Rinku Chowdhury

Abstract Tragedy

3  

Rinku Chowdhury

Abstract Tragedy

অচেনা তুমিও, আমিও

অচেনা তুমিও, আমিও

9 mins
392



সোনাঝুরি,


এই চিঠি যখন তুমি পাবে,তখন তোমার মা তোমার পাশে থাকবে না,জানি তোমার খুব অভিমান হবে, ভাববে কি স্বার্থপর তোমার মা , তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবু এটা ভেবো তোমার মাও মেয়ে ছিল। তোমার মায়ের নারীত্ব উচ্চাভিলাষী নয়, তোমার মা শুধুই অভিমানী। তাই বোধহয় এ চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়েছিল। তোমার ছেলেবেলায় হয়তো অনেকেই বলেছে তোমার মন্দ মায়ের গল্প। হ্যাঁ!আমি ভালোবেসেছিলাম একজনকে,এটা সত্যি। আজ তুমি বড় হয়েছো,হয়তো আজ বুঝতে পারবে,ভালোবাসা অপরাধ নয়।আমি তোমার দিদুনকে এই চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, যেদিন তুমি অনেকটা বড় হবে সেদিন যেন এ চিঠি তোমাকে দেওয়া হয়। না আমি কোন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এ চিঠি লিখছিনা, এ চিঠি এক নারী অপর এক নারী কে লিখছে যার সাথে তার রক্তের বোঝাপড়া।


তোমার একটি ছোট বোন আছে।

তোমরা দুই বোন। জানি শুনে অবাক হবে। কেউই হয়তো বলেনি তোমাকে তার ব্যাপারে।তুমি

কোপাই আর সে খোয়াই।আমার দুই মেয়ে।এই ডাকনাম শান্তিনিকেতন কে ভালোবেসে রেখেছিলাম। তুমি সোনাঝুরি আর ও অমলতাস, আমার দুই সন্তান, আমার আত্মজা,আমার দীর্ঘ আকাঙ্খিত দুই ফুল,যাদের পেয়ে আমি মাতৃত্ব আস্বাদন করেছিলাম। জানো তোমার জন্মের অনেক আগেই তোমার বাবা কে বলেছিলাম,আমার মেয়ে হলে,এ নাম রাখবো। তারপর তুমি এলে, রাঙামাটির দেশ থেকে রাঙা ফুল এল আমাদের জীবনে। আমি তৃপ্ত হলাম। কিন্তু তোমার মা যে উদাসীন, ভবঘুরে মত মন তার। ভালোবেসে ফেললাম যে সে মানুষটাকে। সে যে আমার জীবনের হারিয়ে যাওয়ার পথ, একটা অন্য ভালোথাকা। আমি যে পথ খুঁজতাম, বন্য জীবনের শ্যাওলা গন্ধ প্রাণভরে পান করতে চাইতাম,সে আমাকে তাই দিল।খোয়াই তার সন্তান। একদুপুরে তার বাড়িতে নানাবাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। ঝংকার তুলল দুই রাগ, মিলেমিশে তৈরী হল অবাক করা মোহময় সুর।সেই সুর নিয়ে ফিরে এলাম আমি, খোয়াই এল। 


আমি তোমার বাবাকে ঠকাইনি। তাকে বলেছিলাম সত্যিটা।আশা করেছিলাম যা তাই হল।আমি বাড়ি ছাড়লাম খোয়াই কে নিয়ে।আমি আমার ভালোবাসার মানুষের কাছেও যাইনি। পাছে সেও আমাদের বোঝা ভাবে।আমার কোপাই নদী! এর বেশী তোমাকে কিছুই বলব না।ক্ষমা চাইব না, কারন সেও আমার সন্তান।তোমার জীবন হয়তো দারুন ভাবে চলবে না,তবু তোমার দাদুন আর দিদুন রইল পাশে, কিন্তু খোয়াইয়ের শুধুই আমি রইলাম।কোনদিন কোন এক ভোরে হয়তো দেখা হবে তোমাদের। খুব ভালো থেকো,সুখে থেকো মা আমার। জানি এ জীবনে তোমার,আমার,আমাদের ভালো থাকা সম্ভব নয়, তবুও চেষ্টা করো। 


ইতি

মা।


সোনাঝুরি দত্ত, বিদেশে কর্মরতা, বয়স ত্রিশ। দিদার অসুস্থতার খবর পেয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে এসে,এত বছর পর জানতে পারে,তার মায়ের লেখা এই চিঠির কথা, , দিদার মৃত্যুশয্যায় এ চিঠি সোনাঝুরির হাতে তুলে দেয় ওর মামা। মায়ের চলে যাওয়ার পর থেকে মামার বাড়ির সাথে সম্পর্কটা তেমন ছিল না আর। বাবা সারাদিন নিজের কাজ, পার্টি আর মেয়েমানুষে ব্যস্ত, ছোট মা যাকে বলতো সেই কোপাইয়ের সব ছিল। বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কবে যেন কোপাইকে নিজের মত করে বুকে ধরে রেখেছিল।তবে সেই সুখও সইল না কোপাইয়ের, মারা গেলেন ওর ছোট মা। একেবারে একা অন্ধকারে ডুবে গেল কোপাই। বড় অভিমান ছিল মায়ের উপর, ভাবতো কেন কোপাইকেও সাথে নিল না। আজ যখন খোয়াইয়ের কথা জানল,বুকের ভেতরটা জ্বালা করে উঠল। সারাটাজীবন স্নেহ,মায়া,মমতা থেকে বঞ্চিত।কি দোষ ছিল যে এত অবহেলায় বড় হতে হল ওকে। প্রতিহিংসা মানুষ কে অন্ধ করে দেয়। সোনাঝুরি ও বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছিল।


সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ভীষন কাজের।যখন যাকে খুঁজবে ঠিক নাগালে পাওয়া যায়।সে যে যেখানে থাকুক।সোনাঝুরিও খুঁজে পেল বৈকি। ল্যাপটপের খুলে রাখা স্ক্রীনে যখন তাদের ছবি ভেসে উঠল,অনেক স্মৃতি ঘুম ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো যেন।

 সোনাঝুরির মা অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন, তাই দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেও সোনাঝুরির বাবা উদিত, ওর মাকে ভুলতে পারেননি। মাঝরাতে যখন আকন্ঠ পান করে ফিরতেন, নিজের প্রথম স্ত্রী কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। সেদিনের কথা মনে পড়ল, ক্লাস টেনের প্রি-টেস্ট চলছে, প্রায় মাঝরাত অব্দি পড়াশুনা করে শুয়েছে সবে, বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেল, ওর ছোট মা ওর পাশ থেকে উঠে দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে গেল। তারপর বাইরে ফিসফিস শব্দটা কেমন যেন জোরে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ও ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে চুপিসাড়ে, দেখে উদিত চিৎকার করছেন, 

'ছিনাল, শরীর সর্বস্ব মেয়েছেলে, আমাকে এই আমাকে এই উদিত দত্ত কে নাচিয়ে ছেড়ে দিলি।'

ওর ছোট মা সমানে চুপ করাতে চেষ্টা করছে। 'চুপ কর উদিত প্লিজ,চুপ কর।'

'তুই কে চুপ করাবার বলে এক ধাক্কায় ড্রয়িং রুমের সোফায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ওর ছোট মাকে, 

তারপরের দৃশ্য দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সোনাঝুরি।

সোফার উপরে পড়ে থাকা ছোট মায়ের নাইটি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন উদিত, তারপর চেপে বসেছিলেন ওর ছোট মায়ের উপর।

দু হাতে চোখ ঢেকে নিয়েছিল ও। শুধু গোঙানির আওয়াজ পাচ্ছিল, 

'প্লিজ উদিত ছেড়ে দাও, কোপাই জেগে, প্লিজ, আমার লাগছে,লিভ মি,আমি আর পারছিনা।' 

ছুটে চলে এসেছিল সোনাঝুরি নিজের ঘরে, চোখ টিপে অন্ধকার ঘরে শুয়েছিল চুপ করে। ভোর রাতে ওর ছোট মা ঘরে এসে,শুয়ে পড়েছিল ওর পাশে।

সকাল হতে দেখেছিল, সারা গায়ে লাল লাল দাগ। এর আগেও বহুবার দেখেছে অমন দাগ, কারনটা সেদিন বুঝেছিল।

এর কিছুদিনের মধ্যে ওর ছোট মা আত্মহত্যা করে নেয়।

ঝুলন্ত শরীরটা কে নামানো হচ্ছিল যখন,সোনাঝুরির মনে হল, এ পৃথিবীতে ওর নিজের বলতে আর কেউ রইল না।


সোনাঝুরি নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে দেখল,না সে কোনভাবেই মায়ের মত সুন্দরী নয়। সাদামাটা চেহারা, পুরোটাই যেন উদিতের মুখ। কিন্তু অমলতাস সে তো মায়ের মত হয়েছে, অমন নাক চোখ মুখ। কোঁকড়ানো চুল। অমন শরীর। শরীর বলতে মনে পড়ল, প্লাবন কে। প্লাবন ওর প্রথম প্রেম। প্লাবন, যে দুপুরবেলায় বন্ধ দরজার পিছনে ওকে নারী করে তুলেছিল। প্লাবন, যে ওকে মুখের উপর বলেছিল, কোপাই তোর শরীর আমায় টানে না। 

সেদিন ইচ্ছে করেছিল সবকিছু জ্বালিয়ে দিতে নিজের সারা শরীর কে ক্ষত-বিক্ষত করতে। 


এজীবনে কোপাই শুধু হেরোদের দলে! একটা অসুস্থ পরিবেশে ধুঁকে ধুঁকে দিনযাপন করে ক্লান্ত।আর একটা অপরিচিত মেয়ে কিনা ওর মাকে মা ডাকে, হেসে খেলে জীবন কাটায়। 

সোনাঝুরির মনে পড়ল, দাদু দিদুনের কথা, ওরা তো চেয়েছিলেন,ওদের কোপাই যেন ওদের সাথে থাকে।বাবা চাননি, একরকম তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওদের। ওদের ফোন আসলে, শত মিনতিতেও ডাকা হত না কোপাইকে। একদিন স্কুল থেকে ফিরলে,ছোটমা বলল, দাদু আর নেই। প্রচন্ড কেঁদেছিল সেদিন ও। দুচোখ ফুলে গেছিল।

'আই হেট ইউ মা।' ল্যাপটপের উপর দু ফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল।সোনাঝুরি দুচোখ কচলাতে কচলাতে বাথরুমে চলে গেল। 


বোলপুরের প্রান্তিক স্টেশনে ও যখন নামলো তখন প্রায় দুপুর দেড়টা। নেমেই মিশির কে ফোন করলো,মিশির ওর স্বামী। বিবাহিত জীবনের তিন বছর পার হয়ে গেছে ওদের।গত দুদিন মিশিরের সাথে তেমন কথা হয়নি। মিশির গুজরাতি ছেলে, ও ভারতে আছে এই মুহূর্তে।ও ওর মুম্বই অফিসে একটা ট্রেনিং কন্ডাক্ট করতে এসেছে। মিশির সবটাই জানে,সোনাঝুরি জানিয়েছে। আজ জানিয়ে দিল ও বোলপুরে এসেছে। 


অমলতাস নামটা রবি ঠাকুর রেখেছিলেন, লম্বা- লম্বা ডাঁটিতে হলুদ গুটি গুটি ফুল। থোক হয়ে ফুটে থাকে বুনো ঝোপঝাড়ে। গন্ধ নেই, রুপসী ফুল, নরম পাপড়ি। রুপ,সৌন্দর্য্য, আবেশ, আকর্ষণ, ওই মেয়েটার সাথে সব যায়।হোটেলের আয়নায় নিজেকে আর মোবাইলের স্ক্রীনশটে খোয়াইয়ের ছবি মেলায় ও।সোনাঝুরির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

মানুষের আদিম রিপু হিংসা, ঘৃনা, লোভ এগুলো থেকেও তো মুক্তি নেই।মুক্তি নেই ভেতরের মানুষটা হাত থেকে।ছুঁড়ে ফেলে দেয় মোবাইলটা বিছানার উপর।

দু হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ওর।


আরে দশদিনের মধ্যে সোনাঝুরি কে ফিরতে হবে কাজে। উপর মহল থেকে মেইল আসছে ফিরে আসার কথা জানিয়ে। ও কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে দশটাদিন ওকে সময় দিতে হবে, নিজের কিছু কাজ আছে। ওর ভেতরঘরের যন্ত্রনা ওকে শেষ করে দিচ্ছে। এত বছর পর,নেটওয়ার্কিং সাইটে খুঁজে পাওয়া মায়ের সাথে দেশ ছাড়ার আগে ও একবার দেখা করতে চায়। অনেক প্রশ্ন আছে জমা। সামনা সামনি দেখতে চায় খোয়াই বলে মেয়েটাকেও।


দুপুরের খাওয়া -দাওয়া সেরে বিকেলের দিকে ত্রিশূলাপট্টি যাবে বলে গাড়ি বুক করলো। দিদার মৃত্যু পর ও টানা কুড়ি দিন এখানে আছে। এর মধ্যে খোয়াই আর মাকে ছাড়াও ও খোয়াইয়ের বন্ধুর সূত্র ধরে ওদের বাড়ির ঠিকানা অব্দি জোগাড় করে ফেলেছে। বোলপুরের ত্রিশূলাপট্টি দীর্ঘদিনের বাস ওদের।খোয়াইয়ের বন্ধু নানা প্রশ্ন করেছিল, ও শুধু বলেছিল, আমার মাসী হন,অনেকদিন দেখা নেই, শেষ যখন দেখেছিল তখন খোয়াই জন্মায়নি। ছেলেটি সন্দেহ করলেও কিছু বলেনি,কারন সোনাঝুরির প্রোফাইলের বায়োডাটা। যেখানে সুচারুভাবে ঘোষিত যে ও বিদেশে ব্যাংকে কর্মরতা, এবং পোস্টটিও বেশ ঝকমকে। এইসব রংচং ব্যাপারগুলো বেশ কাজ দেয় অনেক সময়। লোকে মানুষের থেকে পয়সা কে, স্টেটাস কে অনেকটা প্রাধান্য দেয়। এক্ষেত্রে ও তাই। ছেলেটি বেশী বাচালপনা করেনি।


ত্রিশূলাপট্টি নেমে দুটো গলির পর তাদের বাড়ি। বুকের ভেতর কাঁপন।এতবছর পর মাকে দেখবে। বাবাকে ও বহুদিন দেখেনি, আসলে বহুবছর। মাস্টারডিগ্রীর এক ব্যাগ নাম্বার ওকে এগিয়ে দিয়েছিল উন্নতির দিকে। ছোট মা মারা যাবার পর থেকে ওর ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠেছিল বই। ধাপেধাপে অনেক উপরে উঠেছে। গ্র‍্যাজুয়েশনের পর পাকাপাকিভাবে বাড়ি ছেড়ে মেয়েদের হস্টেলে উঠে এসেছে। নিজের খরচা নিজেই চালিয়ে নিয়েছে।প্রচুর প্রাইভেট টিউশন করে, অমানুষিক খেটে, রাতে ফিরে পড়াশুনা করতো। ততদিনে উদিত আবার বিয়ে করেছে।  


'সোনাঝুরি' নামের নেম্পলেটটা দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত দুলুনি,যেন ভূমিকম্প।সোনাঝুরির পা যেন আটকে গেছে মাটির সাথে। সারাজীবন খালি ভেবেছে ভুলে যাওয়া খাতায় ওর নাম।বাবা ভুলে গেছে, প্লাবনও একদিন ওকে ছেড়ে দিল, ছোট মা চলে গেল।এরপর ছেড়ে যাচ্ছে মিশির। সোনাঝুরি জানে মিশির ওর সহকর্মী মালিসা কে ভালোবাসে। এখনো বলেনি বাট হি ওয়ান্টস সেপারেশন। মামুই যখন চ্যাটবক্সে জানালো দিদুন খুব অসুস্থ একবার আয়। ও যেন প্রান পেল।ওই বাড়িটা,ওই সাজানো গোছানো অট্টালিকা ওকে গ্রাস করে ফেলেছিল।দিদুনের অসুস্থতার চেয়ে নিজের জীবনটা বড় হয়ে উঠল সোনাঝুরির কাছে।মনে মনে নিজেকে স্বার্থপর ভাবলেও,ছুটি নিয়ে সোজা কলকাতা চলে এল! ভালো থাকার লোভে।


কলিং বেল টা বাজাবে কি বাজাবে না ভেবে বাজিয়েই দিল। দুবার বাজানোর পর বেড়িয়ে এলেন লাবণ্যময়ী এক প্রৌড়া। সোনাঝুরি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, মনে মনে বলছে 'মা' এতবছর পর তোমাকে দেখছি। মাগো আমাকে কেন ছেড়ে গেলে। তারপর চোখ চোয়ানো জল সামলে নিয়ে বলল, নমস্কার আমি কলকাতা থেকে আসছি।

ভদ্রমহিলা নরম হাসি হেসে বললেন, এসো মা,ভেতরে এস।

সোনাঝুরি বুঝতে পারছে না কি বলবে, কোথায় সে রাগ, ঘৃনা,মা কে দেখা ইস্তক শুধু জড়িয়ে ধরতে চায় । 

মায়ের পিছন পিছন ভেতরে এল, নিপাট সুন্দরভাবে সাজানো প্রত্যেকটা জিনিষ। যেন শিল্পীর আঁকা নিপুণ ঘর। মুগ্ধ হয়ে গেল।

'আমার মেয়ের সাজানো সবটাই।'আমরা দুজনে মিলে করি।সোনাঝুড়ির অবাক হয়ে চেয়ে থাকা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে প্রৌড়া বললেন।

'মেয়ে, আপনার মেয়ে?' কথাটা শুনে ভ্রুকুঁচকে গেল ওর।

'কোথায় আপনার মেয়ে? 'সোনাঝুরি তীব্রভাবে জিজ্ঞেস করল।

'ভেতরে আছে' বলে মুচকি হাসলেন উনি।

'ও'।

'তুমি বসো মা'!

হ্যা বসছি। সোনাঝুরি সোফায় বসল।

ভদ্রমহিলা বললেন, 'এবার বলতো মা কেন এসেছো আমার কাছে?'আসলে আমার একটু তাড়া আছে,বাচ্চাগুলো গান শিখতে আসবে।

'আপনি গান শেখান'? সোনাঝুরির মনে পড়ল মা অসাধারণ গান গাইত, বাবা পছন্দ করতেন না। মা গান গাইলে অশান্তি করতো খুব।তখন সোনাঝুরিরও মনে হত, মা যেন গান না গায়।আজ এত বছর পর ওর মনে হচ্ছে,মা কিছু ভুল করেনি।ভুল ওর,ভুল ওর বাবার মানসিকতার। মা বলে সে ফুরিয়ে যাবেই এমন মাথার দিব্যি নেই তো। এতবড় চাকরী,এত পড়াশুনো করে নিজের এই হীন মনোভাব ওকে আঘাত করল। বিবেকের হুল ওকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ওর নারীসত্তা প্রবলভাবে জেগে উঠছে এই মহিলা আর তার চারপাশ দেখে।

'মা বললে না কেন এসেছ? ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোনে সোনাঝুরি গোধূলি রং দেখতে পাচ্ছে।

আমি ওই গানের ব্যাপারেই এসেছি। সোনাঝুরি উত্তর দিল।

আচ্ছা, দাঁড়াও আমার মেয়েকে ডাকি বলে ভেতর ঘরে চলে গেলেন।

সোনাঝুরির বুকে যেন কেউ লক্ষ মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। আসছে সে।

খোয়াই। খোয়াই আসছে।

ভদ্রমহিলা বাইরে এসে বললেন,আমার মেয়ে আসছে।

আপনার বাড়ির নামটা খুব সুন্দর,'সোনাঝুরি বলল।'

আমার বড় মেয়ের নামে এই বাড়ি।

ঢেউ আছড়ে পড়ল সোনাঝুরির বুকে। 

ও আচ্ছা বলে চুপ করে গেল সোনাঝুরি। চুপ থেকে নিজের বুকের ধুকপুকানি গুলো কে সাজিয়ে রাখছিল সোনাঝুরি।

'মা' মিষ্টি রিনরিনে গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরল সোনাঝুরির। বছর কুড়ির একটি অপরুপা মেয়ে হুইল চেয়ারে বসে, ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।

বুক কেঁপে উঠল সোনাঝুরির। এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে আমি ঘেন্না করতাম। নিজের মন কে বারম্বার প্রশ্ন করল, মন খোয়াই কে এভাবে দেখে তুমি খুশি তো?বল মন বল। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো সোনাঝুরি তারপর বলল,ওর পায়ে কি হয়েছিল মাসীমা? ছোট থেকেই ও এমন মা,কথাটা বলে মেয়ের দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা। কথাটা শুনে কোথায় একটা যন্ত্রনা বেজে উঠল সোনাঝুরির মনে,নিজেকে সামলে নিয়ে বলল আজ আসি মাসীমা, বোন আসি গো।

আচ্ছা মা, বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রৌড়া, তারপর বলল,তুমি বললে নাতো মা কেন এসেছিলে? 

আ..আ..আমি আসলে একটা ঠিকানা খুঁজছিলাম। এখানেই তাদের বাড়ি ছিল। তিনিও গান শেখাতেন।

তাই?? কি নাম বলতো দিদিভাই? খোয়াই জিজ্ঞেস করল।

নাম? নামটাই মনে পড়ছে নাগো।আসি হ্যাঁ।

আচ্ছা। সাবধানে যেও দিদিভাই। খোয়াই বলল।

প্রৌড়া ততক্ষণে ওকে গেট অব্দি এগিয়ে দিতে এসেছেন


সোনাঝুড়ি গাড়িতে উঠে বলল, বোলপুর চল।

পিছন থেকে প্রৌড়া চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মা তোমার নামটা বললে না।

গাড়ির জানলা দিয়ে মুখটা বের করে সোনাঝুরি হেসে বলল, সোনাঝুরি দত্ত, ডাকনাম কোপাই বলেই আর কিছু শুনতে পাওয়ার আগেই দুকানে গুঁজে নিল ইয়ারফোন। মনে মনে বলল,ভালো থেকো মা। ভালো থাকিস খোয়াই, এই দশ মিনিট জীবন থেকে আলাদা করে সরিয়ে রাখবো।


 ছাতিমগন্ধী বাতাসেরা পাক খেয়ে, ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। শান্তিনিকেতনের বকুলবীথি তে রাত নেমেছে। নরম ফুলঝুরি রাত। ফুলেদের নিবিড় আলাপন। শুধু একা এক মেয়ে সমস্ত যন্ত্রনা ভুলে জীবন সমুদ্রে একাই সাঁতরাবে বলে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। কাল সকালে পাড়ি দেবে কলকাতা আর তারপর সাত সুমুদ্দুর তেরো নদীর দেশে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract