Pronab Das

Classics

2  

Pronab Das

Classics

নিশিরাতের ঠেক ।

নিশিরাতের ঠেক ।

10 mins
813


রসুলপুর বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া মুকুলদার হোটেলটা বেশ পুরনো। আগে মুকুলদার বাবা চালাতেন, বাবা গত হওয়ায় নিজেই দেখভাল করে। দুবেলা ভাত, ডাল, রুটির সাথে সাথে চা কিন্তু সর্বক্ষণই পাওয়া যায়। মুকুলদা ভারী রসিক মানুষ। সারাদিন সবার সাথে বক বক করে, আর গুন গুন করে কিশোর কুমারের গান গায়। গলা ভালো তাই শুনতে বেশ লাগে। আমাদের আড্ডার ঠেকটা ঠিক এই হোটেলের পাশে। তিন দিক খোলা খড়ের চালা লাগানো বাঁশের তৈরি মাচা। হোটেলের সামনে পাকা রাস্তার পরেই বিঘার পর বিঘা জলকর। রাস্তার দু দিকেই যতদূর চোখ যাবে শুধুই জল আর জল। কোমর সমান জল তাতে। চাষের জমিতে খালের মাধ্যমে ইছামতির নোনা জল এনে বাগদার চাষ করা হয়। এটাই এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা বা ব্যবসা। এই জলকরের ধার ঘেষে পাকা রাস্তার ঢালের ওপর দূরে দূরে খড়ের কয়েকটা গুমটি,.... এগুলি পাহারা দেওয়ার জন্য। ফাক পেলেই যে ছিঁচকে চোরেরা লুকিয়ে জাল ফেলে। মাঝে মধ্যেই এলাকায় ডাকাতির ঘটনা কানে আসে, মাছ বিক্রির কাঁচা টাকার লোভে। অন্ধকারে রাস্তার দুপাশে গুমটি গুলোতে তেলভরা লুণ্ঠনের জুলু জুলু আলো দেখতে বেশ লাগে।


       আমরা কয়েক জন এলাকার বন্ধু বান্ধব কাজ থেকে ফিরে সন্ধের পর প্রায় রোজই এই মাচার ঠেকে আড্ডা দেই। আর এই আড্ডা চলে প্রায় রাত দশ টা পর্যন্ত। আসলে ওই সময়ই মুকুলদার হোটেল বন্ধ হয় আর এই পথের শেষ বাস টা এই সময়ই স্ট্যান্ডে তার প্যাসেঞ্জার নামিয়ে পাততাড়ি গোটায়। কয়েক ঘন্টার জম জমাট এই আড্ডায় বেশ কয়েক বার চা, ঘুগনী ও ওমলেট চলে। মোটামুটি সন্ধ্যার টিফিন ওখানেই সারা হয়ে যায় আমাদের। আমরা ক-জনবন্ধু বান্ধব এই ঠেকের রোজকার সদস্য। গোপাল খুড়ো মাঝে মধ্যে এখানে এসে সময় কাটান, তামাক খান, গল্প বলেন। আগে সেলসম্যান এর চাকরী করতেন। সেইসূত্রে অনেক দেশ- বিদেশে তাঁর ঘোরা। সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এমন ভাবে বলেন যেন এই এঁদো রসুলপুর গ্রামে বাঁশের মাচার ওপরে বসেও ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পাই। 


      আজ শনিবার, অফিস থেকে ফিরে এক কাপ চা দুটো বিস্কুট খেয়ে আড্ডা দিতে বেরিয়ে পড়লাম। কার্ত্তিক মাসের সবে শুরু, হালকা শীত পড়েছে। প্রায় সবার গায়েই পাতলা চাদর বা গরম পোশাক। জলকরের লোনা হওয়ায় বেশ আমেজ লাগছে। 


     ঠেকে পৌঁছে মুকুলদার হাতের চায়ের গ্লাসে সবে একটা চুমুক মেরেছি, দেখি গোপাল খুড়ো তোফা মেজাজে সিগারেট টানতে টানতে এদিকে আসছে। তাঁকে দেখেই মনে মনে বললাম, ....... আজ আসর জমবে। নীলু ও হারু এখনো এসে পৌঁছয় নি। খুড়োকে এদিকে আস্তে দেখেই মুকুলদা সুরকরে কিশোর কুমারের "হামে তুমসে পেঁয়ার কিতনা...…....." গানটা গাইতে গাইতে এককাপ ঘন দুধের চা উনুনে চাপিয়ে দিল। খুড়ো যে আবার স্পেশাল দুধ চা ছাড়া খান না। গনগনে উনুনের পাশে চা খেতে খেতে খুড়ো বাকিদের খোঁজ নেওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল।


     ইতিমধ্যে বাকিরা ঠেকে এসে গেছে, দরমার হোটেলের ভেতর থেকে হারু আর নীলুর মশকরা শুনতে পাচ্ছি। গোপাল খুড়োকে লুকিয়ে বিড়ির সুখটানে ব্যাস্ত। ছেলে দুটো এমনি ভালো, দোষের মধ্যে একটাই, মাঝে মধ্যে নেশা ভাঙ খেয়ে এদিক ওদিক পড়ে থাকে।

  

    খানিক পরেই আমরা মাচায় উপবিষ্ট হলাম। একথা সেকথা, ঠাকুর দেবতার কথার পর আমরা সরাসরি ভৌতিক ও অলৌকিক কথায় চলে এলাম। অলৌকিক তবুও ঠিক আছে, কিন্তু ভুত নামক বস্তুটির ওপর আমার আর গোপাল খুড়োর তীব্র অবিশ্বাস ঠেকের পরিবেশকে ঈষৎ উষ্ণ করে তুলল। যদিও নীলু, হারু এরা কেউই কোনোদিন ভুত দেখেনি তথাপি ওদের ভুতের ওপর এইরূপ অগাধ বিশ্বাস আমাকে ও গোপাল খুড়োকে অবাক করে তোলে। যাইহোক, পরিস্থিতি সামাল দিতে খুড়ো ফস করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে, একরাশ সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে, তাঁর সাথে ঘটা একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা শুরু করল।..............


       "আমি তখন যাদবপুর ইউনিভারসিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রথম বর্ষের ছাত্র। বাবা বোসপুকুরে এক আত্মীয়ের বন্ধুর তিন তলা বাড়ির এক ছোট্ট ঘরে পেয়িংগেস্টর ব্যবস্থা করে দেন। বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ দম্পতি, দোতলাতে থাকেন। মধ্য বয়সী এক আশ্রিত দম্পতি তাঁদের দেখাশোনা করে। তাঁদের একমাত্র ছেলে বিদেশে কর্মরত। এক ও তিন তলাতে ছাত্রাবাস। ওই অঞ্চলে তখন ফ্লাট কালচারের ধুম লেগেছে। উঠতি প্রমোটারেরা মস্তানের সাহায্য নিয়ে একপ্রকার ভয় দেখিয়ে এই ধরণের বাড়ি গুলো কব্জা করত। প্রশাসন কে জানিয়েও বিশেষ লাভ হতো না। আমাদের ছাত্রাবাসের মালিক বৃদ্ধ দম্পতিও এই ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হন। দিনে দুপুরে প্রমোটারের লোক জন কখনো ঘরে এসে, কখনো টেলিফোন করে ওই বাড়ি বিক্রির জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্ত এসবেও কাজ না হওয়ায় তাঁদের সরাসরি হুমকি দেওয়া শুরু হল। ওদের সাথে সাথে আমরাও খুবই দূর্ভাবনায় থাকতাম। এরই মধ্যে এদিন আনুমানিক রাত দুটো হবে, সবে পড়া শেষ করে শুতে যাব, হঠাৎই বাড়ির পেছনের দিকের দেওয়ালে বার তিনেক  দ ...... রা .......ম  ! ! ! , দ ...... রা ....... ম ! ! ! শব্দ। মনে হল বাড়ির দেওয়ালে কেউ বোমা মেরেছে, এক্ষনি বোধ হয় হুর মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে। বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে ওই ভয়ানক শব্দে। প্রায় সকলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি কিন্তু এমন কোন কারণ খুজে পাওয়া যায়নি যার দ্বারা ওই রকম ভয়ানক শব্দ হতে পারে। পাশের লাগোয়া পরিত্যক্ত দোতলা বাড়িটি বহু বছর বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাড়ির পেছনে দেওয়াল থেকে প্রায় সাড়ে তিন ফুট দূরে এক জোড়া মাঝারি মাপের তাল গাছ আছে, সেটি বাতাসে দোল খেয়ে অতো জোরে ধাক্কা মারবে তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। 

অদ্ভুতভাবে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল প্রায় পনেরো দিন পর, ঠিক আগের মত ভোর রাতের দিকে। এই ভৌতিক ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে দু চার জন ওই ছাত্রাবাস ছেড়ে দেয়। বৃদ্ধ মালিকও এই ঘটনায় প্রচন্ড ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পরে। ঘটনাটি বাবাকে চিঠিতে জানাতেই উনি ছুটে আসেন। সমস্ত দেখে শুনে কিছু দিনের মধ্যেই আমার অন্যত্র থাকার বন্দোবস্ত করবেন বলে মনস্থির করলেন। বাবা আসার সময় আমার জন্য একটা বাইনোকুলার এনে ছিলেন। পরদিন দুপুরে ছাদে ওই বাইনোকুলার এ চোখ দিয়ে পুরো শহরটা খুব কাছ থেকে দেখছিলাম। ছাদের আশপাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখার সময় হঠাৎ চোখ পরল ওই তালগাছের দিকে। দুটো গাছের একদম ওপরের দিকে নুইয়েপড়া শুকনো পাতার ফাঁকে বেড় দেওয়া লোহার হুক লাগানো। খালি চোখে অতটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। মনে প্রশ্ন জাগলো,.... কিন্তু কেন এই হুক? এর সাথে ওই ভৌতিক শব্দের সম্পর্ক নেই তো!!.... সামনেই এক্সাম, এখন একটু বেশি রাত করেই শুতে যাই আর মাঝে মধ্যেই পেছনের জানালার দিকেও খেয়াল রাখি। ঠিক সেই দিনই রাত তিনটে হবে, হটাৎ কাঁচের জানালা দিয়ে চোখ গেল পাশের পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ির ছাদের দিকে। তিনজন রোগা লোক লম্বা লোহার রডের মত কিছু ওই জোড়া তাল গাছের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি ঘরের বাতি বন্ধ করে ঘাপটি মেরে অবাক হয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলাম। হঠাৎই পর পর সেই কান ফাটানো শব্দ। বিষয় টা বুঝতে আর বাকি রইল না। পরদিনই ওই প্রমোটার আর তার সাগরেদ এরেস্ট হয়।"------

   গোপাল খুড়ো হাসতে হাসতে আফসোস করে বলে,.... "ভায়া এই বাষট্টি বছর বয়সেও যখন তেনাদের দেখা পাইনি, বাকি জীবদ্দশায় ও আর পাব কিনা সন্দেহ আছে।"


  হারু মুকুলদা কে চার কাপ চায়ের জন্য হাঁক দেয়। ঘড়িতে তখন সোয়া নয়টা। মুকুলদা তখন কিশোর কুমারের " কভি আলভিদা না কহেনা"...গানটা করতে করতে বলল ,...."এর পর কিন্তু আর চা হবে না, দোকান গোটাবো।"

 

   মুকুলদার হাতের গরম চা খেয়ে রাত দশটা নাগাদ আমরা যে যার বাড়ির পথ ধরলাম। খুড়ো বলে উঠল পৌনে দশ টার লাস্ট বাস টার আজ কি হলো? মুকুলদা দোকান গুটিয়ে সাইকেলে উঠে খ্যাক খ্যাক করে সশব্দে হেসে বলল…….

     " আজও মনে হয় কোথাও বিগড়েছে, যা লজঝরে বাস ওটা, ....হি ....হি ....হি....."

 

         পাশেই গোপাল খুড়োর বাড়ি। তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি বাড়ি ঢুকব ঢুকব করছি, দেখি মুকুলদা হন্ত দন্ত হয়ে ফিরে আসছে। আমাকে দেখে গজ গজ করে বলল ,......  

          "দেখনা ভাই দোকানের ভেতরেই বাড়ীর চাবির ব্যাগটা ফেলে এসেছি,........ আবার সব তালা খোল রে..... ভালো লাগেনা।" বলেই সে দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। আমি বাড়িতে ঢুকে গেলাম।


         দ্রুত সাইকেল চালিয়ে মুকুল হোটেলের সামনে পৌঁছে যায়। একটা খুঁটিতে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে পকেট থেকে চাবি বের করে। সহসা পাশে বাসের মাচার দিক থেকে কয়েক জনের চাপা গলায় ফিস ফাস তার কানে আসে। মুকুল কোন কথা না বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিষয় টি দেখার চেষ্টা করে। চার জন লোক একটা গামছার ওপরে বেশকিছু সোনার গহনা ও কয়েক বান্ডিল টাকা নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারার তর্ক বিতর্কে ব্যাস্ত। সে এগিয়ে গেলে ওরা হকচকিত হয়ে পরে। মুকুলের বুঝতে আর বাকি থাকেনা যে ওরা ডাকাতির মাল ভাগে ব্যাস্ত। ইতিমধ্যে তীব্র আলো ফেলে রুটের লাস্ট বাস টা হোটেলের সামনে দাড়াতে ওরা সরে পরে। মুকুল তালা খুলে দোকানে ঢোকে। খানিক পরে মুকুল হোটেল থেকে বেরোতেই ওরা মুকুলকে খতম করে দেয়।

 

         আজ রোব্বার, আয়েশ করে ঘুমোনোর দিন। অথচ কাক ভোরে সদরের দরজায় ডাকা-ডাকিতে বেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি হারু ও নীলু দাঁড়িয়ে। কিছু বলার আগেই নীলু বলল,.....

  " মুকুলদা খুন হয়েছে।"

  " গলার নলি কেটে, পেট চিরে জলকরে ফেলে রেখে গেছে।"


      শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ওখানেই বসে পড়লাম। সারাদিন আর বেরোলাম না। বিকেলের দিকে কিছু সময়ের জন্যে বেরিয়ে ছিলাম। আমাদের আড্ডার মাচার প্রায় হাত দশেক দূরেই জলের উপর ওর ওল্টানো মৃতদেহ টা পাওয়া যায়। মুকুলদার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা সবাই ভেঙে পড়েছি। দিন পনেরো বাড়ি আর কাজে যাওয়া ছাড়া বাড়ির বাইরে বেড়াতাম না।


       সেদিন পূর্ণিমা ছিল। পাশের গ্রামে কীর্তন শুনতে শুনতে রাত হয়ে গিয়েছিল গোপাল খুড়োর। মনের সুখে গান করতে করতে খুড়ো জলকরের রাস্তা ধরে। খানিকটা হাঁটার পর খুড়ো চমকে ওঠে। মনে মনে বলে,.....

 "আরে এখানেই তো মুকুলের লাশটা ভাসতে দেখেছিলাম।"

খুড়ো পা চালিয়ে এগোতে থাকে। লাশটার কথা মনে পড়তেই বুকটা অজান্তেই কেমন যেন দুরু দুরু করতে থাকে। সুনসান রাস্তায় মানুষ তো দূর, আজ একটা কুকুরও নেই। হোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বন্ধ হোটেলের ভেতর থেকে কে যেন চাপা গলায় ডেকে ওঠে,........"খুড়ো"। ডাক টা এমনি অপার্থিব, শুনে একটা শিহরণ গোপাল খুড়োর হাড় কাঁপিয়ে দিল। নিজেকে শান্তনা দিয়ে বিড় বিড় করে বলে ওঠে,....... "নিশ্চিত মনের ভুল।" এক পা এগোতে যাবে, আবারও কানে এল.....

" ও গোপাল খুড়ো,.....আমি মুকুলগো।"


এবারে খুড়োর সমস্ত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি গুলো এক লহমায় লুপ্ত হয়ে, বিস্ফারিত চোখে জড় মূর্তির মত মুকুলের হোটেলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোন আবেশে, কতক্ষন যে সে ওখানে দাড়িয়ে ছিল বলা যাবে না। সম্বিৎ ফিরল এলাকারই একটি ছেলের সাইকেলের ঘন্টির শব্দে। খুড়োকে এত রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কিছু বলতে যাবে, খুড়ো কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

 


     আজ ছুটির দিন দেখে বিকেলে হারু আর নীলু আমার বাড়িতে এসেছে। প্রায় মাস তিনেক হল আমরা ঠেকে আড্ডা দেইনি। কত কথাই না জমেছিল। তিন জনে হাঁটতে হাঁটতে জলকরের রাস্তা ধরে ঠেকের কাছে পৌঁছলাম। একটু অপরিচিত লাগছিল জায়গাটা। খানিকক্ষণ বসলাম ও সেখানে। মুকুলদার জমজমাট হোটেলটা আজ অনাদরে বন্ধ হয়ে আছে। খুবই খারাপ লাগছিল। এদিকে বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে আসছে। হারু কোমর থেকে একটা ছোট বিলিতি মদের বোতল বের করে খানিকটা গলায় ঢেলে নীলুর দিকে বাড়িয়ে দিল। নীলু আড়ালে কল্কে সাজাতে ব্যস্ত। বাড়িতে কয়েকটা মুদি মাল কেনার ছিল। পাশেই রসুলপুর হাঁট। আমি ওদের এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলে হাটের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। ফেরার পথে গোপাল খুড়োর সাথে হঠাৎ দেখা। তাঁর মুখে সেদিনের কীর্তন থেকে ফেরার ঘটনা শুনে আঁৎকে উঠলাম। মনেমনে একটা শঙ্কা হচ্ছিল এইভেবে, যে খুড়ো কি সত্যিই মুকুলদার কথা শুনতে পেয়েছিলেন? তিনি যে খুবই বাস্তববাদী,আজেবাজে কথা বলেন না।


   এদিকে মাচার ঠেকে কতক্ষন ওরা নেশায় বুঁদ হয়ে পরে ছিল, মনে নেই। লাস্ট বাসটা সেই যে কখন চলে গেছে, খেয়াল নেই। একসময় নীলু হারুকে ধাক্কা দিয়ে ডাকে, বাড়ি ফেরার কথা বলে।


 নীলু মুখে আঙুল ঠেকিয়ে বলে,..….

"স... স…. স..….শুনতে পাচ্ছিস?"


 হারু বিরক্ত হয়ে বলে….

" কি শুনব…. শালা!!"


মুকুলদার হোটেল থেকে ফ্যাস ফ্যাসে চাপা গলায় ভেসে আসা একটা গান,.............

 "পেঁয়ার মঙ্গা হ্যায় তুমহিসে,.…."


 দুজনেই শুনতে পেল। কে যেন খুব কষ্ট করে গানটা গাইছে।

খানিক চুপ থেকে হারু কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিল,.....

"এ যেন মুকুলদা গাইছে।" 


নেশা ছুটে যায় তাদের। হঠাৎ ই চোখ যায় তাদের, পাশেই কে যেন এক হাতে খুঁটি ধরে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। দর দর করে ঘামতে ঘামতে নীলু প্রশ্ন করল,...

"ওটা মানুষ না অন্য কিছু? কে ওখানে?"


ছায়াময় অবয়ব মাথা নিচু করে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলে..........

"আমি মুকুলদা রে। সেদিন দাগী রশিদ ও তার দলবল এই মাচায় বসে ডাকাতির মাল ভাগ করছিল। আমি ওদের চিনতে পারায় শুয়োরের বাচ্চারা আমায় মেরে দিল। একজন আমার পেটে চিরে দিল। আরেক জন পেছন দিক থেকে গলার নলিটা কেটে দিল!!!!,.....নলিটা কাটার কি দরকার ছিল বল? একটু আধটু গান করতাম, সেটাও গেল।....... রশিদের বাড়ির উঠানের পাতকুয়ায় একটা পুটুলিতে এখনও ঐ ডাকাতির মাল পড়ে আছে।"

মুকুল মুখ তুলে ওদের দিকে তাকায়। চাঁদনী রাতে মুকুলের সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখার ক্ষমতা তাদের কলজেতে ছিল না। প্রচন্ড ভয়ে, নেশায় অবসন্ন শরীরে কোনমতে তারা সেখান থেকে পালিয়ে আসে।

 

        পরদিন সকালেই আমরা খুড়োকে সঙ্গে নিয়ে রসুলপুর ফাঁড়িতে পৌঁছে যাই। ইন্সপেক্টর শঙ্কর ঘোষাল খুড়োর বিশেষ পরিচিত। মুকুলদার খুনের সাথে দাগী রশিদের যোগাযোগ ও ডাকাতির মাল নিয়ে বেশ কিছু কথা তিনি ঘোষাল বাবুকে জানান। সমস্ত শুনে ঘোষাল বাবু তৎপর হয়ে ওঠেন। ঘন্টা খানেকের ভেতর সদর থেকে বিশেষ দল রশিদের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রশিদের বাড়ির পাতকুয়া থেকে ডাকাতির মাল উদ্ধার হয়। ফাঁড়িতে নিয়ে রশিদ কে চাপ দিতেই সে খুনের কথা কবুল করে।

  

     আজ মুকুলদার বাৎসরিক, সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। দুপুরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হওয়াতে বিকেলে শীতের কামড় বেশ অনুভূত হচ্ছে। কাজ থেকে ফিরতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। দেওয়াল ঘড়িতে সাত-টা বাজল। মুকুলদার কথা মনে পড়তেই মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল। এক কাপ চা খাওয়ার পরেই মন আর ঘরে থাকতে চাইছে না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। একটা মোটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঠেকের উদ্দেশ্য। ঠান্ডা লাগলেও অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। জাঁকিয়ে ঠান্ডা আর কুয়াশার জন্য আজ পথ ঘাট একেবারেই সুনসান। যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঠেকে পৌছে দেখি সবাই আছে। আমায় দেখে হারু বলল ….…

    "আরে গুরু যে,.,.....নীলু, সরে বোস,..... আসর আজ জমবে।"


হঠাৎ ই একরাশ কড়া তামাকের ধোঁয়া আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ল। মুখ ঘুরিয়ে দেখি গোপাল খুড়ো মুচকি মুচকি হাসছে।

 নীলু মনোযোগ সহকারে কল্কে সাজাতে সাজাতে একটা হাঁক দিল,.......

   "মুকুলদা,....... চার কাপ চা লাগবে।" 

 তৎক্ষণাৎ পাশেই দরমার বেড়ার ওপার থেকে চায়ের গ্লাসে চিনি ঘোটার ঠক ঠক শব্দের সাথে সাথে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় ভেসে এল, .........."পল পল দিলকে পাস….. তুম রহেতে হো……"।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics