STORYMIRROR

Dola Bhattacharyya

Tragedy Classics Others

4  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Classics Others

না মিটিতে আশা

না মিটিতে আশা

19 mins
392


                         ১

গ্রামের পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে ফুলেশ্বরী নদী। এত স্বচ্ছ যে তলার নুড়ি পাথরগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট করে দেখা যায়। গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় এই ফুলেশ্বরী কে ঘিরেই। তাই গ্রামের নামও ফুলেশ্বরী। কি মিষ্টি নাম, ফুলেশ্বরী। অলস ছন্দে শান্ত মেয়েটির মত গ্রামের কোল ঘেঁষে কেমন বয়ে চলেছে! ভরা বর্ষায় ওর দুকূল ছাপানো সজল রূপ ভারী মনোমুগ্ধকর। পথিকের চোখ কে তৃপ্তি দেয়। 

ফুলেশ্বরী কিন্তু সত্যি ভারী শান্ত। তীব্র জলোচ্ছাসে কখনও গ্রাম ভাসায়নি, ঘরও ভাঙেনি কারও। বরং ওরই কল্যাণে গ্রামের মাটি হয়েছে সরস। এ গ্রামের মাটিতে যে সোনা ফলে। 

ফুলেশ্বরীর তীরে ছুটোছুটি করে খেলা করে মিনু আর কিশোর। গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনা করে ওরা। কিশোর দুই বছরের বড় মিনুর থেকে। ছুটতে ছুটতে বেদম হয়ে পড়ে মিনু, "কি-শো-র, এবার দাঁড়া, আর পারছি না। এই দ্যাখ, কি এনেছি তোর জন্য!" 

"কি এনেছিস রে? নারকোল নাড়ু! তোর ঠাকমা করেছে বুঝি?" 

মিষ্টি হেসে কয়েকটা নাড়ু কিশোরের দিকে এগিয়ে দেয় মিনু। 

"মাত্র এইকটা! আর কটা আনতে পারলি না!" 

চোখ পাকায় মিনু," হ্যাংলা কোথাকার!" 

নাড়ু চিবোতে চিবোতে নদীর ধারে পা ছড়িয়ে বসে দুজনে। পাঠশালা থেকে ফেরার পথে রোজ দুপুরে এখানে আসে ওরা। কোনো কোনো দিন ওদের অন্য বন্ধুরাও আসে। যোগ দেয় খেলায়। খেলা জমে ওঠে বেশ। খানিকটা খেলার পর সঙ্গীরা বাড়ি চলে যায়। থাকে শুধু মিনু আর কিশোর। অনেক গল্প করে ওরা। তারপর বিকেল হয়ে আসছে দেখে দুজনেই উঠে পড়ে।

   গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের মেয়ে মিনু। ভালো নাম মিনাক্ষী। খুব বড়লোক ওরা। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভর্তি গরু, পুকুর ভর্তি মাছ, কি নেই ওদের! মিনুর মাকে ঠিক যেন দূর্গা প্রতিমার মত দেখতে। অনেক বার দেখেছে কিশোর, কাছে গেলে ফুল, চন্দন, ধুপ, ধুনো মিশ্রিত একটা সুন্দর গন্ধ বেরোয় গা থেকে। খুব ভালো লাগে কিশোরের। 

   কিশোরের বাবার ফুলের ব্যবসা। গঞ্জে একটা ছোট মত দোকানও আছে ফুলের। নিত্য ফুলের যোগান দিতে হয় মিনুদের বাড়ি, রাধামাধবের পুজোর জন্য। কিশোরই ফুল নিয়ে যায় রোজ। আবার কোনো কোনো দিন এক আধটা ফুল গিন্নীমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসে কিশোর। বাণীমঞ্জরী বলেন," আমার রাধামাধবের পুজোর আগেই ফুল চাইছিস তুই!" ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে কিশোর। হেসে বলেন বাণীমঞ্জরী, "আচ্ছা নে, তুই ও তো আমার গোপাল ঠাকুর"। খুশিতে দুচোখ চিক্ চিক্ করে ওঠে কিশোরের। 

বাড়ি ফিরতে মা খুব বকাঝকা করে। "পুজোর আগেই গিন্নীমার কাছে এভাবে ফুল চাস তুই! ঠাকুর পাপ দেবে তো এতে"। সরল নিস্পাপ চোখদুটো তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে কিশোর, "পাপ কি মা" ? ছেলের এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না নলিনী। 

    বিকেলে ফুলেশ্বরীর ধারে এসে মিনুকে ফুলটা দেখায় কিশোর। ফুলটা দেখে মুখ বেঁকায় মিনু, বলে," এটা কি আমার জন্য?" 

ঘাড় নাড়ে কিশোর, "পছন্দ হয়নি তোর?" নিঃশব্দে হাত বাড়ায় মিনু। 

"এটা তোর চুলে লাগিয়ে দিলে খুব সুন্দর দেখাবে তোকে জানিস! আয়, লাগিয়ে দই" । কিশোরের কাছে না এসে দৌড় লাগায় মিনু। চোখে জল এসে যায় কিশোরের। রাগ করে ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিতেই দৌড়ে এসে ওটা কুড়িয়ে নেয় মিনু। মুচকি হেসে বলে," এমা! তুই রাগ করলি" ! 

"কি করব বল! তুইই তো রাগিয়ে দিলি আমাকে।" 

" আচ্ছা। আর রাগাব না"। ফুলটা নিয়ে কিশোরের খুব কাছাকাছি সরে আসে মিনু, "নে, এটা লাগিয়ে দে আমার চুলে।" মিনুর চুলের ক্লিপের সাথে ফুল টা আটকে দেয় কিশোর। একলাফে কিশোরের গলা জড়িয়ে ধরে মিনু, "এবার বল, কেমন দেখাচ্ছে আমাকে"? 

" খুব সুন্দর। তোকে খুব সুন্দর দেখতে রে মিনু"। বলাই বাহুল্য, কিশোরের বয়স আট, আর মিনুর ছয়। 

                            ২

রোজ সকালে অনেক গুলো ফুলের মালা গাঁথতে হয় নলিনীকে। বিয়ের মরশুমে ফুলের মুকুট, বাজু এসবও করতে হয়। কিশোর মুগ্ধ হয়ে দেখে মায়ের হাতের কাজ। মনে মনে নিজের মাকে ওইসব গয়না পরা অবস্থায় কল্পনা করে রাতে স্বপ্ন দেখে, মায়ের পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, মাথায় ফুলের মুকুট, গলায় মালা, হাতে বাজু। গা ভর্তি ফুলের গয়না পরে একটা সুন্দর জলাশয়ের মাঝখান থেকে একরাশ পদ্ম তুলে নিয়ে উঠে আসছেন মা। ঘুম ভাঙতে একটা ভীষণ ভালো লাগার আবেশে মনটা ভরে গেল ওর। খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আকাশ উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর। একছুটে বাইরে এসে দাওয়ায় মায়ের পাশে বসল ও। একরাশ ফুল নিয়ে মালা গাঁথছেন নলিনী। কিশোরও একটু একটু করে শিখছে ফুলের কাজ। মায়ের পাশে বসে বেশ সুন্দর মালা গাঁথতে পারে এখন। আবার এক একদিন বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়েও বসে। বাবার হাতের কাজ লক্ষ্য করে। অপটু হাতে সাহায্য করতেও চেষ্টা করে। খুব ইচ্ছে, বড় হয়ে বাবার কাজটাই ও করবে। কিন্তু বনমালীর ইচ্ছে, ছেলে একটু লেখাপড়া শিখুক। 

মাকে রাতের স্বপ্নের কথা বলতেই হাসতে হাসতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নলিনী। সস্নেহে বলে," কি চাই" ? "একটা পদ্মফুল দেবে আমাকে" ? আধফোটা স্বরে বলে কিশোর। অবাক হয়ে বলে নলিনী, "সে কি রে! একেবারে পদ্ম" ! 

"দেবে আমাকে" ? অনুনয় ঝরে পড়ে ওর গলা থেকে। 

একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে নলিনী, "না রে। পদ্ম সব গোনাগুনতি। বাবা জানতে পারলে রাগ করবে। আর শোন, গিন্নীমা র কাছেও চাস না যেন"। মুখ ভার করে মায়ের সামনে থেকে সরে যায় কিশোর। 

           দেখতে দেখতে পাঠশালার পাঠ শেষ হল কিশোরের। একটু দূরে ছেলেদের হাইস্কুলে ওকে ভর্তি করে দিল বনমালী। মিনু এখন পাঠশালার ছুটি হলে সোজা বাড়ি চলে যায়। দুপুর গড়িয়ে গেলে নদীর ধারে এসে অপেক্ষা করে কিশোরের জন্য। আর কিশোর! স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে বইটা রেখেই কোনওরকমে নাকে মুখে কিছু গুঁজে একছুটে চলে আসে নদীর ধারে। তারপর শুরু হয় ওদের খেলা। খেলতে খেলতে যখন আর ভাল লাগেনা, তখন ওরা গল্প করে। নতুন স্কুলের বন্ধুদের সম্পর্কে, স্যারদের সম্পর্কে কত কথা বলে যায় কিশোর। ভুগোলের স্যার কত দেশবিদেশের গল্প বলে। আবার অঙ্কের স্যার টা কেমন কাঠখোট্টা। সব কথা বলা চাই মিনুকে। চুপ করে শোনে মিনু। সূয্যি ঠাকুরকে পাটে বসতে দেখলে উঠে পড়ে ওরা। ফিরে আসে যে যার বাড়িতে। 

    আরও দুটো বছর এভাবেই কাটল। পাঠশালার পড়া শেষ হয়ে গেল মিনুর। মিনুর বাবা ঠিক করলেন মেয়েকে এবার ওর পিসির বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন এখানে মেয়েদের কোনো ভালো স্কুল নেই। পিসির কাছে থেকে পড়াশোনা করবে মিনু। ওখানে ভালো স্কুলও আছে। সেই স্কুলেই ওকে ভর্তি করে দেবেন রমানাথ বাবু। খুব কাঁদল মিনু। কান্না চেপে মুখের হাসি বজায় রেখে পুরো ব্যাপারটাই মেনে নিলেন বাণীমঞ্জরী। মেয়েকেও বোঝালেন অনেক করে। 

নির্দিষ্ট দিনে চলে গেল মিনু। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। কদিন একা একাই শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াল। তারপর আবার সব স্বাভাবিক। আবার আগের মতই মিনুদের বাড়িতে ফুল দিতে যায় রোজ। মায়ের সঙ্গে মালা গাঁথে, পড়াশোনা করে, স্কুলে যায়। ইদানিং একটা স্বপ্ন দেখছে ও, আর সেটা বেশিরভাগ সময়ই জেগে জেগে। ওর খুব প্রিয় দুজন বন্ধু কে বলেওছে কথা টা। ওরা প্রশ্ন করেছে কিশোর কে, "হ্যাঁ রে কিশোর! মিনুর সঙ্গে তোর খুব ভাব, তাই না রে" ? 

 "হ্যাঁ রে। মিনুকে আমার খুব ভালো লাগে। বড় হয়ে ওকে আমি বিয়ে করব দেখিস। বাবার মত ফুলের কাজ শিখব আমি। আর মিনুকেও শেখাব ।আমার মা যেমন ঘরে বসে আমার বাবা কে সাহায্য করে, মিনুও সেরকম আমাকে সাহায্য করবে। ও ফুল দিয়ে মালা গাঁথবে, গয়না তৈরি করবে। আর আমি সেগুলো দোকানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করব"। কিশোরের এই ইচ্ছার কথা বন্ধুদের মারফত তাদের বাবাদের কানে উঠল। সেখান থেকে রমানাথ বাবুর কানে উঠতেও দেরী হলো না। তেরো বছরের কিশোরের স্বপ্নটার বাস্তবে যাতে ছায়াপাত না ঘটে, সেজন্য সাবধানতা অবলম্বনই শ্রেয়, ভাবলেন রমানাথ বাবু। মিনুকে একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। স্কুলের ছুটি হলে পিসির বাড়িতেই আসবে মিনু। মা বাবার সঙ্গে ওখানেই দেখা হবে ওর। কোমল বুকের তলায় সদ্য জন্ম নেওয়া ভালবাসার কোরকটিকে এভাবেই সকলের অগোচরে নিষ্ঠুর ভাবে উপড়ে ছিঁড়ে ফেলা হল। দুটি কচি প্রাণের মর্মন্তুদ আর্তনাদ কর্ণগোচর হল না কারও। 

                           ৩

এক বছর বাদে বাড়ি এল মিনু। ঝুলন পূর্ণিমায় খুব ঘটা করে রাধামাধবের পুজো হয় ওদের বাড়িতে। সেই উপলক্ষে রমানাথ বাবু বাড়ি নিয়ে এসেছেন মেয়েকে। প্রতিদিনের মত সেদিনও সকালে কিশোর ফুল দিতে গেল মিনুদের বাড়িতে। আজ ওর মনে খুব আনন্দ। পুজো হবে মিনুদের বাড়িতে। কত কিছু ভালোমন্দ রান্না হবে। মিনুর মা আবার ভোগ পাঠাবেন ওদের বাড়ি। ভাবতেই কি ভালো লাগছে। ঠাকুরের ভোগ খেতে খুব ভালোবাসে ও। 

সাজি ভর্তি ফুল নিয়ে ঠাকুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। ঠাকুরমশাই পুজোর জোগাড় করছেন। গিন্নীমাও ব্যস্ত। সাহায্য করছেন ঠাকুরমশাই কে। কিন্তু দরজার দিকে পেছন ফিরে বসে ও কে চন্দন বাটছে! একপিঠ খোলা চুল! চমকে উঠল কিশোর। মিনু! হঠাৎ ধেয়ে আসা এক ঝলক টাটকা বাতাস মিনুর খোলা চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল। মুহূর্তের জন্য থেমে গেল হাতের কাজ। তারপর আবার স্বাভাবিক। বাণীমঞ্জরী বললেন, "কিশোর! এসেছিস বাবা! একটু দাঁড়া" । কাচা জামাকাপড় পরে এলেও ঠাকুরঘরে ঢোকার অধিকার কিশোরের নেই। হাতের কাজ সেরে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন বাণীমঞ্জরী। চৌকাঠের সামনেটায় গঙ্গাজল ঢেলে দিলেন খানিকটা। সাজি টা ওখানেই রাখল কিশোর। 

পুস্পপাত্রের ওপর ফুল গুলো সাজাচ্ছেন বাণীমঞ্জরী। গোলাপ, চাঁপা, যুঁই, বেল। "বাঃ! কটা বকুল ফুলও রয়েছে দেখছি। ও কিশোর, আর কটা বেলপাতা আনতে পারলি না বাবা। যাক গে, যা আছে ওতেই চালিয়ে নেব খন" । ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল মিনু, "উঃ মা! এই গরমে শাড়ি পরে বসে থাকতে আর পারছি না আমি" । 

"তা যা না। কে বলেছে তোকে বসে থাকতে! শাড়িই বা কে পরতে বলেছে তোকে"! মাকে কথা টা শেষ করতে না দিয়েই একছুটে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিনু, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে। ছুটন্ত মিনুর শাড়ির আঁচল টা মুহূর্তের জন্য কিশোরের মুখের ওপর এসে আছড়ে পড়ল। দুচোখে অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল কিশোর। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে মিনুকে। নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে ও আজ। কানে সোনার দুল, গলায় সোনার চেন। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে দুহাতে আবার নীল রঙের কাঁচের চুড়ি পরেছে। আরে! রাধারাণীর অঙ্গেও যে আজ নীল রঙের পোশাক। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। চমক ভাঙল গিন্নীমার ডাকে, "ও কিশোর! এই নে বাবা তোর ফুলের সাজি।" 

তিনতলায় ঠাকুর ঘর। সেখান থেকে ধীর পায়ে একতলায় নেমে এল কিশোর। মনটা ভারী হয়ে আছে। মিনু ওকে দেখেও না দেখার ভান করল! পায়ে পায়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে এল ও। দরজা দিয়ে বেরোবার সময়ে আবার বিপত্তি। একরাশ দমকা হাওয়ার মত কোথা থেকে ছুটে এল মিনু। বাইরে কোথাও গিয়েছিল। এখন ফিরছে। আবার ওকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেয়েটা। যাবার সময় একটুকরো চৌকো কাগজ ওর হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে। কাগজটা কুড়িয়ে নিল কিশোর। কি যেন লেখা রয়েছে! 'বিকেলে নদীর ধারে এসো '। লেখাটা পড়ে চমকে উঠল কিশোর। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর করে লিখেছে মিনু। অদ্ভুত ভাল লাগায় মনটা ভরে গেল ওর। মিনু তাহলে ওকে ভুলে যায়নি। 

  "এত দেরি করে এলি কেন কিশোর? আমি সেই কখন থেকে তোর জন্য বসে আছি" । কপট রাগের সঙ্গে কথাগুলো বলল মিনু। এ বেলায় সেই নীল শাড়িটাই পরেছে ও। চুলগুলো খুব সুন্দর করে খোঁপা বাঁধা। কপালে নীল টিপ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মিনুকে। ওর পাশে বসতে বসতে কিশোর বলল, "তোর জন্য কি এনেছি দেখ মিনু"। 

 কই দেখি। হাত বাড়িয়ে দিল মিনু। ছোট আকারের একটা পিচবোর্ডের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই মিনু অবাক। পেতলের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি একটা, দোলনায় বসানো। দোলনাটা আবার ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। "বাঃ! কি সুন্দর" ! 

"তোর পছন্দ হয়েছে মিনু"? 

" হ্যাঁ। খুউব। এটা তুই কোত্থেকে কিনলি রে কিশোর" ? 

"রথের মেলা থেকে এটা তোর জন্যই কিনেছিলাম" । 

"এত সুন্দর জিনিসটা আমায় দিলি তুই। আমি এটা খুব যত্ন করে রেখে দেব।" খুশিতে দুচোখ চিকচিক করে উঠল মিনুর। 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ওরা। একটু পরে গ্রামের কতকগুলো বৌ জল নিতে এল। জল নিয়ে চলে যাবার সময় ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল ওরা। রাধুপিসি বলল, "কিরে মিনু! কতদিন বাদে বাড়ি এলি। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে রে তোকে"! রূপা বৌদি বলল, "আবার শাড়ি পরেছে দেখো। কত বড় দেখাচ্ছে। তা হ্যাঁ রে কিশোর! বন্ধুর সাথে কতদিন বাদে দেখা হল। ওর জন্য রাখী বানিয়েছিস তো? আর কদিন বাদেই তো রাখীবন্ধন।" 

"বানাবো পিসি" । নিস্পাপ হাসিতে ঝলমল করে উঠল কিশোরের মুখ। ওরা চলে গেলে পরিবেশটা হঠাৎ করেই যেন শান্ত হয়ে গেল। মিনু বলল," একটা গল্প বল না কিশোর"। ফুলেশ্বরীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে ছিল কিশোর।" গল্প! বাপ্পাদিত্যর গল্প শুনবি?" 

" বাপ্পাদিত্য! সে কে?" মিনু বিস্মিত ।

ক্লাস এইটে পড়া কিশোর, স্বপ্নের মত সুন্দর গল্প টাকে খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করল মিনুর কাছে। গল্প শেষ হয়ে গেলেও রেশ রেখে গেল বক্তা ও শ্রোতা দুজনের মনেই। 

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সোনার থালার মত গোল চাঁদ উঠেছে পুব আকাশে। সেই দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল দুজনে। 

"গল্প টা তোর ভালো লেগেছে মিনু?" 

"হ্যাঁ। কি সুন্দর করে বললি তুই! এটা তুই কোথায় পড়েছিস?" 

"এ গল্প টা আমাদের সিলেবাস আছে।" 

"সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার বাড়ি চল কিশোর। একটু বাদেই পুজো শুরু হবে।" মিনু বলল। কিশোরের চোখে মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল হঠাৎ," একটা জিনিস তো দেওয়া হয়নি তোকে। একটু অপেক্ষা কর।" 

" কি রে"! মিনু অবাক। 

" বলছি। তোর হাতে ওটা কিসের বালা রে? সোনার তাই না?" 

হ্যাঁ। মিনু বলল। 

একবার দে তো আমার হাতে। হাতের বালা খুলে নিঃসঙ্কোচে কিশোরের হাতে দিল মিনু। বালাটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখছিল কিশোর। ও জানে এটা খুব দামী গয়না। মিনুর বাবার অনেক পয়সা। পালে পার্বনে এরকম গয়না মিনু পরতেই পারে। মিনুর মা তো সবসময় কি সুন্দর সব গয়না পরে থাকে। ওর মাও গয়না পরে। শাঁখা পলার সঙ্গে বহু পুরনো হয়ে যাওয়া ব্রোঞ্জের চুড়ি দুগাছি, আর ততোধিক পুরনো কানের দুল একজোড়া। সরু লিকলিকে একটা হারও আছে মায়ের। ওটা ওর বৌকে দেবে বলে বাক্সে তুলে রেখে দিয়েছে মা। এই মুহুর্তে ওর সামনে দাঁড়ান মিনুর হাতে, কানে, গলায় যে গয়না গুলো রয়েছে, সেগুলোর তুলনায় ওর মায়ের গয়নাগুলো কিছুই নয়। তবুও এতটুকু হিংসে হচ্ছিল না ওর। মিনুর তাড়া খেয়ে সম্বিৎ ফিরল কিশোরের। 

"আয়, এটা তোর হাতে পরিয়ে দিই" । মিনুর হাতটা টেনে নিয়ে বালাটা ওর হাতে পরিয়ে দিল কিশোর। দূরে রাধামাধবের মন্দিরে আরতির শাঁখ ঘন্টা বেজে উঠল। "ওই দ্যাখ মিনু, ঠাকুরের আরতি শুরু হল। ঠিক এইরকম দিনে এইরকম সময়েই বাপ্পাদিত্য শোলাঙ্কি রাজকুমারী কে বিয়ে করেছিল। সেদিনও ঠিক এইরকম বড় চাঁদ উঠেছিল" । মিনু নির্বাক। একখণ্ড জলভরা মেঘ খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল গোল চাঁদটার দিকে, কেউই টের পায়নি ওরা। প্লাস্টিকের মধ্যে করে ভিজে কাপড় জড়িয়ে একটা বকুল ফুলের মালা পকেটে করে নিয়ে এসেছিল কিশোর। সেটা বার করে এবার মিনুর সামনে তুলে ধরল," এই দ্যাখ। এটা আমি নিজের হাতে গেঁথে এনেছি তোর জন্য। আজ আমি বাপ্পাদিত্য, আর তুই শোলাঙ্কি রাজকুমারী। তোকে আমি বিয়ে করব। তুই আমার বৌ হবি মিনু" ? মন্ত্রমুগ্ধের মত কিশোরের কথাগুলো শুনেছিল মিনু। হঠাৎ একটা বিজাতীয় ভয় গ্রাস করে ফেলল ওকে। ওর ছোট্ট বেলার চেনা বন্ধু টা কিরকম যেন অচেনা আচরণ করছে! অন্তর থেকে উঠছে সাবধান বাণী। মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঝংকার তুলছে সেই বাণী, 'এ ঠিক নয়, এ ঠিক নয়' । সেই বাণী অমান্য করার সাহস ওর নেই। কিশোর আবার বলে উঠল, "কিরে। বল না। হবি তো আমার বৌ" ? 

ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে মালাটা কেড়ে নিল মিনু। ঠোঁট দুটো কাঁপছে ওর। 

"মিনু" ! কিশোর অবাক। 

"না।" 

"মিনু!" 

"না না না" । ছুটতে শুরু করল মিনু। 

        পরদিন সকালে কাজের লোকের হাত দিয়ে কিশোরদের বাড়িতে কিছু প্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন বাণীমঞ্জরী। মিনুও সঙ্গে গেল। মিনুকে দেখে খুব খুশি হল নলিনী। আজও একটা শাড়ি পরেছে মিনু। "বাঃ! তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে" ! মিনুকে আদর করে কাছে টেনে নিল নলিনী। খুকুর মা বলল, "আজ বিকেলে চলে যাবে ও। তাই দেখা করতে এসেছে তোমার সঙ্গে" । প্রসাদ গুলো অন্য একটা পাত্রে রাখতে রাখতে খুকুর মা র সাথে কথা বলছিল নলিনী। সেই ফাঁকে ঘরে এসে কিশোরের বইপত্রগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল মিনু। কিছুক্ষণ বাদে খুকুর মা ডাকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। যাবার সময় ওকে আবার আদর করল নলিনী।" আবার আসিস মা। কিশোর তো এখন ইস্কুলে। সেই বিকেলে আসবে। এবেলা আর ওর সাথে দেখা হবে না তোর।" 

       মিনুর চিঠিটা রাতে পেল কিশোর। ওর বাংলা বইয়ের মধ্যে ঢোকানো ছিল। কিন্তু এখন তো পড়া যাবে না। যেকোনো মুহূর্তে বাবা মায়ের হাতে ধরা পড়ার ভয় রয়েছে। সারা রাত ঘুম এল না ওর। ভোরে উঠেই একছূটে বাড়ির বাইরে। পায়ে পায়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়াল ও। প্যান্টের পকেটে মিনুর চিঠিটা খচখচ করছে। কি লিখেছে মিনু! চিঠি টা বার করে পড়তে শুরু করল কিশোর - 

-কিশোর, তোর সাথে আমার আর দেখা হবে না। কাল নদীর ধারে বসে অতক্ষণ তোর সাথে গল্প করেছি বলে বাবা আমাকে খুব বকেছে। বাবা বলেছে,' অসময়ের ফল দামী হলেও খেতে খুব একটা ভালো হয় না' । আমার মনে হল কথা টা তোরও জানা উচিত। তাই তোকে জানালাম। তবে বাপ্পাদিত্যর কথা কাউকে আমি বলিনি। তোর দেওয়া রাধাকৃষ্ণের মুর্তি টা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। একটা গোপন কথা জানাচ্ছি তোকে, আমি কিন্তু তোর ছোটবেলার বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। বিশ্বাস কর, বৌ হতে আমার একদম ইচ্ছে করে না। আমি পড়াশোনা করতে চাই। তোর বাপ্পাদিত্যর মত আরও যে সব গল্প আছে, আমি সেগুলো সব পড়ব। তুইও পড়াশোনা করিস মন দিয়ে। 

                             ইতি - তোর বন্ধু, মিনু। 

                      ৪

সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছুক্ষন আগে। একটা দুটো করে তারা ফুটে উঠছে আকাশে। বৈশাখ মাস শেষ হতে চলল প্রায়। সন্ধ্যাবেলার এই সময়টায় বেশ সুন্দর ঝিরঝিরে হাওয়া দেয়। খুব ভালো লাগে। কিশোরের মনটা আজ ভীষন খারাপ। বেশ কদিন ধরেই মনটা ভালো নেই ওর। সেদিন সকালে বাবা যখন বললেন, 'মিনুর বাসর ঘর সাজাতে হবে ওকেই।' খুব খারাপ লেগেছিল ওর। 'কেন! ও ছাড়া আর কি কেউ নেই একাজটা করার জন্য' ? মায়ের কাছে যেদিন প্রথম মিনুর বিয়ের খবর টা শুনেছিল, তখন একটা কথাই মনে হয়েছিল ওর, মিনু তাহলে সত্যিই ওর বৌ হবে না! কৈশোরে দেখা সেই স্বপ্নের ছবি টা মনের ক্যানভাসে রং তুলি দিয়ে আঁকতে আঁকতে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে এসে সেটাকে সম্পুর্ণ করে তুলেছিল। আজ সেই ছবিটাই কেমন বিবর্ণ লাগছে ওর কাছে। নদীর ধারে বসে সেই থেকে ভেবেই চলেছে কিশোর। আচ্ছা, চোদ্দো বছরের একটা ছেলে কি এত গভীর প্রেমে পড়তে পারে! কুড়ি বছরের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে ছয় বছর আগে ফেলে আসা দুরন্ত কৈশোরটাকে দেখতে চেষ্টা করে ও। মনে পড়ে সেদিন খুব বড় একটা ভুল করার হাত থেকে রক্ষা করেছিল মিনু। মিনুকে ভুল বুঝেছিল ও। এই মুহুর্তে মিনুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় জল আসে ওর চোখে। নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে মিনু। শুভেচ্ছা জানাল ওকে, সুখী হোক মিনু। হলোই বা ও অন্যের বৌ। 

বাংলায় অনার্স নিয়ে বি এ পড়ছে কিশোর। আর ইচ্ছে থাকলেও এইচ এস দিতে পারে নি মিনু। তার আগেই ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। সেদিন একঝলক ওকে দেখতে পেয়েছিল কিশোর। ওকে দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি সেদিন। লাল রঙের ডুরে শাড়িতে ঠিক মা লক্ষ্মীর মতই দেখাচ্ছিল মিনুকে। কিশোরকে দেখে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিয়েছিল মিনু। 


বিয়ের দিন বাসরঘর সাজাচ্ছিল কিশোর। মুহুর্মুহু শাঁখ আর উলুধ্বনি জানিয়ে দিল, বর এসেছে মিনুর। পায়ে পায়ে মিনুর ঘরে এসে দাঁড়াল কিশোর। এই মুহুর্তে একাই বসে আছে মিনু। কিশোরকে দেখে একটুকরো সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। লাল রঙের বেশ বড় সাইজের একটা ফোটা গোলাপ বাড়িয়ে দিল কিশোর, মিনুর দিকে। ফুল টা গ্রহণ করল মিনু। ফুলের মাঝখানে জরি দিয়ে লেখা 'ক' অক্ষর টা বেশ জ্বলজ্বল করছে। অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মিনু। ঠিক ছোট বেলার মত একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল কিশোরের মুখে, বলল, "তোকে যে খুব ভালোবাসে, ওটা তারই নামের আদ্যক্ষর" । চমকে উঠল মিনু। গোলাপের ডাঁটিতে লুকোনো ছোট্ট একটা কাঁটা অসাবধানে ফুটে গেল ওর হাতে। একফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এল ক্ষতস্থান থেকে। ব্যথায় ভরে উঠল কিশোরের মন, "ইস্! কি করলি বলতো" ! আঙুল টা তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে ঢেকে নিল মিনু, ও কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে এখুনি। আমরা মেয়েরা এভাবেই আমাদের সব কষ্টকে লুকিয়ে ফেলতে পারি। তুই ভাবিস না কিশোর। আর কষ্টও পাস না। 

মিনুর কাজলটানা দুটো চোখের কোলে জলের আভাস চিকচিক করে ওঠে। 

       সকালে নদীর ধারে চুপ করে বসে আছে কিশোর। মিনুর লেখা চিঠি টা এইমাত্র ভাসিয়ে দিল ও ফুলেশ্বরীর জলে। একটু পরেই সামনের ওই রাস্তা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে মিনু। এইমুহূর্তে কত লোক ওদের বাড়িতে। কিশোর যাবে না ওই ভীড়ের মধ্যে। এখান থেকেই ও শুভেচ্ছা জানাবে মিনুকে। কাল সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। শরীর ভেঙে আসছে ওর। নদীর ধারে নরম ঘাসের ওপর শরীরটাকে এলিয়ে দিল কিশোর। ঘোর লেগে আসছে চোখ দুটোতে। আরে! ওই তো মিনু! কি আশ্চর্য! নদীর ধারে ভিজে কাপড়ে চুপ করে বসে আছে। সদ্য স্নান করে উঠেছে ও। চুল দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। পায়ে পায়ে ও এগিয়ে আসে মিনুর দিকে। চোখ তুলে তাকায় মিনু, কি দেখেছিস কিশোর? মুগ্ধ কিশোর বলে ওঠে, "সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে /বসিয়াছিলে উপল উপকুলে" ।

"দূর, সাগর কোথায় পেলি! এটা তো ফুলেশ্বরী নদী।" 

কিশোর হাসে, "তাই!" 

"হ্যাঁ। এখন কবিতা রাখ। আমায় সাজিয়ে দিবি না কিশোর" ! মিনুর সামনে ঝুড়ি ভর্তি নানা রকমের ফুল। একটা একটা করে ফুল দিয়ে ওকে সাজাতে লাগলো কিশোর। সব সাজ শেষ হলে উঠে দাঁড়ায় মিনু। মুগ্ধ আবেশে ওকে অনুসরণ করতে থাকে কিশোর। ফুলেশ্বরীর বুক থেকে উঠে আসা বাতাস স্নিগ্ধ পরশে আদর করে যায় ওদের। গুনগুন করে গেয়ে ওঠে কিশোর, 

"রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্।

ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্।।

ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।

পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দনচঞ্চলকরযুগশালী।

পততি পতত্রে বিচলতি পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্।

রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্।।

মুখরমধীরং ত্যজ মঞ্জীরং রিপুমিব কেলিষু লোলম্।

চল সখি কুঞ্জং সতিমিরপুঞ্জং শীলয় নীলনিচোলম্।"


 অনেকগুলো শাঁখের আওয়াজ আর উলুধ্বনির শব্দে ঘোর লাগা ভাবটা কেটে গেল কিশোরের। মিনু তাহলে সত্যিই শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে! এই সমস্ত তাহলে স্বপ্নই ছিল! 

                        ৫ 

তারপর অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। কিশোরের বয়স এখন বাষট্টি পেরিয়েছে। বৌ তো কবেই গত হয়েছে। ছেলেটা তখন মাত্র দুবছরের। সেই ছেলেরই ছাব্বিশ বছর বয়স এখন। বাবার ফুলের ব্যবসা এখন অনেক টা বাড়য়েছে কিশোর। আশপাশের পাঁচ ছটা গ্রামের মধ্যে সব থেকে বড় ফুলের দোকান ওর। বছরখানেক হল একটা ডেকরেটারের দোকান খুলেছে কিশোর। ছেলে জয়দীপকে বসিয়েছে সেখানে। ফুলের দিকটা নিজেই দেখে। 

   সময়ের সাথে সাথে গ্রামটার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কিন্তু নদীর পরিবর্তন নেই। ফুলেশ্বরী ঠিক আগের মতই গ্রামের পাশটি দিয়ে বয়ে চলেছে আপন ছন্দে। কিশোর এখন খুব ব্যস্ত। নদীর ধারে আসার সময়ই নেই ওর অভিমান হয় ফুলেশ্বরীর। কিশোর ভুলে গেছে ওকে। মিনুও ওকে ভুলে গেছে। ব্যথায় ভরে ওঠে ফুলেশ্বরীর বুক। ঝড় আসে কালবৈশাখীর। বড় বড় ঢেউ ওঠে নদীর বুকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টির সঙ্গে ফুলেশ্বরীর কান্না মিশে যায়। আকুল হয়ে ডাকে ফুলেশ্বরী - "কোথায় আমার রাই কমলিনী, আয় রে আমার রাখাল কিশোর।" 

     সেদিন কিশোর দোকানে আসতেই ওর কর্মচারী ফাগুয়া জানাল, "সুন্দরনগরের বসাক বাড়ি থেকে একটা অর্ডার এসেছে। শ্রাদ্ধবাসর সাজাতে হবে। আগামও দিয়ে গেছে" । কিশোর জিজ্ঞেস করে, "কবে" ? 

"এই তো, সামনের রবিবার।" 

" ঠিক আছে। তুই গিয়ে করে দিয়ে আসিস"। কারও বাড়িতেই এখন আর যেতে চায় না কিশোর। তিন চারজন কর্মচারী আছে ওর। তারাই এসব করে। মাঝেমধ্যে দুএকজন ধরে কিশোর কে।" না দাদা। আমরা আপনার হাতের কাজ চাই"। এসব ক্ষেত্রে বাধ্য হয় ও। তবে শ্রাদ্ধবাড়িতে একেবারেই যায় না। 

সুন্দরনগর! বসাক বাড়ি! নামটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে! সুন্দরনগরের বসাক বাড়ি নামকরা ব্যবসায়ী পরিবার। প্রচুর বৈভব ওদের। এছাড়াও নামটা কিভাবে যেন কিশোরের সত্ত্বার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। স্মৃতির সরণি হাতড়াতে থাকে কিশোর। আরে! ওই বাড়িতেই তো বিয়ে হয়েছে মিনুর। নাঃ। তাহলে তো যেতেই হয়। দীর্ঘদিন বাদে মিনু কে দেখার লোভ সামলাতে পারে না কিশোর। পুরোনো দিন গুলোর কথা মনে পড়লে অভিজ্ঞ প্রবীণ মানুষটার এখন হাসিই পায়। তবুও কোথাও যেন একটা অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে থাকে বুকের ভেতর। ঘটনা গুলোকে শুধুমাত্র ছেলেবেলার ছেলেখেলা বলে উড়িয়ে দিতে পারে না। 

   রবিবার সকালে নিজেই সুন্দরনগরের দিকে রওনা দিল কিশোর। সাইকেলে যেতে যেতে ভাবছিল ওকে দেখে চিনতে পারবে তো মিনু। কি বলবে ওকে দেখে! খুব অবাক হবে নিশ্চয়ই। চোখের কোণে জল, ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে কথা বলবে মিনু। প্রথম দর্শনে কি বলবে ও কিশোর কে?

 '' বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইত পরাণ গেলে।।

এতেক সহিল অবলা বলে।

ফাটিয়া যাইত পাষাণ হলে।।

দুখিনীর দিন দুঃখেতে গেল।

মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল?"

হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল কিশোর। কিসব আবোল তাবোল যে ভাবছে। অল্প বয়সে ও একটু ভাববিলাসী ছিলই। তার কিছু টা এখনও রয়ে গেছে ওর মধ্যে। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলে কিশোর। গান যে বড় ভালোবাসে ও। 

      আরিব্বাস! কি বড় বাড়ি! এই বাড়িতে মিনু থাকে! সদর পেরিয়ে পায়ে পায়ে ভেতরে এল কিশোর। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেউই লক্ষ্য করছে না ওকে। একটা চাকর গোছের লোককে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল কিশোর। বলল, "তোমাদের বাবু কে বলো শ্রাদ্ধবাসর সাজাবার জন্য পুস্পবিতান থেকে লোক এসেছে" । ঘটা করে নিজের দোকানের নামটা বলল কিশোর। একটু পরেই ভেতরে ডাক পড়ল ওর। বিশাল একটা ড্রয়িং রুম। এদিক সেদিক করে ছড়ানো গুটিকয় গদিমোড়া চেয়ার, সোফাসেট। ঘরের এককোণে সেগুন কাঠের স্ট্যান্ডে একটা বেশ দামী টিভি সেট শোভা পাচ্ছে। অবাক হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল কিশোর। 

"আপনি এসেছেন পুস্পবিতান থেকে?" সত্তর ছুঁই ছুঁই সৌম্যদর্শন একজন বৃদ্ধ। এখনও বেশ ঋজু নির্মেদ চেহারা। হাতজোড় করে নমস্কার করল কিশোর। আর কোনো বাক্য বিনিময় না করে উঁচু গলায় হাঁক পড়লেন বৃদ্ধ," স্বর্ণ, স্বর্ণ মা। এদিকে আয় তো একবার।" 

ডাকলে বাবা? ধীর পদক্ষেপে যে মেয়েটি ঘরে এসে ঢুকল, তাকে দেখে চমকে উঠল কিশোর। একদম মিনুর মত দেখতে। মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে অল্প কয়েকদিন হল বিয়ে হয়েছে ওর। চোখেমুখে শোকের চিহ্ন লেগে আছে। 

"আয় মা। ইনি ফুলের দোকান থেকে এসেছেন। ওপরে নিয়ে যা এঁকে। শ্রাদ্ধের ঘরটা উনি ই সাজিয়ে দেবেন।" 

"আপনি ফুল এনেছেন তো" ? প্রশ্ন টা কিশোরের উদ্দেশ্যে। 

"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই" । ফুলের ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করল কিশোর। দোতলার বারান্দা পেরিয়ে একদম শেষ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। খুব পরিপাটি করে সাজানো ঘর। গুনগুন করে গান গাইছিল কিশোর, 'চম্পা পারুল যুথী টগর চামেলা /আর সই সইতে নারি এই ফুল ঝামেলা'। যে মারা গেছে তার ছবি টা বিছানার ওপর বসান রয়েছে। মোটা একটা যুঁই ফুলের মালা পরানো রয়েছে ছবিটায়। মালাটা ঝুলে পড়ে ছবির মুখটাকে আড়াল করে রেখেছিল। এগিয়ে এসে মালাটা ঠিক করে পরিয়ে দিতে গেল কিশোর। পারল না। ছবির মানুষটার দিকে চোখ পড়তেই নিদারুণ বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল ও। কে? এ কে? এই মানুষটার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিল না ও! স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। 

"আমি বোধহয় আপনাকে চিনতে পেরেছি" । স্বর্ণর কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে কিশোর, "কি? কি জান তুমি আমার সম্পর্কে?" 

"কেন? বাপ্পাদিত্যর সব কথাই জানি।" 

কিশোর চুপ। কিছুক্ষণ বাদে আবার বলে স্বর্ণ, "বাপ্পাদিত্যর সাথে শোলাঙ্কি রাজকুমারীর মিল হয়নি। কিন্তু ওরা আজীবন একে অপরকে ভালোবেসে গেছে। একটা জিনিস দেখবেন?" কিশোরের সম্মতির অপেক্ষা না করে হাতের বন্ধ মুঠি টা মেলে ধরল ওর সামনে। এ তো সেই রাধাকৃষ্ণের মূর্তি টা, যেটা ঝুলন পূর্ণিমার দিন মিনুকে দিয়েছিল ও। এ কি দেখছে কিশোর! 

এটা খুব যত্ন করে মা নিজের কাছে রেখেছিল। 

বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিল কিশোর। স্বর্ণ কে বলল, "তুমি তো সব কিছুই জান দেখছি। যদি কিছু মনে না কর তাহলে একটা রিকোয়েস্ট করবো তোমাকে?" 

"বেশ তো। করুন না।" 

"তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি বোধহয় মা হতে চলেছ। তাই না মা?" 

লজ্জায় মুখ নিচু করল স্বর্ণ। 

"ফুলের কাজ ছেড়ে দেবার আগে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি মা, তোমার কোলে যদি তোমার মা আবার ফিরে আসেন, তাহলে তার পাঁচ বছর বয়সে ঘটা করে জন্মদিন কোরো। আর সেইদিন আমি আমার ছোট্ট মিনুর জন্য ফুলের গয়না বানাবো। আমি নিজে হাতে সেই গয়না পরিয়ে সাজাব ওকে। এ আমার অনেক দিনের সাধ। "

চোখ ভরা জল নিয়ে স্বর্ণ বলল," ভিক্ষা বলছেন কেন? আমি নিশ্চয়ই রাখব আপনার কথা। "

একটু আগেই যে গানটা গাইছিল কিশোর, তার শেষ লাইনগুলো মনে পড়ে গেলো," ফুলের সাথে প্রিয় /ফুল মালীরেও নিও /তুমিও একেলা সই, আমিও একেলা /আর সই সইতে নারি /এই ফুল ঝামেলা"। সত্যিই আর পারছে না কিশোর। জীবনের শুরুতে ভালোবেসে যে কাজটাকে গ্রহন করে ছিল, আজ তারই চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। কিন্তু এখনও একটা কাজ বাকি। আরও কিছুদিন বাঁচতে হবে ওকে। ছোট্ট মিনু আসবে। আরও কিছুদিন তার জন্য অপেক্ষা করবে ও ॥

   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy