#নিশীথ_রাত্রির_জোড়াসাঁকো
#নিশীথ_রাত্রির_জোড়াসাঁকো
জোঁড়াসাকো ঠাকুরবাড়ির সব চেয়ে বড় দেয়াল ঘড়িটায় রাত বারোটার ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং শব্দে। সেই শব্দে কয়েকটা নাম না জানা রাতপাখি ডানা ঝাপটে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে ক্ষান্ত হলো। আকাশ নির্মেঘ। শীতের ফিনফিনে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। মধ্য রাতের আকাশে একটা দুটো তারা মিট মিট করে জ্বলছে। ভাঙা চাঁদটা জেগে আছে সেই তারাদের মাঝে রাজার মত। আশেপাশে মানুষজনের গতিবিধি নেই খুব একটা।
ঠিক সেই সময় ঠাকুর বাড়ির মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো একটি ফিটন গাড়ি। গাড়ি থেকে হাস্যজ্বল মুখ নিয়ে ধীর পায়ে নামলো এক উনিশ কি বিশ বছরের তরুণী। তরুণীর নাম অমৃতা। তার পরনে সাদা চুড়িদার। চুল গুলো এলো করে ছাড়া পিঠের ওপরে। খুব পরিচিত ভঙ্গীতে সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। উঠে এলো দোতলায়। বেশ কয়েকটা বড় বড় ঘর আর করিডোর পার হয়ে চলে আসলো একদম শেষের দিকের একটা ঘরে।
ঘরটা প্রশস্ত। বড় বড় জানালা। জানালায় সাদা লেসের পর্দা ঝোলানো। ঘরের ভেতর হাওয়া চলাচল করছে নিশ্চিন্তে। একটি উঁচু স্ট্যান্ডে জ্বলছে টিমটিমে গ্যাস বাতি । ঘরের মাঝে একটা উঁচু খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা লিখছেন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। তাঁর দেহের গড়ন মজবুত এবং দীর্ঘকায়। তীক্ষ্ণ নাসা, কুঞ্চিত চুল এবং বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনী। মানুষটি অন্য কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!
অমৃতা ঘরের ভেতর ঢুকতেই রবিবাবু ভ্রুকুটি বক্র চক্ষু মেলে তাকালেন তার দিকে।
'ওহ,তুমি!' অস্ফুটে বললেন তিনি।
অমৃতা আপ্লুত কন্ঠে উত্তর দিলো, 'জি আমি, আপনি আমার অপেক্ষায় ছিলেন বুঝি?'
রবি ঠাকুর প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। অমৃতাকে ইশারায় বসতে বলে আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। এই কার্তিকের হিম হিম রাতেও তাঁর গায়ে শুধু একটি অবিন্যস্ত ধুতি আর পাতলা চাদর। অমৃতা হাসিমাখা কন্ঠে বলল,
'জানেন , আজকে আমাদের ওখানে আপনার জন্ম বার্ষিকী পালন করা হলো কত ধুমধাম করে..'
'তাই নাকি?' রবি ঠাকুরের গলায় কৌতুহল ফুটে ওঠে।
"কত তম জন্মবার্ষিকী?" প্রশ্ন করেন তিনি উদ্বেগ নিয়ে।
'১৬০ তম।'
'বাহ, বেশ তো! তা কি উৎসব করলে তোমরা হে?আমার জন্মদিনে?'
'কত কত অনুষ্ঠান ! কত নাচ, গান, নাটক, আলোচনা সভা! সব আপনাকে কেন্দ্র করে পুরো দেশ মেতে উঠলো আপনাকে নিয়ে। '
রবি ঠাকুরের চোখে কিসের যেন একটা ঘন ছায়া পড়লো, যেন নিজের চোখের তারায় তিনি ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন। অনেক অনেক দিন পরের কোনো এক পঁচিশে বৈশাখের সকাল। যখন তিনি সশরীরে থাকবেন না কিন্তু বাংলার মানুষ তাঁকে প্রাণভরে স্মরণ করবে। তাঁর সৃষ্টিকে স্মরণ করবে।
'কী লিখছিলেন?' অমৃতার কথায় কবিগুরুর চমক ভাঙ্গলো।
- 'একটা আর্টিকেল লিখছিলুম , লিখতে লিখতে হঠাৎ মাথায় চলে আসলো কয়েকটা কবিতার লাইন ,সেই লাইনগুলোই কাগজে টুকে রাখছিলুম । একটু থেমে কিছু একটা আচমকা মনে পড়ার ভঙ্গীতে বললেন,
'আজ সন্ধ্যেবেলা শিলাইদহ থেকে ফিরলাম।'
অমৃতার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। তার নিজের বাড়িও কুষ্টিয়া। রবিঠাকুরের কুঠিবাড়িতে তার যাওয়া হয়েছে প্রায় শ'খানেকবার। সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললো,
'বাহ! আমাদের বাড়িতে আসলেই পারতেন!'
রবিঠাকুর হাসলেন, 'তুমি তো অন্য যুগের বাসিন্দা! তোমাদের সাথে যে আমাদের যোজন যোজন দূরত্ব। সে যাই হোক, এবারে গিয়েছিলুম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে। মিতিন, মৌ,মিতা,রাই আর প্রিয়া ! মিতিনকে এবারে আমি হাতে ধরিয়ে সাঁতার শেখালুম পদ্মার বুকে। দুদিনেই শিখে গেছে। এছাড়া ছেলেমেয়েদের নিজে সময় নিয়ে পড়ালাম, আসলে পড়ালেখার ব্যপারে আমি ডাইরেক্ট মেথডে বিশ্বাসী। সবাইকে একই পড়া পড়তে হবে, একই জিনিস মুখস্থ করতে হবে, তা কিন্তু নয়। ছোটবেলা থেকেই যার যেই দিকটায় ঝোঁক তাতেই দীক্ষা দেয়া উচিত।'
'আপনি এতদিকে মাথা ঘামিয়েও কি করে যে লেখালেখিতে মন দেন? ভাবতে অবাক লাগে!'
রবীন্দ্রনাথ বুঝি খানিকটা আনমনা হলেন, স্তিমিত কন্ঠে বললেন, 'এ কথা সত্য, সকল কাজই আমি মন দিয়ে করি। জমিদারী, সংসার, আয়বর্ধন, প্রজাদের সুযোগসুবিধা দেখা, কোনো কিছুতেই আমি কোনো রকম ফাঁকি দিতে চাই নে.. কিন্তু জানো! এ সমস্ত কাজের মাঝে, সমস্ত সংসারের ব্যস্ততার মাঝে কেবল মাত্র লেখার সময়টাকেই আমার সম্পূর্ণ নিজের বলে মনে হয়। একটা হৃদয় নিংড়ানো টান থেকে যায় সবসময়, কাগজ কলম নিয়ে নিভৃতে বসবার সময়টিতে! প্রতিদিন কিছু না কিছু না লিখলে আমার চলেই না!'
'ইশশ, আমি যদি আপনার মতো লিখতে পারতাম! পারি না। আমি কেন , আমাদের সময়টার কেউ আপনাদের মতো লিখতে পারলো না, জানেন! আমাদের যুগটারও যে একজন রবীন্দ্রনাথ চাই, নজরুল, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চাই !" অমৃতা ঘোর লাগা কন্ঠে বলে...
রবীন্দ্রনাথ একটু অন্য গলায় বললেন, 'তুমি বলো, তুমি কেমন আছ? তোমাদের যুগটা সম্পর্কে জানতে পেরে আমার বেশ লাগে। '
"সত্যি? আমার ঠিক উল্টোটা মনে হয় জানেন? আপনাদের সময়ের গল্প শুনতে দারুন লাগে, মনে হয় আমি যদি আপনার সময়টাতে জন্মাতে পারতাম। আপনার সাথে এইখানটায় যদি থেকে যেতে পারতাম জন্ম জন্মান্তরের জন্য। কেবলই মনে হয় একটা ভুল সময়ে আমার জন্ম হয়েছে।' আফসোসের গলায় বলল অমৃতা।
রবীন্দ্রনাথ অবাক গলায় বললেন, 'সে কি! প্রযুক্তি তোমাদের কত এগিয়ে নিয়ে গেছে, আমরা যা ভাবতেও পারি নি কখনো... সেইরকম সব অসম্ভবের গল্প তুমি শুনিয়ে যাও আমায়। আমার তো তোমাদের যুগের গল্প শুনলে রুপকথা বলে ভ্রম হয়। এরপরও এত ক্ষোভ কিসের? তোমরা পৃথিবীকে ছোট করে নিয়ে এসেছ হাতের মুঠোয়। তোমরা কতটা ভাগ্যশালী! চিন্তা করে দেখেছ কখনো? মেয়েদের কথাই ধরো, আমাদের এই যুগে ভারতবর্ষের মেয়েরা কতটা অবহেলিত। কতটা দুর্ভোগ তাদের সারাটা জীবন ধরে বইতে হয়, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আমাদের চারপাশ... তোমরা তো এই বাঁধাগুলো পেরিয়ে গেছো, তাই না?'
অমৃতা চিন্তিত মুখে বলে , 'তা ঠিক, কিন্তু তবুও.. তবুও কিসের যেন একটা খুব বড়সড় অভাব আছে আমাদের সময়টায় জানেন? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একটা আলো, একটা সত্যিকারের দ্যুতি প্রয়োজন আমাদের, আপনাদের মতো মানুষের মধ্যে দিয়ে যেই দ্যুতিটা সর্বসাধারণের ভেতর ছড়িয়ে যাবে। দূর হবে সমাজের সমস্ত কলুষতা। আমার মনে হয়, আমরা বুঝি সেই দ্যুতির অভাবেই এখনো প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারিনি।'
রবি ঠাকুর দুর্বোধ্য হাসলেন , 'ব্যপারটা ঠিক তা নয় খুকি! তোমাদের যুগেও আনাচে কানাচে অনেক জ্ঞানীগুণী লোক লুকিয়ে আছেন। সমাজের জন্য তাঁরা ভাবছেনও খুব। কিন্তু তোমরা ঠিক এই মূহুর্তে তা অনুধাবন করতে পারছ না। তোমাদের ঠিক এক শতাব্দী পরের ছেলেমেয়েরাও দেখবে ঠিক তোমার মত করেই ভাববে। হয়ত তোমাদের যুগে জন্মানো কোনো মহাপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক একইভাবে সে তার নিজের যুগটি নিয়ে আফসোস করবে। বাস্তবিক কথা হলো এই যে, প্রতিটি যুগেরই খারাপ ভালো দুইই আছে। সেই অর্থে চিন্তা করতে গেলে প্রতিটি যুগই একেকটা স্বর্ণযুগ, কিন্তু সেই উপলব্ধিটা আমাদের মাঝে কাজ করে সময়টা গত হয়ে যাবার পর। মানব মনের এই এক অদ্ভূত রহস্য, সে কখনো নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।'
অমৃতা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল , 'হয়ত!'
জানালা দিয়ে হু হু করে মাঝরাত্তিরের হাওয়া আসছিল। সেই হাওয়ায় উড়ছিল জানালায় ঝোলা লেসের পর্দা, কবিগুরুর লেখার কাগজ।
অমৃতার চোখে ঘোর। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম বাজনা। সত্যি কি সে কবি গুরুর সামনে বসে আছে? মন খারাপের সময় গুলোতে এই মানুষটার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে বসে থাকে। আজকে কি তবে সেই শুভক্ষণ চলে আসলো? তার বুকের ভেতর তোলপাড় হয়, পৃথিবীটাকে হঠাৎই স্বর্গ বলে ভ্রম হয়। এলোমেলো লাগতে থাকে সব কিছু।
চোখ খুলে দেখল সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। বুকের ওপর পড়ে আছে খোলা ডায়রি। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে কবিগুরুর লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন লেখা,
'ওগো তরুণী!
ছিল অনেক দিনের পুরনো বছরে
এমনি এক খানি নতুন কাল
দক্ষিন হ়াওয়ায় দোলায়িত সেই কালেরই আমি
মুছে আসা ঝাপসা পথ বেয়ে এসে পড়েছি ..
বনগন্ধের সংকেতে
তোমাদের এই আজকে দিনের নতুন কালে।
পার যদি মেনে নিও , আমায় সখা বলে।
হে তরুণী ! আমাকে মেনে নিও তোমার সখা বলে,
তোমার অন্য যুগের সখা'