arijit bhattacharya

Classics

2  

arijit bhattacharya

Classics

নীলগ্রহে আগন্তুক

নীলগ্রহে আগন্তুক

5 mins
944


ভারতভূমের উত্তরাংশে শুভ্র তুষার কিরীটী পরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে গিরিরাজ হিমালয়। গগনচুম্বী অভ্রভেদী এক একটা শৃঙ্গ- ত্রিশূল,নন্দাদেবী,ধৌলাগিরি,কাঞ্চনজঙ্ঘা,সাগরমাথা, কৈলাস,কুলাকাংরি, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি। ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট আর ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষে জন্ম নেওয়া অভ্রভেদী হিমালয় শুধু ভারতকে মধ্য এশিয়ার শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়া থেকে রক্ষাই করে নি,শুধু ভারতীয় সমভূমিকে রুক্ষ তিব্বত মালভূমি থেকে পৃথকই করে নি,ভারতের সভ্যতা আর সংস্কৃতিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ গুহা থেকেই সম্ভবা হয়েছেন পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা। যুগে যুগে হিমালয়ের গিরিপথ থেকেই এসেছে গ্রীক থেকে শুরু করে পাঠানরা, যারা পরে ভারতমায়ের মধ্যেই লীন হয়েছেন,সমৃদ্ধ হয়েছে জম্বুদ্বীপের সংস্কৃতি। মা দুর্গারই তো আরেক রূপ হিমালয়নন্দিনী পার্বতী। এই হিমালয়ের তুষারাবৃত দুর্গম স্থানেই তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন প্রাচীন যুগের ঋষিরা। 

তাই তো আজও হিন্দু ধর্মে হিমালয়ের স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান ছড়িয়ে আছে হিমালয়ের বুকের ওপর। আছে ভগবান হরির কেদারনাথ -বদ্রীনাথ,হরের অমরনাথ, কাটরায় বৈষ্ণোদেবী মন্দির,কুলাকাংরি। এখানেই পরম গৌরবে বিরাজমানা গঙ্গোত্রী,যমুনোত্রী,পিণ্ডারী। হিমালয় যেন শুধু কোনো পর্বত নয়, প্রকৃতির ওপর বিরাজমান তুষারে ঘেরা একচিলতে স্বর্গ। এমন এক ল্যান্ডস্কেপ যে কবির মনে জাগিয়ে তোলে এক অনন্য অনুভূতি,মনে করিয়ে দেয় তাকে ভুলে যাওয়া ছন্দ। আর এই হিমালয়েরই কন্যা তথা মা শক্তিরই অপর রূপ- নন্দাদেবী। 

পশ্চিমে ঋষিগঙ্গা ভ্যালি,পূর্বে গৌরীগঙ্গা ভ্যালি -তার মাঝে বিরাজ করছেন কুমায়ুন হিমালয়ের কন্যা, পূর্ণযৌবনা শক্তিস্বরূপা তুষারমুকুটপরিহিতা নন্দাদেবী।উত্তরাখণ্ডের চামোলী,পিথোরাগড় আর বাগেশ্বর জুড়ে মোটামুটি 2 কিমি দীর্ঘ এই পর্বত একটি নয়,দুটি শিখরের সমন্বয়ে তৈরি। পশ্চিমের উচ্চতর দুর্গম শৃঙ্গ নন্দাদেবী নামে বিখ্যাত হলেও পূর্বদিকের অপেক্ষাকৃত অনুচ্চ শৃঙ্গটি সাধারণ স্থানীয় মানুষের কাছে হিমালয়দুহিতা নন্দাদেবীর কনিষ্ঠ ভগিনী সুনন্দাদেবী নামেই পরিচিত। পূর্বদিকে রয়েছে পাছু হিমবাহ,দক্ষিণপূর্বে বিদ্যমান নন্দাঘুন্টি হিমবাহ। পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশিখরগুলির মধ্যে 23 তম স্থানে বিদ্যমান এই নন্দাদেবী সমগ্র ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ , কাঞ্চনজঙ্ঘার পরেই। তবে পুরোপুরিভাবে ভারতের মধ্যেই অবস্থিত এমন শৃঙ্গগুলির মধ্যে নন্দাদেবী উচ্চতম। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ ও ভাগবত গীতায় যেমন দেবী হিসাবে নন্দাদেবীর উল্লেখ আছে, তেমনই 1982 সালে প্রতিষ্ঠিত নন্দাদেবী ন্যাশনাল পার্ক জীববৈচিত্র ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্থান করে নিয়েছে UNESCO এর তালিকাতে। এখানে নিশ্চিন্তে বিচরণ করে হিমালয়ান মাস্ক ডিয়ার, তুষারচিতা,তুষারভল্লুক আর লেঙ্গুর। এখানে ফার,বার্চ,রডোডেনড্রন আর জুনিপারের সবুজ অরণ্য যেন কোনো সুদক্ষ চিত্রশিল্পীর হাতে অঙ্কিত ক্যানভাস। এখানে লাইকেনও খুব কমন জিনিস।

নন্দাদেবীর শিখরে শীতল সমীরণের মধ্যে সূর্যোদয়ের রক্তিম দৃশ্য অতি মনোহর, মনে হয় পৃথিবীর কোলে যেন নেমে এসেছে একচিলতে স্বর্গ। নন্দাদেবী মানেই পিথোরাগড়,যোশীমঠ,নন্দাদেবীর মন্দির ,চোখ জুড়ানো ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস।এক কথায় পৃথিবীর সুন্দরতম স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম,কিন্তু এমন অনন্য সুন্দর স্থানেই ঘটে থাকে রক্তজল করা বিভীষিকাময় ঘটনা।

সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। তখন পৃথিবীর বুকে মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন। ভারতেও মেহেরগড়ে সভ্যতার তখন ব্রাহ্মমুহূর্ত। আর এই সভ্যতার ব্রাহ্মমুহূর্তে উষাকালে শুভ্রধবল কিরীটী পরে দাঁড়িয়ে আছেন উদ্ভিন্নযৌবনা নন্দাদেবী। পৃথিবী জেগে উঠছে। বইছে মৃদুমন্দ বায়ু। স্বচ্ছ নীলাকাশের বুকে তখন নানা রঙের খেলা। নতুন দিনের বারতা নিয়ে উদিত হচ্ছেন দিবাকর। সেই রক্তিম অপরূপ আলো শুভ্র তুষার কর্তৃক প্রতিসৃত ও বিচ্ছুরিত হয়ে মায়াবী প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করছে। "ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর", চারদিকে এক অপরূপ শান্তভাব বিরাজ করছে। কিন্তু এই শান্তি,এই সৌন্দর্য,এই মুগ্ধতা বেশিক্ষণের জন্য স্থায়ী হল না। সহসাই এই প্রেমের রাজ্যে ঘটল উল্লেখযোগ্য পটপরিবর্তন।

হঠাৎই নীলাকাশের পটভূমিতে দেখা দিল এক অগ্নিপিণ্ড,অভিকর্ষের টানে ভূমে পতিত হচ্ছে। এটা কি উল্কা না কি ধূমকেতু। না,উল্কা নয়,জিনিসটা কাছাকাছি আসতেই বোঝা গেল তার স্বরূপ-একটা প্রকাণ্ড অগ্নিময় চাকতি। না, চাকতি নয়,এবার ভূপৃষ্ঠের আরো কাছাকাছি চলে এসেছে জিনিসটা। এ যেন এক যান,বিশেষ প্রযুক্তিতে বানানো এক যান যে প্রযুক্তি সম্পর্কে এই নীলগ্রহের বাসিন্দারা সম্পূর্ণ অনবহিত। যেন থমকে গিয়েছে সময়!


বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষণে যানটায় অগ্নিসংযোগ হয়েছে ঠিকই,কিন্তু বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি যে হয় নি,সেটা যানটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।আর পৃথিবীতেও কেমন যেন এক অদ্ভুত পরিবেশ।মৃদুমন্দ বয়ে চলা উষার শীতল সমীরণও যেন থমকে গেছে। এ কি স্বাভাবিক নিয়মেই হয়েছে,না কি কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার পূর্বাভাস। আচ্ছা,এই অত্যাধুনিক যানটা কি পৃথিবীতে এসেছে আরোও উন্নততর কোনো সভ্যতার বার্তা নিয়ে!

অবশেষে সময় নিয়ে এল উত্তর। নীলগ্রহের বুকে ল্যান্ড করল সেই হাজার হাজার আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে আসা আগন্তুক। অবশেষে এক যান্ত্রিক ধ্বনির সঙ্গে খুলে গেল যানের দরজা,ততক্ষণে নিভে গেছে আগুন। ধীরে ধীরে আকাশগঙ্গার একমাত্র যে গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে,সেই গ্রহের বুকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এসে দাঁড়াল আগন্তুক। আহা,কি অপরূপ দৃশ্য। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। লাল ফুল ফুটেছে রডোডেনড্রনে। তুষারে ঢাকা আকাশচুম্বী পর্বতশৃঙ্গ যেন স্রষ্টাকে জানার ধ্যানে সমাহিত। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘপুঞ্জ।

আর,মা ধরিত্রীও মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকল তাকে। আগন্তুক দ্বিপদ,মূল্যবান রূপোলী বর্ম পরিহিত,উচ্চতায় ছ ফুট ,কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো লম্বা চুল,চওড়া কপালে বুদ্ধি আর চিন্তনশীলতার ছাপ সুস্পষ্ট,নীল চোখে প্রেমের বার্তা, আর হাতে যেটা সেটা সম্পর্কে নীলগ্রহের কেউই অবহিত নয়। দ্বিপদ এই আগন্তুক অনেকটা তখনকার সবচেয়ে উন্নত জীব হোমো সেপিয়েন্সের মতো হলেও তাদের থেকে অনেকগুণ উন্নত। এ যেন হোমো সেপিয়েন্সেরই হাজার বছর পরের বিবর্তিত রূপ। পৃথিবীমাতা মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকলেন তারই সবচেয়ে উন্নত জীব মানুষ কি এতোটা উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে! পারবে কি কোনোদিনও! না হলে এই আগন্তুকই হোক তার বুকে সভ্যতার পথপ্রদর্শক। মুগ্ধ নয়নে রহস্যময় আগন্তুককে দেখতে থাকল পৃথিবী। বইতে থাকল শীতল সমীরণ,আগন্তুকের পদচুম্বন করার জন্য উড়ে এল তুষারকণা,হাসি ফুটল আগন্তুকের মনে,ফিরে এল স্বস্তি। না তাকে ফিরিয়ে দেয় নি,বরং অভ্যর্থনাই জানিয়েছে আকাশগঙ্গার নীলগ্রহ।

পৃথিবীও মুগ্ধ নয়নে নিরীক্ষণ করতে লাগল মানবজাতির ভবিষ্যকে। তখন এই নীলগ্রহও জানে না,আগন্তুকের হাতের ঐ অদ্ভুত অস্ত্র হাজার বছর পরে লেজার গান নামে অভিহিত হবে। এদিকে ভিন গ্রহ থেকে আগত রহস্যময় আগন্তুককে দেখে অ্যালপাইন গুল্মের আড়ালে থমকে গেছে তুষারচিতাও।

হঠাৎই ঘটল সেই অদ্ভুত পরিবর্তন। হঠাৎই আগন্তুকের শরীর বিকৃত হতে লাগল, আর সেই শরীরের চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এল সহস্রপদবিশিষ্ট মাকড়সার ন্যায় এক অদ্ভুত প্রাণী। কালচে লাল রঙের এক অতিকায় বিভীষিকা। মানুষেরা যেমন পুরনো পোষাক ছেড়ে নতুন পোষাক পরে,এই বিভীষিকা যেন নিজের পুরনো পোষাক ছেড়ে অতি হিংস্র নগ্নরূপ ধারণ করেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা,প্রাণীটার মুখের গড়ন আগন্তুকের মতোই। কোথায় দেবদূত, কোথায় সভ্যতার প্রাণপুরুষ,এ যেন এক নরকের কীট। তুষারচিতার দিকে নিজের বিষাক্ত লালা ছিটিয়ে দিল জীবটা, কিন্তু সেটা গায়ে লাগার আগেই পালাতে সক্ষম হল তুষারচিতা। বিভীষিকাপূর্ণ গর্জনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল জন্তু, আর সবচেয়ে বড়ো কথা ওর আকৃতিও এখন অতিকায় থেকে অতিকায়তর হচ্ছে।মোটামুটি নরকের দৈত্য বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু নন্দাদেবী তো সাক্ষাৎ দেবী আদিশক্তি,তিনি তো ভবানীর আরেক রূপ। তিনিই বা কেন এরকম দানবের প্রতিস্পর্ধা সহ্য করবেন। আকাশে পূর্ণতেজে উদিত হয়েছেন দিবাকর। তুষার থেকে প্রতিফলিত হওয়া সূর্যের প্রখর আলো সহ্য করতে পারল না দানব,হয়তো এই আলোর সাথে সে পূর্বপরিচিত নয়। জ্বলে উঠল তার সহস্রভুজ অতিকায় শরীর,কয়েক মুহূর্ত পরেই একমুঠো ভস্মে পরিণত হল সে। প্রকৃতির মধ্যে ফিরে এল আগের মতো শান্ততা।

শুধু জানা গেল না আগন্তুকের পরিচয়। কে সে,কেন এসেছিল এই গ্রহে। সে কি এখানে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে এসেছিল, সে কি এখানে শিকার ধরতে এসেছিল,না কি হতভাগ্য সে নিজেই শিকারে পরিণত হয়েছিল কোনো ক্রুরের কাছে। পলাতক তার মনে হয়েছিল এই নীলগ্রহই হয়ে উঠতে পারে তার আশ্রয়দাতা। কিন্তু শেষে সে হয়তো পালাবার আগেই শিকারে পরিণত হয়েছিল শয়তানের। যাই হোক, এই সবের উত্তর তো মহাকালই দেবে। আপাতত এখন পৃথিবীর বুকে শরতের প্রাতঃকালের অভিরাম সৌন্দর্য প্রতিভাত।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics