জাস্টিস
জাস্টিস


মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল তনুজার।রাত্রি তিনটে পনেরোয় চৈতির ফোন! ঘুম চোখে রিসিভ করল,"কী রে !এত রাতে ফোন কেন?" বিপরীতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে মুহূর্তের জন্য ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে গেল।
তনুজা আর চৈতালী দুই অভিন্নহৃদয় বান্ধবী, সেই নার্সারি থেকে।তারপর স্কুল, কলেজ,ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে আজ যে যার কর্মজীবনে ব্যস্ত।তবু যতই ব্যস্ততা থাক,দিনে একবার তাদের কথা হবেই।
দুজনেই পড়াশোনায় তুখড়।বই,নোটস থেকে শুরু করে জামা-কাপড় ,কসমেটিকস এমনকি মনের গোপনতম খবরাখবর সব কিছুই শেয়ার করত তারা ।একদম পার্ফেক্ট ক্রাইম পার্টনার।অন্যান্য বান্ধবীরা মজা করে বলত," এবার কি তোরা বয়ফ্রেন্ডও শেয়ার করবি নাকি..?"
ভয়টা অবশ্য তাদের দুজনেরও ছিল।যদি সত্যি সত্যিই দুজনের একই ছেলে পছন্দ হয়!
সেবার সেকেন্ড ইয়ার,ইউনিভার্সিটি থেকে এক্সকারশানে গিয়েছিল রামগড়।জন পনেরোর টিম সঙ্গে দুই অধ্যাপকও ছিলেন।অদ্ভুত সুন্দর পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শহর এই রামগড়।তিন রাত ,চিরদিনের ট্যুর।হৈ হৈ করে কাটছিল।কতগুলো রঙিন প্রজাপতি বাধাহীনভাবে উড়ে বেড়িয়েছিল পাহাড়ী ঝর্ণা আর সবুজের কোলে।পাহাড়ি মানুষগুলোর সরলতা মুগ্ধ করেছিল তাদের।আর মুগ্ধ করেছিল পলাশ।তাদের গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারের ছেলে।বয়স আন্দাজ সাতাশ-আটাশ।সুদর্শন, সপ্রতিভ আর অতিথি বৎসল।পুরো ট্যুরে সেই লোকাল গাইডের কাজ করেছিল। তনু আর চৈতি দুদিনেই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল পলাশের প্রতি।পলাশের রোমান দেবতার মত পাথর কুটে তৈরী মেদবর্জিত দেহসৌষ্ঠব ,পাহাড়ি বুনো গন্ধ, সারল্য পাগল করেছিল শহুরে দুই উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীকে। তারা বিলক্ষণ বুঝেছিল এটা ভালোবাসা নয়,শুধুমাত্র প্রবল শারীরিক আকর্ষণ।এর পরিণতি নেই, আছে শুধু ক্ষণিকের মাদকতা।সেই নিষিদ্ধ মাদকতাতেই মেতেছিল তারা ।
উচিৎ অনুচিতের বেড়া ভেঙে ফেরার আগের দিন রাতে তারা পলাশকে ডেকেছিল নিজেদের রুমে।আন্তরিক ব্যবহারে আর ধন্যবাদ জানানোর অছিলায় পলাশের পানীয়তে মিশিয়েছিল মাদক।তারপর অর্ধচেতন পলাশের সাথে দুই বান্ধবী মেতেছিল আদিম খেলায়।
আচ্ছন্ন পলাশ সে রাতে বুঝতে পারেনি ,তার সাথে ঠিক কি হয়েছিল; পেরেছিল পরদিন সকালে।যখন পুলিশ এসে তনু আর চৈতির ঘর থেকে মাতাল পলাশকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় মলেস্টিংএর অপরাধে।জ্ঞান ফেরার পর সে বুঝতে পারে আসল ঘটনা।কিন্তু ততক্ষণে বহু দেরী হয়ে গিয়েছিল।ছোট্ট শহর রামগড়ে ধোঁয়ার মত ছড়িয়েছিল অপবাদ।বন্ধ হয়েছিল তার বাবার সাধের গেস্টহাউস।
অপমান সইতে না পেরে লক-আপের ভেতরেই কিছুদিন পর আত্মহত্যা করে পলাশ।-- সব ঘটনাই পরে জানতে পেরেছিল তনুজা আর চৈতালী।সেদিনের উত্তপ্ত যৌবনের কামনায় করা ভুলটা দুজনের মনেই কোথাও না কোথাও একটা কাঁটার মত বিঁধেই ছিল।কিন্তু সেটা যে এতদিন পর ঘা'এর জন্ম দেবে তারা বোধ হয় দুঃস্বপ্নেও ভাবনি।পলাশ তো মৃত ,তাই সত্য উন্মোচনের ভয় তাদের কোনদিনই ছিল না।
আজ তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এক নতুন সমস্যার উদ্রেক হয়।
তনুজা নামী দৈনিক কাগজের রিপোর্টার ,থাকে নিজের বাড়িতেই আর চৈতি গভর্মেন্ট ফুড অফিসার,থাকে কোয়ার্টারে।কয়েকদিন ধরেই চৈতি তনুজাকে ফোনে একটা অদ্ভুত কথা বলছে ।ওর নাকি কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছে কেউ ওর ওপর নজর রাখছে,কোয়ার্টারে যেন সে একা নয় ,আরও কেউ ওর কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করছে! তনুজা প্রতিবারই আশ্বস্ত করেছে ,"বেশি টেনশন করিসনা" বলে..
তাই এত রাতে ফোন আসাতেও চৈতির নাম দেখেই ধরেছিল ফোনটা।
প্রচন্ড ভয়ার্ত গলায় কেঁপে কেঁপে এইটুকুই বলেছিল চৈতি,--
"তনু,পলাশ ফিরে এসেছে, আমার সামনে।ও জাস্টিস চায়!"..
ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায় তনুজার, চোখের সামনে অন্ধকার দেখে।পলাশ কি করে আসবে?ও তো আত্মহত্যা করেছিল!
তারপর বহুবার চৈতিকে রিংব্যাক করেও পায়নি।পুলিশে কল করে তনু।ভোররাতে নিউসপেপারের রিপোর্ট কভার করতে তাকেই যেতে হয় চৈতির কোয়ার্টারে।
..' যুবতীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য সরকারি আবাসনে,হত্যা না আত্মহত্যা?'
তনু জানে ,তদন্ত, পোস্টমর্টেম, খানাতল্লাশিতে তার নাম জড়াবেই; মৃত্যুর ঠিক আগেই কললিস্টে লাস্ট ডায়াল্ড নাম্বার তারই।
পুরোনো ঘটনার পর্দা ওঠাবে নাকি অন্য কোনও গল্প ফাঁদবে রিপোর্টার তনুজা?পলাশ কি এবার ওর কাছেও আসবে জাস্টিস চাইতে?
পরদিন আবার খবরের কাগজে হেডলাইন...' নিজের আবাসন থেকেই যুবতী সাংবাদিকার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার ; স্যুইসাইড নোটে লেখা "স্যরি পলাশ"!