে ওঠে।

-“ও,তাইতো,তাইতো।ক্যাবলা হলে কী আর তোমার মতো মাছ বঁড়শিতে গাঁথতে পারত!”

তোড়া ঘুষি পাকিয়ে ভোম্বলকে তেড়ে যায়।সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। বিয়ের আগে থেকেই যদিও দুজন দুজনকেই চেনে,তাও এখন সদ্য হওয়া দেওর-বৌদি সম্পর্কের খুনসুটির মজাই আলাদা।শিঞ্জন কিন্তু ওদের এই নিখাদ বন্ধুত্বটা এতদিন বেশ উপভোগই করত।কিন্তু আজ যেন চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি।হঠাৎ করে সবার মধ্যেই শিঞ্জন তোড়াকে ধমক দিয়ে উঠল।

-“কি ছেলেমানুষী হচ্ছে তোড়া?যাও সবার জন্য চা নিয়ে এস”।

তোড়ার মুখটা শুকিয়ে যায়।–“আমি কী করলাম শিঞ্জন?”

-“আহ্ বাবু, দুজনে একটু মজাই তো করছে... তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেনো?”

শিঞ্জনের চোখদুটোতে যেন আগুন জ্বলে উঠল।

-“মজা নয়,অসভ্যতা করছে”।বলেই সে ঘর ছেড়ে দপাদপ করে বেরিয়ে গেল।

সবাই হাঁ করে শিঞ্জনের চলে যাওয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।এ কোন শিঞ্জনকে তারা দেখছে!তোড়া চোখের জল লোকাতে চা বানানোর অছিলায় রান্নাঘরে রওনা দিল।কেউ মুখে আর রা’ কাটছে না।প্রাঞ্জল আর বিয়ানকা তাদের ছেলের ব্যবহারে লজ্জায় ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।এমন সময় হঠাৎ তোড়ার ব্যাথাতুর গলার আওয়াজে সবাই রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।

গিয়ে দেখে রান্নাঘরের মেঝে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।তোড়ার পায়ে বড় বড় সূঁচ ফুটে রয়েছে।ও ব্যথায় মেঝেতেই বসে পড়েছে।পুরো রান্নাঘরের মেঝে জুড়ে কেউ যেন অসংখ্য ছোট বড় সূঁচ বিছিয়ে দিয়েছে। প্রাঞ্জল চিৎকার করে ওঠে-“এত সূঁচ এল কোথা থেকে?”

বিয়ানকা দেখে শুধু মেঝেতেই নয় রান্নাঘরের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অসংখ্য সূঁচ। সেগুলো এক এক করে গেঁথে যাচ্ছে তোড়ার চোখে,মুখে,মাথায়,বুকে; তোড়া যন্ত্রণায় ছটপট করছে।দূর থেকে শিঞ্জন যেন বলেছে-‘ঠিক হয়েছে,বেশ্যা মেয়ে মানুষের এমনই হওয়া উচিৎ।মর,মর”। আর শুনতে পারে না বিয়ানকা।মাথা ঘুরে ওখানেই পড়ে যায়।চেতনা হারানোর আগে মনে হয় যেন ফুলদিদা সব সূঁচগুলো একত্রে গুছিয়ে বেঁধে ঐ আলমারিটার ভেতরে ফেলে দিচ্ছে।


ডাক্তার বাড়িতে এসে তোড়ার পায়ে ড্রেসিং করে দিয়েছে।বিয়ানকারও জ্ঞান ফিরে এসেছে।জ্ঞান ফিরতেই বিয়ানকা তোড়ার খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

-“তোড়া কেমন আছে প্রাঞ্জল?আর শিঞ্জন?ও কোথায়?”

-“তোড়া ঠিক আছে বিনু।ডাক্তার পায়ে ড্রেসিং করে দিয়েছেন আর মেডিসিনও দিয়েছেন।কিন্তু শিঞ্জন কেমন যেন অস্বাভাবিক বিহেভ করছে।একটিবারের জন্যও তোড়ার কাছে যায়নি।এমনকি এখানেও আসেনি।সেই থেকে নীচের স্টাডিতে গোঁজ হয়ে বসে রয়েছে”।

-“আর সূঁচগুলো?”

-“কি অদ্ভুত ব্যাপার বিনু,তুমি অজ্ঞান হয়ে যেতে আমরা তো তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।ভোম্বলই তোমায় পাঁজাকোলা এনে ঘরে শুইয়ে দিল।তারপর একটু পরে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সব যেমনকার তেমন।কোথায় সূঁচ, কোথায় রক্ত! তবে তোড়ার পা-দুটো কিন্তু ক্ষতবিক্ষত।

কি করে অত সূঁচ এল,তোড়ার পায়ে ফুটলই বা কি করে,তারপর কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল,কিছুই বুঝলাম না।সব কেমন যেন ভূতুড়ে ব্যাপার হয়ে গেল”।

-“ভূতুড়ে নয় গো,পাপ আর অভিশাপ”।

-“পাপ?কিসের?অভিশাপই বা কার?কি সব বলছো বল তো?”

-“,ও তুমি বুঝবেও না,বিশ্বাসও করবে না।আমাকেই যা করার করতে হবে” বলেই খাট থেকে নেমে তোড়ার ঘরের দিকে গেল বিয়ানকা।

-“আরে,কি করো কী?ডাক্তার তোমায় বিশ্রাম নিতে বলেছেন যে...”


তোড়ার পায়ে মলম লাগাতে লাগাতে ফুলদিদা,ফুলদাদু,ছোটোদাদু আর নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতার গল্প শোনায় বিয়ানকা।তোড়াকে শক্ত হতে বলে।শিঞ্জনকে যে ফুলদাদু সম্পূর্ণ আবিষ্ট করে নিয়েছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।সেইজন্যই ফুলদিদা আর ছোটোদাদুর সম্পর্কের মতো তোড়া আর ভোম্বলের বন্ধুত্বকেও ও বিষনজরে দেখছে।এখন ওদের দুজনের কাজ হল ফুলদিদার সেই সূঁচের বাক্স বা পুঁটুলি যাই থাক,সেটা খুঁজে বের করে ধ্বংস করা।নাহলে এ অভিশাপ যাওয়ার নয়।বিয়ানকার দৃঢ় বিশ্বাস সেই জিনিসটা তার ঘরের ঐ আলমারিটার আসেপাশেই কোথাও রয়েছে।কারণ ফুলদিদাকে সূঁচগুলো সে ওখানেই রাখতে দেখেছে।

তোড়া বুদ্ধিমতী মেয়ে।বিয়ানকার সব কথা শুনে বলে,

-“ঐ আলমারিটা তো তোমার নয় মা।ওটা তো তোমার বিয়ের আগে থেকেই ওখানে আছে তাই না?”

-“হ্যাঁ,ওটা ফুলদিদার।উনি মারা যাওয়ার পর ওটা আমিই ব্যবহার করতাম।তবে ওটাতে শিঞ্জনের জিনিসই বেশি রাখতাম”।

-“তব ওটাতেই থাকবে মা...চল খুঁজি”।

-“তুই এই অবস্থায়,না থাক...”

-“চল, আমার কিচ্ছু হবে না”


সত্যি সত্যিই ঐ আলমারির চোরাকুঠুরি থেকে লাল মখমলের কাপড়ে জড়ানো মস্ত এক সূঁচের পুঁটুলির হদিস পাওয়া গেল।কত রকমের বাহারি সূঁচ তাতে।সোনামূখী সূঁচ থেকে কাঁথা সেলাইয়ের মোটা সূঁচ,আসন বানানোর সূঁচ, আরও কত কী।আর একদম নীচে পাওয়া গেল ছোট্ট একটা অপূর্ব নকশীকাঁথা।তাতে ফুলদাদুর নাম লেখা –“মহীন”।সেই সূঁচের পুঁটুলি হাতে করে এনে বিয়ানকা আর তোড়া রাখল শিঞ্জনের সামনে।নিমেষে চকচক করে উঠলো তার দুটো চোখ।এই চোখেই ফুলদাদুর মতো ঘনিয়ে আসছিল সন্দেহের বীজ,তোড়া আর ভোম্বলকে নিয়ে।তার পর থেকেই যত গন্ডগোল।বিয়ানকা শিঞ্জনের চোখের সামনে একটা একটা করে সূঁচ গেঁথে দিল নকশীকাঁথাটায়।প্রতিবার সূঁচ গাঁথার সময় অসহ্য চিৎকার করে কঁকিয়ে উঠছিল ছেলেটা।তোড়া শিঞ্জনকে জাপটে ধরে সাহস জুগিয়ে চলেছে।দুজনের চোখই কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে।

-“আর একটু শিঞ্জন,সব ঠিক হয়ে যাবে”।

সবকটা সূঁচ কাঁথাটায় গাঁথা হয়ে বিয়ানকা সূঁচগুলো সমেত নকশীকাঁথাটা পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিল গঙ্গার জলে।


শিঞ্জন এখন পুরোপুরি সুস্থ।তোড়া ভোম্বল আর শিঞ্জন তিনজনে সন্ধ্যায় ছাদে জমিয়ে আড্ডা বসায়।ভোম্বল অবশ্য কিছুদিন পরই বিদেশে ফিরে যাবে।প্রাঞ্জল বিয়ানকার কথাগুলো আর হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় না।তবে বিয়ানকারও এখন আর কেউ আসেপাশে আছে বলে মনে হয় না।সারা দুপুর ধরে সকলের জন্য সোয়েটার,চাদর,নকশীকাঁথা সেলাই করে তার সেলাইয়ের সূঁচগুলো সে এখনও আলগা ছাড়ে না।সুতো দিয়ে গিঁট বেঁধে চাদরের গুঁজে দিয়ে তবেই ওঠে।বিয়ানকা এখনো বিশ্বাস করে যে,

 ‘বেঁধে রাখতে হয়,আলগা ছাড়লেই সব শেষ! ’



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror