অপরাধ
অপরাধ
অনেকক্ষণ ধরেই রমেন বাবুর বাড়ির সামনে চেচামেচি হচ্ছে, পাড়ার সবাই জড়ো হয়েছে ওখানে। তালা ভেঙে উনার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে সব। রমেন বাবু বাড়ির ভেতর থেকে হাত জোর করে সকলের কাছে অনুরোধ করছে এরকমটা না করতে। তখন পাড়ার কেউ কেউ বলছে যদি এসব না চান ছোট মেয়েকে বার করুন ঘর থেকে, একটা ছেলের প্রাণ নিয়ে এখন ঘরে লুকিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে রমেন বাবুর ছোটো মেয়ে রুপা অনেকক্ষণ ধরেই তার ঘরের দরজা বন্ধ করে রয়েছে। রমেন বাবুর স্ত্রী মেয়েকে ডেকেই চলেছে কোনো সারা শব্দ নেই ভেতর থেকে। রমেন বাবুও এবার মেয়ের ঘরের সামনে গিয়ে কয়েকবার ডাকলেন, তারপর চেষ্টা করলেন দরজা ভাঙার, পারলেন না। শেষে বাইরের গেট খুলে দিলেন পাড়ার ছেলেরা ভেতরে ঢুকে দরজা ভাঙলো। দরজা ভেঙে দেখা গেল পাখার সাথে রুপার দেহটা ঝুলছে। ওই দৃশ্য দেখে রমেন বাবুর স্ত্রী জোরে এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তখনও পাড়ার যারা বাইরে রয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছে ওকে বাইরে নিয়ে আয় আদৌ মরেনি মরার নাটক করছে।
রমেন বাবু ডিফেন্সে ছিলেন রিটায়ার্ডমেন্টের পর যা জমানো টাকা ছিল তা দিয়ে কয়েকমাস হল বাড়িটা করে এই পাড়ায় নতুন এসেছেন পরিবার নিয়ে। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক বছর হল। আর ছোট মেয়ে হল এই রুপা , একটি প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকরি করে, ওর বয়স এখন ৩৫। কয়েকবছর আগে ওর একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল কোনো কারণবশত ভেঙে গিয়েছিল বলে ও আর বিয়ে করবেই না ঠিক করেছিল।
এই নতুন বাড়ি তৈরি হওয়ার পর, গৃহ প্রবেশের দিন রুপার সাথে প্রথম দেখা হয় প্রবীরের। ক্লাবের ছেলেদের ইনভাইট করা হয়েছিল তাদের সাথেই আসে প্রবীর। প্রবীরের বাড়ি ওই পাড়াতেই , পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ফ্যামিলিতে ওর মা আর দুই বোন আছে,ওর বয়স ২৮। সেদিন দুজনেরই চোখাচোখি হয়, একে অপরকে প্রথম দেখাতে ভালোও লাগে। তারপর থেকে যাতায়াতের পথে দেখা হত, দুজন দুজনকে দেখে হাসি দিত। তারপর প্রবীর একদিন নিজে থেকেই এগিয়ে যায়, রুপাকে জানায় ও রুপাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু রুপার ওকে ভালো লাগলেও ও জানতো প্রবীর ওর থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। তাই রুপা বলে দেয় এই সম্পর্ক টা হওয়া সম্ভব নয় ওদের বয়সের গ্যাপের জন্য। তারপর থেকে প্রবীর যখনই রুপাকে দেখতো বোঝানোর চেষ্টা করতো বয়সটা কোনো ব্যাপার না ভালোবাসাটাই আসল। প্রবীর এই ২৮ বছর বয়স অব্দী কখনো কোনো প্রেম করেনি। ছোটবেলায় বাবা মারা গেছিল অনেকটা কষ্টের মধ্যে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। এখন গোটা ফ্যামিলি ও চালায়। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে এইসব প্রেম টেম আর করে ওঠা হয়নি ওর। তাই রুপাকে ভালো লাগাতে নানাভাবে চেষ্টা করছে যাতে সম্পর্কটা হতে পারে। রুপাও নিজেকে অনেকটা একা অনুভব করত এই বয়সে এসে,এইসময় প্রবীরের এই প্রস্তাবে ওর আর বেশিদিন না করে থাকতে পারলোনা। ওদের সম্পর্ক শুরু হল, অফিসের পর দুজনে প্রতিদিন দেখা করত, গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরত। ছুটির দিনগুলোতে একসাথে কোথাও ঘুরতে যেতো। আর ফোন,ম্যাসেজে তো কথা হতই। এবার প্রবীর আর রুপা দুজনে রমেন বাবুকে জানালো ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে। রমেন বাবুর কোনো আপত্তি ছিলনা উনিতো উল্টে চেয়েছিলেন রুপাও তার বাকি দুই মেয়ের মতো সংসার করুক খুশি থাকুক। কিন্তু সবার এটাই চিন্তা ছিল প্রবীরের বাড়ির থেকে মানবে কিনা। আর ঠিক সেই সমস্যাই হল প্রবীরের বাড়ির লোক কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছিল না। প্রবীরও চেষ্টা চালাচ্ছিল মানানোর, আর ও এটাও ঠিক করেই নিয়েছিল বিয়ে করলে ও রুপাকেই বিয়ে করবে। রমেন বাবুও একদিন কথা বলতে গিয়েছিল প্রবীরের বাড়িতে কিন্তু ওর মা দিদি উনাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। তারপর একদিন রুপার সাথে প্রবীরের দিদি আর বোনের রাস্তায় দেখা হয়, আর ওরাও তখন রুপাকে খুব অপমান করে তাতে রুপা বুঝেই যায় এই বিয়ের পর কখনই ওদের মেনে নেবেনা উনারা কেউই সুখী হবেনা এই বিয়ের পর। পাড়ার অনেকেই তখন ব্যাপারটা জেনে গেছিল। তাই রুপাকে দেখলে তারাও টোন টিটকিরি কাটতো। রুপাও চাইছিল না প্রবীরকে ওর পরিবার থেকে আলাদা করতে তাই সবার কথা ভেবে রুপা ওদের সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে চাইল না। কিন্তু প্রবীর কোনোভাবেই ছাড়তে চাইছিল না। রুপা ওকে ইগনোর করেই চলছিল। প্রবীর এরপর সুসাইড করার কথা বলতে থাকে, রুপা অতো ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দিচ্ছিল না ভাবছিল কয়েকদিন পর আস্তে আস্তে প্রবীর সব ভুলে যাবে। এখন সদ্য সদ্য বলে হয়তো এমন করছে। তবে তা হলনা, চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাপ দিয়ে সত্যি প্রবীর সুসাইড করে নিল। এখন ওর ডেডবডি ক্লাবের সামনে রেখে পাড়ার সবাই তাই রুপার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছে রুপাকে বের করে ওর অপরাধের শাস্তি দেবে বলে।
রুপা আর কাওকে সুযোগ দিলনা নিজেই নিজেকে অপরাধের শাস্তি দিল। ওর অপরাধ এটাই ছিল নিজের থেকে কম বয়সী একটা ছেলেকে ভালোবাসা। আবার ছেলেটির পরিবারের কথা ভেবে ওর জীবন থেকে সরে আসা। আজ রুপার মৃত্যুর পরও এই সমাজ ওকেই অপরাধী ভেবে যাবে, আফসোস তো কেউ করবে না উল্টে ওর মৃত্যুতে খুশি হবে।
