নিষ্ফলা
নিষ্ফলা
অ মাণকে! মাণকে! একবারটি আয় বাপ চুলোটা একটু ফুঁকে দে যা। নিশ্বেস বন্দ হয়ে যাচ্চে বাপ আমার। শ্বাস ফুলে উঠতেছে।
অ মানকে! আ মলো ঢ্যাঁড়ার পো। ডেকে-ডেকে মল্লেও তো শুনতি পাসনে। অ মানকে! এতক্ষণ আদর করে ডেকে, উনুনের ধোঁয়ায় গলা শুকিয়ে এল আন্নার। গলা তুলেই ফেলল শেষমেশ।
-চেঁচাস কেন মা। আসতিছি তো। একছুটে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মাণিক। রান্নার চুলহাটা জোরে ফুঁকে আঁচটা ধরিয়ে দিয়ে,মাকে একঘটি জল দিল। আন্না একপাশে সরে বসে কাশতে-কাশতে তরকারী কাটছিল। ছেলের দেওয়া একঘটি জল গলায় ঢেলে ছেঁড়া আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছলো।
-হ্যাঁরে বাপ তর আজ ইস্কুল লাই? ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
-আচে ত! ভুলে গিছিস? কী রান্নারে মা আজকে? খিদা লাগছে। মায়ের গলা জড়িয়ে সাত বছরের মাণিক জিজ্ঞেস করলো।
-পান্তা ভাত আচে আত্তিরের। এট্টু আলু সেদ্ধ দিতিছি।পেঁয়াজ লঙ্কা দে খেয়ে ইস্কুল যা। অবলা অন্যকিচু করবো নে। বামুনবাড়ি থিক্যে ডাকচে। দুটি পয়সা পেলে আতে গরম ভাত খাবি।
-ভাত? গরম ভাত? আহ! কী সোন্দর গন্দ ভাতের। ধোঁয়া ওঠা ভাত মারে। খেতি খুব ভালো।প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল মাণিক। ওর ভাব দেখে হেসে ফেলল আন্না।মাকে হাসতে দেখে লজ্জা পেল, যাই ছুট্টে চান সেরে আসি, বলে ছুট দিল মাণিক পুকুরের দিকে। আন্না হাঁ করে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। মনে- মনে ভাবছে কে বলবে ও বাগদীর ছেলে। সোনার মত গায়ের রঙ, তেমন রূপ।আন্নাও এই বত্রিশেও কম সুন্দরী নয়। এ গাঁয়ের লোক হাঁ করে তাকিয়ে দেখে ওর আর ওর ছেলের দিকে। পুকুর ঘাটে চানে গেলে গাছপালার আড়ালে অনেক চোখের ভিড় এলিয়ে থাকে ওর মাজা শরীরের দিকে। ও সব জানে তবু না জানার ভাণ করে কাটিয়ে দেয়। সে তো সেই একজনের আশায়। যে কোনদিন আন্নার নিজের মানুষ হবে না।
মাণিক স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেলে,ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে পুকুরের দিকে এগোলো আন্না। স্নানের সময়টা একটু আগু-পিছু করেছে ও। পারাণ মাঝির বৌ কলি-টা খুব টেড়িয়ে-টেড়িয়ে কথা বলে। সেদিনও বলল, 'বাবা আন্না তুর ত রং ফেটি পড়চে। দেকে তো কেউ বুলবে না তুই বেদোবা।তুর ছ্যালেটাও ত গোরাংগো ঠাউর। অমন কেলে মিনসে,তোর সোয়ামী,তার এইরকম রাজপুত্তুর খোকা? কী খ্যে বিইয়েছিলে র্যা। পুকুরপাড়ের সব মেয়েরা কলির কথায় তাল মিলিয়ে কদর্যভাবে হেসে উঠেছিল। কী খেয়ে যে মাণকে কে বিয়েছিল আন্নার মনে নেই, মনে আছে একটা গোপনতম স্মৃতি আর দু'টো চোখ। যে আছে, তাকে আপনার বলে কোনদিন ডাকতে পারবে না। সেই ঝড়জলের রাত আর তাকগোল পাকানো সময় এ-ই তার নিজস্ব। মাঝেমধ্যে ভাবে এই তো মা ছেলেতে বেশ কাটছে। তবু যেদিন-যেদিন ছেলের পাতে ভাত ওঠে না মনটা হুহু করে, এই জন্ম, এই দারিদ্র কী ওর জন্য বরাদ্দ। এ জীবনে এত কষ্ট ওর বরাতে দিয়েছে। চোখে জল এলে মুছে ফেলে আঁচলে, পাছে কেউ দেখে ফেলে। পারাণের বৌয়ের খিলিখিল হাসিতে হুঁশ ফেরে আন্নার, কী লো কী ভাবতেছিলি? পারাণের বৌ মুখ টিপে হেসে ঢিল ছোঁড়ে আন্নার দিকে। আন্না দমে যাবে, তেমন মেয়ে ও নয়,পাল্টা বলে,'কিচু নাকো দিদি, ভাবতিছি রাত-বেরেতে তোমার সোয়ামী যেবাবে হামলে আসার আমার দুয়ারে, কোনদিন না সাপে কাটে। একটু খেয়াল রেকো। ভীমরুলের চাকে যেন ঢিল পড়লো, ফোঁস করে উঠলো কলি, সাবধানে কতা কবি মাগী, বেবুশ্যে, ভাবিস কিছুটি বুঝিনা, সব জানি, আন্না হেসে বলল, জানো যকন, তকন এত মুক কেন নাড়ান দাও, বলে কলসিটা কাঁখে নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল আন্না। কলি তখনও শাপ-শাপান্ত করেই চলেছে, আন্না না শোনার ভাণ করে চুপ করে এড়িয়ে চলে গেল।
ও গোপাল! খেয়ে নে বাছা, দুধ যে জুড়িয়ে গেল। খা বাবা। গোপাল গোঁ ধরে বসে রইল। তার মা মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে ক্লান্ত হয়ে শেষকালে রেগেমেগে এক কিল বসিয়ে দিল ছেলের পিঠে। গোপাল কাঁদলো না আর ছেলেবেলার মত বরং মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁচের গ্লাস্টা লাথি মেরে ফেলে দিল, তারপর মা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে গেল বাবার ঘরের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতা অবাক করলো ইন্দু কে, তারপর ভাঙা কাঁচ কুড়োতে-কুড়োতে আপনমনে বলল, রক্তের দোষ যাবে কোথায়। আমার কপালটাই খারাপ, নইলে যেমন স্বামী তেমন সন্তান জুটলো আমার। নিজেকে শাপ-শাপান্ত করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো, বার- ঘরের দুয়ারে বসে থাকা পাগল দেওরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠলো ইন্দুর, নিজেরমনে বলল, যে ভালো ছিল তাকে তো সবাই মিলে.. কথাটা শেষ না করে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। কমল, দত্তবাড়ীর ছোট ছেলে।এ গ্রামে ওদের বিত্তশালী বলেই সকলে জানে, অগাধ সম্পদ, একডাকে বড়বাড়ি বলে চিহ্নিত করে গ্রামের মানুষ।ছোট ছেলে কে নিয়ে ভারী গর্ব ছিল তার প্রয়াত বাবা অশ্বিনী দত্ত-এর। বিলেতের ডাক্তারী ডিগ্রী নিয়ে ফেরা সুপুরুষ, রূপবান কমল। যার জন্য কিনা মাটিতে পা পড়তো না তার বাবার। সেই কমল কিনা তার সব স্বপ্নে আগুন জ্বালিয়ে প্রেমে পড়ল হাঘরে ঘরের এক মেয়ের, কম যন্ত্রনা, কষ্ট পেতে হয়নি কমলের জমিদার বাবা কে এই সম্পর্কের ইতি টানাবার জন্য। শেষমেশ দ্বারস্থ হলেন বড় ছেলের, মেরে ছোট ছেলের পা দুটো ভেঙে দিয়ে হাভাতে মেয়েটিকে অন্য ঘরে পাত্রস্থ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে বড়-বড় চুলের, নোংরা চেহারার কমল কে দেখে বোধহয় শান্তি পেয়েছিলেন। হাজার হোক বংশমর্যাদা রক্ষা হয়েছিল, দুটো জীবনের বিনিময়ে। ইন্দুবালা স্বামীর পা'দুটো চেপে ধরেছিলেন, 'ঠাকুরপোর এই দুর্গতি করো না,ধম্মে সইবে না। বিষয়-বুদ্ধিসম্পন্ন অমল দত্ত সুযোগ পেয়ে গেল অনায়াসে, সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করার। বাবার সুপুত্তুর হয়ে কমলের প্রেমিকা-কে দীর্ঘদিন শারীরিক নির্যাতন করে তারপর অন্য পাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অমল দত্তের ছেলে গোপাল যোগ্য সন্তান হয়েছে তার বাবার। ইন্দুবালা আড়ালে শাপ-শাপান্ত করেন স্বামী-সন্তান কে, এ সংসারে তার দাম আর কমলীর মায়ের দাম একই। গয়না দিয়ে মুড়িয়ে রাখা ঝি।যাকে যখন ইচ্ছে লাথি-ঝাঁটা মারা যায়।
ও মা জানিস আজ ইস্কুলের মাস্টারদাদা বললে, সময় পাল্টেবে, ধনী- গরীব এক হবে রে মা। আমাদের ঘরেও ঘি, দুধ থাকবেরে গোপালদের বাড়ির মত। আমাদেরও সন্মান হবে মা। আমি বড় হয়ে চাকরী কল্লে, তোর জন্য অনেক শাড়ি আনবোখনে।দেখিস তুই। ছেলের কথা শুনে হেসে কুটোপাটি খেল আন্না বলল, ' বাপ, মা বিয়েছে গরীব, মরবো গরীবরে বাপ। বড়লোক আর গরীব কী এক নাকি? তুই পড়াশুনো কর বাপ, স্বপ্ন দেখিসনে। ওসব স্বপ্ন বড় খারাপ। কথাটা বলে ছেলের পাতে আরেকটু মুড়ি তুলে দিল নিজের পাত থেকে। মাণিক বলল, তুই যাই বল মা,মাস্টারদাদা কত গল্প বললে। তুই কিচ্ছু বুঝিসনে মা। আমরা কেন রোজ দুবলা ভাত পাবোনে? বড়বাড়িতে আজ মোচ্ছব, গোপালের জম্মদিন ভালো-মন্দ খাবার, আজ তো আমারও জম্মদিন, আমি কেন শুখা মুড়ি খাবো। আন্নার চোখ ভিজে গেল, সত্যিইতো আজ তো মাণকেরও জম্মদিন।
পনেরোয় পড়লো মাণকে। পনেরো বছর আগে এদিনের জমিদারবাড়িতে ইন্দুবালা ছেলে গোপাল কে বিয়োলো। আর তার মাণকে এই ভাঙা বাড়িতে জম্মালো। মাণকেরও তো কপালটা রাজার মত হতে পারতো। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, ছেলের দিকে তাকালো, তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল, বুজে আসা গলায় বলল, তোর খাওয়া হলে শুয়ে পড়িসখনে, আমার ঘুম লাগছে বলে চলে গেল। মাণকে অবাক হয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখলো,তারপর নিজের মনে বলল, তুই দেখিসরে মা, ধনী-গরীব এক হবেরে। হবেই। সময় আসবে।
এই মাণকে! শোন! এদিকে আয়। কী রে কানে যে কথাই যায় না তোর। খুব তড়পানি বেড়েছে। কী ভাবছিস? তোর মাস্টারদাদা তোকে একবারে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে। শালা তোরা আজীবনের পাতকুড়ানি, মরবি যখন তখনও তাই থাকবি বুঝলি। কথাগুলো বলার সময় গোপাল ওর জিভে নিম-বেগুন খাওয়া তিতকুটে স্বাদ পেল। গতরাতে কথাগুলো শোনা অব্দি,শান্তি পাচ্ছিল না গোপাল। কতক্ষণে স্কুলে এসে মাণিক কে ধরবে,ভেবে-ভেবে সারাটা রাত একরকম ঘুমহীন কাটিয়েছে। আজ স্কুলে এসে মাণিক কে সামনে পেয়ে যেন নিজেকে সামলাতে পারেনি গোপাল। এমনিই গোপালের নামে স্কুলে হাজার নালিশ, তবু ও জানে কারুর হিম্মত নেই ওকে কিছু বলে। জমিদারের সুপুত্তুর গোপাল কে স্বয়ং হেডমাস্টার চটায় না তো অন্য কেউ কী বলবে। এসব কিছুর সুযোগ নিলেও, গোপাল মাণিকের উপর তার চাপা ঈর্ষা কিছুতে কাটাতে পারে না। আজ মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে মাণিক কে একহাত নেওয়ার। চারটে স্কুল ঘুরে আসা গোপাল জানে ওর বিদ্যের মান, স্কুলে যে ছুটির ঘন্টা বাজায় তার থেকেও নীচে। শুধু বাপের টাকা আছে বলে পার পেয়ে যায়। অথচ বাগদীর ছেলে মাণিক রুপে, গুণে, লেখাপড়ায় ওকে ভেতর-ভেতর বিপর্যস্ত করে তুলছে। প্রতিদিন মাস্টারগুলো ওর প্রশংসা করে, ইতিহাসের নতুন মাস্টার বিমল রায় তো মাণিকের নামে ঘটি-ঘটি জল খায়। আজ এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়বে না গোপাল। মাণিক এক মনে কী লিখছিল, গোপালের ডাক শুনেও ঘাড় গুঁজে কী যেন লিখেই চলেছে। আবার ডাকলো গোপাল, কী বে শুনতে পাচ্ছিস না, নাকি পাত্তা দিচ্ছিস না কথায়। মাণিকের পাশে বসে থাকা ছেলেটি কনুই দিয়ে ঠেলল মাণিক কে, মাণিক মাথা তুলতে, চোখের ইশারায় গোপাল কে দেখালো ছেলেটি। মাণিক দেখলো, গোপালের চোখে-মুখে হিংস্রতা, নরমভাবে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে গোপাল? গোপাল ফিচেল হাসলো, ন্যাকা! কিছু বোঝে না। শালা হারামী। চোয়াল শক্ত হল মাণিকের, গোপালের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, 'ভদ্রভাবে কথা বল, আমি তোমার কেনা গোলাম নই।' আগুনে ঘি পড়ল যেন, গোপাল হাত মুঠো করে এগিয়ে গেল মাণিকের দিকে।
আন্না শুকনো কাঠ, লতা-পাতার বোঁচকাটা নামিয়ে রেখে,রান্নাঘরে ঢুকে জল খেল। বাইরে বেশ গরম, গা পুড়ে যাচ্ছে। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে মাটির ঠাণ্ডা মেঝেতে সবেমাত্র গড়িয়েছে, হঠাৎ বাইরে কাদের চেঁচামেচি শুনে বুকের কাপড়খানা ঠিক করে উঠে পড়ল। দরজা খুলে দেখে রমেশ, হারু মাঝির ছেলে। রমেশের সাথে আরও কয়েকজন আছে। সবার চেহারায় ভয়, উদ্বেগের ছাপ। আন্না কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রমেশ বলল, 'ও আন্না পিসী শিগ্গির চল, মাণকে ইস্কুল মাঠে পড়ে আছেনে।' ইস্কুলের মাঠ অব্দি আন্না যেন হাওয়ায় ভর করে ছুটে গেল। মাঠের সামনে গিয়ে আন্নার চোখের সামনে শুধুই নিকষ অন্ধকার। ওর তীব্র চিৎকারে চারদিক থমকে গেল। জ্ঞান হারালো আন্না।
আন্নার যখন জ্ঞান ফিরলো, চারদিকে পিঁপড়ের চাকের মত লোক গিজগিজ করছে। কারা যেন মাণিকের উলঙ্গ, নিষ্প্রাণ শরীরটা কে পুরোনো কাপড় দিয়ে ঢেকে শুইয়ে দিয়েছে স্কুলবাড়ির বারান্দায়।সে নিজেও এতক্ষণ ওখানেই শুয়েছিল। জ্ঞান আসা ইস্তক ছেলের সারা শরীর হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে যাচ্ছে আন্না। হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, মাণিক রে!বাপ আমার! তারপর সকলকে অবাক করে একটানে সরিয়ে দিল মাণিকের দেহ ঢাকা দেওয়া কাপড়টা। সতেরোর কিশোরের শরীরে বসন্তের ডাক। যৌবন উঁকি দিচ্ছে মাণিকের ফর্সা, সুন্দর শরীর জুড়ে। সারা শরীর কালশিটে, জমাট রক্ত,চাপ-চাপ রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। ঠৌঁট ফুলে উঠেছে। নির্দয়ভাবে কারা যেন কুপিয়েছে তার ছেলের সোনারঙ। আন্না ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, একসময়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওখানে জমে থাকা ভিড়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল, 'ওকে নে চল বড়বাড়ি, আজ সমুখে উত্তর দিতি হবে, এ সব্বোনাশ কেন অল আমার।'
ইন্দুবালা সবে গা- হাত ধুয়ে এসে বারান্দায় বসে এক খিলি পান মুখে পুড়েছে, সদর দরজায় চেঁচামেচি শুনে চমকে উঠে স্বামী কে ডাকতে গেল। অমল দত্ত একমনে হিসেবের খাতায় আয়-ব্যয় লিখতে ব্যস্ত, পাশে পড়ে থাকা অ্যাস্ট্রেতে আধখানা সিগারেট ধিকিধিকি করে জ্বলছে। ইন্দুবালার উপস্থিতি টের পেয়েছে বুঝতে পেরে বলল, দরজা খোলার দরকার নেই, বেকার ভিড়। ইন্দুবালা থতমত হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি শুনতে পেয়েছো। অমল দত্ত শুধু,'হুম' বলে আবার কাজে মন দিল। ইন্দুবালা জানে এই লোকটা কতখানি শয়তান, কোন অন্যায় এর পক্ষে অসম্ভব নয়, তাও কী হয়েছে জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, কীসের গন্ডগোল, কিছু জানো।' খাতার উপর থেকে মাথা না তুলে উত্তর দিল অমল, আজ দুপুরে আন্নার ছেলে মাণিক কে গোপাল আর তার দলবল পিটিয়ে ফেলে এসেছিল স্কুলের মাঠে। ওরাই হবে। তুমি তোমার কাজে যাও। আমাকে বিরক্ত করো না।' পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল ইন্দুবালার, 'ক্-ক্-কী বললে, আন্নার ছেলে? মাণিক। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মাণিকের মায়াভরা চোখ দূুটো। ইন্দুর পা দুখানা কে যেন মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে। নিজের ছেলেকেও ছাড়লে না? তুমি কী মানুষ? স্ত্রীর কথায় ঝেঁঝে উঠল অমল দত্ত, দাঁতে- দাঁত ঘষে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে লেকচার দিলে আমাকে, ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব তোমাকে। কথাটা বলে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বার করে দিয়ে দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দিল ইন্দুর। ইন্দুবালা উঠোনের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখল, কুড়ি-তিরিশ জনের একটি দল সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনে চলে এসেছে। এগিয়ে গেল ইন্দুবালা।
'এ আমনাদের কেমন বিচের মা, এ অভাগীর একমাত্ত সন্তান কেও কেড়ে নিলেন, আন্নার আলুথালু চুল, কালশিটে চোখ-মুখ দেখে ফু্ঁপিয়ে উঠল ইন্দু, কিছু বলার আগেই ইন্দু দেখল তার ছোট দেওর এক-পা দু'পা করে উঠোনে শোয়ানো মাণিকের মৃতদেহর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, এরপর সবাইকে অবাক করে নিজের ঊর্ধ্বাঙ্গের জামাটা খুলে গায়ে দিয়ে দিল মাণিকের। আন্না হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ইন্দুবালা পায়ে-!পায়ে এগিয়ে গেল আন্নার দিকে, ওকে জড়িয়ে ধরল, কেঁপে-কেঁপে উঠল আন্নার দেহ। এত চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এসেছে অমল দত্ত, নিজের স্ত্রীকে চিৎকার করে ডাকলো,' নিজের ভালো চাও তো এখনি এদিকে এসো নইলে..
ইন্দুবালা আন্না কে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো, স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির উদ্দ্যেশ্যে বলল, আন্না! তোর ছেলে এভাবে চলে যাবে না, একটু দাঁড়া ওর জন্য নতুন কাপড় আনি। এ বাড়ির ছেলে মাণিক,এ বাড়ির ছেলে। সকলে চমকে উঠলো, বারান্দা থেকে ইন্দু হুংকার দিল অমল দত্ত। আন্নার কানে এসব কিছুই যাচ্ছেনা আর, ও শুধু শুনতে পাচ্ছে, ধনী-গরীব কিছু থাকবেনেরে মা, সবাই বাঁচবে মানুষের মত। দেখিস মা। এতকিছুর মধ্যে এতক্ষণে সবাই দেখতে পেলো ইন্দুর পাগল দেওর মাণিকের কপালে হাত বুলিয়ে হুহু করে কেঁদে চলেছে।
