ময়লাওয়ালা
ময়লাওয়ালা
গল্প লেখার শুরুতে মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানের লেখা কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল -
" কারো ভাষা মিষ্টি অতি
কারো ভাষা কষ্টা।
কারো ভাষার মাধুর্যতায়
খুশি মহান শ্রষ্টা। "
সপ্তাহে তিনদিন ঘুম ভাঙত রঘুর বাঁশির আওয়াজে, শুনতে পেতাম ওর ডাক ''বৌদি ময়লা''। কোনোদিন মা বাবা নয় আমি ময়লার বালতিটা দিতে এগিয়ে যেতাম। ও যখন আসতো রোজ একটাই গান গাইতো। কিন্তু শব্দগুলো ভোজপুরি ভাষায় বলে ঠিক বুঝতে পারতাম না, এটুকু বুঝতে পারতাম গানটা ওর খুব প্রিয়। কাজটা ছিল ওর ময়লা নেওয়ার তবে সেই কাজটাও অত্যন্ত আনন্দের সাথেই করত। ময়লা নেওয়া হয়ে গেলে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে যেতো রঘু। ওর ভালো ব্যবহার,আধা বাংলা হিন্দি মেশানো কথা আমাদের পাড়ার সবার মন ছুয়ে গেছিলো। ওকে কেউ আর সে অর্থে ময়লাওয়ালা বলে ভাবতো না। আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী পুজো হলে নাড়ু, মোয়া মা ওর জন্য আলাদা করে রাখত, পরদিন সকালে আসলেই ওকে দিতো। শুধু আমাদের বাড়ি বলে নয় পাড়ায় যেকোনো বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে ওর ভাগটা তোলা থাকত।
খুব আনন্দ পেতো ওসব পেয়ে, নিজে খেত না বাড়ির জন্য নিয়ে যেতো। মা বলত কে কে আছে রঘু তোমার বাড়িতে, রঘু উত্তরে বলত বৌ দুটো মেয়ে আর ছেলে। রঘুর বেশি বয়স ছিল না এই বয়সে সে তিনটে বাচ্চার বাবা এই শুনে আমাদের পাড়ার অনেকেই ওর সাথে ঠাট্টা করত। রঘুও মজাই পেতো। কখনও রাগতে দেখিনি ওকে। পাড়ার সবার সাথেই ও খুব সম্মান দিয়ে কথা বলত, আর দেখলে এক গাল ভরা হাসি দিতো। সকাল সকাল ওর হাসি টা যেন দিন ভাল করে দিতো সবার। রঘুর গায়ের রংটা ছিলো কালো,খুব একটা লম্বা নয়,কোঁকড়ানো চুল, স্বাস্থ্যটা বেশ ভালই ছিলো। মা কয়েকবার বলেছিল ওকে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে একবার এসো, বলেছিল ঠিক আছে বৌদি নিয়ে আসবো। হঠাৎই কিছুদিন ধরে রঘু আসছিল না, অনেকে ভাবল গ্রামে গেছে আবার কেউ কেউ ভাবল অন্য এলাকায় বদলি হয়ে গেছে, আমাদের এখানে হয়তো নতুন লোক আসবে। এরই মধ্যে পৌরসভার কিছু সাফাই কর্মীর সাথে রঘুর বৌ আর ওর তিনটে বাচ্চা এলো সাহায্য চেতে, সবাই তো অবাক ওদের দেখে, ওদের কাছ থেকে জানতে পারলাম রঘু আর নেই সান স্টোক হয়েছিল ওর। আমাদের পাড়ার সবারই শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, মনে হয়েছিল এটা আবার মরার বয়স নাকি। যে যেভাবে পারল ওই সময় টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিল ওর পরিবারকে।
আজ বহু বছর হয়ে গেছে রঘুর পর অনেক ময়লাওয়ালাই এসেছে কিন্তু ওর মতো কেউ সেরকম জায়গা করে নিতে পারেনি। তাই পেশা যেরকমই হোক না কেন মানুষের ব্যবহারটাই আসল। তাই আজও মনে হয় রঘু হয়তো বাঁশি বাজাতে বাজাতে আসবে আর বলবে ''বৌদি ময়লা''।
