Suchismita Chakraborty

Drama Classics Others

4.4  

Suchismita Chakraborty

Drama Classics Others

সন্ধ্যে নামার পরে

সন্ধ্যে নামার পরে

9 mins
299



 বিস্কুটের কারখানাটার গা ঘেঁষে ম‍্যারাপ বেঁধে চোঙা লাগিয়ে হৈ হৈ করে সকাল থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন চলছে।ছোট্টু,বিট্টু,পাপলু,পিকলু,বুবলাই সকলেই নিজের নিজের রঙিন ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে মাঠে হাজির।সেদিন আর পড়াশুনো নেই।সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।নানারকমের ঘুড়ির সম্ভার নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনায় সব মত্ত।কেউ কাঁচের গুঁড়ো দিয়ে বেশ করে মাঞ্জা দিয়েছে, তো কেউ চীনাবাজারি মাঞ্জা সুতো কিনে এনেছে।বেলা বারোটার পর প্রতিযোগিতা শুরু হলে একটি ঘাড়ও আর সোজা দেখতে পাওয়া গেল না।নীল সাগরের মতো আকাশের বুকে তখন লাল, নীল,হলুদ, সবুজের মেলা বসেছে।সঙ্গে থেকে থেকেই রব উঠছে “ভোকাট্টা” “ভোকাট্টা”

পটল কমদামি একটা ছোট্ট লাটাই আর সাধারণ একটা ঘুড়ি নিয়ে ঘরের বাইরের দাওয়ায় বসে বসে লাটাইয়ের একটা দিক দিয়ে অন‍্যমনস্কভাবে মাটি খুঁটে চলেছে।মাঠে প্রতিযোগিতা শেষ হলে তবেই গিয়ে সে ঘুড়ি উড়োবে।দূর থেকে ‘ভোকাট্টা’ আওয়াজ পেলেই হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ ফিরোজা রঙের পেটকাটিটা হেলতে দুলতে ওর মাথার উপর দিয়েই ভেসে চলল ভৌমিকদের আমবাগানের দিকে।আর স্থির থাকতে পারল না পটল।ছুটে চলল উঠোন,রাস্তা,পাঁচিল পেরিয়ে একদম আমবাগানের মধ‍্যিখানে।গাছের মগডালে তখন পাকা আমের মতোই উঁকি দিচ্ছে ‘মহারাণী ফিরোজা’।নীচের ছেলে ছোকরাদের পেছনে ফেলে তরতর করে একদম মগডালে উঠে পটলা ঘুড়িটাকে পেড়ে আনল।গাছের নীচের গুজগুজ ফুসফুস নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল।সবাই জানে,পটলা যখন উঠেছে তখন আর কারোর সুযোগ নেই।লেখাপড়া,খেলাধুলা সবেতেই ও অনেকের থেকে বেশিই পারদর্শী।রতন অনেকটা উঠেছিল বটে,কিন্তু পটলকে ঘুড়ি সমেত নেমে আসতে দেখে বেজায় রেগে গেল-

“দিলি তো সব মাটি করে?এখন ঐ ঘুড়ি আর কেউ হাতই দেবে না।তুইই ওড়া গে যা...”

পটল বুঝে উঠতে পারে না, ওর গায়ে কি এখনো নর্দমার পাঁক লেগে আছে?বাবা তো সেই কোন সকালে কাজ সেরে পরিস্কার হয়ে তবেই বাড়ি ঢোকে।তাহলে ওরা কিসের অচ্ছুৎ!

পাঁকে তো পুরো সমাজ ডুবে রয়েছে।স্কুলে হারানমাস্টার বড় বড় মহাপুরুষদের বাক‍্যি পড়ালেও মানার সময় সেই মদন বাড়ুজ্জ‍্যে আর শশী ভৌমিকদের কথাই মেনে চলেন।ওনাদের কথা মেনেই পটল আর ওর মতো ছেলেদের স্থান হয়েছে ক্লাসরুমের এক কোনায় নীচে চাঁটাই পেতে।বসার জায়গা নীচে হলেও পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে পটল থুড়ি পার্থ গুড়‍্যার নাম সবসময় থাকে সবার উপরে।এখানেই সকলের রাগ।‘ব‍্যাটাছেলে করবে তো সেই বাপ-ঠাকুরদার মতো নর্দমা পরিস্কার, তার আবার অত অত নম্বর পেয়ে পাশ দিয়ে কী হবে শুনি?’

শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে নিজের কঠোর অধ‍্যাবসায়ের জোরে বছর বছর ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর আর সরকারি অনুদান পেয়ে পটল উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে পাড়ি দিল।আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি পটলকে।পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহরের নামী স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে গেল।কিন্তু ছোটো থেকেই বৈষম্যমূলক সমাজের অংশ হয়ে চলা পটলের মনের কোণে জেদ লুকিয়ে ছিল কিছু একটা ব‍্যতিক্রমী করার।মা গত হয়েছেন।বাবা ততদিনে বৃদ্ধ।গ্রামের পাঠ চুকিয়ে স্কুলের কাছে ছোট্ট একটা ঘরে বাবা-ছেলের গোছানো সংসার।ঘরে একজন মহিলার বড্ড অভাব বোধ হলেও দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল।পটল ওরফে পার্থ গুড়‍্যা স‍্যারের ‘কাজ’ শুরু হল বাড়ির কাছের ‘অন্নপূর্ণা ভাতের হোটেল’ থেকে।হোটেলের নিয়মিত খদ্দের নাহলেও দু-চারবার রাতের রুটি-তরকারি আনার সময় খেয়াল করেছে সকাল বিকেল মিলিয়ে বেশ কটা বাচ্চা বাচ্চা ছেলে ঐ হোটেলে কাজ করে।এছাড়া আশেপাশের কয়েকটা চা-দোকান, পান দোকানেও অনেকগুলো কমবয়সী ছেলে আছে।হোটেলটায় বিকেলে যে ছেলেটা রুটি বানায়,তার নাম মনুয়া।চারটে গরম রুটি নিতে নিতে এই কয়দিনে বেশ কিছু কথা হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে।

-“তুই কতদিন আছিস এই হোটেলে?”

-“বেশিদিন লয় বাবু,হেই মাসপাঁচেক হবেক”

-“তুই পড়াশুনো করিস না?দিনের বেলায় নিশ্চয়ই স্কুলে যাস্?”

-“ইশকুলি তো বড় লুগের ছ‍্যানারা যায় গো বাবু; আমানদের ঘরে বই পড়লি যে ভাত ফুকবেনিকো...”

গ্রামের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় পার্থর।মুখে বলে

-“হ‍্যাঁ রে তোর পড়তে ইচ্ছে করে কি না বল?”

চোখ নামিয়ে লাজুক স্বরে মনুয়া বলে “মুই তো নাম সহি কুরতে পারি বটেক।বানান করি টুকু পড়তিও পারি কিন্তু ঐ বাদলাটা কিচ্ছু পারেনিকো”।

-“ও তাতেই হবে।আমাকে একবার তোর বাড়ি নিয়ে যাবি?তোর মায়ের সাথে কথা বলব..”

এমনি ভাবেই আশেপাশের ছোটোখাটো দোকানের বিশু,ফটিক টোটোন সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের মা-বাবাদের বুঝিয়ে প্রত‍্যেককে স্কুলমুখো করেছে।যদিও পথ সহজ ছিল না।সবথেকে বেশি অন্তরায় ছিল তাদের আর্থিক সঙ্গতি,যে কারণে তারা প্রত‍্যেকে দোকানে কাজ করত।প্রথমে তাদের ভবিষ্যতের কথা বলে এবং না বুঝতে চাইলে পরে আইনের ভয় দেখিয়ে সবাইকে রাজি করাতে হয়েছে।দোকানের মালিকরাও এই কারণে পার্থর উপর বেজায় বিরক্ত।কম পারিশ্রমিকেই তারা এই বাচ্চাগুলোকে দিয়ে বেশি কাজ পাচ্ছিলেন।তাদেরও শিশুশ্রম আইনের ভয় দেখিয়ে অগত‍্যা নিরস্ত করতে হয়েছে।

এখন তারা বেশিরভাগই নিয়মিত ক্লাস করে।তাদের পড়াশুনো হয় মুক্ত বিদ‍্যালয়ের সৌজন্যে।অবসরে টুকটাক হাতের কাজ করে তারা অল্প উপার্জনও করছে।এক যুদ্ধে জয়ের পর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ।আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই সব ছেলেদের বাড়ির মেয়েদের অবস্থা বড়ই করুণ।নাবালিকা বয়সেই বেশিরভাগ মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হত কোনোরকম খোঁজ খবর ছাড়াই।বিয়ের পর তাদের অবস্থা কি হচ্ছে, তারা কোথায় আছে বা কেমন আছে এই খবর নেওয়ার প্রয়োজন টুকুও বোধ করত না বাড়ির লোক।খাওয়ার পেট একটা কমেছে,এই তাদের কাছে যথেষ্ট।মনুয়ার বড়দিদিরই বিয়ের ঠিক হয় বছর পনেরো বয়সে।পাত্র উত্তরপ্রদেশের কোনো এক দোকানের কর্মচারী।খোঁজখবর না নিয়েই তোরজোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।মনুয়া এসে ঠিক সময়ে খবর দেওয়ায় পার্থ তার ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে মেয়েপাচারকারীর চক্রটিকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।শিক্ষকতা করে যেটুকু মূলধন জমেছিল তার থেকেই অনেক মেয়ের বিবাহের দায়িত্ব পার্থ নিজের কাঁধে তুলে নেয়।কর্মগুণে ধীরে ধীরে পার্থ তাদের নিজের লোক হয়ে উঠেছে।কিন্তু পার্থর নিজের লোক বলতে একমাত্র তার বৃদ্ধ বাবা।যদিও ছেলেমেয়েগুলোকে সে নিজের সন্তানসম মনে করে,এবং তারাও পার্থকে অপার শ্রদ্ধা ভক্তি করে।বাবা বহুবার বলেছে

“সারাদিন তো অন‍্যের কথাই চিন্তা করিস পটল,এবার একটু নিজের কথা চিন্তা কর।এত বয়স হয়ে গেল, একটা মেয়েও কি চোখে লাগে না?”

-“আমি কি আর মেয়ে দেখে বেড়াই বাবা...”

-“এবার একটু থিতু হ’ বাপ আমার, তোকে সংসারী দেখে তবেই আমি শান্তিতে চোখ বুঝতে পারব..”

-“আজে বাজে বোকো না তো বাবা।ঠিক সময়ে সব হবে”।

-“আর কবে যে তোর সময় হবে?”

বাবার কথাগুলো কানে বাজতে থাকে।সত্যিই তো মেঘে মেঘে বেলা তো কম হোলো না।এক্কেবারে যে কাউকে চোখে ধরেনি তা নয়,কিন্তু সাহস করে মনের কথা বলা হয়ে ওঠেনি।পার্থর স্কুলেরই সাহিত্যের শিক্ষিকা কৃষ্ণা লাহিড়ী।যেমন নাম,ঠিক তেমনই কৃষ্ণকলির মতো চেহারা।মিষ্টি মুখশ্রীর সঙ্গে সবসময়ের আলগা হাসিটা উপরি পাওনা।দেখা হলেই মিষ্টি হেসে বলে-

“চারিদিকে তো আপনার কাজের খুব প্রশংসা হচ্ছে পার্থবাবু,খুব ভালো কাজ করছেন।আমরা প্রত‍্যেকেই গর্বিত”।

পার্থর মনে একটা শিরশিরানি অনুভূতির সৃষ্টি হয়।পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বন্ধুত্বে পরিণত হলেও মধুর পরিণতির পথে আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় পার্থর পদবী,বংশ পরিচয়।সংস্কারের উর্দ্ধে গিয়ে দুটো মনের মিলন সম্ভব হয় না।মনের গভীরে কোথাও একটা দুর্বলতা থাকলেও দিনের শেষে কৃষ্ণার উচ্চাকাঙ্খা,বংশগরিমা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।প্রত‍্যাখ‍্যান বা অবহেলা পার্থর জীবনে নতুন নয়।সে নিজের কর্মে ব্রতী হয়ে এগিয়ে চলে।

পরবর্তীতে পার্থ অবশ‍্য মফস্বলের সাধারণ মেয়ে কমলিকার মধ্যে নিজের যোগ্য সহধর্মিনীকে খুঁজে পায়।বাবা গত হয়েছেন।মনুয়া,বিশু,ফটিকদের পথ দেখিয়ে নিজে যাত্রা করেন আরেক আলোর সন্ধানে।অন‍্য একটা স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয় পার্থ।ধীরে ধীরে বছর গড়ায়।চুলের রুপোলী রেখা জানান দেয় সময় থেমে নেই।নিজের ছেলেমেয়েরা স্কুলের গন্ডি পেরোলো বলে।তবে পার্থর কর্মকাণ্ড থেমে থাকে না।দুস্থ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবেও পার্থর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।অন‍্যায়,অত‍্যাচার বা যেকোনো কিছু অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পার্থ গুড়‍্যা।পাড়ার গুন্ডা থেকে আমলা,নেতা-মন্ত্রী আড়ালে ষড়যন্ত্র করলেও,মুখোমুখি তাকে বেশ সমীহ করেই চলে।শত্রু মিত্র দুই-ধরনের মানুষদের নিয়েই জীবন রথের চাকা এগিয়ে চলে।

রায়চক মাধ‍্যমিক বিদ‍্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার্থ গুড়‍্যার অবসরের আর বেশি বছর বাকি নেই।ইতিমধ্যে একদিন পিওন হরিকিষণ এসে বলে- “স‍্যার এখানকার নতুন বিডিও এসেছেন তার ছেলেকে নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে”।

-“আমার সঙ্গে?”

-“হ‍্যাঁ, বলছে এইস্কুলেই তার ছেলেকে ভর্তি নিতে হবে।ক্লার্ক বাবু বলেছেন যে আর সিট খালি নেই, কিন্তু উনি নাছোড় স‍্যার...”

-“ঠিক আছে,ওনাকে ভেতরে আসতে বল,কথা বলি”।

বলতে বলতেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর সঙ্গে একটি বছর সাতেকের ছোট্ট ছেলে।ছেলেটির পরণে হাফ প‍্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট।তবে তার বি ডি ও বাবার পোশাকআশাক বেশ ধোপদুরস্ত।সাদা পাজামা পাঞ্জাবী আর তার উপরে নেহেরু জ‍্যাকেট,সঙ্গে পালিশ করা শ‍্যু।ঘরে ঢোকা মাত্র কথা নেই,বার্তা নেই,বিডিও ভদ্রলোক হঠাৎ করেই পায়ে হাত দিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে পড়লেন একদম মুখের সামনে।বাবার দেখাদেখি ছেলেটিও ধপাস করে প্রণাম করে আবার বাবার পাশটিতে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।ঘটনার আকস্মিকতায় পার্থ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে কথাই হারিয়ে ফেলেছে।জানা নেই,শোনা নেই,হঠাৎ করে এমন কেউ প্রণাম করতে পার্থ রে রে করে উঠে বলে

-“আরে আরে করেন কি?থাক বাবা থাক থাক।এবার বলুন তো কী দরকার?”

-“আমাকে চিনতে পারছেন মাস্টারমশাই?”

স্মৃতির অতলে হাতড়েও এই মুখ তিনি মনে করতে পারলেন না।যদিও বুঝলেন, মাস্টারমশাই যখন বলছে তখন কোনো প্রাক্তন ছাত্র তো বটেই।মুখে বললেন

-“বুড়ো হয়েছি,স্মৃতিশক্তি আর আগের মতো নেই।চিনতে একটু অসুবিধে হচ্ছে বৈকি...নামটা বললে হয়ত..”

-“আমি মনোতোষ,মনোতোষ হাতি”

-“নাঃ,এ নামে কোনো ছাত্র ছিল বলে তো মনে পড়ছে না বাবা..”

-“আমি জ’পাড়ার মনুয়া মাস্টারমশাই!”

-“কি?মনুয়া?সেই ‘অন্নপূর্ণা ভাতের হোটেল’?”

-“হ‍্যাঁ, মাস্টারমশাই!”

এমনও হয়!এ যে রূপকথার গল্প।সেই হোটেলে কাজ করা ছেঁড়া জামা পরা মনুয়া,আজ এক্কেবারে সাহেব!এত বড় পদ!আবেগে বিহ্বল হয়ে মনুয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে পার্থ।

-“আজ আমার জীবন সার্থক মনুয়া”

-“আপনার জন্যই আজ আমি এই জায়গায় মাস্টারমশাই।তাই আমার ছেলেকেও আমি আপনার হাতেই তুলে দিতে চাই”।

-“অবশ্যই অবশ্যই;ওকে আমার স্কুলেই ভর্তি নেব”।


বাড়ি ফিরে বুকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে পার্থ।পদ্ম তো পাঁকেই ফোটে,কিন্তু দেবীর পাদস্পর্শেই তার জীবনের সার্থকতা।তেমন মনুয়ার মতো একজন যে সমাজের অতল অবস্থান থেকে উঠে বর্তমানে এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে,এটা জেনেই তার শিক্ষক জীবনের সার্থকতা।কিন্তু নিমেষেই কিছু ঘটনার কথা মনে করে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বর্তমান কলুষিত সমাজে এইসব আদর্শ, সত‍্য,সংকল্প এই জিনিসগুলোর কোনো দাম নেই।উপর উপর মুখে সম্মান দেখালেও প্রোমোটার ভোলা বেশ কিছুদিন তার পেছনে পড়ে রয়েছে।পান চেবানো লাল মুখে পিচ করে একগাল পিক রাস্তার উপর ফেলে একটা অশ্লীল হাসি হেসে প্রায়ই বলে “ছার,বয়স তো হল,আর কতদিন?ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে,সমাজ সমাজ করে পাগলামিটা বন্ধ করে এবার ওদের দিকে একটু নজর দেন;নইলে যা দিনকাল পড়েছে, কখন কি বিপদ হয়!”

-“আমার জমিটাতো তোমাকে দেব বলেছি ভোলা,তুমি বস্তির জমিটা ছেড়ে দাও।গরীব মানুষগুলো কোথায় যাবে বলতো?”

-“ফুঃ,আপনার ঐ এক ছটাক জমি নিয়ে আমি কি মুদি দোকান দেব ছার?হ‍্যাঃ হ‍্যাঃ হ‍্যাঃ...”

তার উদ্দেশ্য স্কুলের সামনের বস্তিটা উচ্ছেদ করে সেখানে বিশাল একটা শপিং মল খোলা।কিন্তু পার্থ বিডিও অফিসে দরখাস্তর উপর দরখাস্ত করে সমানে এর বিরোধিতা করে গেছে।বস্তির অনেক ছেলেমেয়ে তার স্কুলে পড়ে তাছাড়া বস্তি উচ্ছেদ হলে সেখানকার লোকজনই বা যাবে কোথায়!এর জন্য মিটিং মিছিল সভা কতদিন ধরে হয়েই চলেছে।পুরোনো বিডিও বদলি হয়ে তার জায়গায় মনুয়া থুড়ি মনোতোষ আসায় পার্থর মনে বেশ স্বস্তি হয়।এখন ঐ ধূর্ত ভোলা বসাক আর ভুল বুঝিয়ে বস্তির মানুষগুলোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।মনুয়ার সঙ্গে অবিলম্বে এই ব‍্যাপারে কথা বলতে হবে।

কিন্তু জলে থেকে কুমীরের সাথে বৈরিতা করলে যে কতখানি বিপদ তা মনুয়া জানে।

-“মাস্টারমশাই, ওরা খুবই পাওয়ারফুল।অনেক উপরের চেয়ার পর্যন্ত ওদের জানাশোনা।আগের বিডিও এই নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন বলেই তো রাতারাতি ওনার বদলি হয়ে গেল”।

-“তা বলে আমরা কিছুই করব না মনুয়া?বস্তির নিরীহ লোকগুলো যাবে কোথায় বলত?”

কিছুটা সময় নিয়ে একটু আমতা আমতা করে মনুয়া বলে,

-“আপনার বয়স হয়েছে মাস্টারমশাই।ওরা খুবই ভয়ঙ্কর;সত‍্যি বলতে আমি সদ‍্য এখানে এসেছি,সঙ্গে বৌ-বাচ্চা।এসেই ঝামেলায় জড়াতে চাইছি না।ঐ ভোলা বসাক লোকটা খুব একটা সুবিধের নয়।আমাকে ইতিমধ্যেই বেশ হুমকি দিয়ে গিয়েছে।তবে বেআইনি কিছু হলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করব আর বস্তির লোকেদের পূনর্বাসনের দিকটাও আমি গুরুত্ব সহকারে দেখব,কথা দিলাম”।

পার্থ বুঝতে পারে দিন সত‍্যিই বদলেছে।যুবক বয়সে নির্ভীকভাবে সে যা করতে পেরেছে, তা এখন আর সম্ভব নয়।যে তুরুপের তাসের ভরসায় সে এসেছিল কার্যকালে সেই তাস কোনো কাজের নয়।নিজের সমস্ত মূলধন সে সারা জীবন ধরে অন‍্যদের সেবায় লুটিয়ে গেছে।এখন আর খুঁটির জোর নেই।তাছাড়া নিজের দুটো সন্তানকেও তো স্বাবলম্বী করতে হবে।বহুবার ঠারেঠোরে প্রচ্ছন্ন হুমকিও পেয়েছে ভোলা বসাকের কাছ থেকে।এবার বোধ হয় তাকেও থামতে হবে।

ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পার্থ।বাইরে তখন সন্ধ‍্যা নামছে।পশ্চিমাকাশ লাজে রাঙা হয়ে চতুর্দিকে তার লাল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে।একঝাঁক পাখি কিচিমিচি করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।তাদের ঘরে ফেরার বড্ড তাড়া।বাসায় তাদের সন্তান-সন্ততি অপেক্ষারত।সেইদিকে তাকিয়ে পার্থর মনে হয় সারা জীবন অবহেলিত থেকে জীবনের আকাশে সমস্ত উজাড় করে,কোনো কিছুর পরোয়া না করে সে শুধু উড়েই গেল,বিলিয়েই গেল।সন্তানসম বহু ছাত্রকেই নিজের আদর্শ দিয়ে গড়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু বেলাশেষের সফর সেই একার।জীবনের রণক্ষেত্রে চাকা যখন গড়াতে গড়াতে থেমে যায় বা গর্তে খাবি খায়,সুযোগসন্ধানী বা ধূর্ত লোকেরা সেই সময়ের অপেক্ষাতেই থাকে,আঘাত হানে।তখন হয় যুদ্ধে ক্ষান্ত দিতে হয় না হয় পরাজয় স্বীকার করে পিছিয়ে আসতে হয়।এই মূহুর্তে পার্থরও নিজেকে ঠিক সেই পরাজিত সৈনিকের মতোই বোধ হচ্ছে,যার রথের চাকা এক জায়গায় এসে স্থবির হয়ে গিয়েছে।তাকে গড়িয়ে নিয়ে এগোবার ক্ষমতা একা পার্থর আর নেই।সন্তান, ভার্যা,ছাত্রছাত্রী,শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই থাকা সত্ত্বেও এই যুদ্ধে পার্থ সম্পূর্ণ একা এবং এই মূহুর্তে পরাজিত।

বুকের বাঁ-দিকটা অদ্ভুত এক চিনচিনে ব‍্যাথার অনুভূতি হতে থাকে।দিনের আলো নিভে আসার সাথে সাথে টলমল পায়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় পটল ওরফে পার্থ গুড়‍্যা।।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama