Rinku Chowdhury

Classics Crime Thriller

4  

Rinku Chowdhury

Classics Crime Thriller

সুরক্ষিত

সুরক্ষিত

5 mins
429



পারমিতার বড় মেয়ে যখন বাড়ি ছাড়লো,কতই বা বয়স তখন তার। আঠেরো হবে। আমার মেয়ে নিনি আর ওর বড় মেয়ে নয়না একই বয়সী।একদিন অফিস ফেরতা নয়না কে আমি দাশু মাস্তানের সাথে সিনেমা হল থেকে বেরোতে দেখি।আমি অবাকের চেয়ে একটু বেশী হয়েছিলাম।এটাকেই বোধহয় রেগে যাওয়া বলে।যদিও আমি খুব ঠান্ডা মাথার এবং গন্ডগোল এড়িয়ে চলি,তবু সেদিন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। নিজের একটি কন্যাসন্তান আছে বলেই বুঝি ভয়ও পেয়েছিলাম।যদি নিনিও এরকম কিছু করে।আমি বাড়ি ফিরে হন্তদন্ত হয়ে পারমিতার বাড়ি যাই, নয়নাকে যে দেখেছি সেটা জানানোর থেকেও বেশী আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে বাঁচানো।নয়নার বাবা বিরাট চাকরী করে আর তার মেয়ে ইশ ভাবতেই পারছিলাম না।


ওর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পাই, ভেতরে তুমুল গন্ডগোল হচ্ছে।বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি যে কিসের জন্য এত অশান্তি চলছে।ফিরে আসি।এর ঠিক দশদিনের মাথায় নয়না পালিয়ে বিয়ে করে দাশুকে।


নয়নার এই পালিয়ে যাওয়াটা আর সবাই ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারিনি। কি একটা যেন বদলে যাচ্ছিলো আমার ভেতরে।সারাদিন মেয়ের দিকে নজর রাখতে শুরু করি। ওর গতিবিধি জানার চেষ্টায়,চাকরী ছেডে দিই। পাছে আমার অফিসে থাকার সময় সে কিছু করে বসে।না থাকলে ওর বই খাতা হাতড়াই। মোবাইল রেখে স্নানে গেলে টেক্সট পড়ি। এবং এগুলো তে অদ্ভূতভাবে আমার কোন অপরাধবোধ হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো আমি আমার মেয়েকে বাঁচাতেই এসব করছি।


একদিন আমার স্বামী সমর ধরে ফেলল আমাকে।তখন আমার হাতে মেয়ের মোবাইল ধরা, আর আমি ওর বন্ধুর পার্থর

 মেসেজ খুলে বসেছি।


"তুমি কি করছো এসব? 

মনে হোলো সমর স্বাভাবিকের থেকে একটু জোরেই কথাটা বলল।

নিজের থতমত ভাবটা কাটিয়ে উঠে বললাম। "কোই কিছু নাতো"।

মিথ্যে বোলো না।আমি দেখেছি তোমাকে কি করছিলে।

আমি হিস হিস করে বললাম, চুপ করে থাকো,যা করেছি বেশ করেছি। নিনির দিকে তো তোমার কোন নজর নেই। তোমার মেয়েও যেদিন নয়নার মতো- 

কথাটা শেষ করতে পারলাম না গলার ভেতর কি একটা গুলিয়ে উঠলো।মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলাম।

সমর ঘরে যেতে যেতে বলল।'তুমি অসুস্থ'।

ছিঃ।আমি ভাবতেই পারিনি এসব করবে।



এর কয়েক দিন পর মেয়ে স্নানে গেলে ওর মোবাইল নিয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম পাসওয়ার্ড চাইছে।বুঝতে বাকী থাকেনি,কার কারসাজি।সারাদিন একরকম গোঁজ হয়ে থাকি।রাতে সমর কে শোয়ার সময় সোজাসুজি জিজ্ঞেস করি,

'তুমি নিনি কে বলে দিয়েছো সেদিনের ব্যপারে,তাইনা?

সমর সারাদিন পর এই সময় পেপার পড়ে। আমি বিয়ের পর থেকে দেখছি ওকে। পেপারের উপর থেকে চোখ না তুলে ও উত্তর দিল 

না। আমি কিছুই বলিনি।

মিথ্যে কথা।তুমি বলেছো।আমি জানি তুমিই বলেছো।গলায় জোর দিয়ে বললাম।

আমি তোমার মত অসুস্থ নই। তাই এই বিষয়ে মেয়ের সাথে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না।নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিল ও।

হাতের কাছে থাকা পাউডার কেসটা ছুঁড়ে মারলাম সমরের দিকে। ওর গায়ে আর একটু হলেই লেগে যেতো। 

ও চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিলো আমার।

একদলা চিৎকার সারা বাড়িতে ছড়িয়ে গেলো।

শয়তান শয়তান সব শয়তান।


এতটা বলার পর একটু দম নিলেন মানসী সেন।

টেবিলের অপর দিকে বসে থাকা সাইকোলোজিস্ট অমিতাভ রায় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞ্রস করলেন। কেন মারলেন নিনি আর সমর কে??


ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে খেঁকিয়ে উঠে মানসী বললেন বেশ করেছি, আমার বিরুদ্ধে মেয়ে আর বাবা প্ল্যান করছিলো। আমি ওই মেয়ে ওই সংসারের জন্য কি করিনি?? 


তাই বলে খুন?? আপনি শুনেছিলেন ওরা কি কি ভেবেছিলো আপনার জন্য?ডাঃ অমিতাভ রায় খুব নরম করে প্রশ্নগুলো করলেন মানসী কে।


আবার বলতে শুরু করলেন মানসী। হ্যাঁ। সেদিন সকালে আমি মেয়েকে টিউশন থেকে আনতে গেছিলাম। মেয়ে আর সমর ততদিনে আমাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে।একা লাগতো আমার। ওদের সমস্ত জিনিষ ওরা গুছোতে শুরু করেছিলো। আমাকে কিছুতে হাত দিতে দিতো না। বাড়িতে থাকলে নিজেদের হেফাজতে রাখতো।আর না থাকলে মেয়ের ঘর তালাবন্ধ থাকতো। সমর নিজের ল্যাপটপ মেয়ের ঘরে রেখে যেতো। রাতে খাবার টেবিলেও চুপচাপ। একা লাগতো আমার ভীষন একা হয়ে গেছিলাম।এত নৈশব্দ আমাকে যন্ত্রনা দিতো।রাতে সমর গেস্ট রুমে শুতো আর আমি আমাদের বেডরুমে। এটা জীবন? আমি আর পারছিলাম না।


তারপর কি হোলো ম্যাডাম? কি এমন হোলো যে আপনি এই কাজ করলেন? ডাঃ রায় ধীর গলায় প্রশ্ন করলেন।


একটু জল দেবেন? গলাটা শুকিয়ে গেছে।বলে মানসী টেবিলে আঙুল দিয়ে হিজিবিজি কাটতে লাগলেন।


সরু পাড়ের সাদা শাড়ি পড়া, হাতখোপা করা চুল, চোখে রিমলেস ফ্রেমের চশমা , মধ্যবয়সী এই মহিলা কে দেখলে কেউ অপরাধী বলবে না,ভাবতেই পারবে না,ঠান্ডা মাথায় নিজের একমাত্র মেয়ে ও স্বামী কে হত্যা করেছেন। সমস্ত শরীরে আভিজাত্য ছড়িয়ে। নিজের ঝানু চোখে একঝলক মেপে নিলেন ডাঃ রায়।তারপর এক গ্লাস জল দিতে বললেন ওনাকে।


জল খেয়ে কাপড়ে মুখ মুছলেন মানসী।জানেন গত দু মাস আগে বাজার করতে গিয়ে শুনি, পারোমিতার মেয়ে নয়না আত্মহত্যা করেছে। রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। চেনা পরিচিত কিছু মানুষ আমাকে পৌঁছে দেন বাড়িতে। সমর ও মেয়ে দুজনেই আমার খবর শুনে বাড়ি চলে এসেছিল। ডাঃ আমাকে ঘুমের ওষুধ দেন। তখন বেশ তন্দ্রাছন্ন শুনতে পাই বাপ মেয়ে বলাবলি করছে,

"তোর মাকে নিয়ে আমাকে এবার কিছু একটা ভাবতে হবে"।সমরের গলা পেলাম।

"বাবা আমিও আর পারছিনা।ডু সামথিং"।মেয়ে ফিসফিস করে বলল।

"কাল বাইরে মিট করে কথা বলছি আমরা,বুঝলি নিনি"।

"ওকে বাবা"।

আমি তার ঠিক দুদিন পর মেয়েকে কার সাথে খুব আস্তে কথা বলতে শুনেছিলাম।

আমি বুঝেছিলাম,আমি ওদের না মারলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।


আপনি ভুল বুঝেছিলেন মানসী। ওরা আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।ডাঃ রায় বললেন।


না।মিথ্যে কথা। সব! সব! সব! মিথ্যে।আপনারা মিথ্যেবাদী। উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মানসী।


শুনুন আমার কথা।একটু শান্ত হোন

আপনার মেয়ে ও স্বামী আপনার চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। আপনি যাতে সুস্থ হয়ে ওঠেন। আপনার এই মানসিক অস্থিরতার উপযুক্ত চিকিৎসার দরকার।বাচ্চা মেয়েকে সামলানোর মত করে বললেন ডাঃ রায়।


আমি পাগল নই। আমি আমার মেয়েকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলাম।আমার সংসার সাজিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।

এখন ওরা সুরক্ষিত।আমার ছোট্ট মেয়ে,আমার সমর এখন সবসময় ভালো থাকে।আমাকে বলেছে।এই তো আমার কোলেই বসে নিনি ,আর সমর আমার পাশের চেয়ারে। ফাঁকা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে মহিলা বিড়বিড় করে বললেন,এই সমর বলো না তোমরা ভালো আছো।


ওকে নিয়ে যান নার্স। ডাঃ রায় তার সহযোগী কে বললেন।


রাতে খাওয়ার টেবিলে স্ত্রী মনামী কে অস্থির দেখে অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে?

জানো আমি মিমো কে থাপ্পড় মেরেছি।

মিমো ওদের একমাত্র ছেলে। কোনদিন ওর গায়ে হাত তোলেনি ওরা। আজ এমন কি হোলো। কি করেছে মিমো।

মিমো প্রেম করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মনামী।

তুমি কি করে জানলে? খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো অমিতাভ।

ওর মোবাইলে হাতড়ে। মনামী বলল।

কি? চমকে উঠলেন অমিতাভ।ওর সামনের চেয়ারে যেন মনামী না মনীষা বসে। 

'আমি মা আমি ওকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলাম।' কথাটা মনে পড়ে গেল ওর।

একছুটে বেসিনে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেললেন,শহরের বিখ্যাত ক্রিমিনাল সাইকোলোজিস্ট।

পিছনে দাঁড়িয়ে মনামী চেচাচ্ছেন, কি হল, ছেলের রাগ আমাকে দেখাচ্ছো? বল কি হোলো।


বুকের নীচ থেকে ব্যথাটা তখন ক্রমশ অসাড় করে দিচ্ছিল অমিতাভকে।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics