মুণ্ডুবিহীন
মুণ্ডুবিহীন
ইশ! অনেকটা দেরি হয়ে গেল। ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় হঠাৎ করে লাইন আটকে দাঁড়িয়ে পড়বে ভাবতেই পারিনি। এই ছাড়বে, এই ছাড়বে করে যখন প্রায় মিনিট কুড়ি পার হয়ে গেল, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। স্থির ট্রেনের গেটের সামনে এসে ঝুঁকে দেখলাম বাইরেটা। সন্ধ্যের আলো ফুটছে এদিক ওদিক। শ্মশান কালীর মন্দিরের ঝিমধরা বাল্বটা হলদে হয়ে জ্বলছে।
পাশের লাইনটা থেকে সাঁ আ আ করে একটা মেল বেরিয়ে গেল।
বাব্বা! খুব তাড়া?
নীচে তাকালাম। নুড়ি ছড়ানো। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে লাফিয়ে নামলাম।
পায়ে যেন কিছু একটা ফুটলো।
মাথাটা ঘুরে গেল। অমন হয়। অনেকক্ষণ ট্রেনের ভিতর নিশ্চুপ বসে থাকা, অসহ্য।
স্থবির ট্রেনের প্যাসেঞ্জার গুলোও আজব।
দাঁড়ানো ট্রেন থেকে নামছি, এত হইহই রৈরৈ করার কী দরকার! যত্তসব।
এদিক ওদিক থেকে আবার কোনো ট্রেন আসছে কিনা দেখে এগোলাম।
এই রাস্তায় বহুবার হেঁটেছি। স্কুল ফেরত, কলেজ কেটে পার্টটাইম বান্ধবীদের হাত ধরে কত সুখসময় কাটিয়েছি! আহা! ভাবতেই কিরকম যেন 'জুবি ডুবি' হয়ে উঠলো মনটা।
সত্যি! স্মৃতি মানুষের অবস্থান কিরকম পাল্টে দেয়! নাহলে এই প্যাচপ্যাচে গরমে, লেট ট্রেনে বাড়ি ফেরার জন্য প্রায় আধা মাইল পথ হাঁটতেও শরীর এত ফুরফুরে হয়!
জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মৌজ করে একটা গানের কলি ধরলাম। হাঁটছি।
এদিকটা বেশ অন্ধকার। দশ হাত ছাড়া ছাড়া পোস্টার থেকে টিমটিমে দশ ওয়াটের বাল্ব।
রাস্তা ভালো হলেও লোকসমাগম এদিকটা ততোটাও নেই। নিজ্ঝুম। আগে তবু পাড়ার মাতব্বর কিংবা চ্যাংড়ারা তাস পিটোতে আসতো। এখন সান্ধ্যকালীন সিরিয়াল আর জিওর জামানায় কে আর রাস্তায় বেরোয়!
শ্মশানের কাছে আসতে অজান্তেই বুকটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল।
কেন এমন হলো? কেউ কি আশেপাশে চলছে? দেখবো? ননননা! থাক। কোনোদিক না তাকিয়ে হাঁটা দিলাম জোরে। আশেপাশের অদৃশ্য 'কেউ কেউ'রাও যেন তাল মিলিয়ে গতি বাড়িয়েছে আমার সঙ্গে। ইচ্ছে করছে, দৌড় লাগাই।
ওই তো শঙ্করদের বাড়ির গেট। বেল বাজাবো?বুলডগটা হেব্বি চেঁচায়।
বেল বাজছে না। পাওয়ার কাট?
কুকুরটা জুলুজুলু দেখলো। কিচ্ছু বললো না!
পাশ দিয়ে একটা পুলিশের জিপ বেরিয়ে গেল। ধুর! আমি খামোকাই ভয় পাচ্ছি। বোলে তো, ভয় লেনে কা নেহি দেনে কা।
বুক ফুলিয়ে 'কে আসবি আয়' গোছের ভাব নিয়ে এগোলাম। নাহ! কোনো ভয় নেই।
আপাতত বাড়ির কাছাকাছি। বাঁশ ঝাড়টা আজ জোনাকিতে ভরে রয়েছে। জোনাকিই তো! এগিয়ে গেলাম। নাহ! জোনাকি তো নয়, তাহলে! কী?
সাইকেল নিয়ে ভগা যাচ্ছে। ডাকলাম। ব্যাটা শুনলই না! এমন সময় কিসের এত তাড়া ওর?
এহ হে! পা'টা পিছলে গেল! বৃষ্টি হয়েছিল নাকি!
পা ঘষতে ঘষতে পুকুরের দিকে গেলাম। বড্ড পিছল। বহুদিন সৎকার হয়নি। একবার পড়লে আর রক্ষে নেই।
কী মনে হতে, পিছন ফিরলাম। জোনাকিগুলো নেমে আসছে। ঠিক জোনাকি নয়। তাহলে? লম্বা লম্বা মানুষের আকৃতি যেন। চারিদিকটা আলোয় ভরা। দূর থেকে বোঝা যায় না। আমিও আজকাল অতিপ্রাকৃতিক দেখছি নাকি! হাসি পেল। আচমকাই ... ও কি!
গায়ে জল লাগতেই জ্বলে উঠলো কেন?
মনের ভ্রম?
আর একবার দেখি।
এগিয়ে গেলাম।
জলের উপর একটা প্রতিবিম্ব।
জল হাতের তালুতে আঁচলা ভরে নিতে গিয়েও থমকে গেলাম।
ও ও ও কে এ এ!
মাথার খুলি উল্টে গিয়ে ভিতরের ঘিলু উঁকি দিচ্ছে। রক্তমাখা মুখে চোখদুটো ঠিকরে আসছে।
সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বরাবর একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম। বাড়ির টেলিফোন বাজছে। মা টিভি দেখছিল, উঠে এলো। আমায় দেখতে পায়নি নাকি!
আতঙ্কিত, ভয়ার্ত মুখে চিৎকার করে মা বসে পড়লো। বুঝিবা জ্ঞানও হারালো। আমি দৌড়ে গেলাম। ওদিক থেকে বাবাও। বাবা উদ্বিগ্ন মুখে মাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখতে পাচ্ছে না?
আমি ডাকলাম, "বাবা... মা...!"
কেউ শুনতে পেল না।
এক পা এক পা করে পিছতে লাগলাম। হাতের মুঠোয় জল নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে মার মুখে।
পিছনে ড্রেসিং টেবিল। আর এগোতে পারলাম না। কী ভেবে একবার পিছন ফিরলাম।
আশ্চর্য! আয়নায় আমার মুখ দেখা যাচ্ছে না!
তবে কি...!!
বুকটা ধড়াস করতে গিয়েও বুঝলাম, শরীরের নীচের অংশ আমার সঙ্গে নেই। তাহলে,
ওটা কোথায়?
চকিতে একটা কিছু শুনলাম।
ট্রেন চলার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ। অজান্তেই মনে হলো, রেল লাইনের পাতে কান দিয়ে শুনছি ট্রেন আসার শব্দ, ঠিক যেমন ছোটবেলায় শুনতাম!
কিন্তু এখন শুনছি...
একটা ধক ধক শব্দ!
পাশেই একটা মুণ্ডুবিহীন হৃৎপিন্ড। রক্তমাখা!