প্রশ্নপত্র
প্রশ্নপত্র
কাচে ঘেরা গাড়িটা এসে গেটের সামনে দাঁড়ালো, জানি ওটা করে তুমিই এসেছো। গায়ে নামাবলি, গলায় মালা, চোখে তুলসী পাতা আর নাকে তোমার তুলো গোজা। দিব্যি শুয়ে রয়েছো তুমি, তোমার মা তোমার ছেলেরা বাকী আত্মীয়রা তোমার গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সবার কান্নার আওয়াজ আমি ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম, বিশেষ করে তোমার মায়ের। এতো বছর পর তোমায় দেখলো, তাও এইভাবে এই বয়সে এটা উনার জন্য অনেক বড় আঘাত। আমাকে সবাই বলছে তোমায় শেষবারের মতো দেখতে যেতে কিন্তু আমিতো এখন প্রশ্নপত্র তৈরি করছি এটা ছেড়ে যাই কি করে, আর ওরা বলছে যে শেষ দেখা সেটাতো দশ বছর আগেই আমার হয়ে গেছিল। আজ হয়তো তোমার ছোটো ছেলে তোমায় প্রথম আর শেষ দুটোই দেখবে।
কুড়ি বছর আগে প্রথম দেখা হয়েছিল বলো আমাদের। আমার তখন ১৮ তোমার ২০। আমি যেখানে নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছিলাম তার বাইরে ইলেকট্রিকের দোকানটাতেই তো তুমি কাজ করতে। একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল ছাতাটা নিয়ে যেতেও ভুলে গেছিলাম তোমার দোকানের ছাউনির তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেদিনই প্রথম কথা হল আমদের । এক কথা দু কথা থেকে জানতে পারলাম পাশের পাড়াতেই তুমি থাকো, আমাদের ক্লাবের কোনো অনুষ্ঠান হলে ইলেকট্রিকের কাজ তুমিই করো। এমনকি আমার দাদাকে ভালোভাবেই চেনো। তারপর থেকেতো যাতায়াতের পথে রোজই কথা হতো আমাদের। বৃহস্পতিবার করে তোমার দোকান বন্ধ থাকতো। তা এরকমই এক বৃহস্পতিবার দেখি সাইকেল নিয়ে আমার ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে তুমি। আমায় দেখে এগিয়ে আসলে আর একটা কথা বলতে চাইলে আমিও খানিকটা অবাক হয়েছিলাম। তারপর তুমি জানালে তোমার আমাকে ভালোলাগে আমায় ভালোবেসে ফেলেছো। সেদিনতো আমি কোনো উত্তর দিয়নি, দুদিন পর জানিয়েছিলাম । আসলে এই যাতায়াতের পথে আমারো তোমাকে ভালোলেগে গিয়েছিল ।দেখতে শুনতে তুমি ঠিকঠাকই ছিলে শ্যামবর্ণ, কোকরানো চুল, চোখ গুলো তোমার বেশ মায় মায়া ছিল ।আমার উত্তরের পর থেকে চুটিয়ে প্রেম করেছিলাম বলো দুজন। তোমার ছুটির দিনগুলো করে সিনেমা দেখতে যেতাম। তোমার সাইকেলে বসে এদিক ওদিক কতো ঘুরেছি। শেষে দাদার কোন বন্ধু আমাদের একসাথে দেখে দাদাকে বলে দিয়েছিল, ব্যাস শুরু হয়ে গেছিল বাড়িতে অশান্তি। মা তো ভীষণ বকাবকি করত। দাদাটো তোমায় একদিন রাস্তায় দেখে খুব শাসিয়েছিল। কিন্তু তখন বলো কে আমরা কার কথা শুনি, প্রেমে মত্ত দুজন। মা দেখলাম ছেলে জোগাড় করছিল আমার বিয়ে দেবে বলে। তোমাকে এই কথাটা বলতেই তুমি আর দেরি করলে না, শুধু তুমিনা আমারো ইচ্ছা ছিল।তাই পালিয়ে বিয়ে করে নিলাম। তারপর মা দাদা অনেকদিন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগই রাখেনি আমর সাথে। উনাদের অভিমান করাটা স্বাভাবিক ছিল বলো সে সময়তো তুমি সেরকম কাজকর্মও করতেনা। ওই গেটটা দিয়ে তোমার হাত ধরে বৌ সেজে এসেছিলাম এই বাড়িতে। ভেবেছিলাম মন দিয়ে সংসার করবো। বিয়ের প্রথম বছরটা তোমায় অনেক কষ্ট করতে দেখেছি দোকানে কাজের সাথে সাথে যে যেখানে বলতো ইলেকট্রিকের কাজের কথা ছুটে যেতে। কিন্তু কখনো আমায় কাজে বেড়োতে দাওনি। কত বলেছিলাম নার্সিং এর ট্রেনিং টাতো আছে কোথাও কাজ করি তুমি রাজী হওনি। বাবান আসার খবরটা যখন পেলে তোমার মতো খুশি আর কেউ একটা ছিলনা। খুব খেয়াল রেখেছিলে আমার ওই সময়। আর ও হওয়ার পরতো ডেকে ডেকে সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলে । মা দাদাও আর অভিমান করে থাকলো না ওরাও মেনে নিলো আমাদের। তবে তুমি কাজের চেষ্টা করে যাচ্ছিলে যাতে আমার আর ছেলের কোনোরকম অসুবিধা না হয়। হঠাৎ ই তোমার জ্যাঠতুতো দাদার কোম্পানিতে তোমায় ইলেকট্রিক ডিপার্টমেন্টে সুপারভাইজার পোস্টে চাকরি দিল। আমাদের অবস্থারও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হল।
আরও কয়েকটা বছর একসাথে কাটিয়ে দিলাম।তখনও পর্যন্ত কোনো কিছুর অভাব হতে দাওনি আমায়। বাবানকে ভালো স্কুলে ভর্তি করেছো তার সাথে সাথে ড্রইং, সাঁতার এসবও শেখাচ্ছিলে। বাবানকে নিয়ে তারপর সংসারের নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তখনই লক্ষ করছিলাম তুমিই রোজই নেশা করে ফিরছিলে।তোমায় প্রশ্ন করায় তুমি বলতে বাড়িতে এসেতো তুমি মাতলামি করোনা। এটা ঠিক এ কবছরে আমাদের যখন টুকটাক ঝগড়া হতো তা মিটেও যেতো কিছুক্ষনের মধ্যে।স্বামী বা বাবা হিসেবে তুমি কোনো কিছুর কমতি রাখোনি তাই তোমার এই নেশা করার ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলাম। হয়তো এটা বড় ভুল ছিল আমার।
আমাদের বিয়ের দশ বছরের মাথায় সেকেন্ডবার যখন প্রেগন্যান্ট হলাম তখন থেকে আমাদের দূরত্বটা বুঝতে পারছিলাম। রাত করে বাড়ি ফিরতে, কোনো ফোন আসলে আমার থেকে দূরে গিয়ে কথা বলতে। প্রেগন্যান্সির ছমাসে যখন বাবানকে নিয়ে মায়ের কাছে এলাম। তখনতো তুমি খুব কম দেখতে যেতে। তোমায় ফোন করলে বেশিরভাগই বিজি পেতাম। কিছু জিগ্যেস করলে অফিসের চাপ অফিসের কল বলে চালিয়ে দিতে।বুঝতে পারছিলামনা কি হয়েছে তোমার বা আমি কি করেছি কেন তোমার এতো অবহেলা। আসলে সে সময় তোমার অনেক টাকা হয়েছিল কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলে না, এক এক করে অনেক রকম নেশাই ধরেছিলে। ছোট বাবু হওয়ার পর তোমাদের বাড়িতে ফিরলাম। তখন থেকে নানা কারনে অশান্তি শুরু করলে।আমার মা তোমার মা তোমায় কতো বোঝাতো কারোর কথাই শুনছিলে না তো তুমি সে সময়। একদিনতো বলেই ফেললে যে তোমার আর আমাকে ভালো লাগেনা আরোও অনেক মহিলার সাথে তোমার সম্পর্ক আছে, ডিভোর্স চাও তুমি। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, যেই মুখে একদিন ভালোবাসো বলেছিলে আজ সেই মুখেই এটা বললে। অনেক অনুরোধ করেছিলাম এরকমভাবে সম্পর্কটা শেষ না করতে। আমার জন্য না হয় ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে অন্ততঃ। কিন্তু তুমি ভীষণ জেদি ছিলে কিছুতেই মানলে না যখন শেষে বুঝলে আমি কিছুতেই তোমায় ডিভোর্স দেবোনা তখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে।
আজ আবার দশ বছর এই বাড়িতে ফিরে এলে। এই দশ বছরে আমরা কেমন আছি কী করছি কী খাচ্ছি কিচ্ছু জানার প্রয়োজন তোমার ছিলনা বলো? এই ছেলে দুটোকে তোমার মায়ের কাছে রেখে রাত রাত হাসপাতাল গুলোতে নার্সের ডিউটি করেছি আর চোখের জল ফেলেছি তবেতো তখন তুমি অনেক খুশিতে ছিলে, তোমার অনেক খবরই পেয়েছি, কর্মজীবনে তোমার আরও উন্নতি হয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনেছো দিত্বীয় স্ত্রীকে নিজের অতীত না জানিয়ে বিয়েও করেছো সেও শুনলাম এখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। তা তোমার জীবনে এতো সুখ থাকা সত্ত্বেও আজ এভাবে ফিরে এলে কেন? আমাকে, তোমার ছেলেদের তোমার পরিবারকে ছেড়ে গিয়েও তুমি সুখী ছিলেনা? তোমায় শেষে অ্যাসিড খেতে হল কেন? এই সব প্রশ্ন নিয়েই প্রশ্নপত্র তৈরি করছি, জানি তোমার ওই নিথর দেহ আজ এই উওর গুলো দিতে অক্ষম তবে যেদিন তোমার ওখানে যাবো এই তালিকাটা সাথে রাখবো তখন ব্যাখা সহকারে এর উত্তরগুলো আমি নেবো।