Rinku Chowdhury

Abstract

4  

Rinku Chowdhury

Abstract

খোঁজ

খোঁজ

12 mins
270


''হুর-পরী দেখার নসীব হকলের হয় না বুঝলা নসীম। হেসব অইন্য কায়দা। তাগো তৌর-তরীকা একদম অইন্য হয়।' 


'লেকিন আমি যে দেখতে পাই।ওই ছাদের কার্নিশে আমি চাঁদনী রাতে বসে থাকতে দেখেছি দাদাজান।'কি সুন্দর ডানা, কোমল শরীর।


'নসীম মিঁঞা পড়াশুনায় মইন দাও। নামাজ পইড়ো পাঁচ ওয়ক্ত। মন পবিত্তির রাখো।এহব দিকে ধ্যান দিতাসো? সিধা হস্টেলে পাঠাইয়া দিমু। ভেজায় ঢুকাইয়া লও কথাখান।


'দাদাজান, সত্যি বলছি আমি ওদের দেখতে পাই। আর ওরা আমায়। 


'ইয়াল্লাহ! নসীম! দিওয়ানাদের মত বোলচাল হয়েছে তোমার। বেরো এখান থেকে। মক্কারী শিখছে। 


এই ছবনম শুনেছিস, বড় কত্তাদের বাসায় গোল বাধসে।

গোল? গোলের কথা শুনে বছর ছাব্বিশের শবনমের চোখ আরো গোল হয়ে গেল।

হুঁরে! বড় খালাম্মার ছুট নওয়াব নাকি পাগল হইয়ে গেসে।

কি কইছস? সে ত রাজপুত্তুর। হায় আল্লাহ।রহম।

অ মরণ রাজুপুত্তুর। পিরিত হইসে নাকি তার লগে?কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠল রাবেয়া বেগম।

ক্যান অইতে পারে না? শুদু বিদ্যেটাই যা নাই প্যাটে। রুপের কি কমতি আছে নাকি খালা? ফোঁস করে উঠল শবনম।

হায় রে ছবনম বানু। মাগীর সব আছে শুদু ভাতারের সুক নাই। খ্যাক খ্যাক করে হেসে মাটিতে ঢলে পড়ল পঞ্চাশের রাবেয়া।

মর গুখাকি, বলে পুকুরপাড় থেকে বাসন গুছিয়ে উঠে পড়ল শবনম।



কুঞ্জপুকুর গ্রাম, শহর থেকে সামান্য কিছু দূরে। নামে গ্রাম হলেও আসলে আধা শহরতলি। আধা কারণ এখনও আংশিক গ্রাম্যভাব চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পুরোনো গমকল, শাপলার চাষ, পানের বরোজের পাশাপাশি দু একটা মাঝারি মানের দু'তলা বাড়ি, আধুনিক সাজসামগ্রীর দোকান, বড় রাস্তা, বটতলা ছাড়াও পুরোনো জমিদারবাড়ির মতন একখানা দেখার মত বাড়ি। গ্রামের লোক বলে কিরামত চৌধুরীর বাসা। ইংরেজ আমলে বহুল পয়সা কামিয়ে এই একশ বছরের পুরোনো বাড়ির ইঁট গাঁথা হয়েছিল।জমিদার নাহলেও চাল এদের জমিদারের কিছু কম নয়। চাষবাস, লোক লস্কর,,জমি-জিরেত, শিক্ষা-দীক্ষার মুন্সিয়ানায় এরা গমগম করে। তাই কুঞ্জপুকুরে কিরামত চৌধুরীর বংশধরেরা কেউকেটাই বটে।


কিরামত চৌধুরীর বড় ছেলের নাতি এই মুহূর্তে গ্রামের খাস খবর।নসীম ওরফে নসীমুদ্দিন চৌধুরী জন্মানোর পর গ্রামসুদ্ধ লোক কে ডেকে খাইয়েছিল ওর দাদাজান আলো চৌধুরী ওরফে আলাউদ্দিন চৌধুরী। সেই দাদাজান এখন ওকে দেখলেই মারতে যায়। গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে নসীম পাগল হয়ে গেছে। আলে -বালে ঘুরে বেড়ায়। দানোয় পেয়েছে ওকে।সুন্দর ব্যাটাছেলেদের নাকি অমন হয়। দানো,যক্ষীরা এদের খুঁজে বেড়ায়।তা রূপ আছে বটে,অমন সুপুরুষ, সৌম্যকান্তি পুরুষ আর কটাই বা আছে কুঞ্জপুকুরে। অমন রূপ যে ছেলের সে এখন মলিনত্বের সীমা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে একা।


একজন অবশ্য আছে যে মনে মনে ওই নসীম পাগলকে ভালোবাসে, একসময় একটু দেখতে পাওয়ার আশায় ছুটে যেত নসীমদের বাড়ি। শবনম বানু। বয়সে নাসীমের চেয়ে খানিক বড়ই।ইমান কে নিকাহ করার আগে অব্দি শবনম নাসীমদের বাড়ি ওর আম্মির সাথে যেতো। শবনমের আম্মি তখন নাসীমদের বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাজ করতো। শবনম সতেরো,নাসীম চোদ্দোর এদিক ওদিক।তারপর... তারপর একদিন... হঠাৎ গাই গরুটা ডেকে উঠল, শবনম চমক ভেঙে দেখে, ভাবতে ভাবতে কখন যেন পৌঁছে গেছে বাসায়। 




'কাছে এসো। অতদূরে দাঁড়িয়ে কেন? কি গো। শরম লাগছে? তোমার জন্য শায়রী লিখেছি শুনবে না? ও মলিকায়ে হুস্ন। কিছু তো বলো আমার শাহজাদী।  

আচ্ছা বেশ রাগ করেই থাকো তবে। আর আমি দূরেই থাকি। ওই গুলাবী ঠোঁট তো আর আমার নয়। থাক আমি দূরেই থাকি। কিন্তু শায়রীটা শুনে যাও মেরে জানেহুস্ন



ইস কদ্র ওয়াফা কে রাহো কো সমহালা ম্যায়নে

কি ওর কিসি কো দেখনে কি চাহত না হুই

জিন্দেগী শুনি সী মেহফিল থি তেরে আনে সে পেহলে

আজ ভিগি হুই শায়রী বন গই।


কি গো শুনলে? কি গো।


ও ছোট কত্তা কার লগে কথা কন।কেডা আসিল এখানে? 


তুই? কেন এসেছিস এ ঘরে? কি চাই? চিৎকার করে উঠল নসীম। 


আমি তো দুধের গিলাস দিতে আইসলাম।বড় আম্মি পাঠাইলো। থতমত খেয়ে উত্তর দিল বিল্লু। নসীমদের পুরোনো কাজের লোক।


বেরো ঘর থেকে এক্ষুনী। দুধের বাহানা নিয়ে লুকিয়ে দেখতে এসেছিলি। বেরো শালা আউলিয়ার পুত।রাগে ঝেঁঝে বিল্লু কে মারতে উদ্যত হল নসীম।


বিল্লু তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, আম্মিজান গো।আমারে মাইরা ফ্যালাইলো গো। ও আব্বুজান গো, আমারে মরতে দিওনি গো। নসীম ভাইজানরে দানোয় পাইসে হো।জিনে ধরসে। খুন কইর‍্যা দিসিল হেই আল্লারে।


বিল্লুর চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে উপস্থিত হয়েছিল নাসীমের মঞ্জিলে।একে একে জ্বালানো হয়েছিল তার শায়রীর খাতা, কবিতার বই, আছড়ে পড়েছিল বেত সারা শরীরে। নসীম শুধু বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছিল, 'আমি ওদের দেখতে পাই বিশ্বাস কর দাদাজান, আম্মু।'



আলো চৌধুরী নিজের ঘরে যাওয়ার সময় বলে গেল, মৌলবী সাব কে ইতেল্লা কর,মসজিদের পাক পানী আর দরগার মাটি চাই।





হায় মেরী হুরি, আজ তোরে লাজবাব লাগতিসে। নরম গোস্ত আর এই মৌসম। শব্বো আর কত দেরী কইরবি? ইমান বিছানায় শুয়ে আওয়াজ লাগালো। 

শবনম জানে কি হতে চলেছে, তাই বিছানায় যেতে দেরী করছিল। ইমানের ঘুমানোর অপেক্ষা করতে লাগলো, ঘরের ভেতর ঘুরঘুর করে এটা সেটা গোছাতে লাগলো।এই কাজ ওই কাজের বাহানা দিয়েও ইমান কে আজ টলানো যাচ্ছে না। বালিশে আতর লাগাচ্ছে ইমান, হাল্কা মেজাজে বিড়ি ধরালো, শবনম সব লক্ষ্য করছে,ওর ভেতরে হিমেল হাওয়া,প্রবল শৈত্য,জলোচ্ছাসে ওর ডিঙি মাঝদরিয়ায় ভেসে যাচ্ছে। কিনারা নেই।আশ্রয় নেই।



কি রে আর কতক্ষণ? বলে ইমান নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে এসে একটানে বুকে টেনে নিল শবনম কে। পাঁজাকোলা করে বিছানায় শুইয়ে নিজেকে আর শবনম কে নিমেষে মুক্ত করল পার্থিব আবরণ থেকে।ইমান ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে শবনমের আকাশে। ইমানের মুখে বিড়ির বিশ্রী গন্ধ, ওর ঘামে চিটচিটে শরীরে হাত রাখতেও ঘেন্না হচ্ছে শবনমের। শবনম শুনতে পাচ্ছে ইমানের বুকের ঘড়ঘড়ানি শব্দ। পুরোনো কাশির কফ বুকে জমে, ইমানের বুক থেকে ইদানীং শিল নোড়া ঘষার আওয়াজ পায় শবনম। গা গুলোচ্ছে শবনমের। একদলা গুরুপাক বমি গলার কাছটাতে নড়াচড়া করছে ওর। হাঁফাচ্ছে ইমান। বরফের চাঁই থেকে পা হড়কে যাচ্ছ্র যেন ওর। কিছুতেই পারছে না। শবনম দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ,কোথাও একটা বাজ পড়লো। থেমে গেছে ইমান। শবনম জানে এবার কি হবে। টপটপ করে জলের মত ঘাম পড়ছে ইমানের শরীর থেকে, শবনমের শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইমান।নীচে পড়ে থাকা লুঙিটা পড়ে নিয়ে প্রবল আক্রোশে শবনমের চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে বিছানা থেকে টেনে নামালো। তারপর এলোপাথাড়ি লাথি মারতে লাগলো। শবনম পড়ে আছে। মার খাচ্ছে। ইমান বলে চলেছে শালি তর বড় গুমর তাই না? হারামী মাগী।অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল ইমান।শবনম তখনও পড়ে আছে মাটিতে। ও জানে ইমানের রাগের কারণ। ইমান পুরুষত্বহীন। 

অসহ্য যন্ত্রনায় চোখ বুজলো শবনম।বন্ধ চোখের ওপারে ভেসে উঠলো নসীমুদ্দিন।




পাপ! পাপ! বুইঝলা পাপ! কিরামতের ব্যাটাদের কম পাপ জমা আসে। অদের চেনস না। কত ম্যাছেলের জীবন যে খতম কইরেসে অই আবাগীর পুতরা। তুই কি বলিস ছবনম, কথাটা বলে মুখ টিপে হাসলো রাবেয়া।রাগে গা রি-রি করে উঠলো রাবেয়ার।দুপুরবেলা পুকুর ঘাটে আড়া-পাড়ার মেয়েদের ভিড় হয়।নানা কথা চালাচালি হয়। রাবেয়া আর শবনমও থাকে।রাবেয়া বেগম সম্পর্কে শবনমের মাসী হলেও শবনমের উপর অজানা রাগ আছে রাবেয়ার।তাই সবসময় শবনম কে ঠুকো মেরে কথা বলে। শবনমের জীবনের নানা অন্ধকার দিকগুলোতে ঢিল মেরে দেখতে চায়,এখনও ব্যথা হয় কিনা। আজ শবনম যেন রাগ সামলাতে পারলো না, হাসতে -হাসতে বলল, এসব কথা ছাড়ান দাও,বাসায় যাও রাবেয়া বিবি, তোমার শোহর তো পালতোলা নৌকা,যেহানে -সেহানে ডিঙা ভাসায়। দেখ আজ আবার কন পানী তে আছড়াইল। পাড়ার বৌ -মেয়েরা হেসে উঠলো শবনমের কথায়।রাগে লাল হয়ে উঠল রাবেয়ার মুখ, হিসহিস করে বলল, তোর শহরের মত ম্যান্দা নই। দেহসুখ পাইবারে ছুকছুক করস চৌধুরীদের বাসায় সব জানি আমি, তুই তোর আম্মি,দুইটাই এক।একটা পালাইসে বড় বাড়ির গেঁড়েটার সঙ্গে। মুখ খোলাইস না আমার।

শবনম কথা না বাড়িয়ে বাসন নিয়ে উঠে পড়ল। ওকে এভাবে চলে যেতে দেখে, রাবেয়া পিছন থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। শবনম জানে রাবেয়া এখন ওর পিছনে আরও নোংরা কথা বলবে,ওর কিছুই যায় আসে না তাতে। শুধু আজ আম্মি কে খুব মনে পড়ছে। 



কিরামত চৌধুরীর বাসায় প্রথমবার যেদিন শবনম ঢুকেছিল,অবাক হয়ে দেখছিল চাদ্দিক। কি বড় বড় কারুকাজ করা থাম, রান্নাঘরে থরে থরে সাজানো বাসন। মেহগনি পালঙ্ক। বাগানের সারি সারি ফুল। সারাটাদিন শুধু দেখেছিল।আর দেখেছিল নাসীমুদ্দিন কে। বড় বড় চোখ, মাজা রং, অদ্ভুত একজোড়া ঠোঁট।আপন মনে তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। তার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ওই কিশোর কিভাবে যেন ছুঁয়ে নিয়েছিল শবনমের মন।তারপর থেকে মোটামুটি রোজ যেত বড় বাড়িতে। শবনমের মা আয়েষা বুঝতে পেরেছিল মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।

আয়েষা মেয়ে কে বারবার বারণ করেছিল বড় বাড়ি থেকে দূরে থাকতে। শবনম শোনেনি, আসলে পারেনি। তারপর তো কত পানী গড়ালো নদী দিয়ে।




'নসীম! 


একটা কাগজে মাথা নীচু করে কি যেন খস খস করে লিখছিল নসীম।নিজের নাম শুনে মুখ তুলে তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো

'আপনি কে? এখানে কি করছেন?


আমি ডাক্তার রায়


 ভ্রু কুঁচকে তাকালো নসীম।

''ডাক্তার? এখানে কি চাই? এখানে কারা ডাকলো?'


তোমার দাদাজান বললেন তোমার অসুখ করেছে। তাই দখতে এলাম।'


'অসুখ? আমার অসুখ? আপনি ভুল করছেন আমি না আমার আম্মি অসুস্থ। আপনি ভেতরে যান।সব্বাই ওখানে আছে।গণ্ডগোল পাকাচ্ছে গিয়ে দেখুন।


ডাক্তার সুবিমল রায় পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি দিয়ে মেপে নিলেন বছর তেইশ -চব্বিশের অপরূপ সুন্দর যুবকটি কে।ছেলেটি এক মনে কি যেন হাতড়ে চলেছে ফাঁকা ঘরের দেওয়ালে।যেন নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছে।অসহায় চোখমুখ।চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রং -ছবি, বই। অনেক গুলি সাদা কাগজ পড়ে রয়েছে এদিক -ওদিক।আর তার উপর আঁকা এক জোড়া চোখ। ডাঃ রায় একটা ছবি তুলে নিলেন। তারপর নসীম কে জিজ্ঞেস করলেন,তুমি এঁকেছো? 

মুহূর্তে বদলে গেল নসীমের চোখদুটি।ডাঃ রায় দেখলেন নসীমের চোখ ঠিকরে ঝরে পড়ছে রাগ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,'ওটা রেখে দিন। নইলে -- নইলে --- নইলে কথা শেষ করার আগেই বিছানায় পড়ে থাকা পেপারওয়েট তুলে নসীম ছুঁড়ে দিল ডাঃ রায়ের দিকে। জিনিষটা ডাঃ রায়ের কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল।


ডাঃ রায় বেরিয়ে এলেন নসীমের ঘর থেকে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নসীমের দাদাজান । তিনি ডাঃ কে ভালোভাবে জরিপ করলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আফনে ডাকদার? তা কেমুন দ্যাখলেন নসুরে?


'বলছি। আচ্ছা তার আগে একটু কি নসীমের মায়ের সাথে কথা বলা যাবে?'


কথাটা ঠিক পছন্দ হল না আলো চৌধুরীর, রাগত স্বরে বললেন, 'তারে কিসে লাগবো? সে নাই।'


ডাঃ রায় বললেন, নসীম বলল, তিনি নাকি অসুস্থ। 


'হা হা হা হা হা! নসু কইসে অর মা অসুস্থ। অসভ্যের মত চিৎকার করে হেসে উঠলেন চৌধুরী। 


ডাঃ রায় বিরক্ত মুখে বললেন, হাসছেন যে। তাকে কি পাওয়া যাবে? 


কোনরকমে হাসি চেপে চৌধুরী বললেন,'হ যাবে, পিছনের বাগানে হুয়ে আছে মাটির নীচে,যান কথা কয়ে আসেন।' 


লোকটার অনেক বদনাম এই গ্রামে আসা ইস্তক শুনেছেন সুবিমল।কিন্তু এতখানি পাজী ভাবতেই পারেননি। এই ধরণের কথা যে বলে সে যে কি ধাতু তে গড়া বুঝতে এতটুকু দেরী হয়নি তাই প্রথম থেকেই শান্ত স্বরে কথা বলে চলেছেন।এখনো তাই ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে, শান্ত অথচ দৃঢ় ভাবে বললেন,' আপনার নাতি স্কিৎজোফ্রেনিক।

ওর চিকিৎসার প্রয়োজন।



আলো চৌধুরী মুখ ভেচকে বললেন,'মোদ্দা কতা অইল নসু পাগল তাই ত?


ঠিক পাগল না, ডাঃ রায়ের কথা মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে চৌধুরী বললেন,আফনে যা করার করসেন,এবার আসেন।আসেল্লামাইলেকুম।


ডাঃ রায় বিরক্তমুখে বললেন আপনাদের ছেলের ভালো মন্দ আপনাদের কাছে, আমায় সুলতান বলেছিল আসতে তাই এসেছিলাম। নমস্কার।


ডাঃ সুবিমল রায় চলে গেলেন। আলো চৌধুরী নিজের ছোট ছেলে সুলতান কে ডেকে বললেন, 'লায়েক হইসো? কে কইসিলো ডাকদার আনতে? দরগার মাটি আর জলপড়াই ঠিক করবো ওই দানোয় পাওয়া নসু রে। হাকিমেও কিছু অইবো না হুকুমেও না। বুজছো? এহন যাও ইহান থিক্যে।আওয়ারা ছোকরা। সুলতান মাথা নীচু করে চলে গেল।সুলতান জানে আলো চৌধুরীর জিভ ছুরির ফলার মতো।




শবনম শুয়ে আছে মেঝের উপর চাটাই পেতে ।বিছানো চাটাইয়ের উপর পানের ডিবা, বালিশ,চিরুনি,ফিতে আরও কিছু টুকিটাকি।সবে গা ধুয়ে এসে শুয়েছে ও। ভাদ্দরের গরম,প্যাচপ্যাচে,ঘিনঘিনে। শাড়িটাকে যাহোক করে জড়িয়েছে শরীরে। বুকের উপর ছড়ানো পাউডার। আরাম লাগছে। আজ ইমান ফিরবে না। ইমান কাঁচ তৈরীর কারখানায় কাজ করে। মাঝে মধ্যেই নাইট ডিউটি থাকে। 

 ইমান যেদিনগুলোয় কারখানায় কাটায় শবনম নিজের মত মেলে ছড়িয়ে শুতে পারে। ভাবনার ডানাগুলি পিঠে এসে জুড়ে যায়। উড়ে যায় শবনম। ক্ষেত থেকে ক্ষেত,মেয়েদের স্কুলের ছাদ টপকিয়ে সন্ধামনি ফুলেদের কুঁড়ি ছুঁয়ে, আসমানিদের বাড়ির কুয়োতলা। সেখানে দাঁড়িয়ে স্নান করলে দেখা যায় নসীমের ঘর। নসীমুদ্দিন। তার আশিক। চোখ বুজে আসে শবনমের। বন্ধ চোখে সবচেয়ে ভালো দেখে ও। দেখতে পায় কিশোর নসীমুদ্দিন জানলা দিয়ে দেখছে ওকে।বিস্ফোরিত চোখে।কিশোরী শবনম একে একে খুলে ফেলছে পোষাক। আসমানিরা কেউ নেই,ফাঁকা বাসা। সাদা চকচকে শরীরের উপর লুকোচুরি খেলছে জলের রেখা। নিতম্ব অব্দি খোলা চুলে শুষে খাচ্ছে জল। নসীমুদ্দিন দেখছে অপলক, নিশ্চল।এক অভূতপূর্ব শরীরী রোশনাই গিলে খাচ্ছে তার কৈশোর।



 শবনমের অতীত ওর দুচোখে গত জন্মের গল্পের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সব।মনে পড়ছে ইলিয়াস কে। মনে পড়ে যাচ্ছে সমস্ত অপমান। মনে পড়ছে এক রাতে ইলিয়াস জোর করে ঢুকে এসেছিল ওদের বস্তির ঘরে। নসীমের বাবা ইলিয়াস।  ওর মায়ের দ্বিতীয় শোহর ইলিয়াস। আর তারপর......


তার পর ওকে নগ্ন করে ঘোরানো হয় কিরামতদের বাড়িতে।নসীমুদ্দিনের উপর কালা যাদু করার অপরাধে।মা আর ইলিয়াসের ঘর ছাড়ার অপরাধে। অপমানের গ্লানিতে ক্লান্ত শবনম সেদিনও একজোড়া বিস্ফোরিত চোখ দেখতে পেয়েছিল দরজার পাশে।সেদিনের ঘটনার পর আর কোনদিন পা রাখেনি ও বাড়িতে।


 শবনমের বিয়ে ঠিক হয় ইমানের সাথে। পুরুষত্বহীন ছেলের জন্য শবনমের মত খুবসুরত মেয়ে পেয়ে ইমানের আম্মি যেন হাতে চাঁদ পেল। শবনম পেলো আশ্রয়। তবু আজও নসীম ওর জখমের মরহম।




আম্মিজান তুমি বুঝি? কতদিন পর আজ এলে এ ঘরে। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না আম্মু ছেলেবেলার মত। আজকাল তো এঘরে আসা ছেড়েই দিয়েছো। দেখো আমি কেমন দুবলা হয়ে যাচ্ছি। সবুজ শিরাগুলি উঠে আসছে। সবুজ চর যেভাবে তৈরী হয় শ্যাওলা জমে-জমে। আমিও তেমন শ্যাওলা ধরা চর,জনমনুষ্যহীন। কতগুলো বছর ধরে মরচে পড়া জীবন টেনে চলছি। সবাই আমাকে পাগল ভাবে।তুমি তো জানো আম্মু তোমার নসু পাগল নয়।তোমার নসুর জিগর আছে। শুধু যখন তুমি আসো আমি উতলা হয়ে পড়ি সেই আগের মতো।সেই ছেলেবেলার আমি যখন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধাতাম।আকাশে ওড়া ঘুড়ির দিকে দেখতে দেখতে হোঁচট খেয়ে পা ফুলিয়ে বাড়ি আসতাম।তুমি যত্ন করে জলপটি দিতে, আঙুল বেঁধে দিতে। তারপর তুমি একদিন হঠাৎ করে নেই হয়ে গেলে। একেবারে নেই।কোথাও নেই।আমি বড় একা ছিলাম আম্মু।তুমি নেই আরও একা। তারপর একদিন একজন এল, হলুদ জড়ি ওড়না। আম্মু ও আম্মি শুনছো তুমি? ও আচ্ছা শুনছো। কোথায় ছিলাম যেন? উম.... হুম। আমার মনে পড়ে যায় ওই চোখ দুটো, লম্বা কোমর ছাপানো চুল আর না কিছু না। আমি বলতে পারবো না সে কথা। কুয়োতলায় আসমানিদের, একদিন মাত্র একদিন। স্নান,জল,দৃশ্য, অনুভূতি জন্নত,হুস্ন। আর তারপর উফফ সে কি বিভৎস। নানা আমি কিছুতেই পারবো না। সেসব মুখে আনতে ইয়াল্লাহ তৌবা। পরহেজগার নই আমি মুমিনও নই।শুধু মুর্শিদ হতে চেয়েছিলাম। ইশকের, আশিকির, ভালোবাসার। আল্লাহ রসুল আমাকে একজোড়া চোখের বন্দগী দিলেন। অপ্রাপ্তি নিয়ে ঘর ছাড়ছি আমি।আমাকে মাফি দিও। দুয়া করো আমার ইন্তেকালের। আম্মি চলে গেলে.... দুয়া করো মৌলা, ইবাদতে খুদা নাহোক বেহেস্ত নসীব হোক।




'ছবনম দরজা খোল। আমি আইসি ইমান।'ও ছবনম খোল দরজা মেরি হুরী।'

'খুলসি খাঁড়াও।

শবনম দরজা খুলে দেখে ইমান দাঁড়িয়ে । শবনম বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল,'এত রাতে ফিরলা, অন্যদিন ত আস না এত রাইতে ? 

ইমান বিশ্রীভাবে তাকালো বলল,কাজে মন বসাইতে পারতেছিলাম না।তর জিস্ম ভাসছিলো চোখে তাই। শবনম প্রত্যুত্তর দেওয়ার আগেই সটান শুইয়ে দিল ওকে মেঝেতে। শবনমের অন্যদিনের মত আজ গা গুলোলো না চোখ বুজে এল ওর। হাজার মেইল পেরিয়ে যাচ্ছে আবেশে। মেঘ থেকে নদী চরাচর উড়ে যাচ্ছে,ভেসে যাচ্ছে । অসস্ফুটে বলল, 'নসীম,তুমি আমার।' কথাটা বলেই চোখ খুলে ফেলল, ঘামছে শবনম। থেমে গেছে ইমান। ক্রুরদৃষ্টি দিয়ে মাপছে শবনম কে,ঠোঁটে আক্রোশের হাসি,বলল, 'নসীম?,নসীমুদ্দিনের ভূত নামে নাই ঘাড় থিকে। শালী বেবুশ্যে।নসীব দেখসো আমার আল্লাহ?আমার শাদী করা বিবি অন্য মরদের শরীলে সুখ পায়। ব্যাশ! তবে যা আজ তকে আমি তালাক দিলাম।তিন তালাক, যা দূর হ।যা গিয়ে আসমানিদের বাসায় ন্যাংটো হ বেবুশ্যে মাগী।চমকে উঠল শবনম।নগ্ন শবনম কে চুলের মুঠি ধরে বের করে দিল ইমান।মুখের উপর বন্ধ করে দিল দরজা।করুণ আকুতি,মিনতিতেও দরজা খুলল না ইমান।শবনম কাঁদতে কাঁদতে এক সময় থেমে গেল। ছুটে গেল নিজেকে শেষ করে দেবে বলে। উন্মাদিনীর মত ছুটে চলেছে। পেরিয়ে যাচ্ছে অনন্ত যাতনার আগুন কে। শ্যাওলা, নোনা ধরা পুকুরপাড়ে এসে থমকে গেছে শবনম,এত অন্ধকারেও চিনতে ভুল হয়নি। 




আব্বুজান আফনে ঘুমান নাই? সুলতানের আওয়াজে টিভি বন্ধ করে,বিছানায় উঠে বসল আলো চৌধুরী। হাঁক মেরে বললেন,' ভিতরে আইসো। এত রাত্রে কি চাই বেটা? সুলতান আমতা আমতা করে বলল, আব্বু ভাইজান চিঠি দেসে। লিখসে, আয়েষা আর বাঁইচা নাই। আফনে যদি এহন বাসা আইতে হুকুম করেন। হের লইগ্যা...

সুলতান কে থামিয়ে দিলেন আলো চৌধুরী, বললেন, ওই বেবকুফটার জন্যই আজ এই দশা আমাগো পরিবারটার। হালায় বিবিটা কে খুন কইরলো, কাজের মাগীর জন্য।তাই দেইখ্যা নাতিটা পাগল হইল। আবাগীর পুত। আমি যদ্দিন আসি, ও দূরেই থাক।অরে কইয়া দিও।আর তুমি এহন ঘুমাও সুলতান, রাত হইসে। এহন আসো।'বলে

আলো চৌধুরী সুলতান কে একরকম তাড়িয়ে দিলেন ঘর থেকে।তারপর দরজা ভেজিয়ে আলো নিভিয়ে দিলেন ঘরের। আজ বহুদিন পর পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো জমে আসছে চোখে।হঠাৎ মন বিষন্ন হয়ে উঠল নসীমের জন্য। মনে পড়লো ছোট্ট নসীম তার হাত ধরে ঘুরতো। 

 কেঁদে ফেললেন শিশুর মতন।কতক্ষণ কেঁদেছেন মনে পড়ল না। ঘরের লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে।একদলা সর্দি নাক থেকে ফ্যোঁৎ করে ঝেড়ে ফেলে, ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন।



'আফনে এত রাত্রে এহানে কি করতাসেন?

 নসীম পুকুরঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে।ঘুরে তাকিয়ে,অবাক চোখে দেখছে শবনম কে।

শবনমের হুঁশ এল,ও যে একেবারে নগ্ন।নিজেকে দু'হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করল।

নসীম নরম গলায় বলল, তুমি এসেছো শাহজাদী, চলো এই জন্নতের মেহফিলে এক হয়ে যাই আমরা।ওই দুই চোখ, ঠোঁটে খেলা করুক ইশক। নসীম উঠে এল পুকুরঘাট থেকে।হাত ধরল শবনমের। শবনম ঘিরে ধরেছে নেশাঘোর আঁধার।মনে মনে ভাবলো,আজ এই মুহূর্তটাই জন্নত। সারাজীবন এই ত চেয়েছে সে।নসীম জড়িয়ে ধরলো শবনম কে।শবনম এলিয়ে দিল নিজেকে নসীমের বুকে। দুজনে ভেসে যাচ্ছে সুখে। ডুবছে ভাসছে,নসীম ফুল ফুটিয়ে তুলছে দু আঙুলের ইশারায়। এক সময় থেমে গেল নসীম। নিঃশেষ সমস্থ সঞ্চিত সুখ।আলগা করল নিজেকে। হাল্কা শরীর।কখন যেন হাতের বাঁধন কেটে ভেসে গেছে শবনম। নসীম বুঝতেই পারেনি দু বাহুর মধ্যে পিষ্ট হয়ে যাওয়া শবনমের শ্বাসরোধ করে দিয়েছে ও।

হঠাৎ দুপা ভারী হয়ে যাচ্ছে নসীমের নড়তে পারছে না। জলের মধ্যে মাঝপুকুরে দাঁড়িয়ে। বুকে অসম্ভব যন্ত্রনা। চোখের সামনে খেলে বেড়াচ্ছে হাজার জোনাকি।


পরের দিন সকালে ফুলে ফেঁপে ভেসে ওঠা নসীমের প্রাণহীন দেহ। থকথকে করছে শ্যাওলা সারা শরীরে।নসীমের দাদাজান ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে তাকালো নাতির শবদেহের দিকে।তারপর দাঁত কিড়মিড় করে 'আপদ গেছে' বলে একদলা পানের পিক ফেলে যেভাবে এসেছিললেন ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন।নসীমের হাতে তখন অব্দি মুঠো করে ধরে রাখা শবনমের কোমরের তাগা। শবনম তখনও লাপাতা। লাপতা বেহেস্ত কিম্বা জন্নতের খোঁজে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract